প্রবন্ধ
মৃত্যু ভয় কে উপেক্ষা করে বাঙালির দুর্গাপূজা ইউনেস্কোতে স্থান
লাভ করল
বটু কৃষ্ণ হালদার
বাঙালিদের একটি
জরূরী ও একত্রীকারী বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে তারা বেশীরভাগ বাংলা ভাষা মাতৃভাষা হিসাবে ব্যবহার
করে, যা ইন্দো-ইরানি ভাষাসমূহ থেকে আগত।২২.৬ কোটি দেশী ও বিশ্বব্যাপী ৩০ কোটি মোট বাংলাভাষী
আছে, তাই বাংলা হচ্ছে পৃথিবীর ষষ্ঠতম চলমান ভাষা। বাংলা ভাষা বেশী অংশে বাংলা লিপি
দিয়ে লেখা হয়, এবং প্রায় ১০০০-১২০০ খ্রীষ্টাব্দে মাগধী প্রাকৃত থেকে প্রকাশ হলো।
বহুরূপে এই ভাষা আজ প্রচলিত, এবং এটা বাঙালি সংহতির জন্য একটি জরূরী প্রভাব সরবাহ করে।
এসব ভিন্ন রূপ তিন বিভাগে বিভক্ত করা যায়:
বাঙালির বাংলা
ভাষা ও সাংস্কৃতি শুধুমাত্র ভারতবর্ষের পশ্চিম বাংলা নয় সমগ্র বিশ্বের কাছে আবেগ ও
বিস্ময়ের। ইতিমধ্যে বাঙালির বাংলা ভাষা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে র রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে
স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাংলা ভাষা এক দিকে যেমন রাষ্ট্রপুঞ্জের দরজায় কড়া নেড়ে ছে।
ইতিমধ্যেই সাউথ আফ্রিকার এক যুবকের কণ্ঠে "সাদা সাদা কালা কালা" গানটিতে
বিশ্বের তামাম বাঙালি মজেছেন। তবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির এমন অভূতপূর্ব সাফল্যের পিছনে
লুকিয়ে আছে রক্তে রাঙানো ইতিহাস।১৯৫২ সালের আগে এই বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে নাড়াচ্ছিল
পাকিস্তানি হায়না দারারা। তৎকালীন সময়ে যারা বাংলা ভাষাকে হৃদয় ধারণ করেছিল এর বিরুদ্ধে
গর্জে উঠেছিল। শুরু হয়েছিল এক রক্তক্ষয়ী মহা সংগ্রাম। অবশেষে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত,
সালাম, রফিক,বরকতদের সহ অনেক বাঙালিদের আত্ম বলিদানে অবিভক্ত বাংলার বুকে ১৯৫২ সালে
২১ শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা স্বীকৃতি লাভ করে।এখানেই শেষ নয়, বাংলা ভাষার জন্য পুনরায়
এগারো জনকে শহীদ হতে হয়। সালটা ছিল ১৯৬১।বাংলা ভাষার জন্য রক্তক্ষয়ী আন্দোলন হয়েছিল
আসামের শিলচরে বরাক উপত্যকায়।বর্তমান সময়ে এসে বাঙালিরা ভাষা দিবস পালন করলে, নিজেদের
অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই জারি রেখেছে পশ্চিমবাংলায়।বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলা
ভাষা সংস্কৃতি গবেষণা ও মুখ্য আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠলেও, বাংলা ভাষার অপর ঘর এই পশ্চিমবাংলায়
ভাষা সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসের পথে।
তবু বাঙালি আছে
স্ব মহিমায়।এই বাঙালির অন্যতম আবেগ ও বিস্ময়ের জায়গা হল দুর্গোৎসব।বিগত তিন বছরের
অজানা ঘূর্ণিঝড়ের তা থৈ তাথৈ নৃত্যে জীবনের অন্তরসলিলে মৃত্যুর মিছিলে থমথমে পৃথিবীর
আতঙ্কিত রূপের কথা মনে পড়লেই শরীরটা হিম হয়ে যায়।
অদৃশ্য ঘাতকের
হাজারো প্রশ্ন বানে বিপন্ন,ও অনিশ্চয়তার আবহে ঘুরপাক খেয়েছে মানব জাতির জাগতিক সময়।
গৃহবন্দী মানুষ একাকিত্বের যন্ত্রণায় ছটফট করেছে। কান পাতলেই শোনা যেত স্বজন হারানোর
চিৎকার। বিগত ২-৩ বছর যাবত হৃদয়ের বসন্তে ফুল ফোটেনি,সাতরঙা রামধনু একা একা ফিরে গেছে
শরতের শিহরণ থেকে বঞ্চিত হয়েছি আমরা সবাই।কারণ অতিমারি করোনার ছোবলে ইতিমধ্যেই বহু
প্রিয়জনকে হারিয়েছেন অনেকেই।বাঙালির প্রাণের উৎসব ওই সময় নমো নম করে ঘট পূজাতে স্থিমিত
হয়েছে। কেউবা ছোট্ট একটা মূর্তি দিয়ে নিয়ম-বিধি মেনে দূরত্ব বজায় রেখে পূজা সারলো।
