রহস্য গল্প
নীল মৃত্যু
উজাগর
শ্রাবণী গুপ্ত সরকার
অলঙ্করণঃ স্বরূপ চক্রবর্তী |
ঘুম ভেঙে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো
ঈশা।
আবারও সেই বিকট বাজে স্বপ্নটা। দিব্যি নিজের সাদা ধবধবে দামী বেডশিট
বিছানো সুন্দর খাটে, রীতিমতো সুসজ্জিত বেডরুমে শুয়ে আছে ও। এর মধ্যে
জঙ্গল, অন্ধকার আর...আর... সেই ভয়ঙ্কর ভয়টা
কেন এসে তাড়া করলো ওকে? মোবাইলে সময়
দেখলো ঈশা।
আড়াইটা বাজে।
গভীর রাত।
খুব নামী ফ্যাশন ডিজাইনার ঈশা মিত্রের একটা ফোন সারা রাত্রি খোলা থাকে। যদি কোন
ব্যবসায়িক ফোন আসে এই ভেবে। সামনের মাসে ওর নিজস্ব বুটিকের একটা একজিবিশন আছে
নিউইয়র্কে।
আপাতত খুব ব্যস্ত ঈশা।
সারাদিন নিজের কাজ নিয়েই মত্ত ছিল। অফিস, স্টুডিও, আজ আবার নতুন মডেল বাছাইয়ের কাজ ছিল। আসলে বিদেশে কিছু ওয়েস্টার্ন ড্রেসও
নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে বিদেশে। তাই সেসব পোশাকে দুর্দান্ত দেখায় এমন ফিগারের একজন মডেল
খুব প্রয়োজন ছিল ঈশার।
একটি মেয়েকে ইন্টারভিউতে খুব মনে ধরেছে ওর। নাম নেহা। কম বয়স, চমৎকার
ফিগার।
খুব মানাবে পশ্চিমি পোশাকে।
কাজের চাপে ঈশা ভুলেই গিয়েছিল
আজ ওর জন্মদিন। মা, বাবা দুজনেই পৃথিবী ছেড়েছেন নিতান্ত অকালে। দুজনেই
দুটো পৃথক দুর্ঘটনার শিকার। বাবা কার অ্যাক্সিডেন্টে যখন ঈশা ক্লাস টুয়ে পড়ে। আর একটা
ভয়ঙ্কর দুর্যোগের রাতে কলেজ থেকে ফেরার পথে আটকে থাকা মেয়ের জন্য উদ্বেগে অস্থির
মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষারত অবস্থায় বাজ পড়ে চলে গেলেন, বিরাট পৃথিবীতে মেয়েটাকে একা করে দিয়ে। ঈশা খুব শক্ত মেয়ে। মাথা
ঠান্ডা করে স্নাতক হয়েছে।
ফ্যাশন ডিজাইনিং কোর্স করেছে নামী প্রতিষ্ঠান থেকে। তারপর নিজের একটা বুটিক খুলে কাজ
আরম্ভ করেছে মনপ্রাণ দিয়ে। টাকা পয়সার অভাব কোনোদিনই হয়নি ওদের প্রচুর সম্পত্তির
কারণে। আর
সেই ছোটোবেলার বন্ধু শ্রীজা ওর সবসময়ের সঙ্গী, মানে
চিন্তাভাবনার আর কি।
শ্রীজা থাকে কিছুটা দূরে ওর বাবাকে নিয়ে, বিয়ের কথা
দুই বান্ধবীর কেউই ভাবছে না এখনও। যদিও বয়স ত্রিশের কোঠা ছুঁয়েছে তাও। এই স্বাধীন জীবন খুব উপভোগ করে ঈশা। শ্রীজা খুব
ছোটোবেলা থেকে চমৎকার আঁকে। ডিজাইনার হিসেবে প্রথম থেকেই ওর সঙ্গে কাজ করছে শ্রীজা। ওর
নান্দনিক রুচি অসাধারণ।
ঈশা ভুলে গেলেও শ্রীজা মোটেই ভুলে যায় নি জন্মদিনের কথাটা। দিব্যি পাঁচতারা হোটেলের ব্যাংকোয়েট হল বুক করে, নিমন্ত্রণ করে সব ব্যবস্থাই সম্পূর্ণ করে রেখেছে নিজের বুদ্ধিমতো। এমন কি বিকেলবেলা টেনে নিয়ে গেছে একটা নামী পার্লারে। হলোই বা ত্রিশ বছরের জন্মদিন বার্থডে গার্ল সাজবে না।
দুর্দান্ত পার্টি হলো। বেশীর ভাগই
ওর ব্যবসা জগতের বন্ধু, সহকর্মী, হ্যাঁ রীতেশও ছিল বৈকি। রীতেশ ওর খুব ভালো বন্ধু। তার বেশী
এখনও কিছু ভাবে না ঈশা।
