গল্প
তন্বী চ্যাটার্জী
সেবার কলেজের সোশ্যালে মঞ্চ
সাজানোর দায়িত্ব এসে পড়ল রণজয়ের উপর। ও সবকিছুর তদারকি করছে তখন, হঠাৎ
তিমির দৌড়ে এল সন্দীপনের কাছে। সন্দীপন ওদের নাটকের পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে।
রণজয় শুনতে পেল খুব উত্তেজিত
হয়ে তিমির সন্দীপনকে বলছে, "মেকআপ
আর্টিস্ট আসবে না বলেছে। ঐ
অল্প টাকায় ওঁর নাকি পোষাবে না। এবার তুই বল ভাই কি হবে"।
সন্দীপন প্রায় মাথায় হাত
দিয়ে বসে পড়ল।
"শাজাহান" নাটকটা মঞ্চস্থ করবে বলে কতদিন থেকে সবাই মিলে পরিশ্রম করছে
আর আজকে মেকআপ আর্টিস্টের জন্য সব বানচাল হয়ে যাবে?
রণজয় এগিয়ে এল, "কি সমস্যা হয়েছে আমাকে একটু বলবি তোরা?"
ওকে দেখে সন্দীপন যেন একটু
ভরসা পেল।
"শোন্
না, তুই তো ভালো সাজাতে পারিস। দেখ না যদি
কোনোরকমে নাটকটা উতরে দিতে পারিস। একটু সামান্য মেকআপ করে দিলেই হবে। পারবি তুই?"
"শাজাহান
নাটকে সামান্য মেকআপ? তাহলে নাটকের শেষে সবাই পচা ডিম
ছুঁড়বে," রণজয় বলল।
"তাহলে
কি হবে এবার? সময়ও তো বেশি নেই একদম", সন্দীপনের উদ্বেগ ভরা প্রশ্নের উত্তরে রণজয় বলল, "আমার কাছে যে অল্প মেকআপের জিনিসপত্র আছে তাতে এই নাটকের
এতজনের মেকআপ করা সম্ভব নয়। তবে তোরা চিন্তা করিস না, আমার
চেনাজানা একজন আছে তার কাছে সব জিনিসপত্র ভাড়া পাওয়া যায়। বোধহয় আমাদের বাজেটের মধ্যে এসে
যাবে।
আমাকে এখন অল্প কিছু টাকাপয়সা দে, আমি বরং ঐ
ভদ্রলোকের কাছ থেকে সব নিয়ে আসি। তিমির, তুইও চল
আমার সঙ্গে।"
সন্দীপনের উপর মঞ্চ সাজানোর
বাকি দায়িত্বটা দিয়ে টাকাপয়সা নিয়ে তিমিরের সাথে দৌড়ে বেরিয়ে গেল রণজয়।
প্রোগ্রাম প্রায় শুরু হতে
চলেছে, গ্ৰীনরুমে সবাই অধৈর্য্য হয়ে পড়েছে। সন্দীপন
সবাইকে স্থির থাকতে বলছে ঠিকই, কিন্তু ও
নিজেই যে আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারছে না। রণজয়ের উপর দায়িত্ব দিয়ে ভুল করল না তো? শুধু একটাই সান্ত্বনা, নাটকটা
সবশেষে মঞ্চস্থ হবে।
প্রায় মিনিট পঁয়তাল্লিশ পর
হাঁফাতে হাঁফাতে রণজয় আর তিমির হাজির হলো বিশাল ঢাউস দুটো ব্যাগ নিয়ে। ততক্ষণে
উদ্বোধনী সঙ্গীত হয়ে অধ্যাপকদের বক্তৃতা চলছে।
একজন একজন করে সবাইকে যখন
সাজানো শেষ করলো রণজয় তখন নাটক শুরুর ঘোষণা করা হচ্ছে।
পরিচালনার সাথে সাথে
ঔরঙ্গজেবের চরিত্রে অভিনয়ও করছে সন্দীপন। আয়নায় নিজেকে দেখে চিনতে কষ্ট হচ্ছিল ওর, এতো সুন্দর মেকআপ করেছে রণজয়।
মঞ্চ কাঁপিয়ে অভিনয় করল
সকলেই, শুধু দিলদারের চরিত্রে অভিনয় করতে
গিয়ে তিমির এক জায়গায় একটু গুলিয়ে ফেলেছিল। তবে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা ম্যানেজও
