প্রবন্ধ
শক্তিদায়িনী বরদাত্রী দেবী দুর্গা
রূপম চক্রবর্ত্তী
শ্রী মায়ের আগমনী
ধ্বনীতে প্রাণে উষ্ণ শিহরণ জাগে। প্রাণে প্রাণে আনন্দের দোলা লাগে। ছুটে চলে সবাই মায়ের
শ্রী চরণে অঞ্জলি দিতে। শ্বশুর আলয় থেকে মেয়ে আসবে বাপের বাড়িতে। তাই সবার মুখে হাসি
হাসি রব। পাড়া প্রতিবেশির সত্তায় একটিই আকুতি কখন শারদ প্রভাত আসবে, কারণ তারা তাদের
মেয়েটিকে শিউলি ফুলের মালা গেঁথে পরাবে। বার্তা প্রেরকের ভূমিকায় শুভ মহালয়া আসে। বাপের
বাড়িতে শুরু হয়ে যায় প্রেমানন্দের সমারোহ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,
"আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ,
আমরা গেঁথেছি শেফালি মালা।
নবীন ধানের মঞ্জুরী দিয়ে,
সাজিয়ে এনেছি ডালা।
এসো গো শারদ লক্ষ্মী,
তোমার শুভ্র মেঘের রথে।
যে মেয়েটি আসবে
তিনি মা জগৎজননী। অসুরবিনাশিনী, শক্তিদায়িনী বরদাত্রী দেবী দুর্গা। যে অসুর প্রতিনিয়ত
আমাদেরকে দুর্গতি প্রদানে সচেষ্ট থাকে সে দুর্গম অসুরকে মা বধ করেন তাঁর অপার্থিব করুণায়।
দুর্গম অসুরকে জানতে হলে আমাদেরকে আরেকটু গভীরে যেতে হবে। দুর্গম অসুরের দুই রূপ। প্রথম রূপকে আমরা স্বার্থান্ধতা হিসেবে আখ্যায়িত
করতে পারি। প্রতিটি মানুষ সংসার বন্ধনে আবদ্ধ।
সংসারের ঘুর্ণিপাকে মানুষ ঘুরতে ঘুরতে হয়ে পড়ে স্বার্থান্ধ। নিজের স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য মানুষ তার মনুষ্যত্বকে বিকিয়ে দিয়ে হিংসার
দাবানলে নিজেকে দহন করতে থাকে। কেউ চান অন্যজনকে ছোট করে নিজেকে বড় করতে। আর কেউ আছেন
পরের সম্পত্তি দখল করে নিজেকে কোটিপতি বানিয়ে জগতে প্রচার করছেন। কিছু কিছু মানুষ আছে
দুর্বলের উপর নির্যাতন করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করছে। আমরা পূজো বাড়িতে যখন যাই তখন দেখি
মায়ের পদতলে বিজিত মহিষাসুর। " মহীং ইষ্যতি" ইতি মহিষ। যে মহীকে অর্থাৎ জগতকে
উগ্রভাবে কামনা করে সে মহিষ। মহিষবৃত্তি সম্পন্ন মানুষ জাগতিক ভোগ সুখ ও আনন্দ লাভের
জন্য জগতকে উগ্রভাবে কামনা করে। দুর্ভাগ্যের বিষয় ভিতরের পশুশক্তির পাদুর্ভাবের কারণে
সে দুঃখ ভোগ করে। মা সে পশুশক্তি স্বার্থান্ধতা
নামক দুর্গম অসুরের হাত থেকে আমাদেরকে রক্ষা করেন বলে তিনি দুর্গা। মা বিভিন্ন সময়
বিভিন্নভাবে তাঁর সন্তানকে রক্ষা করে চলেছেন।
দেবী ভাগবতে আছে,
" সেয়ং শক্তির্মহামায়া সচ্চিদানন্দরূপিণী।
রূপং বিভর্ত্যরূপা চ ভক্তানুগ্রহহেতবে।।"
সেই সচ্চিদানন্দরূপিনী
মহামায়া পরাশক্তি অরূপা হইয়াও ভক্তগণকে কৃপা করিবার জন্য রূপ ধারণ করেন। মা এত করুণাময়ী
কেউ থাকে সকামভাবে ডাকুক অথবা নিষ্কামভাবে ডাকুক তিনি মায়ের কৃপা অবশ্যই লাভ করবেন।