খুব ভালো ফটোগ্রাফার রীতেশের সূত্রে ওর সবচেয়ে পছন্দের মডেল খুশবুর সঙ্গে যোগাযোগ। খুশবু খুব
লাবণ্যময়ী।
সালোয়ার, ঘাঘড়া, লেহেঙ্গা, শাড়ি সব রকম ভারতীয় পোশাক ওর শরীরে অন্য মাত্রায় পৌঁছে যায়। খুব ভালোওবাসে
খুশবুকে ঈশা।
আসলে ওর লাকি মডেল যে।
পার্টিতে ওরই ডিজাইনার শাড়ি, ব্লাউজে
উজ্জ্বল খুশবুর দিক থেকে চোখ সরানোই মুশকিল হয়ে পড়ছিল অতিথিদের, জীবন্ত অ্যাড।
পার্টি শেষ হলো দশটায়। আজ ঈশার
বাড়িতে রাত কাটানোর জন্য অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও শ্রীজা ওর সঙ্গী হলো না। বাবার
হাঁপানির টানটা বেড়েছে।
বাড়ি ফিরতেই হবে ওকে।
নিজের গাড়ির পিছনের ডিকিতে ভর্তি উপহার সামগ্রী, শ্রীজাকে
বাড়িতে পৌঁছে বাড়িতে ফিরলো ঈশা। যমুনা দি দারোয়ান আর ড্রাইভার কিশোরীলাল সব
উপহার নিয়ে এল ওর শোবার ঘরে। যমুনাদি, দারোয়ানকে
খাবারের প্যাকেট দিয়ে ঘরে গেল ঈশা।
কিশোরীলাল পার্টিতেই খাওয়া দাওয়া করে এসেছে। আজ রাতে দারোয়ানজীর সঙ্গে থেকে যাবে। কাল অফিসে
ঈশাকে পৌঁছে একদম বাড়ি ফিরবে।
ক্লান্তির চোটে কোনমতে পোষাক
পালটে, ব্রাশ করে, মেকআপ
রিমুভ করেই ঘুমিয়ে পড়েছিল ঈশা। তারপরেই এই বিকট স্বপ্ন দেখে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। টয়লেট গিয়ে
চোখেমুখে জল দিয়ে এসে, ঢকঢক খানিকটা জল খেলো ও, ঘুমটা কেটে গেছে। তার থেকে উপহারগুলো দেখা যাক। উপহার দেওয়ার চেয়ে কম হলেও উপহার
পাওয়ার মধ্যেও মজা আছে বৈকি। কাজেই বিছানার উপর গোটা কুড়ি গিফট নিয়ে বসলো ঈশা। একটা একটা
করে খুলতে লাগল ও।
পাঁচ নম্বর বাক্সটা খুলেই আতঙ্কে শক্ত হয়ে গেল ওর হাত পা। দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে এল। কম্পায়মান
হাত দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল বাক্সটাকে। চীৎকারটা শুকিয়ে যাওয়া গলা দিয়ে বেরোলো না। সব ঝাপসা
হয়ে গেল।
যমুনার এই বাড়িটায় প্রায়
চল্লিশ বছর হয়ে গেল।, দাদাবাবুর বিয়ে, বৌদির
হাসিমুখ, ঈশার জন্ম, বেড়ে
ওঠা- এই সব নিয়েই যমুনার জগৎ, কাল রাতের
খাবারটা চমৎকার ছিল।
ঈশা বড় ভালো মেয়ে।
কিন্তু আজ তো ঈশার অফিস, ডাকতে হবে
মেয়েটাকে, গরমজল মধু আর লেবুর রস মিশিয়ে ঈশার
ঘরের দিকে চললো যমুনা।
মেয়েটা বড়ো সুন্দর।
শ্যামলা, ঝকঝকে চামড়া, সিল্কের
মতো চকচকে কালো চুল, টানা টানা চোখ, নাক, হাসিভরা মুখ। আর মনটা তো
সোনা দিয়ে তৈরী।
যমুনাকে গতকাল ফিরে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছে ঈশা। বন্ধ দরজা ঠেলে ঢুকেই চীৎকার করে
উঠলো যমুনা—ঈশা মেঝেতে পড়ে। চারিদিকে ছড়িয়ে নানারকম উপহার। ঈশার শ্যামলা মুখখানা শক্ত আর নীল ...চোখদুটো
আতঙ্কে বিস্ফারিত।
যমুনার বাড়ি কাঁপানো চীৎকারে যখন ছুটে এল দারোয়ান ব্রিজেশ আর কিশোরীলাল তখন ঘড়িতে
সাড়ে নটা বাজছে।
পুলিশের জীপ থেকে নামলো ও.সি.
