অলীক পাতার অন্যান্য সংখ্যা- পড়তে হলে ক্লিক করুন Library ট্যাব টি



। । "অলীক পাতা শারদ সংখ্যা ১৪৩১ আসছে এই মহালয়াতে। । লেখা পাঠানোর শেষ তারিখ ১৫ ই আগস্ট রাত ১২ টা ।.."বিশদে জানতে ক্লিক করুন " Notice Board ট্যাব টিতে"

Saturday, October 1, 2022

গল্প - আমার দুর্গাপুজা- শ্যামল কৃষ্ণ বসু

 গল্প  

আমার দুর্গাপুজা
শ্যামল কৃষ্ণ বসু




‘ দুর্গাপুজা করবা ? ‘- উনি অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

 

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ জ্যাঠামশাই।’ 

 

নিস্তেজ মানুষটা যেন হঠাৎ বেশ আনন্দিত হয়ে উঠলেন, ‘মায়ের পুজা করবা! সে তো বেশ কথা’

 

আমি আবার ও বললাম, ‘হ্যাঁ জ্যাঠামশাই। বাড়ীতে এবার মা দুর্গার পূজার শুরু করব বলে আপনার কাছে এসেছি।’

 

জ্যাঠামশাই যেন কেমন করে তাকিয়ে রইলেন মুখের দিকে। আসলে আমার মতো একজন সাধারন চাকুরিজীবি মানুষের পক্ষে…

 

সাধারন পুজা অপেক্ষা এত বড় রাজসুয় যজ্ঞ যে একটা সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার সেটা ভেবেই উনি  একটু অবাক হয়ে গেছেন ।

 

          রমেশ চক্রবর্তী আমাদের পাড়ার একমেবম পুরোহিত। আমি ডাকি ‘জ্যাঠামশাই’ বলে। উনি আমাদের বাড়ীর সব পূজা-আচ্চা করেন। এখন ওনার বয়স নব্বই পার। তিন মাথা এক হয়ে গেছে। লম্বা মানুষটা এখন বেশ কুঁজো হয়ে গেছেন। নিজের বাড়ির রোয়াকে বসে হাত পাখা দিয়ে হাওয়া খাচ্ছিলেন। বসে আছেন কেমন একটা ম্রিয়মাণ ভাবে। আমাকে দেখে ওনার মুখে একটা প্রসন্নতা ছড়িয়ে পড়ল ।

 

‘ও বাবা, শ্যামল যে! কতদিন পরে আইলা! আছ নি ভালো?  কি মনে কইরা?’  

 

একসাথে অনেক প্রশ্ন। আজকাল এদিকে আসা ও হয়ে ওঠে না। আজ তাই জ্যাঠামশায়ের কাছে এসে দাঁড়াতে বৃদ্ধের মুখটা যেন আনন্দ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।

 

 একটা নমস্কার করে বললাম, ‘এসেছি অনেক কিছু মনে করে জ্যাঠামশাই।  দুর্গাপুজা করব ।’ জ্যাঠামশাই  যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলেন না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে ।

 

আমি আবার বললাম, ‘আমি বাড়িতে এবার দুর্গাপুজা করব মনস্থির করেছি জ্যাঠামশাই ।’

 

জ্যাঠামশাই আরো অবাক হয়ে বললেন, ‘তাই? কিন্তু বাবা, মায়ের পুজা বইলা কথা। কমপক্ষে তোমারে পুজা তো তিন বচ্ছর করতেই লাগব!’

 

‘জ্যাঠামশাই আমার তো ইচ্ছা এই যে প্রতিবছর পুজা করি আপনার হাতে।’ - আমি বললাম।

 

জ্যাঠামশাই অপলকে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন । বুঝতে চেষ্টা করলেন আমার কথার ওজনটা। একটা কিছু চিন্তা করতে করতে মাথাটা ঈষৎ দোলাতে থাকেন অল্প অল্প।

 

               এ বছর আমি বাড়িতে দুর্গাপুজা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাই সর্বপ্রথম ‘জ্যাঠামশাই’ এর কাছেই দৌড়ে এসেছি আলোচনার জন্য। উনি যদি রাজি থাকেন তাহলে পুজোর ব্যাপারে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হতে পারে।

 

