অলীক পাতার অন্যান্য সংখ্যা- পড়তে হলে ক্লিক করুন Library ট্যাব টি



। । "অলীক পাতা শারদ সংখ্যা ১৪৩১ আসছে এই মহালয়াতে। । লেখা পাঠানোর শেষ তারিখ ১৫ ই আগস্ট রাত ১২ টা ।.."বিশদে জানতে ক্লিক করুন " Notice Board ট্যাব টিতে"

Showing posts with label অলৌকিক. Show all posts
Showing posts with label অলৌকিক. Show all posts

Thursday, April 15, 2021

অলৌকিক গল্প -বোষ্টমপাড়ার নিমাই ড্রাইভার - ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়

 

বোষ্টমপাড়ার নিমাই ড্রাইভার

ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়


রাত তখন প্রায় বারটা। নন্দুর দাদুর বুকটা কেমন কেমন করে উঠল। তারপরে হাঁচড়পাঁচড় খেতে লাগল। একটা টিয়াপাখি যেন খাঁচার মধ্যে ডানা ঝাপটে যাচ্ছে। তারপরে শুরু হল প্রচন্ড যন্ত্রণা।

দাদুর পাশে শোয় নন্দু। দাদুকে অস্থির হতে দেখে নন্দুর ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে উঠে গিয়ে তো মাকে আর বাবাকে ডেকে আনল। ওরা বুকে অনেক মালিশ টালিশ করতেও কিছু হল না। ব্যথা বেড়েই চলল। রাতে কোনও ডাক্তারকে পাওয়া মুশকিল। কী হবে এখন?

নন্দুর মা তো কেঁদেই ফেলল। আসলে বুড়ো শ্বশুরকে সে খুব ভালবাসত। শাশুড়ি নেই। নন্দুকে খুব ভালবাসে তার দাদু। নাতির সব কিছু দেখাশোনার ভার তার ওপর দিয়ে খুব নিশ্চিন্তে সংসারের কাজ করে যায় নন্দুর মা।

কিন্তু এখন বেশ ভাল রাত। এমন সময়ে গাড়িঘোড়া পাওয়া খুব মুশকিল। তাছাড়া বড় রাস্তা থেকে বেশ দূরে তাদের বাড়ি। কাছাকাছি একটি মাত্র অ্যাম্বুলেন্স আছে। ফোন করে জানা গেল সে অন্য কলে গেছে।

এখন কী হবে? মাথায় হাত সকলের। নন্দু বলল, ভোঁদাদাদাকে বল না বাবা।

ভোঁদার একটা সাইকেল ভ্যান আছে। কিন্তু সেই ভ্যান সে সূর্য ডোবামাত্র ঘরে তুলে দেয়। তার নাকি খুব ভূতে ভয়। নন্দুর বাবা তার বাড়িতেই কড়া নাড়তে লাগল। কিন্তু ভোঁদার কোনও সাড়াশব্দ নেই।

অগত্যা আবার কড়ানাড়া। কিন্তু কড়া তো দূরে থাক দরজাই ভেঙ্গে যাবার জোগাড় ভোঁদা দরজা খোলে না। ভেতর থেকে কোঁ কোঁ করে বলছে, ভূত আমার পুত শাকচুন্নী আমার ঝি—

 

বিরক্ত হয়ে নন্দুর বাবা বলল, এই ভীতুর ডিমটাকে দিয়ে কিস্যু হবে না।

 

শেষে নন্দুর মাও বেরিয়ে এসেছে। দরজায় ঠেলা দিতে দিতে বলছে, ও ভোঁদা, ভোঁদা বাপ আমার। তোর দাদুর যে বুকের ব্যথা উঠেছে বাপ। একবার চল না বাবা লক্ষ্মীটি। টাকা তোকে যা বেশি লাগে দোব। যা চাইবি তাই দোব। কেবল আজকের দিনটা উদ্ধার করে দে না বাপ আমার।

কিন্তু মায়েরও সব অনুনয় বিনয় সার। ভেতর থেকে ভোঁদা শুধু গোঙাতে গোঙাতে বলছে, ওরে বাপ এ যে নিশির ডাক। ভূত পেত্নী সব একসঙ্গে এসেছে। রাম রাম রাম রাম...

বাবা বলল, আ মল‍! রাত সবে বারটা। তাতেই নিশির ডাকের ভয়ে দরজায় কুলুপ এঁটেছে। না একে দিয়ে কিছু হবে না চল দেখি অন্য কী ব্যবস্থা করা যায়।

মা বলল, পচাকাকার গাড়িটা পাওয়া যায় কিনা একবার দেখলে হয় না?

কিন্তু দুর্ভাগ্য পচাকাকার গাড়ি এখন এক সপ্তা ধরে গ্যারেজে পচছে। কী একটা পার্টস নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। মেকানিক ছ্যাবলা বলেছে, কাকু এই ছত্রিশ বছর আগের গাড়ির পার্টস এখন আর পাওয়া যাবে না। এখন সব ডিজিটাল হয়ে গেছে না? দেশী একটা আছে সেটা দিয়ে যদি চালান তো দেখেন। তবে সেটা দিয়ে ছ’মাস কি ছ’দিন যাবে গ্যারান্টি দিতে পারব নি।  

পচাকাকা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে নি। তাই গাড়ি এখন ছ্যাবলার গ্যারেজে পচছে। তলে তলে সে নাকি এটা কিলো দরে বেচে দেবার ফন্দিতে আছে। পচাকাকা তো রেগে আছে খুব।

আর এত সাত কাহন শোনার সময় তো নেই নন্দুর বাবারও। নন্দুর দাদুকে যে করেই হোক খুব তাড়াতাড়ি পাঠাতেই হবে হাসপাতালে। পাগলের মত এদিক ওদিক পায়চারি করছে।

এমন সময় একটা গাড়ির শব্দ। গাড়িটা ঠিক তাদের বাড়ির সামানেই দাঁড়াল বলে মনে হল। এ সময় আবার তাদের বাড়িতে কে? নন্দুর বাবা বাইরে বেরিয়ে এল। গাড়িটা একটা অ্যাম্বুলেন্স। যাকে ফোন করা হয়েছিল সেই কোলকাতা থেকে ফিরে এল নাকি?  বাড়ির সকলের বুকে যেন বল এল। ড্রাইভারের আসনে বসে যে লোকটা তাকে দেখে কেউ চিনতে পারল না। চেনার সুযোগও নেই। কারণ আলো নেই সেখানে তেমন। তাতে আবার পেল্লায় বড় তোয়ালে নাকি কাপড় সে বেঁধে রেখেছে মুখে।

 

গম্ভীর কিন্তু খটখটে একটা স্বর ভেসে এল তার দিক থেকে, এ বাড়িতে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে কাকে?