শ্রী শ্রী চণ্ডীর দ্বাদশ অধ্যায়ের ৩৭ নাম্বার শ্লোকে আছে, সেই দেবীই এই বিশ্ব সৃষ্টি
করেন ও তাঁহার দ্বারাই এই জগৎ মায়ামগ্ধ হয়।
তাঁহাকে নিষ্কামভাবে আরাধনা করলে তিনি
অযাচিতভাবে তত্ত্বজ্ঞান দান করেন এবং তাঁহাকে
সকাম উপসনা দ্বারা পরিতুষ্টা করলে তিনি ঐশ্বর্য প্রদান করেন। অযাচিত তত্ত্বজ্ঞান লাভের
মাধ্যমে আমরা নিজের ভিতরে লুকে থাকা স্বার্থান্ধতাকে দূর করতে পারি।
দুর্গম অসুরের
দুই রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রথমে স্বার্থান্ধতার কথা বলেছি। এবার আমি অবিদ্যার কথা
বলব, দুর্গম যখন অবিদ্যার অধীন হয় তখন মায়ার গর্তে পড়ে হাবুডুবু খেতে থাকে। মায়ামুগ্ধ
জীব ভাবে পৃথিবীর সকল কিছুই তার। তিনি চিরদিন বেঁচে থাকবেন। যা ভোগ করতে ইচ্ছা করে
তিনি চেষ্টা করেন তা ভোগ করার জন্য। অজ্ঞান
বা মায়া দ্বারা আমাদের প্রকৃত জ্ঞান আবৃত থাকে। মায়া শক্তির কারণে জীব আমি কর্তা, ভোক্তা,
ইত্যাদি কল্পনা সৃষ্টি করে সংসার মোহে হাবুডুবু খায়। পরম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন,
" পাপ কর্ম পরায়ণ বিবেকশূন্য নরাধমগণ মায়া দ্বারা হতজ্ঞান হইয়া আসুর স্বভাব প্রাপ্ত হওয়ায় আমাকে ভজনা করেনা।"
নিজের অস্তিত্ব বিনাশী অবিদ্যা রূপ মায়াকে যিনি ধ্বংস করেন তিনি জগৎজননী মা দুর্গা।
মা হচ্ছেন অভিষ্টদায়িনী। তিনি পরমা ইচ্ছা শক্তি। মানুষের মধ্যস্থিত আসুরিক শক্তিকে
বিনাশ করে মুক্তি পথের সন্ধান দেন মা জগৎজননী। আমাদের মত ব্যাক্তিদের মায়ার হাত থেকে
নিস্তার পাওয়া খুব দুরহ ব্যাপার। মায়ের কাজ হচ্ছে যারা ধর্ম বিমুখ তাদের প্রতিনিয়ত
আবদ্ধ করা। শ্রী চৈতন্য চরিত্রামৃতে বলা হয়েছে,
" কৃষ্ণ ভূলি সেই জীব অনাদি বহির্মুখ।
অতএব মায়া তারে দেয় সংসার দঃখ।।
কভু স্বর্গে উঠায় কভু নরকে ডুবায়।
দণ্ড্য জনে রাজা যেন নদীতে চুবায় (চৈঃচঃমধ্য
২০)
যাহা হোক দুর্গম
অসুরের কথা বলতে গিয়ে স্বার্থান্ধতা এবং অবিদ্যার কথা বিশ্লেষণ করেছি। মাতৃপূজায় আমাদের
প্রার্থনা থাকবে এ দুটি অসুরকে বিনাশ করে আমরা ধর্মপথে অথবা অথবা ইষ্টপথে নিজের জীবনকে
যেন পরিচালিত করতে পারি।
মানব জীবনে অর্থ
বিত্তের প্রাচুর্যতা থাকতে পারে কিন্তু সে অর্থ যদি সঠিকভাবে বন্টিত না হয় তাহলে সুন্দর
জীবন গঠন করা যাবেনা। বন্টন করার গুপ্ত রহস্য ধর্মই সন্ধান দিতে পারে। ধর্মীয় অনুশাসনবাদ
মানুষের জ্ঞানের আলো খুলে দেয়। ধর্মীয় আচরণগুলোর সহজ ও তাত্ত্বিক দিকগুলো আমরা গুরুর
কাছ থেকে শিখতে পারি। অন্যদিকে আমরা যারা দুর্গাপূজা করি, কালী পূজা করি সরস্বতী পূজা
করি তখন খেয়াল রাখতে হবে পুজোর ভিতরের রহস্যগুলো নিজের জীবনে অধিষ্ঠিত করছি কিনা। যেমন ধরুন পূজা করতে বসলাম কিন্তু দেখা গেল আমরা