সায়ক মজুমদার, বিশাল গেটওয়ালা মস্ত বাড়ি। বনেদী
বড়োলোক ছিলেন মহিলা।
বিজ্ঞাপনের দৌলতে ঈশা মিত্রকে চেনা, মানে
মুখচেনা আর কি। এত
কম বয়সে মৃত্যুতে মন খারাপ হলেও, এই চাকরিতে
অমন মনখারাপ দুঃখবিলাস মাত্র। বাড়িতে ঢুকে দারোয়ানকে প্রশ্ন করে সোজা ভিতরের ঘরে চললো
সায়ক।
মৃত্যুনীল মুখখানা দেখে একটু থমকে গেলো লৌহকঠিন হৃদয়ের অফিসার। খুব
খুঁটিয়ে মৃতদেহ দেখে নিয়ে বিষাক্ত কিছু কামড়েছে বলে তো মনে হলো না। তবে কি
বিষপ্রয়োগ? মুখটা অমন নীল কেন? ঘরের সবদিকে ছড়িয়ে পড়লো পুলিশ কর্মচারীরা। এত উপহারের
প্যাকেট দেখে জড়ভরত হয়ে বসে থাকা যমুনাকে প্রশ্ন করা শুরু করলো সায়ক। যমুনা
এলোমেলো ভাবে কথা শুরু করলেও ধীরে ধীরে ঠিকঠাক জবাব দিতে লাগলো।
ইতিমধ্যে মৃতদেহ পোষ্টমর্টেমে
নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হলো। একটা অটো এসে দাঁড়ালো বাড়ির সামনে। একজন রীতিমতো বিধ্বস্ত, ব্যক্তিত্বময়ী মহিলা এসে দাঁড়ালেন দরজায়। দারোয়ানকে
দেখেই মনে হলো মহিলা খুবই পরিচিত। একটু পরেই ঘরে ঢুকে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়লেন মহিলা, কান্নার মধ্যে একটা কথা পরিষ্কার কেন তিনি কাল রাতে ঈশার
সঙ্গে এলেন না! যমুনার থেকে সায়ক পরিচয় জেনে নিলো নবাগতার, শ্রীজা
সেন, ঈশার ছোটোবেলার বান্ধবী। ব্যবসার
অন্যতম সহায়ক।
শুরু হয়ে গেল পুরোদমে তদন্ত।
পোস্টমর্টেমের রিপোর্টে জানা গেল অসম্ভব আতঙ্কে হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে মৃত্যু। দফায় দফায়
বাড়ির কর্মচারী এবং অফিসের লোকজনকে জেরায় জেরবার করতে করতে লাগল গোয়েন্দা পুলিশের
দল।
দেখা গেল খুব চমৎকার ব্যক্তিত্বের এই উঠতি ডিজাইনারের কোন শত্রুই ছিল না। তবে ওনার
মৃত্যুতে কি কেউ লাভবান হবে? চলতে লাগল
অনুসন্ধান।
অফিসে বসে সায়ক ওর তীরের মতো তীক্ষ্ণ, ধারালো
দৃষ্টিতে পড়ছিল ঈশা মিত্র হত্যারহস্যের জবানবন্দীর ফাইল। মোটামুটি বাড়িতে থাকা যমুনা, ড্রাইভার, দারোয়ান, অফিসের কর্মীদের, বুটিকের
কর্মচারীদের আর জন্মদিনের পার্টির অতিথিদের জবানবন্দী নেওয়া হয়ে গেছে। এটা
পরিষ্কার যে, ঈশা সেদিন একদম একাই শুয়েছিল ওর ঘরে। ওর হার্টসহ
অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে
কোনো অসুস্থতা ছিল না। চমৎকার
প্রাণচঞ্চল একটি মেয়ে, যে কিনা এই বাজারে বেশ কিছু মানুষের
ভদ্র উপায়ে বাঁচার বন্দোবস্ত করেছিল, তাকেই চলে