করে নিয়েছে তিমির।
বন্ধুদের কাছে এই বিষয়টা নিয়ে অবশ্য হাসির খোরাক হয়েছিল তিমির অনেক দিন পর্যন্ত।
নাটকের শেষে গ্ৰীনরুমে এসে
সব্বাই একে একে জড়িয়ে ধরলো রণজয়কে। আজ ও না থাকলে নাটকটাই হয়তো মঞ্চস্থ করা যেত না। আনন্দ
হইহুল্লোড়ের মাঝেই প্রলয় রণজয়কে একপাশে ডেকে নিয়ে গেল।
"তোর
সঙ্গে একজন ভদ্রলোক দেখা করতে চাইছেন। অনেকক্ষণ থেকেই অপেক্ষা করছেন তোর জন্য"।
"সেকি
রে? কে বল তো? আমি
কি চিনি ভদ্রলোককে?" রণজয় বলল।
"তা
আমি কি করে জানব? আমি সব জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিলাম, আমাকে এসে জিজ্ঞেস করলেন এই নাটকের মেকআপ কে করেছে। আমি তোর
নাম করলাম, তখন থেকেই তোর সঙ্গে দেখা করবেন বলে
দাঁড়িয়ে আছেন।
তুই আগে যা, দেখ কি আবার হলো"।
রীতিমতো হন্তদন্ত হয়ে রণজয়
ছুটে এল গ্ৰীনরুমের বাইরে। সেখানে এসে যাঁকে দেখল আগে কখনো তাঁকে দেখা তো দূরের কথা, চেনাজানা পর্যন্ত নেই। মাঝবয়সী একজন ভদ্রলোক, সাদামাটা পোশাক পরনে, চেহারার
মধ্যে আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য কিছু নেই, একদম সাধারণ।
ওকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে
থাকতে দেখে ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন রণজয়ের দিকে।
"আপনি
আমাকে চিনবেন না।
আমিও এর আগে আপনাকে কখনো দেখিনি। এই কলেজে আমার ভাইঝিও পড়ে। ওর কথাতেই আজ আপনাদের কলেজের
প্রোগ্ৰাম দেখতে এসেছিলাম। তবে এখন মনে হচ্ছে ভাগ্যিস এসেছিলাম!"
"সব
বুঝতে পারছি, কিন্তু আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে
চাইছেন কেন?"
"আমি
একটা ছোটখাটো থিয়েটার গ্ৰুপের সাথে যুক্ত, নাট্যারম্ভ। টাকাপয়সা
সেরকম পাই না খুব একটা, কিন্তু আমরা
সবাই ওখানে কাজ করে খুব আনন্দ পাই"।
"কিন্তু
এই কথাগুলো আপনি আমাকে বলছেন কেন?"
"আপনি
তো এই কলেজের ছাত্র, আমার থেকে অনেক ছোট। আমি যদি
তোমাকে তুমি সম্বোধন করি তাহলে তোমার আপত্তি নেই তো?"
"না না, আপত্তি কিসের? আপনি বলুন
কি বলছিলেন?"
"হ্যাঁ, বলছিলাম তুমি যদি আমাদের থিয়েটার গ্ৰুপে যোগ দাও তাহলে কি
তোমার খুব অসুবিধে হবে?"
"আমি? আপনাদের থিয়েটার গ্ৰুপে? কিন্তু
আমি তো অভিনয় করতে পারি না"।
রণজয়ের কথা শুনে হো হো করে
হেসে উঠলেন ভদ্রলোক।
রণজয় তো অবাক, বুঝতেই পারল না এতে এত হাসির কি হলো।
"নাটক
কি শুধু অভিনয় দিয়ে চলে? মঞ্চসজ্জা, মিউজিক, পোশাক, আলো সর্বোপরি মেকআপ, এসবই
তো নাটকের অনুষঙ্গ। এই
যে আজকে তুমি মেকআপটা করে দিলে বলেই তো নাটকটা মঞ্চস্থ হতে পারল! নইলে এতোদিনের এত
পরিশ্রম সব জলে যেত। কি
ঠিক বলছি তো?"