ভক্তি করে মায়ের চরণে নিজেকে সমর্পণ করতে পারলামনা। তাহলে কি আমরা সঠিকভাবে পূজা করছি সেটাই নিজেকে
প্রশ্ন করতে হবে। সমাজে অনেক লোক পাবেন যাদের মধ্যে কেউ কেউ আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য বা
আত্মপ্রচারের জন্য পূজা করছে। যে পূজার মধ্যে রাজসিকতা আর তামসিকতার গন্ধ পাওয়া যায়। একবার আমি চট্টগ্রাম শহরের একটি বিশাল বাজেটের পূজোবাড়িতে
তন্ত্রধারকের কাজ করেছিলাম। আমি দেখলাম জগৎ মাতা দুর্গা দেবীর পূজা হচ্ছে অথচ কোনো
একজন মহিলাকে পাওয়া যাচ্ছেনা একটু উলুধ্বনি দেওয়ার জন্য। পুরোহিত মহোদয় পূজা করছেন,
আমি মন্ত্রপাঠ করছি আর অন্যদিকে পুরোহিত মহোদয়কে সাহায্য করার জন্য কোনো লোক খুঁজে
পাওয়া যাচ্ছেনা। আমরা যদি প্রকৃত ভক্ত হয়ে উঠতে না পারি তাহলে মাতৃ কৃপা থেকে বঞ্চিত
হব।
হিংসা ও অহমিকার
প্রচন্ড আঘাতে জর্জরিত সনাতন সনাতন সমাজকে সাত্ত্বিক পূজা করে মাতৃ করুণা লাভ করার
জন্য এগিয়ে আসতে হবে। দেবী মাহাত্ম্যেও বলা হয়েছে
"শ্রোষ্যন্তি
চৈব যে ভক্ত্যা মম মাহাত্ম্যমুত্তমম।
ন তেষাং দুষ্কৃতং
কিঞ্চিৎ দুষ্কৃতোত্থা ন চাপদঃ।।
যে আমার উৎকৃষ্ট
মাহাত্ম্য ভক্তি সহকারে পাঠ করিবে তাহার কোনো পাপ বা পাপজনিত বিপদ হইবেনা। ঋষি মেধস
শ্রোতা সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্যকে দেবীর চরণে শরণাগত হতে বললেন,
"তামুপৈহি
মহারাজ শরণং পরমেশ্বরীম।
আরাধিতা সৈব
নৃণাং ভোগস্বর্গাপবর্গদা।।
সেই পরমেশ্বরীর
শরণাগত হও। তাঁহাকে আরাধনা করিলে তিনি মনুষ্যদিগকে ভোগ, স্বর্গ ও অপবর্গ দান করিয়া
থাকেন। নিজের পরমার্থিক মুক্তির লক্ষ্যে আমরা শ্রদ্ধা ভক্তি সহকারে মায়ের কাছে আত্মনিবেদন
করব। পাশাপাশি দুর্গাপূজার মূলশিক্ষা সার্বজনীনতাও আমাদেরকে গ্রহণ করতে হবে যাতে একে
অপরের প্রতি প্রেমালিঙ্গনে আবদ্ধ হতে পারি। সুন্দর পরিবার, সমাজ নির্মাণের মাধ্যমে
আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত হয়। প্রত্যেক পূজার্থীর জীবন সুন্দর ও মধুময় হোক। শুভ
ও সুন্দর শক্তির জয় হোক। কবিগুরুর ভাষায়,
তুমি নব নব রূপে
এসো প্রাণে
এসো গন্ধে বরণে,
এসো গানে।
এসো অঙ্গে পুলকময়
পরশে
এসো চিত্তে অমৃতময়
হরষে,
এসো মুগ্ধ মুদিত
দু'নয়নে।
তুমি নব নব রূপে
এসো প্রাণে।
| শারদ সংখ্যা-১৪২৯ | aleekpata.com | 30th Edition |
| ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Durga Puja , 2022 | July-Oct 2022 | Fifth Year Fourth Issue |
| © All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |
| a DISHA-The Dreamer Initiative |
বাহ 👌
ReplyDelete