যেতে হলো পৃথিবী ছেড়ে।
ঈশার ডায়রি লেখার অভ্যাস ছিল না, সেটা ওর
বিশেষ ঘনিষ্ঠ মহলে এবং যমুনার কাছে জানা গেছে। কেমন জেদ চেপে যাচ্ছিল সায়কের। সমাধান
করতেই হবে, এই অদ্ভুত মৃত্যুরহস্যের।
পোস্টমর্টেমে বলা হয়েছে অতর্কিতে হৃদস্পন্দন থেমে গিয়ে মৃত্যু। কিন্তু
মৃত্যুনীল মুখের বিস্ফারিত দৃষ্টি কি অন্য কোনো ইঙ্গিত বহন করছে?
ঝনঝন করে ফোনটা বেজে উঠতেই
ভাবজগৎ থেকে বাস্তবে নেমে এল সায়ক। তড়াক করে সোজা হয়ে বসে ফোনটা তুললো। আরে যমুনা ফোন করেছে, গলাটা উত্তেজনায় কাঁপছে—“পুলিশ বাবু, আপনি এখুনি আসেন না একবার। ঈশা মামনির ঘরের বাইরে থেকে একটা
জিনিস পেলাম।
আপনারে অন্য একটা কথাও জানানোর ছিল”। ছ’ফুট লম্বা রীতিমতো ব্যায়াম করা শরীরটা একদম টানটান হয়ে
উঠলো সায়কের।
তবে কি হারানো কোনো সূত্রে এবার আসতে চলেছে, দুজন
কনস্টেবল নিয়ে জীপে উঠে বসলো সায়ক।
আজ দারোয়ান ওদের দেখেই দরজা
খুলে দিলো।
সায়করা তিনজন বাড়িতে ঢুকতেই ছুটে এল যমুনা, বেশ
উত্তেজিত।
সেটা লক্ষ্য করেই সায়ক কনস্টেবলদের ড্রয়িং রুমে অপেক্ষা করতে বললো। নিজে
যমুনার সঙ্গে চললো ঈশার বেডরুমের দিকে। ঘরে ঢুকতেই যমুনা বললো, “আজ
সকালে বাগান পরিষ্কার করার সময় দেখি ঈশা মামনির ঘরের জানলার বাইরে এটা পড়েছিল। মাসে একবার
বাগান পরিষ্কার হয় তো, সেই কাজ করতে গিয়েই দেখতে পেলাম। আর বাড়িতে
এমন...”। সায়ক
যমুনাকে থামিয়ে দিয়েই জিনিসটার দিকে মনোনিবেশ করলো। দেখলো একটা সাপ, অবশ্যই জ্যান্ত নয়, চমৎকার
স্টাফড করা, দেখেই মনে হয় খুব ভালো হাতের কাজ। গা শিরশির
করে ওঠে হঠাৎ দেখলে।
উত্তেজনা দমন করে সায়ক জানতে চাইলো, “আর কিছু পাও
নি?” “হ্যাঁ, একটা
ছেঁড়া বাক্সও ছিলো তো, সেটা ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিলাম”। সায়ক উঠে
দাঁড়িয়ে বললো ময়লার ঝুড়িটা একবার দেখতে হবে, চলো”। বেশী
খুঁজতে হলো না, কনস্টেবলদের হাতে সহজেই উঠে এল একটা
বাক্স যার গায়ে এখনও র্যাপিং পেপার লেগে আছে।
জিনিসটা উদ্ধারের পর সায়ক
আবার যমুনার দিকে মনোনিবেশ করলো। “কি যেন বলবে বলেছিলে”? “এ
বাড়িতে এমন পুতুল আসবে কোথা থেকে”? “উপহার
দিয়েছে নিশ্চয়ই কেউ।
কিনতেও পারেন”।
“কিন্তু এমন অলক্ষুণে জিনিস ঈশা মা কিনবে কেন? সে
তো সাপে খুব ভয় পেতো।
প্রায়ই রাতে সাপের স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যেত ওর। আর উপহার কেন এমন হবে? এত কিছু থাকতে কিনা সাপের পুতুল!!”