"হ্যাঁ, তা ঠিক বলেছেন। কিন্তু আমি আপনাদের থিয়েটার গ্ৰুপে কি করব? মেকআপ?"
"সেজন্যই
তো তোমার কাছে আসা।
তুমি কি কারোর কাছে এসব শিখেছ?
"না
না, কার কাছে শিখব? তাছাড়া শেখার মতো অত টাকাই বা কোথা থেকে পাব? ছোটবেলা থেকে এইসব দিকে ঝোঁক ছিল, স্কুলে
প্রোগ্ৰামের সময়ে বন্ধুদের একটুআধটু সাজিয়ে টাজিয়ে দিতাম, এই পর্যন্ত"।
"তাহলে
তো তুমি জিনিয়াস হে!! না শিখেও এতো সুন্দর মেকআপ করা সহজ কথা নয়। আসলে
আমাদের মতো ছোট গ্ৰুপে ভালো মেকআপ ম্যান নিয়ে আসা মানে প্রচুর টাকার ব্যাপার। তবে তোমার
চিন্তা নেই, তোমাকে টাকা দেওয়া হবে। হয়তো অনেক
পারব না কিন্তু আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী আমরা তোমাকে টাকাপয়সা দেওয়ার চেষ্টা
করব। কি, রাজী?"
রণজয় বেশ খানিকক্ষণ হতবাক
হয়ে তাকিয়ে রইল।
স্বপ্নেও যা কোনোদিন কল্পনা করেনি বাস্তবে আজ সেটাই হতে চলেছে! একবার নিজেকে চিমটি
কেটে দেখবে ভাবল, কিন্তু সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে
বলে মনের ইচ্ছেটা মনেই চেপে রেখে দিল।
শুরু হলো রণজয়ের পেশাদারী
ভাবে থিয়েটার গ্ৰুপে মেকআপ করা। যেদিন শো থাকত সেদিন কলেজ কামাই
করতে হতো অথবা কলেজের পরে প্রায় দৌড়তে দৌড়তে যেতে হতো। অল্প কিছু রোজগার হতো সেখান থেকে, কিন্তু ওর স্বপ্নটা একটু একটু করে সেই সময় থেকেই দানা
বাঁধতে শুরু করেছিল।
বাড়িতে অবশ্য কেউ জানতেন না এই বিষয়ে, বাবা তো
ঘোরতর বিরোধী ছিলেন এসবের।
প্রথমে বন্ধুদেরও কাউকে সেরকম
কিছু বলেনি।
কিন্তু পরপর বেশ কয়েক দিন কলেজ কামাই হতে তিমির চেপে ধরল রণজয়কে।
সবটা শোনার পর বন্ধুরা
রণজয়কে শুধু মারতে বাকি রেখেছিল। আনন্দের চোটে সন্দীপন তিমিরকে বলল, "যা, কলেজ ক্যান্টিনে গিয়ে দেখে আয় আজকে স্পেশাল কি মেনু আছে? রণজয়ের এই সাকসেসটা সেলিব্রেট করতে আমি খাওয়াবো তোদের
সবাইকে"।
তুমুল হইহুল্লোড় করতে করতে
সকলে রণজয়কে নিয়ে চলল ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে।
"দাদাবাবু, তুমি এখানে বসে আছ? আর
আমি সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি তোমাকে।"
বিশাখার ছবিটা হাতে নিয়ে
অতীতে ডুব দিয়েছিলেন রনজয় চৌধুরী। হারাধনের ডাকে নড়েচড়ে বসলেন।
"হারাধন, কাল থেকে একটি মেয়ে আসবে আমার কাছে কাজ শিখতে। তুই ঘরটা
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখবি।"
হারাধন হতভম্ব হয়ে গেল, এতদিন পর তাহলে আবার সাজঘরটা ব্যবহার করা হবে? সেঁজুতি দিদিকে খবরটা দেওয়া দরকার শিগগিরই, খুব খুশি হবে দিদি।
অর্থনৈতিক কারণে
"নাট্যারম্ভ" থিয়েটার গ্ৰুপটি বছর দুয়েক বাদে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে
রণজয়কে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি কিন্তু। নতুন নতুন থিয়েটার গ্ৰুপ থেকে ডাক পেয়েছে মেকআপের জন্য, রোজগার সামান্য হলেও বেড়েছে। গ্ৰ্যাজুয়েশনটা কোনোমতে শেষ করে