 

নন্দুর বাবা বলল, এই যে আমার বাবাকে। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে সিরিয়াস কন্ডিশন।

 

-বেশ স্ট্রেচারে পেশেন্টকে তুলে আপনাদেরই বয়ে আনতে হবে কিন্তু। আর কোনও লোক নেই।

 

সবাই অবাক হয়ে দেখল অ্যাম্বুলেন্সে আর কোনও লোক নেই। কী আর করা যায় সকলে মিলে স্ট্রেচারে শুইয়ে দাদুকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হল। বাড়ির সবাই মোটামুটি উঠল। এমনকি নন্দুও ছাড়ল না। দাদুর এমন অবস্থায় সে কিছুতেই দাদুকে ছেড়ে থাকতে পারবে না।

 

নন্দুর বাবা বলল, এটা কার গাড়ি?

 

চালকের সীট থেকে গম্ভীর আওয়াজ এল, এটা অ্যাম্বুলেন্স। আপনারা ফোন করেছিলেন।

 

-কিন্তু ওরা যে বলল—

 

আর বেশি কিছু বলল না বাবা। যাক বাবা পাওয়া গেছে এই যথেষ্ট। কিন্তু গাড়িটা হুড়হুড় করে প্রচন্ড গতিতে এগোচ্ছে। এই মরেছে এ আবার কোথাও ধাক্কা না মারে। এমনিতেই রাস্তার যা দশা। তাতে মাঝরাত্তিরে হঠাৎ একটা কুকুরটুকুর এসে পড়লেই বিপদ।

 

নন্দুর মা ফিসফিস করে নন্দুর বাবাকে জিজ্ঞেস করল, এত জোরে চালাচ্ছে কেন?

 

নন্দুর বাবা প্রশ্নটা করল চালককে। সেই সঙ্গে বলল, দেখ বাবা, আবার যদি কিছু একটা হয় তো মহা বিপদ।

 

-কিছু হবে না। বললেন না খুব সিরিয়াস কন্ডিশন তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে?

 

ড্রাইভারের দিকে আলো না থাকলেও অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে মিটমিটে একটা আলো আছে। তাতে ড্রাইভারকে আবছা দেখা যাচ্ছে। নন্দুর বাবা দেখল লোকটার মুখ একটা কাপড় দিয়ে ঢাকা। এত গরমে কাপড়ে মুখ ঢাকা কেন? বেশ অবাক হলেও কিছু বলল না।

 

এরপর অ্যাম্বুলেন্সটা যেন উড়ে চলল। সবচেয়ে অবাক হল তারা তখন যখন দেখল হেলথ সেন্টারের পাশ দিয়ে গেলেও সেখানে থামল না। নন্দুর মায়ের প্রায় কেঁদে ফেলার দশা। বলল, হ্যাঁ গো থামল না যে। এখন কী হবে?

 

অবাক শুধু নয় বেশ রেগে গেছে নন্দুর বাবাও। একটু জোরে বলল, একি হেলথ সেন্টার তো পার হয়ে গেল। আমাদের পেশেন্ট রাস্তায় মারা যাক এই কি তুমি চাও?

 

সামনে দিকে তাকিয়েই ড্রাইভার বলল, এখানে এমন সিরিয়াস কেসের চিকিৎসা করা যাবে না। আপনাদের পেসেন্টের কিচ্ছুটি হবে না। চুপ করে বসুন তো।

 

-কিন্তু কোথায় নিয়ে যাচ্ছ সেটা বলবে তো নাকি? খুব অধৈর্য নন্দুর বাবা।

 

সবাই অবাক হয়ে দেখল লোকটা নন্দুর বাবার প্রশ্নের উত্তর দেবার আগেই অ্যাম্বুলেন্স সিটি হসপিটালের কম্পাউন্ডে ঢুকে গেছে। কিন্তু এই হাসপাতালে পৌঁছতে অন্তত মিনিট পঁচিশ তো লাগার কথা। দিনে হলে তো চল্লিশ মিনিটের কম নয়। মাত্র পনের মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেল এ কি জাদু নাকি?

 

ছেলেটা দারুন চালায় তো। একে একটা বকশিস দিতেই হবে।

 

সবাই বয়ে বয়ে পেশেন্টকে নিয়ে গেল। কাপড়ে মুখ ঢাকা দিয়ে ড্রাইভারও গেল সঙ্গে। রিসেপসন প্রাথমিক ভাবে জেনে বলল, দেখুন এ কেস এখানে হবে না। আপনাদের কোলকাতায় নিয়ে যেতে হবে।

 

সকলের তো মাথায় হাত। এখন কী হবে? এই রাত। বাড়ির লোকগুলো কী করবে?

 

এগিয়ে এল ড্রাইভার। জিজ্ঞেস করল, কেন? হবে না কেন?

 

তার গলাটা আগের মতই খরা খরা। নার্স বলল, এখন হার্টের ডাক্তার কেউ নেই। সব ছুটিতে। একজন ছিলেন কিন্তু এইমাত্র তিনি একটা অপারেশন সেরে বাড়িতে গেছেন। তাঁকে ডাকা মানা আছে। আপনারা অন্য জায়গায় যান। 

 

বেশ কিছুক্ষণ সবাই চুপ করে রইল। সেই খরা খরা গলায় ড্রাইভার বলল, ওনাকে ডেকে দিন। ডাঃ বিশ্বাস খুব ভাল ডাক্তার। তাঁকে কল করলেই তিনি আসেন।

 

-বললাম না তাঁকে ডাকা মানা আছে। নার্স খুব উঁচু গলায় বলল এবার।

 

এবার একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। মুখের ঢাকাটা খুলল ড্রাইভার। সবটা নয়। শুধু মুখের সামনেরটা। তার মানে শুধু নার্স দেখতে পাচ্ছে তার মুখটা।

 

নার্স ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, আ আ আচ্ছা আমি কল করছি।

 

কাঁপা হাতে সে মোবাইলের বাটন টিপতে লাগল। তারপর কানে চেপে ধরল। আবার ডায়াল করল আবার। পরপর তিনবার। তারপর ঘাড় নেড়ে ভয়ে ভয়ে বলল, সুইচ অফ।

 

ড্রাইভার পেছনে ফিরল না। তেমন খ্যারখেরে গলায় বলল, চিন্তা নেই। আমি ডাক্তারকে নিয়ে আসছি।

 

তারপর সবাই দেখল সে একেবারে ভ্যানিস। সবাই অবাক। নন্দুর বাবা ভাবল অ্যাম্বুলেন্স চালানোর মতই সব কাজ এমন ধাঁ করে করে নাকি লোকটা? সবাই রুদ্ধশ্বাস। নন্দুর মনে হল বেজায় ভয় পেয়েছে বেচারি নার্স। কিন্তু কেন এত ভয় কে জানে। এই সামান্য ড্রাইভারটা কি খুব প্রতাপ আর প্রভাবশালী নাকি? 

 

মিনিট পাঁচ কী দশ হবে। ড্রাইভারের পেছনে পেছনে শশব্যাস্তে ডাক্তার এসে ঢুকল। তারপর শুরু হয়ে গেল যেন যুদ্ধকালীন তৎপরতা। ঘন্টা দুয়েক পরে গলায় স্টেথো দুলিয়ে বাইরে এলেন ডাঃ বিশ্বাস। বললেন, এখন ঠিক আছে। আপনারা পেশেন্টকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন। ওষুধ দিলাম লিখে সিস্টার বুঝিয়ে দেবেন।

 

কথাটা বলে চাইলেন ড্রাইভারের দিকে। সে চলল বোধহয় ডাক্তারকে তার বাড়ি পৌঁছে দিতে। নার্স একেবারে ওষুধ-টষুধ সব বুঝিয়ে দিল। নন্দুর বাবা খুব নরম গলায় ধন্যবাদ দিতে গেল নার্সকে। নার্স যেন ভয়ে কেঁপে উঠে বলল, না না আমাকে নয় আমাকে নয়। দিতে হলে--

 

বলে সে তাকাল ড্রাইভারের দিকে। খুব ভয়ে ভয়ে তাও আড়চোখে।

 

ফেরার সময় নন্দুর বাবা বলল, শুনেছি খুব ভাল আর বিশ্বাসী ডাক্তার এই ডাঃ বিশ্বাস। নার্স নিশ্চয় চালাকি করে অন্য কার নম্বরে ডায়াল করেছিল হয়ত।

 

খ্যারখ্যারে গলায় ড্রাইভার বলল, চলুন আর ভয়ের কিছু নেই।

 

মা তো খুব খুশি। বলল, কে বাবা তুমি মাঝ রাত্তিরে এমন দেবতার মত উদয় হয়ে আমাদের উপকার করলে? তোমার ভাল হোক বাবা। দীর্ঘজীবী হও।

 

উত্তর এল না। বদলে এল একটা অদ্ভুত খটখটে আর খসখসে হাসি। সে হাসিতে কেমন ভয়ভয় করতে লাগল নন্দুর। এই ভয়ের যেন একটা কারণ আছে তার মনে হল। আসার সময় এক সময় লোকটার মুখ থেকে কাপড় খুলে গিয়েছিল। মুখটা দেখেছিল সে। অদ্ভুত ভয়ংকর একটা মুখ। ঠিক মনে করতে পারল না এমন ধরণের মুখ সে আর কোথায় দেখেছে।

 

মাত্র মিনিট দশেকের মধ্যেই যেন উড়ে উড়ে এসে বাড়ি পৌঁছে দিল লোকটা।

 

সবাই পেশেন্ট নামিয়ে চলে গেল। একদম পেছনে ছিল নন্দুর মা। লোকটা সেই বিদিকিচ্ছিরি গলায় বলল, আমার নাম নিমাই। ভয় নেই আবার যদি এমন দরকার পড়ে জানতে পারলে আমি ঠিক চলে আসব। কারোর কোনও বিপদ হবে না।

 

বলেই লোকটা স্টার্ট দিল গাড়িতে। আর চোখের পলক পড়ার আগেই চিহ্ন রইল না সে গাড়ির। নন্দুর মায়ের তো চক্ষু চড়ক গাছ। নন্দুরও যেন কেমন ভয় ভয় করছে। সেই মুখটা দেখার পর থেকেই। 

 

পরের দিন সন্ধ্যেবেলা দিব্বি সুস্থ হয়ে বসে চা খাচ্ছে দাদু। নন্দুর বাবা খুব খুশি হয়ে তার মাকে বলল, শুনেছি ডাঃ বিশ্বাস বিরাট বড় ডাক্তার। ভাবা যায় না নিমাই কী করে তাঁকে এনে চিকিৎসা করাল। তারপর ওই নার্সটা? প্রথমে তো তাড়িয়েই দিচ্ছিল। ভাগ্যি নিমাই ছিল।

 

একটু পরেই নন্দুর পাড়ার এক বয়স্ক ভদ্রলোক নিতাই জেঠু এসে হাজির। ইতিমধ্যে দাদুর শরীর খারাপ আর হাসপাতালে যাওয়া আবার সেখান থেকে ফিরে আসার কথা অনেকেই শুনেছে। 

 

-কিন্তু জেঠুকে এক রাত্রের মধ্যে সারিয়ে আবার বাড়ি পাঠিয়ে দিল এ তো বিশ্বাসই করা যায় না।

 

বললেন সেই ভদ্রলোক।

 

-আরে বাবা ডাঃ বিশ্বাসের মত বড় ডাক্তারের হাতে পড়েছিলেন বাবা তাই তো নিতাইদা। নাহলে কী হত ভাবতেও পারি না।

 

-হ্যাঁ ভাগ্যি নিমাই ছিল। অমন উপকারী ছেলে আর হয় না। নন্দুর মা উৎসাহের সঙ্গে গত রাতের সব কথা গল্প আকারে বলতে লাগল। আর চা খেতে খেতে শুনে গেলেন নিতাই জেঠু।

 

-কী নাম বললে? নিমাই? অ্যাম্বুলেন্স চালায়? জেঠুর প্রশ্ন।

 

-হ্যাঁ ঠিক তাই। নন্দুর বাবা খুব খুশি খুশি মেজাজে বলে ওঠে। 

 

-ভগবান ওকে দীর্ঘজীবী করুন। কী পরোপকারী ছেলে। মা বলতে থাকে।

 

-দাঁড়াও দাঁড়াও। হ্যাঁ নিমাই বড় পরোপকারী ছেলে। সে তো থাকে সেই কাপ্তেন পাড়ায়। এখান থেকে তিন চারটে পাড়ার পরে। রাত হোক বিরেত হোক ওকে একবার ফোন করলেই হবে। তোমার বাড়ির দরজায় ওর অ্যাম্বুলেন্স ঠিক পৌঁছে যাবে। আর হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার দেখান থেকে শুরু করে যত কিছু আছে সব সে করে দেবে। কাউকে কুটোটি নাড়তে দেবে না। বলে এমনিতেই রুগীর বাড়ির লোক রুগীর চিন্তায় আকুল হয়ে থাকে। সেই চিন্তার সময় নিজেরা কি করবে আর কি না করবে ভেবেই পায় না। তাই একটু সাহায্য করে দি। কিন্তু-

 

ঘরে যেন একটা বোমা ছুঁড়লেন জেঠু, কিন্তু সে তো মারা গেছে আজ থেকে দশদিন আগে। কাল সে আসবে কী করে?