মাথার মধ্যে চিন্তার জাল বুনে
চলেছে সায়ক। সে
প্রশ্ন করতে লাগল, “ঈশার পরিচিতদের মধ্যে কে কে জানে এই
ভয়ের কথা?”
“শ্রীজা
মা জানে, ছোট্টবেলার বন্ধু তো, আর...আর রীতেশ বাবাও জানতে পারে হয় তো। আর কেউ জানে না বলেই মনে হয় বাবু”।
“থ্যাঙ্ক
ইউ যমুনাদি, হয়তো তোমার এই কথার জালেই সমাধান হবে
ঈশার মৃত্যু রহস্যের”।
সায়ক আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে। এখন অনেক কাজ ওর। যমুনাকে
বারণ করে দেয় এ কথাটা আর কাউকে জানাতে।
শ্রীজা আর রীতেশের সঙ্গে কথা
বলে সায়কের কাজ আরও কিছুটা এগোলো। কাউকেই সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা যায় না, তবুও তাদের থেকে পাওয়া সূত্রগুলোকে কাজে লাগিয়েই খুলতে হয়
সমস্যার জট, পৌঁছোতে হয় সমাধানে। আজ বাড়ি
ফিরেই ইউনিফর্ম ছেড়ে সাধারণ পোশাকে নিজের গাড়িতে করে আবার বেড়িয়ে সায়ক। ঈশার
বাড়িতে পাওয়া গিফট বক্সের র্যাপিং পেপারে থাকা একটা স্টিকার ওর চোখ এড়ায় নি, যাতে উপহারের দোকানের একটা লোগো ছিল।
একটা বহু পরিচিত বাজারে এসে
নামলো ও।
পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে দোকানের নাম আর শপ নম্বর দেখে এগোতে লাগলো সায়ক। একটু সময়
লাগলেও পেয়ে গেল দোকানটা।
ঢুকে জিনিসপত্র দেখতেই ছুটে এলেন সেলসম্যান। কয়েকটা জিনিস দেখার পরই জিজ্ঞাসা করল স্টাফড সাপের কোনো
মডেল পাওয়া যাবে কি না।
নেতিবাচক উত্তর পেয়েই আসল জায়গায় চলে এল সায়ক। নিজের পরিচয়পত্র দেখিয়ে প্রশ্ন করে
জেনে নিল এই জিনিস এক সপ্তাহের ভিতরে কেউ কিনে নিয়ে গিয়েছে কিনা। দোকানের
খাতায় নাম ঠিকানা লেখা থাকে। কিন্তু খাতা দেখে নামটা আদৌ পরিচিত লাগল না। জেসমিন...
এই নামে তো কেউ এই কেসের সঙ্গে যুক্ত নয়। বাড়ির ঠিকানাটা মাথার মধ্যে নোট করে নিলো সায়ক। কিন্তু
খোঁজ নিতে গিয়ে ঐ ঠিকানার কোনো বাড়ি খুঁজেই পেলো না। তবে... হ্যাঁ একটা উপায় আছে। শ্রীজা ও
রীতেশকে ফোন করে জেনে নিলো এই নামের কোনো অতিথি সেদিন পার্টিতে উপস্থিত ছিলো কিনা। দুজনেরই
উত্তর নেতিবাচক হওয়ায় পার্টিতে তোলা সব ছবি পাঠাতে বললো ওদের। যমুনাদিও জানালো যে এই নামের কেউ
ঈশা মামনির বন্ধু ছিল না।
ছবি পেয়েই আবার দোকানে ঢুকলো সায়ক। মোবাইলের ছবিগুলো দেখাতেই সেলসম্যান বিশেষ ক্রেতার মুখটিকে
চিনে ফেললেন।
রহস্য এবার এগোচ্ছে সমাধানের দিকে। বাড়ি ফিরেই বেশ কয়েকটা ফোন করলো সায়ক। আজ অনেকটা হালকা লাগছে ওর।
ঈশার বাড়ির ড্রয়িং রুমে আজ
প্রচুর জনসমাগম।
নাঃ! শ্রাদ্ধানুষ্ঠান নয়, পুলিশের
ডাকে সবাই উপস্থিত হয়েছে এখানে- বুটিক আর অফিসের কর্মচারীরা, বন্ধু বান্ধব, জন্মদিনের