পাকাপাকি ভাবে এই জগতে প্রবেশ করল রণজয়।
এরপর খুব ধীরে ধীরে থিয়েটার
গ্ৰুপের পাশাপাশি ছবির জগতে পা রাখল রণজয়, টেলিভিশনে
কাজ করার প্রস্তাবও এসেছিল। তবে টেলিভিশনের কাজের জন্য যে অতিরিক্ত পরিমাণে মেকআপ
ব্যবহার করতে হয় সেটা জেনেই রণজয় ঐ প্রস্তাবে রাজি হয়নি। কিন্তু
থিয়েটারের মেকআপ করা আর ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কুশীলবদের মেকআপ করা, দুটো যে সম্পূর্ণ আলাদা সেটা ছবিতে কাজ করতে গিয়েই টের পেল
রণজয়।
এই লড়াইটা খুব একটা সহজ ছিল
না।
প্রতি মুহূর্তে নিজের কাছে নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদ অনুভব করেছে। পায়ের
তলার জমি শক্ত হতে অনেকটাই সময় লেগে গেছে।
এরকম একটা লড়াইয়ের দিনেই
রণজয়ের আলাপ হয় বিশাখার সাথে। অভিনয়ের শখ পূরণ করতে থিয়েটার গ্ৰুপে আসে বিশাখা। দেখতে
মারাত্মক সুন্দর না হলেও আলগা একটা সৌন্দর্য্য ছিল ওর চেহারায়। অভিনয়টাও
চলনসই গোছের করত।
দুতিনটে নাটকে পার্শ্বচরিত্রে
অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিল বিশাখা। কিন্তু ঐ পর্যন্ত, অভিনয়ের
শখ মিটে গিয়েছিল অল্পদিনেই। রণজয় সেই সময়ে থিয়েটার গ্ৰুপ ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে ছবিতে
কাজ করার কথা ভাবছে।
ততদিনে ছবির জগতে রণজয়ের বেশ
নামডাক হয়েছে, বিশাখা আর ওর সম্পর্কটাও ভালোলাগা
থেকে ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে। রণজয়ের বাবা ধীমানবাবু এখনো ওর পেশা নিয়ে সন্তুষ্ট নন, মুখে অবশ্য তেমন কিছু বলেন না।
বিয়ের পরপরই কর্মক্ষেত্রে
ব্যস্ততা দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছিল রণজয়ের, সাথে
উপার্জনও।
সংসারে "মা লক্ষ্মী" আখ্যা পেল বিশাখা, কিন্তু
যার জন্য ওর এই সংসারে আসা তার দেখা পাওয়াই ভার হয়ে উঠল। কাজের জন্য বেশিরভাগ সময়ই আউটডোর
লোকেশনে কাটাতে হয় রণজয়কে।
বছর দুয়েক বাদে সেঁজুতি এল
বিশাখার কোল আলো করে।
রণজয় এবার জব্দ হল মেয়ের কাছে, একবার
বাড়িতে এলে আর কাছছাড়া করতে চায় না সেঁজুতি বাবাকে। সবসময় চোখে চোখে রাখে, একটু আড়াল হলেই কান্না জুড়ে দেয়।
সেঁজুতি তখন বেশ ছোট, হঠাৎ করে ধীমানবাবু ঘুমের মধ্যেই চলে গেলেন সবাইকে ছেড়ে। এতদিন
রণজয় জানত বাবা ওর পেশাটাকে কখনোই ভালো চোখে দেখেননি, কিন্তু
বাবার মৃত্যুর পর তাঁর আলমারি থেকে একটা ফাইল পেল যেখানে শুধু রণজয়ের ছবি, ওর কাজের প্রশংসা করা খবরের কাগজের কাটিং, নানা জায়গা থেকে যেসব সম্বর্ধনা পেয়েছিল সেই সবটুকু
সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন মানুষটা। রণজয়ের বুকের ভেতরে এতদিন ধরে বয়ে বেড়ানো পাথরটা নেমে
গেল।