           শরৎ প্রকৃতির আকাশে লেগেছে রঙ। মেঘমুক্ত আকাশ। পেঁজা তুলো মেঘ মায়ের আগমন ঘোষণা করছে। শিউলির গন্ধে ম’ ম’ চারদিক। মায়ের পূজার প্রস্তুতি কলকাতা শহরে। আমার ও ইচ্ছা হয়েছে মায়ের পূজা করার। মা দুর্গার পূজা। সহজ ব্যাপার তো নয়! তবু ইচ্ছাটাই বড় কথা।

 

           কথাটা গিন্নির কাছে পাড়লাম। গিন্নি খানিকক্ষন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলে উঠল, ‘কি বলছ কি এ সব? পারবে? পূজোর তো আর মাত্র আট দিন বাকী!’

 

কথাটা ঠিকই। আর মাত্র আটদিন হাতে। এটা একটা বেশী ঝুঁকি নেওয়ার মতো ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে। তবু বাঙালির শারদীয়া পূজার একটা সেন্টিমেন্ট, সে যে সম্পূর্ণই অন্যরকম একটা ব্যাপার। এত বছর সেই কোন কৈশোর থেকে আজ এই পঞ্চাশ উত্তীর্ণ বয়সে ও পুজায় শুধু নুতন কাপড় জামার কথা ভেবেছি। কত ঠাকুর দেখবো কোথায় কোথায় যাব , কি কি খাব, এই কথাই শুধু ভেবেছি । গত কয়েক বছরে দেখলাম আর এই ভীড় ভাট্টা সহ্য হয় না। পুজার সময় এখন বেরোতে ও মন চায় না। তাই কি মনে মনে বাড়ীতেই পুজার কথা অবচেতনে ভেবেছিলাম ?  হবে হয়ত ।

 

          আগে তো দুর্গাপূজা ছিল পরিবার ভিত্তিক। পরে পরে না হয় দুর্গাপূজা বারোয়ারী পূজায় পরিনত হয়েছে । অফিসে বসে একটা ম্যাগাজীনে পারিবারিক পূজার একটা খরচ খরচা দেখছিলাম। যা দেখলাম তাতে চেষ্টা করলে পূজাটা করা খুব অসম্ভব নয়। আসলে খরচের ভয়ে কেউ পুজা করতে সাহস পায় না। আর আমার এ হেন সিদ্ধান্ত সবার কাছেই অর্বাচীনের সিদ্ধান্ত প্রতিভাত হওয়া অসম্ভব নয় । অথবা সবাই ভেবে নেবে এ আমার একটা একটা বড়লোকি খেয়াল? কিন্তু আমি তো বড়লোক কিছু নই । চাকরি করে খাই। মধ্যবিত্ত জীবন যাত্রা। আসলে মানুষ সাধারন থেকে অসাধারন কিছু দেখলে ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেলে । তখনই সম্ভব অসম্ভবের মাত্রা নিয়ে প্রশ্ন উঠে বসে। কাল পাড়ার লোকেরা ও ভেবে বসবে আমি না জানি কত বড়লোক হয়ে গেছি । তা যদি তারা ভাবে তো ভাববে?

 

আমি বললাম, ‘তুমি কি বলো?’

 

গিন্নি বলে, ‘চার দিনের পূজো। এ কি একা হাতে সম্ভব? আর সে ও মাত্র এই কয় দিনে? ঠাকুরমশাইর সাথে আগে কথা বলে দেখো!’

 

আমার তাই জ্যাঠামশাইর কাছে ছুটে আসা। আমি বললাম, ‘জ্যাঠামশাই আপনি যদি পুজার ভার নেন।’

 

‘বেশ বেশ, পুজা করো। যার পুজা, তিনিই করাইয়া লইবেন।’ - উনি উৎসাহ দিলেন।- ‘মা যখন তোমার বাড়ীতে পূজা ইচ্ছা করেছেন -’

 

আমি বললাম , ‘ জ্যাঠামশাই,  এ আমার হঠাৎ ইচ্ছা। মায়ের পুজা করি এত ক্ষমতা কোথায় ?  দাদু বলতেন দেশের বাড়ীতে পুজা হত । এখন দাদু ও নেই। বাবা ও গত হয়ে গেছেন পাঁচ ছয় বছর আগে। মা আছে এখনো। তাই মনে হল নিজেদের পরিবারে মায়ের হাত দিয়ে যদি এবার থেকে পুজা শুরু করি ?

 

জ্যাঠামশাই মাথায় হাত পাখার বাতাস করতে করতে শুনছিলেন কথাগুলো। এবার বললেন  - ‘ মায়ের পূজা কি যে সে মানুষ করতে পারে শ্যামল? অনেক বড় মনের মানুষ না হইলে এই পূজা করন যায় না। দশ জনেরে নিয়া পূজা।’

 

আমি বললাম, ‘আপনি পূজা করতে পারবেন তো?’

 

জ্যাঠামশাই একটু কানে খাটো হয়ে গেছেন। সব কথা ভালো বুঝতে পারেন না। তাই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি কইলা ! আমারে পূজা করবার কও?’

 

‘আমার তো তাই ইচ্ছা। সেই জন্যই তো আপনার কাছে ছুটে এসেছি ।’ - আমি বললাম।

 

জ্যাঠামশাই কিছুক্ষন কি ভাবলেন। তারপর আমাকে নিশ্চিন্ত করলেন, ‘আইচ্ছা বেশ। তাই হইব।’   

 

আমি বলি, ‘এবার বাদামতলার পূজায় আপনি থাকবেন না?’

 

জ্যাঠামশাই বলে ওঠেন, ‘না। আমার মন্ত্র নাকি অরা বুঝতে পারে না। তাই এই বচ্ছর ওরা আমারে বাদামতলার পুজা থিক্যা বাতিল কইরা দিছে ।’

 

কথাটা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। এ ও মায়ের লীলা। আমার বাড়ীর মায়ের পূজায় জ্যাঠামশায়কে তাই সহজেই পেয়ে গেলাম ।

 

জ্যাঠামশাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘জ্যাঠামশাই পুজার খরচপত্র কেমন পড়বে?’

 

জ্যাঠামশাই এবার নড়ে চড়ে বসলেন। আমাকে হাত তুলে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘খরচ? সে তুমি যেমন করবা । তবে শ্যামল আমি যতটা সাশ্রয় সম্ভব সেই রকম ভাবে তোমার পূজা কইরা দিমু। ফর্দও তোমারে বুইঝ্যা কইরা দিমু। মায়ের কাপড়-চোপড় ও যতটা সম্ভব কমের মধ্যে রাইখবার বইলা দিমু।’

 

‘আর জ্যাঠামশাই, আপনার দক্ষিণা?’ - কথাটা জিজ্ঞাসা করে নেওয়া ভালো ।

 

 জ্যাঠামশাই মুখের দিকে হাসলেন, ‘সে দিও নে যা হয়। আচ্ছা নিজেই তখন চাইয়া লমুনে। চিন্তা কইর না। যাও এহন বাড়ী যাও। 

 

              জ্যাঠামশাইর আশ্বাস পেয়ে আমি বাড়িতে ধাবমান হলাম। গিন্নিকে বললাম, ‘বুঝলে জ্যাঠামশাই রাজি হয়েছেন। উনি সব ফর্দ করে দেবেন।’

 

ভাইদের সংবাদটা দিলাম।   মাকে ও গিয়ে বললাম, ‘মা এবার বাড়ীতে পূজা করব ভেবেছি। জ্যাঠামশাই রাজী হয়েছেন।’

 

মা অবাক, ‘পূজা করবি? এই বাজারে পূজা করা যে খুবই খরচ । পারবি তো?’

 

মাকে বললাম, ‘মা তোমার হাত দিয়ে পূজা তো শুরু করি। দেখি না কতদূর দাঁড়ায়। যাই এবার ঠাকুর বায়না দেখে আসি।’ - মা খুশী। 

 

            পূজার আর দিন দশেক বাকি। প্রতিমা এই ক’দিনে বানিয়ে দেবে কি না কে জানে!  তবু ছুটে গেলাম কাছাকাছি একটা ঠাকুর বানানোর জায়গায়। কথা বললাম প্রতিমা শিল্পী তপন বসাক এর সাথে । উনি বড় চিন্তায় পড়লেন । শুধু বললেন ‘এই ক’ দিনে কি করে আপনাকে আমি ঠাকুর বানিয়ে দিই বলুন তো? এই পুজা রাজকীয় পুজা । এত কম সময়ে এ রকম ভাবে বললে কি করে হয় বলুন? ’

 

আমি চুপ করে রইলাম । সব মায়ের ইচ্ছা । নইলে আমারই বা হঠাৎ করে পুজা করার ইচ্ছা হবে কেন?

 

আমাকে চুপ দেখে তপনবাবু বললেন, ‘কি রকম প্রতিমা করতে বলেন?’

 

বললাম, ‘বড় নয় । একদম ছোট সাইজের!’

 

উনি এবার সদ্য বিচালি লাগানো একটা ছোট্ট কাঠামো দেখিয়ে বললেন,’ এই সাইজ ?’

 

আমার মনে হল এটাই সঠিক সাইজ। বললাম,’ হ্যাঁ। এই রকমই হোক আর ডাকের সাজ দেবেন ।’

 

তপন বসাক রাজি হয়ে গেলেন। বললেন ‘হ্যাঁ তাই করে দেব ডাকের সাজে । আপনি আগাম দিয়ে যান। ‘

 

            আগাম দিয়ে এলাম। পঞ্চমীতে যেতে বললেন ঠাকুর আনতে। এবার আত্মীয়-স্বজন নিকট বন্ধু যারা আছে তাদের সবাইকে পূজায় আসতে আমন্ত্রণ জানালাম।

 

          প্যান্ডেল লাইট রান্নার ব্যবস্থা কোন কিছুই বাদ গেলো না। পাড়ার রান্নার লোক সখিলাল কে রান্নার ভার দিলাম। কানে কম শোনে। তবু আশ্বাস দিল, ‘সে আপনি ভাববেন না।’

 

               আমি ভাবনা ছেড়ে দিলাম জগত জননীর ওপরে। জ্যাঠামশাই এসে ফর্দ দিয়ে গেছেন। গিন্নি কোমর বেঁধে নেমে পড়ল পূজার আয়োজনে। গিন্নি সে একাই এক’শ। দোকান পাট বাজার ঘাট সবেতে সে একাই দশভূজা। আমি ফর্দর পর ফর্দ লিখছি, এই কেনা হল, আর অমুকগুলো বাকি রয়ে গেলো। দুই ছেলে কি কি ছবি তুলবে আর কি কি  ভি ডি ও করবে সেই নিয়ে মেতে আছে।

 

          দমদম থেকে সোনা কাকা এসে গেলেন। কাকার কি আনন্দ। -‘শ্যামল, তুই মায়ের পূজা করবি শুইনাই আমি এক কথায় চইল্যা আইলাম। কাকাকে বললাম, ‘কাকা আপনি এসেছেন। এ আমার অশেষ আনন্দ। চলুন ঠাকুর নিয়ে আসি।’

 

       বাড়ির ছোট জামাই সোমনাথ ও এসে পড়ল। সোমনাথ ও খুব খুশী। পূজার জন্য বাজারপত্র, দশকর্মা, ফুল সব নিজের কাঁধে দায়িত্ব নিয়ে কোমর বেঁধে নেমে পড়ল।

 

        পঞ্চমীতে ঠাকুর নিয়ে এলাম রিকশা ভ্যানে করে। মায়ের একচালা মূর্তি। ডাকের সাজে ছোট প্রতিমা। প্রতিমার সে কি উজ্জ্বল মূর্তি। রাস্তার লোকজন যেই দেখে সেই বলে, ‘বাঃ কি অপূর্ব।’-দশ ভূজা রাজে দশ দিশি ঘিরে, মা এসেছেন আমাদের ঘরে।

 

           ষষ্টির সন্ধ্যায় জ্যাঠামশাই নারায়ন শীলা হাতে পুজা করতে চলে এলেন। মায়ের বোধন হল। কলা বৌ গনেশের পাশে বসানো হল । মাকে অস্ত্রাদিতে সাজানো হল। গিন্নী পূজার কাজে লেগে পড়ল জ্যাঠামশাইকে হাতে হাতে সব গুছিয়ে দিতে। মা ও পূজার কাজে এসে হাত লাগালো। ঢাকির ঢাকের আওয়াজে এবার ষোলো কলা পরিপূর্ণ।

 

          বাড়িতে আত্মীয় স্বজন সবাই এলো। বসল। পূজা দেখল। অঞ্জলী দিল। অষ্টমীর অঞ্জলি হলো। নবমীর সন্ধিপূজা হল। চার দিনে চার রকম রান্নায় সখীলাল মাতিয়ে দিল। সবাই ভোগ প্রসাদ নিল। ভাইরা আসার সময় পেলো না। তারা শ্বশুর বাড়ীতে ঘুরতে গিয়েছিল। যেন দাদার পুজা থেকে সেটা বেশী জরুরী ।

 

          আজ দশমী। জ্যাঠামশাই দশমীর পূজা সারলেন। ডাক দিলেন ঘট বিসর্জন দেখতে। ‘ও বৌমা, ও শ্যামল , কই ছেলেপুলেরা সব এখানে আস। ঘটের জলে মায়ের মুখ দেখো ।’

 

ঘটের জলে মায়ের মুখের প্রতিচ্ছবি দেখে মনটা কেমন একরকম উদাস হয়ে গেলো।

 

কাকা বললেন, ‘পূজা খুব সুন্দর হইল ঠাকুরমশায় ।’

 

জ্যাঠামশাই বলে ওঠেন, ‘সব মায়ের ইচ্ছা।’

 

সখিলাল বলে ওঠে, ‘বড়বাবু আপনার পূজায় কাজ করে খুব আনন্দ পেলাম।’

 

সোমনাথ বলে ওঠে, ‘হ্যাঁ , বাড়ীর পূজা। খুব আনন্দ হয়েছে বড়দা।’

 

ঢাকের তালে তালে বাড়ীর ছেলেপুলেরা খুব নাচছে।  ঠাকুর থাকবে কতক্ষন , ঠাকুর যাবে বিসর্জন ।

 

               বিকেলে পাড়ার এয়ো স্ত্রী-রা এসে প্রতিমাকে বরণ করল। সন্ধ্যায় ঢাক ঢোল সহকারে এস-কে পালের পুকুরে মায়ের বিসর্জন দিয়ে এলাম। মনে মনে বললাম, ‘আর বছরে এসো মা গো।’ 

 

               আর শেষের শেষে জ্যাঠামশাই সবাইকে শান্তি জল ছিটিয়ে দিতে দিতে বলে উঠলেন, ‘আপদ শান্তি, বিপদ শান্তি, গৃহ শান্তি, বিশ্ব শান্তি, পরিমন্ডল শান্তি, গৃহকর্তার শান্তি। ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি।’

 

পুজা শেষ । সবাই ধ্বনি তুলল ‘আসছে বছর আবার হবে ।’

 

    জ্যাঠামশাইকে এবার দক্ষিনা দিতে গেলাম । জিজ্ঞাসা করলাম,’কত দেবো জ্যাঠামশাই।’

 

  জ্যাঠামশাই একটা ভুবন মোহন হাসি হেসে বললেন, ‘বাবা তুমি যা দিবা। আমি তোমার পূজা কইরা খুব আনন্দ পাইছি। এত পূজা করি ।এমন শান্তি কখনো পাই নাই। আমারে না হয় পাঁচশটা টাকা হাতে দিয়া দাও।’                         

 

         আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমার খরচের ভার লাঘব এর জন্য স্নেহবশে উনি এই সামান্য দক্ষিনা চাইলেন। আমরা সবাই বসে আছি ।

 

           জ্যাঠামশাই আমার হাত ধরে বলতে থাকেন, ‘বাবা শ্যামল, এই বছর মায়ের পূজা বারণ হইয়া গেছিলো বাদামতলায়। মায়ের কাছে আক্ষেপ করলাম, মা আমি কি দোষ করলাম? আর দেখি তুমি মায়ের পূজা করবা বইলা আইস্যা দাঁড়াইলা। মায়ের কি লীলা। শ্যামল, বিশ্বাস করবা না। আমার মনে হইল মা দুর্গতিহারিণী দুর্গা আমার হাতে পূজা চায়। তাই তুমি যখন পুজার খরচ পত্র নিয়া চিন্তা করতাছিলা, তখন তোমারে যাতে বিব্রত না হইতে হয় আমি সেমনেই পুজা কইরা দিতে স্থির সংকল্প হইলাম।’

 

আমি বললাম, ‘আপনার হাতেই তো মায়ের পুজা করানোর কথা ভেবেছিলাম । আপনার পুজা খুব ভাল হয়েছে। নইলে আমার দুর্গাপুজা করাটা সম্ভব হতই না ।