পার্টিতে নিমন্ত্রিত সবাই আর এ বাড়ির তিনজন তো আছেই।
সায়ক বক্তব্য রাখা আরম্ভ
করলো- “সবাই জানেন ঈশা নিতান্ত অকালে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। তদন্তে এটা ধরা পড়েছে এটা মৃত্যু নয়, সুপরিকল্পিত হত্যাকান্ড”। সবাই টান টান হয়ে বসে। যমুনা
কেঁদে চলেছে।
বিষণ্ণ মুখ শ্রীজার, কিন্তু চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠলো
রাগে।
সায়ক বলে চলে, “ঈশা খুব ভালো মনের মানুষ, ওনার কোন শত্রুর সন্ধান পাই নি, কিন্তু
তাও ওনাকে চলে যেতে হলো।
ঘটনার দিন ঈশা একজন নতুন মডেলকে বেছে নিয়েছিলেন কেবলমাত্র পাশ্চাত্য পোশাকের মডেল
হিসেবে।
নিজের কাজের জগতে ওনার কারোর সঙ্গে অসদ্ভাব ছিল না, কিন্তু
এই ঘটনায় হয়তো একজন আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে। খুশবু! হ্যাঁ আপনাকেই বলছি। আপনি এখন
একজন প্রতিষ্ঠিত মডেল।
ঈশার সব পোশাকের বিজ্ঞাপন আপনাকে কেন্দ্র করেই। তাও এত অনিশ্চয়তার শিকার কেন আপনি? এই কাজ কেন করলেন?”
খুশবুর সুন্দর মুখ থেকে সব
রক্ত নেমে গেছে।
একদৃষ্টে চেয়ে আছে সায়কের দিকে। কোনো মতে শুকনো গলাটা ঝেড়ে বলতে শুরু করলো, “কি ভাবে বুঝলেন জানি না, তাও
যখন ধরেই ফেলেছেন বলছি।
আমি জন্মেছি রামবাগানের নিষিদ্ধ পল্লীতে। অনেক কষ্টে আদিম পেশার হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে
একটা এন.জি.ও-র সাহায্যে পড়াশোনা করেছিলাম। তারপর মডেলিং-এর জগতে এলাম। আমার সঙ্গে
ঈশা ম্যাডামের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল রীতেশ। রীতেশ ভাবেও নি আমি ওর সঙ্গে জীবন শুরু করার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু পরে
বুঝলাম রীতেশের আগ্রহ ঈশা ম্যাডামের প্রতি। আসলে ওনাকে ভালো না বেসে পারাই যেতো না। কিন্তু
আমিই বা কোথায় যাবো? মা এখন অসুস্থ, ওনার চিকিৎসার জন্য টাকাপয়সার দরকার। নতুন মডেল এলে ম্যাডাম আর আমাকে
রাখবেন না।
মাথার উপর থেকে ছাদটা সরে যাবে। আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। শেষে একদিন ম্যাডামের বাড়িতে চলে
এলাম।
ম্যাডামকে বললাম আমিও ওয়েস্টার্ন ড্রেসের মডেল হতে পারি। উনি রেগে গেলেন। আমাকে লোভী
বললেন।
তারপর চলে যেতে বললেন।
আমাকে নাকি বেমানান লাগবে ওয়েস্টার্ন পোশাকের মডেল হিসেবে। মাথাটা গরম হয়ে গেল আমারও। ওনারা সব
পাবেন, আর আমরা সব সব হারাবো কেন? উঠে আসছিলাম, হঠাৎ দেখলাম
উনি যমুনাকে বলছেন, “শিগগির টিভিটা বন্ধ
করো।
কিসব দেখছো? জানো না আমার সাপ দেখলেই ভয় করে। শরীর খারাপ
লাগে।
তাও কেন দেখো এসব”।
একটু থামলো খুশবু।
যমুনাকে ইশারা করে জল দিতে বললো সায়ক। গলা ভিজিয়ে নিয়ে খুশবু বললো, “স্যার!