রণজয়ের ব্যস্ততা এখন তুঙ্গে। ছবিতে
কাজের পাশাপাশি একটা প্রতিষ্ঠানে মেকআপ শেখানোর ক্লাস নেয় নিয়মিত। অনেক সময়
নিজের বাড়িতেও শেখাতে হয়, বাইরের দিকে
আলাদা একটা ঘর তৈরি করে নিয়েছে সেই উপলক্ষে। নিজের পেশায় এতো ব্যস্ত হয়ে
পড়েছিল রণজয় যে, কখন একটু একটু করে মারণরোগ বাসা
বেঁধেছিল বিশাখার শরীরে তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। যখন বুঝতে পারল তখন পরিস্থিতি হাতের
বাইরে চলে গেছে।
করুণা তখনো সুস্থ সবল মানুষ, চোখের সামনে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া বৌমার শরীরটা দেখে
দিনরাত ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেন আর কামনা করেন নিজের মৃত্যুর।
কিন্তু ঈশ্বর তাঁর সব
প্রার্থনা অগ্ৰাহ্য করলেন,সব
যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়ে বিশাখা পাড়ি দিল সেই দেশে, যেখানে
না আছে কোনো যন্ত্রণা না আছে কোনো দুঃখ। এই আকস্মিক ঘটনায় রণজয় একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। যে
ব্যস্ততার কারণে বিশাখাকে সময় দিতে পারেনি দিনের পর দিন, সেই
ব্যস্ততা থেকে নিজেকে বহু দূরে সরিয়ে নিল ধীরে ধীরে।
স্বামী আর বৌমাকে হঠাৎ করেই
হারিয়ে ফেলে কেমন যেন ছেলেমানুষ হয়ে গিয়েছিলেন করুণা। সেঁজুতি এই পরিস্থিতিতে যেন হঠাৎ
করে বড় হয়ে গেল, পড়াশুনার সাথে সাথে ঠাম্মার
যত্নআত্তির দায়িত্বও নিয়ে নিল ও। নিজেকে সামলানো আর অসুস্থ ঠাম্মার দায়িত্ব নিজের কাঁধে
তুলে নেওয়া, এই সময়টায় সেঁজুতির পাশে ছায়ার মতো থেকেছে
রাজীব।
একই কলেজে পড়েছে ওরা, রাজীব দুবছরের সিনিয়র ছিল। কলেজের শেষ বছরে সেঁজুতির প্রেমে
পড়ল রাজীব।
সুন্দরী, রাজহংসীর মতো গ্ৰীবা, মিষ্টি আদুরে গলায় কথা বলা সেঁজুতিকে ছাড়া রাজীব আর অন্য
কারোর দিকে তাকাতেই পারল না।
রাজীবকে খুব পছন্দ ছিল
ঠাম্মার, অত অসুস্থতার মধ্যেও বুঝতে পারতেন
ওদের দুজনের সম্পর্কটা মিষ্টি মধুর। তাই দুজনকে একসঙ্গে দেখে খালি মুচকি মুচকি হাসতেন।
সেঁজুতির বিয়ের পর বাড়িটা
খাঁ খাঁ করে, করুণা একভাবে ঝিম মেরে বসে থাকেন। বলতে গেলে
হারাধনের ভরসায় সংসার চলে এখন, রণজয় কাজের
ফাঁকে মায়ের কাছে এসে বসেন। কিন্তু করুণা আজকাল ছেলেকেও চিনতে পারেন না।
শেষ চার-পাঁচদিন জ্ঞান ছিল না
করুণার, আগেই খাওয়া দাওয়া পুরো বন্ধ হয়ে
গিয়েছিল।
রণজয় এবার পুরো একা হয়ে গেলেন, হতাশা গ্ৰাস
করছিল ক্রমশ।
কাজের জগত থেকে অনেক দিন আগেই
মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন রণজয়, যাঁরাই তার
কাছে কাজের জন্য এসেছেন তাঁদের সকলকে ফিরিয়ে দিয়েছেন বারবার।
তাই মেয়েটি যখন এসে
নাছোড়বান্দার মতো তাঁর কাছে কাজ শিখতে চাইল তখন ওকে প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের
করতে বাকি রেখেছিলেন।
