আত্মবিশ্বাস
জ্যোতিকা পোদ্দার
|
Vector Courtesy: Internet |
আজ বুবুনের ক্লাস
টেস্টের রেজাল্ট বের হয়েছে। বুবুন অংকে পঞ্চাশে বারো পেয়েছে। অন্যান্য
সাবজেক্টগুলো তে ও বেশ খারাপ ফল করেছে। বুবুনের টেস্টের রেজাল্ট দেখে মিতালী
রণচণ্ডী মূর্তিতে ছেলেকে বকতে শুরু করলো। বলতে লাগলো "সপ্তম শ্রেণীতেই তোকে এতো টিউশন দিয়েছি যাতে, ভবিষ্যতে রেজাল্ট ভালো হয়। এখন থেকে তুই ও যাতে বুঝতে
পারিস যে,
ভবিষ্যতে খুব ভালো রেজাল্ট করতে হবে। তুই যাতে আপ-টু-ডেট
থাকিস সেই জন্য সবথেকে ভালো কোচিং ক্লাস গুলোতে তোকে আমি ভর্তি করে দিয়েছি। কতবার
তোকে বলেছি তোকে এক নম্বর হতেই হবে। আর তার জন্য যত টিউশন লাগে, যত টাকা লাগে, ততো দেবো। তোর বাবা আর আমি উদয়াস্ত পরিশ্রম করি , কার জন্য? শুধু তোর ভালোর জন্য। এই যে তোকে সাঁতার, ড্রয়িং, ক্যারাটে ,কম্পিউটার, ক্রিকেট
কোচিং সবকিছুতেই ভর্তি করে দিয়েছি; সে তো শুধুমাত্র তোর ভবিষ্যৎ যাতে ভালো হয় তার জন্য। তোকে
সবার মধ্যে বেস্ট দেখতে চাই আমরা। কিন্তু তোর তো কোনো উন্নতি ই হচ্ছে না, শুধু অবনতি হচ্ছে দেখছি"। একনাগাড়ে বলেই চলে মিতালী।
মায়ের কথা শুনে ভয়ে
থরথর করে কাঁপতে থাকলো বুবুন। বলতেই পারল না যে, তার এত টিউশনি, এত ক্রিকেট কোচিং, ক্যারাটে ক্লাস ভালো লাগে না।
সে চায় বিকালে একটু
বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে ফুটবল খেলতে, ওদের সঙ্গে একটু গল্প করতে। কিন্তু বিকালে তো কোনো সময়ই
নেই। স্কুল থেকে এসেই হয় কোনদিন ক্যারাটে ক্লাস, নয় কোনদিন ক্রিকেট কোচিং, অথবা কম্পিউটার ক্লাসে ছোটা। বাড়ি এসেই পড়তে বসা।
রাত্রিবেলা দাদু ঠাকুমার সাথে ঘুমাতে ভালো লাগে। ভালো লাগে ঠাকুমার মুখে
রূপকথার গল্প শুনত। দাদু ও তো কত সুন্দর
সুন্দর দেশবিদেশের গল্প বলেন। কত ধরনের অজানা কথা দাদুর কাছ থেকে জানা যায়।
কিন্তু মা মোটেও ঠাম্মা দাদুর সঙ্গে তাকে থাকতে দেয় না। শুধু বলে"
ওইসব পুরনো বস্তা পচা রূপকথার গল্প শুনে কোন লাভ হবে না।
তুই বরং অনলাইনে স্পোকেন ইংলিশ ক্লাস টা
শুরু কর।
এত নিয়মের মধ্যে থেকে
হাঁপিয়ে ওঠেছে বুবুন। ভীষণ ভীষণ চাপ। মনে হয় সে একদিন চাপেই মরে যাবে।
বাড়ির পরিবেশ খুব
থমথমে। বাবা অফিস থেকে ফিরলে আরেকপ্রস্থ বুবুনকে বকা শুরু হলো। রেজাল্ট দেখে বাবা
বললেন"
ছি! ছি !বুবুন! এত বাজে হয়ে গেছো তুমি পড়াশুনায়? আমার তো তোমার রেজাল্টে সাইন করতে ও ইচ্ছা করছে না । আমার
ছেলে হয়ে তোমার এই কি অবস্থা"!