আমি তাকিয়ে দেখলাম ম্যাডামের অমন সুন্দর মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, এসি চলা সত্ত্বেও কপালের উপর জমছে ঘামের বিন্দু। চোখ দুটো
যেন ভয়ে ঠেলে বেড়িয়ে আসছে। আমি জানি না আপনি আমার সম্পর্কে কতটুকু কি জানেন। আমি
সাইকোলজি নিয়ে পড়শোনা করেছি। নিষিদ্ধ পল্লীতে জন্মেছি সে আমার দুর্ভাগ্য। কিন্তু
বেরিয়ে আসার চেষ্টা আমার ছিল। মডেল হওয়ার ইচ্ছাটা ছিল, চেহারাটাও। অনেক টাকা
দরকার ছিল ছিল আমার অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার জন্য। কাজেই পড়াশোনা আর করিনি
গ্র্যাজুয়েশনের পর।
কিন্তু আমার রেজাল্ট দেখলে বুঝবেন আমি ছাত্রী ভালোই ছিলাম। ওনার ফোবিয়ার ব্যাপারটা টের
পেয়েছিলাম সেদিনই।
তারপর রাগটা পড়েও এসেছিল, আমি অসভ্যতা
করা সত্ত্বেও আমার চাকরিটা তখনও খান নি, ম্যাডাম। কিন্তু
ওনার জন্মদিনের দিন নতুন মডেল সিলেকশন হয়ে গেছে জেনে আবার আমার মাথায় আগুন জ্বলে
উঠলো।
তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে বেরিয়ে মার্কেট খুঁজে কিনলাম আমার ইপ্সিত উপহারটি। তবে আমি
খুব অন্যায় করেছি কিন্তু এতটা বাড়াবাড়ি হবে সেটা বুঝতে পারি নি, বিশ্বাস করুন। নিজের কথা ভাবতে গিয়ে আরো অনেককে কর্মহীন করে দিয়েছি। ঈশা
ম্যাডামের মতো ভালো মানুষকে মেরে ফেলেছি। আমায় শাস্তি দিন। কিন্তু আমার মায়ের কি হবে স্যার”?
নিস্তব্ধতা ভেঙে কথা বললো
শ্রীজা, “বড়ো ক্ষতি করলে তুমি নিজেও জানো না
খুশবু। আর
তোমার চাকরি যেতো না।
তোমাকে রাখার কথা আলোচনা হয়েছিল মিটিং-এ। ঈশা তোমাকে খুব ভালোবাসতো। তোমার ক্ষতি ও চায় নি। সব ভারতীয়
পোশাকের মডেল হিসেবে তুমিই থাকতে। মাঝখান থেকে প্রতিষ্ঠানটাও বন্ধ হয়ে গেল। ঈশা নিজেও
খুব দুঃখী মানুষ ছিল। কত
ভয় আর যন্ত্রণায় পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল ও। তবে তোমার অসহায় মায়ের দেখাশোনার দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। ওনার তো
কোনো দোষ নেই”।
এতক্ষণ সায়ক খুব আত্মবিস্মৃত, মুগ্ধ চোখে শ্রীজাকেই দেখছিল। চমক ভেঙে বলে উঠলো, “আপনি কি দেখবেন ব্যবসাটা চালানো যায় কি না। উনি তো
কোনো উইল করে যান নি।
তবে উনি চাইতেন মানুষের কর্মসংস্থান হোক। আপনি দায়িত্ব নিলে হয়তো অনেকেই বেঁচে যাবে”।
সমবেত হৈ চৈ এর মধ্যে শ্রীজা
রাজী হলো।
পুলিশের গাড়িতে ওঠার আগে খুশবু শ্রীজার হাত দুটো জড়িয়ে ধরলো ছলছলে চোখে। জীপ ছাড়লো। সায়ক ভাবছে, নাঃ! এবার শ্রীজার সঙ্গে দরকারী কথাটা সেরে ফেললেই হয়।
| ALEEK PATA- Your Expressive World | Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Bengali New Year 2024 | April-24 | Seventh Year First Issue |
| © All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |
| Published By : Aleek Publishers- www.aleekpublishers.com |
| a DISHA-The Dreamer Initiative |
No comments:
Post a Comment
Please put your comment here about this post