তবে বেশিরভাগ লোক ঘরে বসে অনলাইনে পূজা দেখল পুষ্পাঞ্জলি দিল। আমরা দেখেছি কোথাও বা
গণচিতা গণ কবর সাজানো হয়েছে। উৎসবের রেস থমকে গিয়ে বাঁচার আর্তি যেন প্রকট হয়ে উঠেছিল।চারিদিকে
যেন হাহাকার আর কপাল চাপড়ানি।মনে হতো একটু ফাঁক পেলেই মহামারী ঢুকে পড়বে আর ছিনিয়ে
নিয়ে যাবে তরতাজা প্রাণ। মনটা ডুকরে কেঁদে উঠত বারবার। মানুষ তখন দিশেহারা আবাল বৃদ্ধ
বনিতা কেউ রেহাই পেল না। শূন্য হল মায়ের কোল ঘরে ঘরে সন্তান হলো অনাথ,অসহায়।আমরা
বিভিন্ন লেখকের লেখায় মহামারীর কথা পড়েছি জেনেছি। পুরাতন ভৃত্য কবিতা টা একটু মনে
করুন। কাগজে-কলমে লেখা তেমন ভাবে আমরা ভীত হইনি।তবে খুব কাছে থেকে নিষ্ঠুর মৃত্যুকে
দেখলাম। শংকিত হৃদয় বারবার কু ডাকত। হয়তো একদিন ঝড় থেমে যাবে। সময় নদীর স্রোতের
মত বয়ে যাবে। হয়তো আবার পূর্ণ উদ্দীপনায় পূজা হবে জীবন স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসবে।
কিন্তু যে মানুষগুলো চলে গেল তারা কি আর ফিরবে? তাদের পরিবার কি ফিরতে পারবে স্বাভাবিক
জীবন ছন্দে? পৃথিবীর চিরকালের জন্য মহামারী মুক্ত হোক ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যেন মহামারীর
এই বীভৎসরূপ আর দেখতে না হয়। তবে ওই সমস্ত ভয়ংকর দিনগুলোকে মনে করে নত মস্তকে শ্রদ্ধা
জানাবো সেই সমস্ত ডাক্তার নার্স পুলিশ কিংবা যারা সেবা কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছিল,
যারা ২৪ ঘন্টা মৃত্যু ভয় কে উপেক্ষা করে ওষুধের যোগান দিয়েছে, সবজি দিয়েছে, গ্যাস
সিলিন্ডার পৌঁছে দিয়েছে খাবার দিয়েছে। কিংবা ২৪ ঘন্টা একাধিক শ্মশানে একের পর এক
চিতার আগুনে তুলে দিয়েছে মৃত দেহ।
তবুও সাদা মেঘের
ভেলা ঢাকের বাদ্য, ডাকের সাজ যেন আকাশে কালো ছায়া কে দূরে সরিয়ে দিয়ে আমরা একটু
প্রাণ খোলা হয়ে ওঠার চেষ্টা করব। আবার আমরা একসঙ্গে উৎসবের রেসে মেতে উঠবো।গল্প করব
ঘুরবো। ছোট ছোট শিশুরা প্যান্ডেলে দৌড়াবে খেলবে হইচই করবে।তবে এসবের মাঝে অত্যন্ত
খুশির খবর হলো
কলকাতা তথা বাংলার
প্রধান ও প্রাণের এই উৎসব আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্থান করে নিয়েছে। জাতিসংঘের শিক্ষা,
বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা- ইউনেস্কো বাঙালি হিন্দুদের এই উৎসবকে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল
হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ তথা মানবতার জন্য আবহমান অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তালিকায়
অন্তর্ভুক্ত করেছে। প্যারিসে অনুষ্ঠিত ২০২১ সালে আবহমান বিশ্ব সংস্কৃতি রক্ষা সংক্রান্ত
ইউনেস্কোর আন্তঃসরকারি কমিটির ষোড়শ সম্মেলনে (১৫ই ডিসেম্বর) কলকাতার দুর্গাপূজা তালিকাভুক্তির
স্বীকৃতি লাভ করে।
পরিশেষে এটুকু
বলা যায় মিলনের হাটে অকল্পনীয় প্রতিকূলতার পরিমণ্ডলে দাঁড়িয়ে অন্তরের বালু রাশিতে
আমরা সবাই মিশে যেতে চাই। এই ধোয়া ভরা পৃথিবীর ভীষণ বারুদের বাতাস যেমন থাকবে না,
কেমনি কালো মেঘের ভ্রুকুটি একদিন কেটে যাবে। এক সময় আসবে, চাঁদ মাখা শব্দ ফাল্গুনী।
সমস্ত দুঃখ-বেদনাকে উপেক্ষা করে এক উন্মুখ নতুন রৌদ্রজ্জ্বল সোনালী প্রভাতের অপেক্ষার
অবসানের সাক্ষী হয়ে থাকবো আমরা সবাই।
| শারদ সংখ্যা-১৪২৯ | aleekpata.com | 30th Edition |
| ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Durga Puja , 2022 | July-Oct 2022 | Fifth Year Fourth Issue |
| © All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |
| a DISHA-The Dreamer Initiative |
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post