তারপর বাবা মা মিলে
যুক্তি করল যে, বুবুনকে
অংকে উন্নতির জন্য অ্যাবাকাস এ ভর্তি করা হবে। আর অন্যান্য বিষয় গুলি এবং তার
সাথে অংকে যাতে আরো ও ভালো হয়, তার জন্য শহরের বিখ্যাত কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দেওয়া
হবে। এতে বুবুনের উন্নতি হবেই।
এমনিতেই বুবুনের সপ্তাহে
পাঁচ দিন অন্যান্য টিউশন গুলি থাকে, তার সঙ্গে আবার এই দুটো টিউশন যুক্ত হলে, তার অবস্থা খুব খারাপ হবে ,সে বুঝতে পারল। বুবুন কিছুতেই আর নতুন টিউশনে যেতে রাজি হলো না। মিতালী রেগে ছেলেকে
অবাধ্য বলে ,একটা
চড় মারতে
গেল। বুবুন ভয়েআতঙ্কে
কাঁদতে শুরু করল। ঠাম্মা এসে বুবুনকে কোলে
টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
দাদু এতক্ষণ একটা কথাও
বলেননি,
এইবার তিনি বুবুনের বাবা অর্থাৎ নিজের ছেলে সমরেশ কে বললেন "
তুমি ছোটবেলায় কটা কোচিং সেন্টারে পড়েছো? তোমার জন্য আমি কোন ক্রিকেট ,ক্যারাটে কোচিং এর ব্যবস্থা করেছিলাম? কিছুই তো করিনি। স্কুলে যেতে ,বাড়ি ফিরে এসে মাঠে খেলতে চলে যেতে। সন্ধ্যা বেলা হয়তো
আমার কাছে একটু পড়তে। বাদবাকি তো একাই করেছো। তবে ক্লাস নাইনে ওঠার পর তোমার জন্য
একজন শিক্ষক রেখে দিয়েছিলাম ।কিন্তু তাতেও তোমার খেলাধুলায় কোন ছেদ পড়েনি।
কোনদিনও চাইনি তুমি নাম্বার ওয়ান হও ।শুধু চেয়েছিলাম তুমি প্রকৃত মানুষ হও। যেন সব
সময় আত্মবিশ্বাসে ভরপুর থাকো। আমাদের বৌমা ও তো কোন কিছুতে কম নয়। সেও পড়াশোনা
শেষ করে চাকরি করছে ।কখনো তো শুনিনি বৌমাকে ও পড়াশুনার জন্য তার বাড়িতে
অত্যাধিক চাপ দিত। বরং গান ভালবাসত বলে ,তাকে গান গাওয়ার জন্য পড়াশোনার থেকে অনেক ছাড় দেওয়া
হয়েছিল। তাহলে তোমরা বুবুনকে এত চাপ দিচ্ছো কেন ? ওর শৈশবের আনন্দটাকে এইভাবে নষ্ট করছো কেন"?
মিতালী তড়বড় করে বলে
উঠলো "কিন্তু বাবা তখনকার সময় আর এখনকার সময়ের মধ্যে অনেক তফাৎ
এখন একটু খানি পড়াশুনায় ঢিলা দিলে একদম পিছিয়ে পড়তে হবে তাইতো বুবুনকে এত চাপ
দিয়ে পড়াশোনা করতে বলি"।
বুবুনের দাদু এবার বললেন "তোমাদের এই অত্যাধিক প্রত্যাশা এবং নাম্বার ওয়ান হওয়ার
চাপ দেওয়ার ফলে বুবুনের কি অবস্থা হয়েছে, দেখেছো! প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ের কবলে পড়ে বুবুনের
আত্মবিশ্বাস একদম তলানিতে এসে ঠেকেছে। আর যতক্ষণ নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরে না পাবে ,ততক্ষণ হাজার টিচার দিলেও উন্নতি সম্ভব হবে না। বকে বা
টিচার দিয়ে নয় আমাদের ওকে ভালোবেসে ,ওকে
সময় দিয়ে ওর হৃত আত্মবিশ্বাস ফেরাতে হবে।কিছু মনে করো না বৌমা, একগাদা টিচার তুমি দিয়েছো ঠিকই, কিন্তু তুমি বলো তো
তুমি নিজে কতটুকু সময়কে বুবুন কে দাও? কতটুকু সময় তুমি ওর সঙ্গে কাটাও। যেটুকু থাকো শুধু এটা
পড়,ওটা আরও ভালো করতে হবে বলো।
সমরেশ তুমিও কিন্তু
অফিসের কাজে এত ব্যস্ত থাকো যে , বুবুনের সঙ্গে কথা বলার পর্যন্ত সময় পাওনা। এইভাবে কি শুধু
টাকা পয়সা খরচা করে টিচার দিয়ে ছেলে মানুষ করা যায়? বুবুন তার নিজের সুবিধা অসুবিধার কথা তোমাদের জানাবে না তো
কাকে জানাবে?