 

সবাই যেন স্তব্ধ। নন্দুর বাবা বলল, তুমি নিশ্চয় অন্য কোনও নিমাইয়ের কথা বলছ নিতাইদা।

 

-আরে বাবা না না। অ্যাম্বুলেন্সের মালিক হয়ে সেটা চালায় সেই নিমাইয়ের কথাই বলছি আমি। লেখাপড়া বিশেষ জানত না। বাবা পি-এফ গ্র্যাচুইটির টাকা থেকে তাকে এটা কিনে দিয়ে বলেছিল দ্যাখ চাকরি তো জুটবে না। এখন এটা খাটিয়েও যদি কিছু রোজগার করতে পারিস। তা ছেলেটা যে বড় ভাল এটা তুমি ঠিক কথাই বলেছ বৌদি। সত্যি সে খুব ভাল। এই অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ায় খাটিয়ে সে বেশ পয়সা রোজগার করতে পারত। কিন্তু পরোপকারের নেশা তাকে তাড়া করেছিল। ড্রাইভার রাখে নি। বলে ড্রাইভারকে যদি সর্বদা না পাই। রোগ কি আর অপেক্ষা করতে পারে? সে নিজেই ড্রাইভারি শিখেছিল। খুব কম পয়সায় সে রুগীদের পৌঁছে দিত হাসপাতালে। আর বাকি তো সব তো আগেই বলেছি বিকাশ।

 

ঘর পুরো নিস্তব্ধ। খানিকটা গা ছমছমে ভয় আবার বেশ কিছুটা মন খারাপের জন্যেও বটে।

 

নন্দুর বাবা বলল, কিন্তু মরল কি করে?

 

-ষড়যন্ত্র আর কি। আর একটা আম্বুলেন্স আছে সেই বোষ্টমপাড়ায়। নিমাইয়ের পরোপকারের চোটে তার ব্যবসায়ে ঢিলে পড়ছিল যে ইদানিং। তাই—

 

-তাই?

 

-ষড়যন্ত্র করে তার ব্রেকের তার কেটে রেখেছিল। বোষ্টমপাড়ার মুখে যে কালভার্টটা আছে না সেখানে মারল ধাক্কা। পড়ল নিচে বিরাট খালে। গাড়িটা দেওয়ালে লেগে চুরমার হয়েছিল আর সে পাঁক থেকে উঠতে পারে নি। দম আটকে মারা গিয়েছিল। ভাগ্যি অন্য লোকটা ছিল না। নাহলে আরও একটা মরত।

 

নন্দুর এবার মনে পড়ল কালকের ড্রাইভারটার মুখ। কেমন ছিল সেই মুখ?

 

একটা কংকালের মুখ। দাঁত বার করে যেন সর্বদাই হাসছে খটখট করে। গভীর রাতে অ্যাম্বুলেন্সের হুটারের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল নন্দুর। আবার এই মাঝ রাত্তিরে কার শরীর খারাপ হল? আচ্ছা এই অ্যাম্বুলেন্সটা নিমাইয়ের নয় তো?

 

গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আবার সেই সঙ্গে মনের মধ্যে একটা ভাল লাগার ভাবও।


Download ALEEK PATA Mobile APP
DOWNLOAD ALEEK PATA ANDROID APP

। নববর্ষ-১৪২৮| Aleekpata.com |
  |ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
|Bengali New Year Issue, 2021 | April -July 2021| 
| Fifth Year  First  Issue |27 th Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |


 

অলৌকিক গল্প -যাদু কলম - শ্রাবনী গুপ্ত সরকার

 

যাদু কলম

শ্রাবনী গুপ্ত সরকার  

 

ঊর্মিলের দাদু খুব নামকরা চিত্রশিল্পী ছিলেন। এখনও বিবস্বান চৌধুরীর নাম শুনলেই লোকের চোখে সম্ভ্রম জেগে ওঠে। কিন্তু কেবল তাঁর নাতি বলেই ঊর্মিলকেও দুর্দান্ত ছবি আঁকতে হবে এ কেমন অন্যায় কথা! ঊর্মিল ক্লাস সেভেনে পড়ে। প্রথম পাঁচজনের মধ্যেই প্রতি বছর থাকে। ক্রিকেট আর ব্যাডমিন্টন রীতিমতো  ভালো খেলে। মজার ছড়া লিখতে পারে অনায়াসে, প্রচুর গল্পের বই পড়ে... আর পড়াশোনার জন্য যেটুকু আঁকা দরকার বেশ ভালোই পারে। স্কুলের থেকে আর স্কুলের বাইরে যত ডিবেট আর আবৃত্তি প্রতিযোগিতায়  গেছে কোনটা থেকেই খালিহাতে ফেরেনি। তাও...  

 

আসলে নতুন ড্রয়িং স্যার প্রথম ক্লাসে এসেই বিবস্বান চৌধুরীর নাতি হিসেবে ওর নামটা জেনে ফেলেছেন তার থেকেই বিপদটা আর পিছু ছাড়ছে না ঊর্মিলের। স্যার জোর করে ওকে বিভিন্ন কম্পিটিশনে নাম দিতে বলছেন, আরে ওর চেয়ে শতগুণে ভালো আঁকে যারা তাদের বাদ দিয়ে ওর নাম দেওয়ার কথা ভাবলেই ভীষণ লজ্জা করছে। আর প্রচন্ড টেনশনও হচ্ছে স্যার রেগে যাবেন ভাবলেই।

 

আজ শুক্রবার, আগামী রবিবার বিকেল পাঁচটায় ‘ভোরের আলো’ ক্লাবে একটা ড্রয়িং কম্পিটিশন আছে। বিষয় ‘যেমন খুশী আঁকো’। খুব ভয় করছে ওর। এতদিন যেখানে গেছে পুরস্কার নিয়ে ফিরেছে। আর এবার যে কী হতে চলেছে মা সরস্বতীই জানেন কেবল। 

 

শনিবার দুপুরে হাফছুটির পর বাড়িতে ফিরে ঊর্মিল দেখল মা দাদুর ঘরটা তালা খুলে ঝাড়ামোছার কাজ করছেন। এই ঘরটা সবসময়ে সুন্দর করে গোছানো থাকে। দাদুর আঁকা চমৎকার অয়েল পেন্টিং, জলরঙ, চারকোলের ছবি ছাড়াও চাইনিজ ইংকের বেশ কিছু অসাধারণ ছবি দিয়ে পুরো ঘরটাই সাজানো। হাল্কা নীল রঙের পর্দা, প্রতিদিন মা টাটকা ফুল দিয়ে টেবিলের ফুলদানী সাজিয়ে দেন। দাদু আজ দুবছর হলো পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন। কিন্তু এই ঘরটায় এলে এখনও দাদুর গায়ের সেই মিষ্টি গন্ধটা পাওয়া যায়।  

 

জামাকাপড় পালটে, হাতমুখ ধুয়ে ও দাদুর ঘরে এসে ঢুকতেই মা বললেন, “টেবিলে খাবার আছে, খা।”

 

“একটু থাকি না মা ঘরটায়। খুব চিন্তা হচ্ছে তো রবিবারের কথা ভেবে। যদি দাদুভাই কোনো সাহায্য করেন।”

 

মা একটু হাসেন। “অত চিন্তা করিস না, না হয় পুরস্কার পেলি না, তাতে কী এমন হবে?”   

 

দাদুর আঁকার টেবিলের গায়ে একটা ড্রয়ারের হাতল খুব সুন্দর দেখতে। কাঁচের ভেতর রঙিন ফুল ফুল। হাত বুলাতে বুলাতে একটা টান দিতেই খুলে গেল। অনেক রকম তুলি, রঙ, বিভিন্ন রকমের কাগজ, পেন। ড্রয়ারটা বন্ধ করতে যেতেই একটা পেন যেন আলাদা হয়ে সামনের দিকে গড়িয়ে এল। সুন্দর লম্বাটে, সরু আর চকচকে কালো রঙের পেনটা যেন হাসি মুখে ঊর্মিলের দিকেই চেয়ে  দেখছে। কলমটা তুলে নিল ও। খুব সরু নিবের পেন। দাদু চাইনীজ ইংকের ড্রয়িং করতেন এমন পেন দিয়ে। চাইনীজ ইংক ঊর্মিলের কাছেও আছে। মায়ের অনুমতি নিয়ে কলমটা নিজের কাছে রাখল ঊর্মিল।      

 

আজ রবিবার ড্রয়িং কম্পিটিশন। সব জিনিস গুছিয়ে নিতে গিয়ে দাদুর সেই পেনটাও চাইনীজ ইংক ভরে সঙ্গে নিয়ে নিলো ঊর্মিল। প্রচুর প্রতিযোগীর ভীড়। তার মধ্যে ফর্মের রিসিট দেখিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়লো ঊর্মিল। মাপমতো কাগজ দিয়ে গেল সংস্থার তরফ থেকে। নিজের নাম, বয়স আর  স্কুলের নাম লিখে ফেলল ও। একটু পরেই কম্পিটিশন শুরু হলো। কি মনে হতে ও প্রথমেই ভেবে ফেলল দাদুর কলমটা দিয়েই আজ আঁকবে। একটা ছেলের ঘুড়ি ওড়ানোর দুর্দান্ত ছবি ফুটে উঠলো সাদা কাগজের বুকে কালো আঁচড়ে। আকাশের দিকে তাকানো ছেলেটার চোখে মুখে উদ্বেগ আর উত্তেজনার অভিব্যক্তি অসাধারণ লাগছে হ্যাঁ ঊর্মিলের চোখেই। নিজের আঁকা থেকে চোখটাই সরাতে পারছে না ও। আসপাশে উদ্যোক্তাদের ফিসফাস শোনা যাচ্ছে “হবে না, কার নাতি দেখতে হবে তো। উত্তরাধিকার বলেও তো একটা কথা আছে নাকি!” বেশ লজ্জা করছে ঊর্মিলের। দাদুর কলমটাই হয়তো আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে ওর। তাই ছবিটা এমন সুন্দর হয়েছে। প্রতিযোগিতা শেষ হতেই আঁকাটা জমা দিয়ে বাড়ির পথ ধরলো ঊর্মিল।

 

রাতে পরের দিনের রুটিন অনুযায়ী বইপত্র গোছানোর পর একটা সাদা পাতা আর পেনটা নিয়ে বসে গেল ঊর্মিল। একটা চমৎকার হ্যাংলা বিড়ালের আশ্চর্য জীবন্ত ছবি, আড়চোখে মাছের দিকে চেয়ে ব্যাটা। হঠাৎই  মা বলে উঠলেন “ওমা! এ তো একদম তোর দাদুর ধারার আঁকা রে। খুব সুন্দর হয়েছে তো। তোর বাবা খুশি হবেন দেখলে। পেনটা যত্ন করে রাখিস আর ব্যবহার করিস।” স্কুলে আজ আর পেনটা বার করাই হয় নি ঊর্মিলের। ক্লাস আর ক্রিকেট ম্যাচ নিয়েই মেতে ছিল সারাদিন। বাড়ি ফিরে জলখাবারের পাট মিটিয়ে হঠাৎই মনে হলো পেনটার কথা। একটা কিছু আঁকা যাক। কিন্তু পেনটা কোথায় গেল? স্পষ্ট মনে আছে গতকাল রাতে স্কুলের ব্যাগেই রেখেছিল। সব বইখাতা, পেন্সিল বক্স, জ্যামিতি বাক্স বার করে খুঁজেও পাওয়া গেল না দাদুর পেনটা। ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল ঊর্মিলের। রান্নাঘরে মা খুব মন দিয়ে একটা দারুণ রান্না করছিলেন ভেটকি মাছের। সোজা গিয়ে মাকে সব কথা বলে ফেলল ঊর্মিল। “সে কি রে! কোথায় গেল? আহা বাবার হাতের অমন চমৎকার পেনটা, খুব খারাপ লাগছে।” মায়ের কথায় চোখে জল চলে এল ঊর্মিলের। ওরই দোষ, স্কুলে নিয়ে যাওয়ার তো কোনো দরকারই ছিল না। মাঝখান থেকে দাদুর স্মৃতিমাখা অমন সুন্দর কলমটা হারিয়ে গেল। 