কিন্তু মেয়েটির নামটা শোনার পর থেকেই নিজের মনের ভেতর একটা তোলপাড় শুরু হয়ে
গিয়েছিল। আর
সময় নেননি ভাবার, রাজি হয়ে গিয়েছিলেন মেয়েটিকে কাজ
শেখাতে।
সপ্তাহে দুদিন ক্লাসের জন্য
বরাদ্দ হলেও রণজয় চার-পাঁচদিন ক্লাস করান মেয়েটিকে। প্রায় সারাদিন রণজয়ের কেটে যায়
সাজঘরে, যত্ন নিয়ে প্রতিটি সরঞ্জামের
ব্যবহার শেখান মেয়েটিকে।
খুব তাড়াতাড়ি সবটুকু রপ্ত করে ফেলেছে মেয়েটি। অবাক হয় মেয়েটি, আবার ভালোও লাগে, এত বড়
মাপের একজন মানুষ তাঁর সবটুকু উজাড় করে দেন ওকে শেখাতে গিয়ে।
"তুমি
কি জানো, আমি আবার নিজের কাজের প্রতি টান
অনুভব করছি? ঐ একরত্তি মেয়েটা ওর অজান্তেই আমাকে
টেনে নিয়ে এসেছে কাজের জায়গায়। আমি আবার কাজ করব, যারা
আমার কাছে কাজ শিখতে এসে ফিরে গেছে তাদের ডেকে নেবো আমি।" ঘরের বাইরে থেকে রণজয়ের
কথাগুলো শুনে থমকে দাঁড়ায় বিশাখা। অভদ্রতা হচ্ছে জেনেও ভালোভাবে কান পাতে দরজায়, খানিক পরেই যেটা শুনল তাতে চমকে উঠল ও।
"আর
কেউ না বুঝলেও তুমি তো বুঝেছ ঐ মেয়েটিকে কেন এত সময় নিয়ে কাজ শেখাই। আমাকে তুমি
ক্ষমা করতে পারবে না আমি জানি, কিন্তু আমি
বিশ্বাস করি বিশাখা চৌধুরী না থাকলে সেদিনের সেই রণজয় চৌধুরী কখনোই বিখ্যাত মেকআপ
আর্টিস্ট হতে পারত না।
তাই যখনই শুনলাম এই মেয়েটির নামও বিশাখা, তখনই
সিদ্ধান্ত নিলাম ওকে আমি কাজ শেখাবো। ওর মধ্যে দিয়েই যে আমি তোমাকে সাজিয়ে তুলি প্রতিটি
মুহূর্তে।"
ল্যামিনেট করা ছোট্ট সুন্দর ছবিটা হাতে নিয়ে নিজের মনেই হাসেন রণজয়, "বিশাখা কিছু জানে না, ও
আমাকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছে। কিন্তু আমি যে বড্ড স্বার্থপর, ওর
ভুল ধারণাটা এবার ভেঙ্গে দেওয়া দরকার। তবে একটা কথা আমি বুঝতে পেরেছি মেয়েটি খুব কাজের, হয়তো আমার অবর্তমানে ও-ই পারবে আমার কাজটাকে বাঁচিয়ে
রাখতে।"
খুব সাবধানে সাজঘরের দরজাটা
ঠেলে ঘরে ঢোকে বিশাখা, ওকে দেখে বেশ চমকে যান রণজয়। কিছু বলার
আগেই নিচু হয়ে রণজয়কে প্রণাম করে বিশাখা, প্রথমে
অবাক হলেও কিছুক্ষণ পর সস্নেহে ওর মাথায় হাত রাখেন রণজয়।
শুরু হয় রণজয় চৌধুরীর নতুন
করে পথ চলা, সঙ্গী হয় বিশাখা সেন, বিখ্যাত মেকআপ আর্টিস্ট রণজয় চৌধুরীর উত্তরসূরী হিসেবে।
| ALEEK PATA- Your Expressive World | Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Bengali New Year 2024 | April-24 | Seventh Year First Issue |
| © All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |
| Published By : Aleek Publishers- www.aleekpublishers.com |
| a DISHA-The Dreamer Initiative |
খুব সুন্দর লিখেছ একটা ব্যতিক্রমী বিষয়ের ওপর। ব্যাটন যোগ্য উত্তরসূরীর হাতে তুলে দেওয়াতেই তো শিল্পীর প্রকৃত আনন্দ। অনেক শুভেচ্ছা রইল।
ReplyDelete