দারিদ্র্যতা বিষাদ ছোঁয়নি
কৃষ্ণা সাহা
অনেকদিন পর শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত গ্রামে পা রাখতেই শোভা কাকিমার সাথে দেখা।
কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো ভালোই আছিরে।
আমি বললাম ভালোই যদি আছেন তবে দীর্ঘশ্বাসটা কিসের ?
বললেন নানা ও কিছু নয় রে। বয়সের ভারে এমনটা হয়ে থাকে।
কথাটা আমার ঠিক বোধগম্য হলোনা। মনে হলো কাকিমা কত বদলে গেছে। আগে শত
দারিদ্র্যতার মধ্যেও সদাসর্বদা হাসিখুশি একটা প্রাণোচ্ছল মানুষ ছিলেন। এখন তো সেই
দারিদ্র্যতা আর নেই। ছেলেরা সবাই যে যার মত সংসার পেতেছে। বাড়ি ঘর সুন্দর করেছে।
মেয়েদের ও বিয়ে হয়ে গেছে। তারাও নিজেদের সংসার নিয়ে বেশ ভালো আছে। এটাই তো
বরাবর চেয়েছিলেন কাকিমা। তবে দুঃখ কিসের ?
আমাকে
বলে তুই বুঝবি না। আমার মত শ্বাশুড়ি হলে বুঝবি।
তোর মেসোমশাই তো এখন নেই। আমি এখন ছেলেদের হেফাজতে। সবার মন যোগাতে যোগাতে
নিজের মনটাই এখন হারিয়ে ফেলেছি বুঝলি।
সত্যি পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল। আমি রোজ দুপুরবেলা কাকিমার রান্নাবান্না
দেখতে যেতাম সাথে অনেক গল্প শুনতে। কাকিমা সংসারের সমস্ত কাজ সেরে হেঁসেলে ঢুকতেন।
কাকিমার হেঁসেল বলতে বাইরে একটা চালার নিচে মাটির আখায় খড়ি দিয়ে রান্না।
ধোঁয়ায় চোখ লাল হয়ে যেতো। মোটা বোল্ডার চালের ভাত বসিয়ে বাকি সব অনায়াসে রেডি
করে নিত। কারন এই ভাত হতে অনেক সময় লাগতো চাল তো নয় পাথর আরকি। তবুও রেশনকার্ডে
জুটতো। নাহলে তো মাইলো খেয়ে দিন কাটাতে হতো। ছেলে যদি এদিক সেদিক থেকে মাছ ধরে
আনতো তবেই মাছ খাওয়া হত। না হলে শাক ভাত। নুন পেঁয়াজ কাঁচামরিচ ব্যাস। জলপীড়ি
করে সবাইকে যখন ধোঁয়া ওঠা ভাত
পরিবেশন করতো আমার নাকে সেই ধোঁয়ার গন্ধ এসে লাগতো।
আমি শুধু বসে বসে সবার তৃপ্তি করে খাওয়ার দৃশ্য দেখে যেতাম। আর অবাক হতাম
কারো মুখে একটিও রা নেই। দারিদ্র্যতাই যেন তাদের এত সহনশীল হতে শিখিয়েছে।
কাকিমা কখনো কখনো লজ্জিত হতো তবুও আমাকে খেতে বলার ভদ্রতাটুকু করতে ভুলে যেতেন
না। আমি কখনো খেতে রাজি হইনি ভাবতাম যদি ওদের কম পড়ে যায়। কিন্তু মনে মনে খুব
ইচ্ছে হতো ওদের তৃপ্তি করে খেতে দেখে।
কাকিমা যখন সদ্য স্নান সেরে খোলা ভেজা চুলে রাঁধতে বসতেন লম্বা চুল বেয়ে
ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তো। কপালে বড় করে সিঁদুরের টিপ। রক্তিম সিঁথিতে
সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা মনে হতো।
শত অভাবের মাঝেও কখনো মন খারাপ করে থাকতে দেখিনি। সবসময় হাসিখুশি। তাই তো
অভাব তাকে কখনো ছুঁতেই পারেনি।
কিন্তু এখন আর্থিক অভাব হয়তো মিটেছে। অনেকটাই এখন সচ্ছল তবুও হাসিটা কোথায়
যেন মিলিয়ে গেছে সংসারের মন যোগানোর বেড়াজালে। দিন গুনে চলে শুধু পর পারের
অপেক্ষায়।
| Aleekpatamagazine.blogspot.com |