 

বড্ড মন খারাপ নিয়ে প্রিয় ভেটকি মাছের ঝোলটাও ভালো করে খেতে পারল না ঊর্মিল। ঘুমটাও ঠিকমতো হলো না। খালি খালি অস্পষ্ট সব স্বপ্ন দেখে বারবার ভেঙ্গে যাচ্ছিল।

 

যতই মন খারাপ হোক স্কুলে তো যেতেই হবে, কাজেই স্নান খাওয়া সেরে পরের দিন স্কুলের দিকে রওনা হলো ঊর্মিল।

 

গেটের সামনেই বাহাদুরকাকার ঘর। ওর দুটো ছেলেও এই স্কুলে পড়ে। খুব গুন্ডা, পড়াশোনায় মন নেই। বড়োটাকে চুপি চুপি বিড়ি খেতেও দেখেছে ঊর্মিল। কোথায় পয়সা পায় কে জানে! কিন্তু বাহাদুর কাকা আর কাকি খুব হাসিখুশি, ভালোমানুষ। আজকে গেটেই ওকে এসে রতনবাহাদুর মানে বড়োভাই এসে ধরলো। ভীষণ  ঘাবড়ানো, কাঁদো কাঁদো মুখ, ভাঙা বাংলায় বললো মাফ করে দিতে। ও খুব ভুল করেছে। জিনিসটাও ফেরত দিতে চায় ভেবেছিল বিক্রি করে কিছু টাকা পাবে। কিন্তু ও খুব ভয় পাচ্ছে এখন। কি আশ্চর্য! ওর হাতে দাদুর সেই কলম। অন্যহাতে একটা কাগজ। তাতে একটা আশ্চর্য সুন্দর ছবি। ঊর্মিলের ব্যাগ থেকে রতনই কলমটা নিচ্ছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ফাঁকা ক্লাস ঘর, বেঞ্চ, ঊর্মিলের ব্যাগের নিঁখুত ছবি আর রতনের মিচকেপানা বদমায়েসি মাখা মুখ। 

 

হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিল ঊর্মিল। রতন এবারে কেঁদে ফেলেছে। বলছে ওকে দিয়ে কে যেন জোর করে এই ছবিটা কাল গভীর রাতে আঁকিয়ে নিয়েছে। ভীষণ ভয়ে ভয়ে সারারাত জেগেই ছিল বেচারা। চোখের নীচে কালি পড়ে গেছে, ফর্সা টুকটুকে মুখে ফ্যাকাসে ভাব। ঊর্মিল বলল, “আমি কাউকে কিছু বলবো না রতন। তবে তুই আর এমন করিস না। একটু পড়াশোনা করে কাকুর পাশে দাঁড়াতে হবে তো তোকে। আঁকা  শিখবি? আমি তোকে শেখাবো।

 

শিউরে উঠলো রতন। না আঁকার মধ্যে সে নেই। তবে সন্ধ্যাবেলা, না বোঝা পড়া বুঝতে চায় ঊর্মিলের কাছে। ঊর্মিল জানালো বাড়িতে আলোচনা করে ও বলবে। 

 

আজ বিকেলে আলো ঝলমল মুখে মাকে সব কথা বলতেই মা বললেন, “রোজ না, সোম আর বুধবার রতনকে আসতে বলিস। আর একটু চোখ খোলা রাখিস, স্বভাব বদলাতে কিন্তু সময় লাগে।”

 

“হ্যাঁ মা, আমি ঠিক খেয়াল রাখবো” বলেই ঊর্মিলের চোখ পড়লো দেওয়ালের গায়ে দাদুর ঝকমকে ছবিটার উপরে। মুখের হাসিটা আরো চওড়া লাগছে না! কি জানি! ঊর্মিল মনে মনে বলল, “দাদু আমার মাথার উপর থেকে আশীর্বাদের হাতটা তুমি সরিয়ে নিও না যেন কখনোই। আর যদি কখনোও ভুল করি বুঝিয়ে,  ধরিয়ে দিও সবসময়।” হঠাৎই মনে হলো দাদুর গায়ের সেই মিষ্টি গন্ধটা এসে নাকে ঝাপটা দিলো। মনটা একদম ভরে গেল ঊর্মিলের। দাদু ওর সঙ্গেই আছেন, থাকবেনও। এক সপ্তাহ পরে স্কুলে ড্রয়িং ক্লাসে বসে সুখবরটা পেল ঊর্মিল। ওর সেই ঘুড়ি ওড়ানো ছেলের ছবিটা অনায়াসে জিতে নিয়েছে প্রথম পুরস্কার। 

 

আর রতন বাহাদুর তার ভাইকে সঙ্গে নিয়ে প্রত্যেক সোমবার আর বুধবার সন্ধ্যাবেলা দিব্যি পড়া দেখে যাচ্ছে ঊর্মিলের বাড়িতে এসে। হ্যাঁ, বিড়ি খাওয়া আর চুরি দুটোই একদম ছেড়ে দিয়েছে রতন। এটাতে কিন্তু ঊর্মিল খুব খুশি।

Download ALEEK PATA Mobile APP
DOWNLOAD ALEEK PATA ANDROID APP

। নববর্ষ-১৪২৮| Aleekpata.com |
  |ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
|Bengali New Year Issue, 2021 | April -July 2021| 
| Fifth Year  First  Issue |27 th Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |




 

অলৌকিক- আনন্দস্বরূপা - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

 

আনন্দস্বরূপা

শ্যামাপ্রসাদ সরকার

 

আর একদিন পর থেকেই এ বৎসরের মতো কার্তিকী কৃষ্ণপক্ষের শুরু। আর সেই রোরুদ্যমানা ভয়াল অন্ধকারেই আসন্ন বহুকাঙ্খিত দীপাবলির মহাপূজার ক্ষণটি।

 

এর একটি মাস আগে থেকেই পিতৃলোকের আরাধ্য দেহাত্মাগণ তাঁদের বংশজদের উত্তরণ ঘটাতে এই মর্ত্যভূমিতে অবতরণ করেন আর তাদের হাতে তিলাঞ্জলির পিপাসা নিবারণের পর বংশধরদের ইহজীবনটি ধন্য করেন। এবারে কিন্তু মাসাধিককালের অন্তে তাঁদের উন্মার্গগমনের সেই পরম সময়টি ক্রমেই যে উপস্থিত তা তো আর কারো অজানা নয়!

 

মধ্যরাত এখন অতিক্রান্ত। বাতাসে কার্তিকের ঈষৎ শৈত্য মৃদুমন্দ আভাসে জানিয়ে দিচ্ছে এবারে আদিত্যদেবের অতিপরিচিত সেই দক্ষিণায়ণটির ক্রমপ্রাবল্য।

 

এদিকে এক পর্ণকুটিরের সামনে সুরধ্বনিময় গঙ্গার বুকে কান পাতলে ক্রমে আবার যেমন একটি নতুন জোয়ারস্রোতের কলস্বর শোনা যাচ্ছে বটে আবার সেই গৃহকর্তাটি অন্য রাতগুলির মত এ রাতেও একেবারে বিস্রস্ত, সুপ্তিহীন,বিনিদ্র ও অটলগম্ভীর। মহানিশার এই বিছানায় সুষুপ্ত সব প্রতিবেশী আর পরিবারের লোকজনদের কথা বরং আজ থাক।

 

এখন আমাদের ওই গৃহকর্তা স্বয়ং কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে নিয়েই ক্রমে অগ্রসর হওয়াই ভাল।

 

একদা তিনিও নবদ্বীপরত্ন শ্রীচৈতন্যের সহপাঠী ছিলেন বলে শ্লাঘা বোধ করেন। যদিও সে মহাযুগ এখন ইতিহাসের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে, যখন তিনি, রঘুনন্দন শিরোমণি, রঘুনন্দন ভট্টাচার্য ও শ্রী গৌর একই টোলে নানা জটিল শাস্ত্র অধ্যয়ন করতেন আর বহু তাত্ত্বিক বিতর্ক বাঁধিয়ে তাবড় সব পূর্বতন নৈয়ায়িকদের দর্পচূর্ণ করতেন এই শান্তিপুর-নবদ্বীপে অবস্হান করে। চোখ বুজলে এককালে যে তাঁরও সেই বহ্নিসদৃশ কিশোর গৌরহরির মধ্যে যে একটা প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল তা যেন আজও বিস্মরণে তিনি অক্ষম।

 

পরবর্তীকালে তাঁর সতীর্থটি বৃন্দাবনাশ্রিত সখীভাবে কৃষ্ণভজনের পথে গেলে, দুজনের মধ্যে আদর্শগত মনোমালিন্য হয় ও কৃষ্ণানন্দ তখন শাক্ত পথ অবলম্বন করেন। অবশ্য প্রিয়বন্ধু গৌরের এই নতুন শ্রীচৈতন্যরূপটি যদিও তিনি একদা রামকেলীর আসরে দূর থেকে একবার দেখে অশ্রুমার্জনা করে নীরবে ক্ষমা চেয়ে এসেছেন নিজে, শেষ পর্যন্ত দূরবর্তী দর্শকের আসন থেকেই।

 

***

 

গত নিশাকালটি মনোরম হলেও তিনি এখন বড়ো উতলা। তিনি আসলে মনের মধ্যে কেবল খুঁজে চলেছেন নিভৃত সমর্পণের আদর্শ সেই পরমআরাধ্যা অতিগূহ্য চিন্ময়ীর মাতৃস্বরূপটি।

যা বহু কঠিন শাস্ত্রমন্থনেও সেই রূপটি যে এখনো তাঁর নিজেরই অধরা।

 

আসলে চৈতন্য-পরবর্তী যুগে, যখন ধীরে-ধীরে বৈষ্ণব-আধিপত্য কমে আসছে স্বয়ং ভিত্তিভূমি নবদ্বীপে, তেমনই এক সময়ে সাধক হিসাবে আত্মবিকাশ "আগমবাগীশ কৃষ্ণানন্দে"র।

 

বাংলায় শক্তিচর্চাও তখন বিক্ষিপ্ত, অধোগামী। হাল ধরতে এলেন আগম-নির্গম সব তন্ত্রের সারাৎসার যাঁর ধমনীর মধ্যে সেই তিনিই। বিভিন্ন তন্ত্রশাস্ত্র ঘেঁটে, রচনা করলেন ‘তন্ত্রসার’। লোকে তখন থেকেই " আগমবাগীশ" বলে তাঁর কাছে গুরুজ্ঞানে প্রণত হয়।

 

কিন্তু মেজাজটি আর সাধকোচিত বশে নেই। থেকে থেকেই অকারণ অস্হির লাগছে বড়োই।স্বয়ং চিদানন্দস্বরূপা রূপপ্রকাশের খেলাটিতে কি তবে সত্যিই তাঁর প্রতি নিছক অনুদার?

 

মনের মধ্যে গুঞ্জরিত হয় এযাবৎ চর্চিত সেই শাস্ত্রবাক্যগুলি। আজ অজানিতেই সেগুলিকে সর্বতঃ ব্যর্থ বলেই তবে কেন মনে হচ্ছে কৃষ্ণানন্দের?

 

একটু ধীরগতিতে এসে তিনি সেই পূণ্যসলিলা গঙ্গোদকে পাদস্পর্শ করলেন। তারপর কিঞ্চিৎ স্বচ্ছতোয়ার ধারা হাতে তুলে এবার যেন নিজের মাথায় ছিটিয়ে আত্মশুদ্ধি করলেন।

 

নাহ্ ! তাঁর যে আর আজকাল নিদ্রাই যে আর আসেনা। অথচ স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী ব্রাহ্মপ্রত্যূষে নিদ্রাভঙ্গের পরই তো সেই কাঙ্খিত মাতৃমূর্তিটি প্রকট হওয়ার কথা। তারই প্রলোভনে যে কত রাত তিনি বিনিদ্র আর অপেক্ষমান সেটা আর কাকেই বা তিনি বলবেন?

 

শাক্ত তন্ত্রে এখনো পর্যন্ত মহাশক্তিযন্ত্র ও ঘটে আরাধনা হলেও দেবীর মাতৃস্বরূপটি সবারই অজানা। স্বয়ং তিনিও কি পারবেন এতদিনপরে সেই অভ্রংলিহ কারুণিকের দেবীরূপটিকে একবার চাক্ষুষ করতে?

 

পূবদিকে শেষরাতের মায়াময় স্নিগ্ধতা কাটিয়ে এবার অরুণোদয় ক্রমআসন্ন। এ যেন আরও একটি ব্যর্থতম দিনের উদ্ভাস !