 

জ্যাঠামশাই বলে ওঠেন, ‘বাবা শ্যামল একটা কথা কই, আমার দুর্গাপুজা না বইলা কও মায়ের পূজা। পুজা মানে শ্রদ্ধা ভক্তি ।মায়ের পুজা মা করিয়ে নিলেন। তুমি আমি তো নিমিত্ত মাত্র। ’

 

কাকা বললেন,’ ঠিক বলেছেন ঠাকুরমশাই । আত্মম্ভরিতা নয় । শ্রদ্ধা আসল কথা ।

 

আমার যেন একটা জ্ঞান লাভ হল। 

 

জ্যাঠামশাই বলতে থাকে, ‘শোনো আইজ একটুক চণ্ডী মাহাত্ম্য  কই। পুজার পরে যেমন পাঁচালি শোনে তেমনি এখন দেবী  মাহাত্ম্য শোনো বইস্যা ।’

 

আমরা সবাই শুনতে উৎসুক হয়ে উঠলাম।

 

        জ্যাঠামশাই বলতে শুরু করলেন, ‘তয় শোন মন দিয়া। পুরাকালে সুরত নামে একজন রাজা ছিলেন। শত্রু তাকে আক্রমণ করে তার রাজত্ব কেড়ে নিলেন। রাজ্যহারা সুরত মনের দুঃখে বনে চলে গেলেন। সেখানে মেধা মুনির তপোবনে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। কিন্তু রাজা কিছুতেই তাঁর এই রাজ্য হারানোর দুঃখ ভুলতে পারছেন না। বসে বসে শুধু ভাবেন তাঁর রাজত্বের কথা , তার রাজধানীর কথা , তার ধনভাণ্ডারের কথা, আর তার প্রিয় হাতিটার কথা।

 

আর ঠিক সেই সময়ে সেখানে আরেকজন মানুষ এসে উপস্থিত হলেন। তার নাম সমাধি । জাতিতে তিনি বৈশ্য । তারও ঠিক সেই একই অবস্থা । তাঁরও বিপুল সম্পত্তির ধনরত্ন সবকিছু চলে গেছে। কিন্তু তার সম্পত্তি দস্যুতে অপহরণ করেনি । আত্মীয়-স্বজন কেড়ে নিয়েছে ।

 

তপোবনে বসে সুরত আর সমাধি দুজনে সেই একই ভাবনা ভাবতে থাকে। এই ভাবনা থেকে কিছুতেই তারা নিষ্কৃতি পাচ্ছে না।

 

তখন একদিন তারা মেধা মুনির কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বললেন, ‘এই চিন্তা থেকে আমরা মুক্তি পাচ্ছি না কেন মুনিবর?’

 

মেধা মুনি বললেন, ‘ এই রকমই হয়। এর নাম মায়া। তিনিই মহামায়া।এই মহামায়াই হলেন জগতের মূল । তিনি শুভ। তিনি অশুভ। এই মহামায়াই হলেন দেবী দুর্গা । তাঁকে আরাধনায় প্রসন্ন করতে পারলে তার কাছে যে যা চায় তাই পায়।

 

 আমি বললাম, ‘কিন্তু পৃথিবীতে অশুভ শক্তিই কি প্রবল নয় জ্যাঠামশাই?’

 

জ্যাঠামশাই বললেন, ‘এই পৃথিবীতে শুভ এবং অশুভ এই দুই শক্তিই কাজ করে । অশুভ শক্তিকে প্রবলতর মনে হয়। মনে হয় বুঝি এই অশুভ শক্তির প্রভাব থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু তা নয়। শ্যামল সব অশুভ সরে যায় মহামায়ার কৃপায় । ’

 

জ্যাঠামশাই আবার একটু দম নিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সোমনাথ বলে, ‘ তারপর ?’