আমি বলি কি অত টিচারের
দরকার নেই। যেটুকু না হলেই নয়,সে টুকু থাক আর বাদবাকিটা বাড়িতে আমরা ওকে দেখি ।ওকে সময় দিয়ে, ভালোবেসে ধীরে ধীরে আগে ওর আত্মবিশ্বাসকে ফিরিয়ে আনি। শৈশব
ই তো আত্মগঠন এর প্রকৃত সময়। বকাঝকা না করে আগে ওর অসুবিধা গুলি আমরা জানি, তারপর সেই মতো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।প্রথমেই হয়তো ভালো
রেজাল্ট হবে না ।তবু এখন তো ওর সপ্তম শ্রেণি... হাতে কিছুটা সময় আছে। দেখি না এই
বছরটা ...তারপর না হয় অষ্টম শ্রেণীতে দেখা যাবে..."!
মিতালি সমরেশ অনিচ্ছাসত্ত্বেও দাদুর কথায় রাজি হয়ে গেল কিন্তু
ষাম্মাসিক পরীক্ষা পর্যন্ত । ঠিক হলো এখনই নতুন টিচার নয়। দাদু এবং বাবা মার কাছেই
বুবুন অংক এবং অন্যান্য বিষয়গুলির পড়বে। কিন্তু দাদু একটাই শর্ত দিলেন যে ,বুবুনকে একদম বকা চলবে না। ওকে কোনোপ্রকার চাপ দেয়া যাবে
না। না বুঝতে পারলে একবারের জায়গায় বারবার বোঝাতে হবে ।কিন্তু নিজেদের রাগলে
চলবে না।
এরপর সমরেশ মিতালী এবং
বুবুনের দাদু তাদের নিজেদের মতো করে বুবুনের খেয়াল রাখতে লাগলেন। শুধু পড়াশোনা
নয়,
রীতিমতো খেলাধুলাও করতেন ।বাড়ির থমথমে পরিবেশ অনেক বদলে
গেল। হাসিখুশি বুবুনকে দেখে মিতালী -সমরেশের ও বেশ ভালো লাগলো। কিছুদিনের মধ্যেই মিতালী দেখল
বুবুনের মধ্যে আর সেই আতঙ্ক ,ভয় ,উদ্বেগটা নেই ।ছেলেটা বেশ হাসিখুশি পড়াশোনা করছে। তাদের
দেখলেও অত ভয় পাচ্ছে না। বরং না বুঝতে পারলে, এসে বুঝে যাচ্ছে। ছেলের পরিবর্তন দেখে মনে মনে খুশি হয়
মিতালী।
ষান্মাসিক পরীক্ষার
রেজাল্ট বেরিয়েছে। বুবুন অংকে একশোতে পঁয়ষট্টি পেয়েছে। অন্যান্য বিষয় গুলিতেও
বেশ ভালো নম্বর পেয়েছে। রেজাল্ট হাতে ছুটতে ছুটতে এসে মিতালি কে জড়িয়ে ধরে বললো "মা দেখো ! এবার আমার রেজাল্ট কিন্তু বেশ ভালো হয়েছে। তবে
তুমি দেখে নিও, বার্ষিক
পরীক্ষা তে আমি আরো ভালো রেজাল্ট করব। অংক তে একশো তে একশো পাব...ই"।
ছেলের চোখেমুখে
আত্মবিশ্বাসের ঝলক। ছেলের আত্মবিশ্বাসী মুখ দেখে মনে হয় ছেলে পারবে।
বুবুনের দাদু এগিয়ে এসে
নাতির মাথায় হাত দিয়ে বললেন আমি তো আগেই বলেছিলাম"আমরা পরিবারের লোকজন বুবুনের অসুবিধাটা যতটা বুঝবো, বাইরের লোক সেটা বুঝবে না। বুবুনকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলা
আমাদের দায়িত্ব। কারণ আত্মবিশ্বাস পূর্ণ শৈশব ই দেবে সফলতা পূর্ণ ভবিষ্যৎ"।।
| Aleekpatamagazine.blogspot.in |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
|ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |
| Winter Issue,2010 | January 2020 |
| Third Year Fourth Issue |21st Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |