গল্প
একলা বৈশাখ
মৌসুমী
চৌধুরী
খুব সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে
উঠেছে পর্না। সকালবেলাকার পুজো-আচ্চার কাজটুকু সেরে সোজা রান্নাঘরে ঢুকেছে সে। আজ
যে ১লা বৈশাখ। আজ রায়চৌধুরীদের হেঁসেলে আদ্যন্ত বাঙালি রান্না হবে। তাই জলখাবারে
লুচি-আলুরদম, দুপুরে চিতলের মুইঠ্যা, চিংড়ির মালাইকারী, মোচা ঘন্ট, মাটনকষা থেকে
শুরু করে রাতের খাবারের সববিছু পর্নাকেই নিজে হাতে রাঁধতে হবে, রাঁধুনি বকুল মাসীকে সঙ্গে
নিয়ে। বিয়ে হয়ে যবে থেকে এ বাড়িতে এসেছে সেই থেকে এটাই এ বাড়ির দস্তুর।
অন্যদিনগুলোতে তো এ বাড়ির ব্রেকফাস্ট থেকে ডিনার সবকিছুতেই সাহেবিয়ানার ছোঁয়া
থাকে। তাই সারা বছর নিজেকে বড় ব্রাত্য মনেহয় পর্নার। তখন তার মধ্যবিত্ত মানসিকতা
যেন এঁটে উঠতে পারে না এ বাড়ির আভিজা ত্যের খাপে খাপে!
প্রথম দিন থেকেই এবাড়িতে বড় একলা পর্না। যদিও এতদিনে এই একাকীত্ববোধটা বুকের
ভাঁজে ভাঁজে একেবারে মিলে-মিশে গেছে। সেও যেন এই রায়চৌধুরী বাড়ির শৌখিন
আসবাবপত্রের একটি। আলাদা করে এই বিষয়টায় তার আর খারাপলাগা কাজ করে না।
আচ্ছা, শুধু কি সে-ই একা? দীপ্তও কি একা নয়? এবাড়ির অধ্যাপক-গবেষক ছেলে দীপ্ত, যে তার
সহপাঠিনী নাজনীনকে ভালোবাসে এবং বিয়ে করতে চায়, সেটা এবাড়ির কেউই কোনভাবে মানতে
চাননি। কারণ এ বাড়িতে যে সাতপুরুষের প্রতিষ্ঠিত রাধাগোবিন্দের মন্দির আছে। দীপ্তও
বাবা-মাকে দুঃখ দেবেনা বলে বুক ভরা দুঃখ দিয়েছে নিজেকে, বিয়ে করেছে পর্নাকে।
ফুলশয্যার দিন দীপ্তর মুখে অকপটে এত সবকিছু শোনার পরেও পর্না মায়ের কাছে ফিরে যেতে
পারেনি। কারণ বাবার মৃত্যুর পর থেকে বোন আর তাকে নিয়ে মা তাঁর এক দূর সম্পর্কের
দাদার সংসারে আশ্রিতা। আর সেই মামার অভিভাবকত্বেই দীপ্তর সঙ্গে এই বিয়ে পর্নার।
সেই প্রথম দিন থেকে এভাবেই বুকের মাঝে একটা থমধরা একাকীত্ব পুষে রেখে
রায়চৌধুরী বাড়িতে তিনটি ১লা বৈশাখ কেটে গেছে পর্নার। যদিও দীপ্তর সঙ্গে পর্নার
বন্ধুত্বে কোন খাদ নেই। দীপ্ত তাকে বলেই নাজনীনের সঙ্গে দেখা করতে যায়! রাত করে
বাড়ি ফেরে। পর্না না খেয়ে জেগে বসে থাকলে অনুযোগ করে দীপ্ত। রাতের খাবারটা পর্না
আর দীপ্ত একসঙ্গে খায়। এটুকু সে চেয়ে নিয়েছে দীপ্তর কাছে। তখন তারা পরস্পর
সারাদিনের নানা কথা শেয়ার করে। তারপর শোবার ঘরে ঢুকে দু'জনে দুটো বিছানায় শুতে চলে
যায়।
বাড়ির সব্বার খাওয়া মিটিয়ে আজও দীপ্তর জন্য অপেক্ষা করছিল পর্না। আজ নাজনীন
ডেকেছে দীপ্তকে। কি নাকি এক বিশেষ জরুরি দরকার আছে! বিষয়টা দীপ্তর একান্ত ব্যক্তিগত, তাই নাক গলায় নি
পর্না।
আজ দীপ্ত এল অনেকটা রাত করে, প্রায় বারোটায়। মুখে আষাঢ়ের ঘনকালো মেঘ। রকমারি
বাঙালি পদগুলো দীপ্তকে পরিবেশন করতে শুরু করে পর্না। হঠাৎ আলগোছে পর্নার হাতটা ধরে
দীপ্ত। একেবারে খাদের কাছে গলাটাকে নামিয়ে এনে বলে,
— " আগামী সপ্তাহে নাজনীনের নিকাহ্। আজ শেষবারের মতো
দেখা করতে এসেছিল আমার সঙ্গে। আমার খুব খুব কষ্ট হচ্ছে, পর্না। ভীষণ একলা
লাগছে।"
একজন একলা মানুষ আরেকজন একলা মানুষের হাত ধরে এই ১লা বৈশাখে। খোলা জানালা
দিয়ে তিরতির করে ঢুকে পড়ে নববর্ষের বাতাস।
| শারদ সংখ্যা-১৪২৯ | aleekpata.com | 30th Edition |
| ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Durga Puja , 2022 | July-Oct 2022 | Fifth Year Fourth Issue |
| © All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |
| a DISHA-The Dreamer Initiative |
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post