 

         জ্যাঠামশাই বলতে থাকেন , ‘ সুরথ মুনি তখন তাদের বোঝালেন , দেখ বাপু , সেই মহামায়া এই আমাদের মোহগ্রস্ত করে রেখেছেন ।  কিন্তু তিনি আবার অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করে শুভ শক্তির উদ্বোধন করে দেন। তিনি আমাদের মা। মা কখনো সন্তানের বিরুদ্ধাচরণ করেন না। মেধা মুনির কথায় রাজা সুরত এবং  সমাধি দুজনে দেবী দুর্গার আরাধনা করতে আরম্ভ করলেন তিন বছর ধরে একাগ্র সাধনায় সিদ্ধিলাভ করলেন তারা। দেবী দুর্গা এবার দুজনেরই মনস্কামনা পূর্ণ করলেন। সুরতকে বললেন তুমি তোমার ধনসম্পদ এবং রাজত্বের কথা চিন্তা করেছিলে , কামনা করেছিলেন । আবার সেই রাজত্ব তুমি ফিরে পাবে এবং আগামী জন্মে সাবর্ণি মনু রূপে জন্মগ্রহণ করে সুদীর্ঘকাল রাজত্ব ভোগ করবে।’

 

          কিয়ৎক্ষন পরে জ্যাঠামশাই অভ্যাস মত আবার একটু দম নিয়ে বলতে থাকেন ,’ আর বৈশ্য সমাধিকে বললেন তুমি তোমার অপহৃত  ধন-সম্পদের কথা না ভেবে  ভেবেছিলে তোমার সেই সব পরম আত্মীয়দের কথা যারা তোমার সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে । তোমার স্নেহপ্রবণ মন তাদের মঙ্গল কামনা করেছিল । এইটাই তোমার সত্য লাভের পথে প্রথম পদক্ষেপ । কাজেই তুমি পাবে আত্মার পরমামুক্তি সর্ব ব্রহ্ম জ্ঞান। - এই হইল চণ্ডী মাহাত্ম্য। ’ 

 

          আমরা চণ্ডী মাহাত্ম্য শুনলাম। জ্যাঠামশাই বলতে থাকেন, ‘  তাই এই দেবিপক্ষে আমরা সেই মহামায়ার কাছে প্রার্থনা জানাই সর্ব মানবের সর্বাঙ্গীন কল্যাণের জন্য। তিনি যেন আমাদের সকলকে তার শুভ শক্তির দিকে আকৃষ্ট করুন। আমাদের অন্তর্নিহিত শক্তির উদ্বোধন করুন। আর সব  শেষে মা মহামায়া জগদজননীর কাছে আমরা  প্রার্থনা করি ,  ‘রূপংদেহী, জয়ংদেহী, যশোদেহী,  দ্বিশো জহি। -‘ হে মা  পরমেশ্বরী  , আমায় রূপ  দাও , আমায় জয় দাও , আমায় যশ দাও, এবং আমার কাম ক্রোধাদি রূপ শত্রুর  বিনাশ করো ।’ -আমরা মোহিত হয়ে রইলাম। এমন ভাবে কোন দিন কেউ মা মহামায়ার মাহাত্ম্য শোনায় নি এত সুন্দর করে।

 

        জ্যাঠামশাই এবার গাত্রোত্থান করলেন , ‘ তয় শ্যামল , বাবা ,এইবার আমি উঠি । তোমার পূজায় খুব আনন্দ পাইলাম। তোমার মঙ্গল হোক। আসছে বছর আবার মা আসুন তোমার ঘরে।’-

 

আমাদের সকলের চোখে আনন্দ অশ্রু।


| শারদ সংখ্যা-১৪২৯ | aleekpata.com | 30th Edition |

| ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |

| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |

| Durga Puja , 2022 | July-Oct 2022 | Fifth Year Fourth Issue  |

© All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |

| a DISHA-The Dreamer Initiative |

 



No comments:

Post a Comment

Please put your comment here about this post

Main Menu Bar



অলীকপাতার শারদ সংখ্যা ১৪২৯ প্রকাশিত, পড়তে ক্লিক করুন "Current Issue" ট্যাব টিতে , সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

Signature Video



অলীকপাতার সংখ্যা পড়ার জন্য ক্লিক করুন 'Current Issue' Tab এ, পুরাতন সংখ্যা পড়ার জন্য 'লাইব্রেরী' ট্যাব ক্লিক করুন। লেখা পাঠান aleekpata@gmail.com এই ঠিকানায়, অকারণেও প্রশ্ন করতে পারেন responsealeekpata@gmail.com এই ঠিকানায় অথবা আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।

অলীক পাতায় লেখা পাঠান