 

হায়! আক্ষেপ করে ওঠেন সাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। গত পক্ষকালের মত এই রাত্রিটিও বিফল হল তবে!

 

নিরন্তর তন্ত্রসাধনায় তিনি বুঝেছেন যে সাধারণ মানুষ নিরাকারের পূজা ও তার মর্ম সঠিকভাবে বুঝবে না। অতএব মৃণ্ময়ী মূর্তিতেই এবারে হোক দেবীর আরাধ্যা রূপের প্রকাশ।

 

***

 

ঈষৎ মনস্তাপের সাথে তিনি নবোদিত সদ্যোজাত ক্ষীণ রশ্মিসম্পন্ন সূর্যকে অভ্যাস মতো একবার প্রণাম করলেন। তারপর আচমনের জন্য সামান্য জল তাঁর কন্ঠস্পর্শ করল সভক্তিভরেই।

 

তাহলে! সেই ছদ্মরূপা মহাশক্তি আজও তবে তাঁর কাছে ধরা দিলেন না ! আর একপক্ষকাল পরেই তো অমাবস্যা। দেবী ভগবতী কি তার আগে একটুও এই অধমসাধকটির ওপর সদয়া হতে পারেন না?

 

মধ্যবয়স্ক বৃষস্কন্ধ কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ স্থির করলেন এবারে এই ব্যর্থ অসহায় মনুষ্য দেহটিকে তবে না হয় এজন্মের মত সেই মুক্তকেশী করালবদনাকেই নিজের হাতে প্রণামীর জন্য দিয়ে আসবেন আগামী মহাপূজার শেষে, অমাবস্যাটি বিগত হলেই।

 

***

 

 

তন্ময় সাধকের পথে হঠাৎই গোচর হয় এক নিম্নবর্ণীয়া গোপবধূ। তার ডান পা একটি বারান্দার ওপর তোলা, আর বাঁ পা মাটিতে। ডান হাতে তার কিছু গোময়ের স্তুপ আর বাম হাতটি উঁচুতে তুলে ঘুঁটে দিতে সে এখন উদ্যত সীমানার বেড়াটির গায়ে।

 

রমণীটির কুঞ্চিত মেঘকালো চুলটি আলুলায়িত ও একঢাল, যদিও পরণে তার কোনওভাবে পরিধান করা একটি ছোট শাড়ি তবুও সেই শ্যামবর্ণা প্রায় প্রায়উলঙ্গিনী পরমাপ্রকৃতিটি অত ভোরে স্বয়ং কৃষ্ণানন্দকে দেখে লজ্জায় জিভটি কেটে আবার সঙ্গে সঙ্গেই পিছন ফিরে দাঁড়াল।

 

কৃষ্ণানন্দ স্বয়ং এ দৃশ্যে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন।

 

কিন্তু কে যেন অলক্ষ্যে বসে তাঁর প্রতি অট্টহাস্য করে বিদ্রুপ করে বলছে " রে মূর্খ! এই তো সেই আরাধ্যা চিন্ময়ী স্বরূপা রে! যার ধ্যানে বসলে তুই নিজেই মুগ্ধকন্ঠে বলিস্ তো,

 

- ঘোরদ্রংষ্ট্রাং করালাস্যাং পীনোন্নতপয়োধরাম্।।শবানাং করসংঘাতৈঃ কৃতকাঞ্চীং হসন্মুখীম্।সৃক্বদ্বয়-গলদ্রক্ত-ধারা-বিষ্ফুরিতাননাম্।।

ঘোররাবাং মহারৌদ্রীং শ্মশানালয়বাসিনীম্।

বালার্ক মণ্ডলাকার-লোচনত্রিতয়ান্বিতাম্।।

 

দন্তুরাং দক্ষিণব্যাপি-লম্বমান কচোচ্চয়াম্।শবরূপ-মহাদেব-হৃদয়োপরিসংস্থিতাম্।।

শিবাভির্ঘোররাবাভিশ্চতুর্দ্দিক্ষু সমান্বিতাম্।মহাকালেন চ সমং বিপরীত রতাতুরাম্।।সুখপ্রসন্নবদনাং স্মেরানন-সরোরুহাম্।

এবং সঞ্চিন্তয়েৎ কালীং সর্ব্বকাম-সমৃদ্ধিদাম্"

 

 

হঠাৎ তাঁর মনোজগতে এক অসীমপরিবর্তন ধেয়ে আসছে যেন। কৃষ্ণানন্দের মুখের স্মিত হাসিতে এখন বিশ্বজয়ী সাধকপ্রবরের এক নবঅনুরাগের ক্রমউন্মেষ।

 

আহা! এই তো সেই বহুপ্রতীক্ষিত তাঁর মাতৃকার চিন্ময়ী আনন্দস্বরূপার স্বরূপটি। রূপকের আড়ালে যিনি তো সদাই ভক্তকল্পতরু।

 

ধন্য আজ নিশাবসান! আর তদ্বজনিত প্রকাশমানা আজকের পরম ব্রাহ্মমুহূর্তকালটি!

 

তাঁর দুটি চোখে ততোক্ষণে নেমে এসেছে ভক্তির অশ্রুধারা। বিগলিত কন্ঠে সুরধ্বনীর তীরে শুয়ে আভূমি প্রণত হন তিনি, আর মন্দ্রকন্ঠে উচ্চারণ করেন দক্ষিণাকালিকার প্রতি পুষ্পাঞ্জলি প্রদানের সময়ে সেই বহুচর্চিত ও উচ্চারিত মহামন্ত্রটি -

 

"আয়ুর্দ্দেহি যশোদেহি ভাগ্যং ভগবতি দেহিমে।পুত্রান্ দেহি ধনংদেহি সর্ব্বান্ কামাংশ্চ দেহিমে।। দুর্গোত্তারাণি দুর্গে ত্বাং সর্ব্বাশুভ-নিবারিণি।ধর্ম্মার্থমোক্ষদে দেবি নিত্যং মে বরদা ভয়।। কালি কালি মহাকালি কালিকে পাপহারিণি।ধর্ম্মকামপ্রদে দেবি নারায়ণি নমোহস্তুতে।।"

 

বেশ অভাবনীয়ভাবেই স্বয়ং চিন্ময়ীকে আজ প্রত্যক্ষ করেছেন শেষপর্যন্ত। এবারে কালাকালের ভাবতরঙ্গে সেই রূপটিকেই ভবিষ্যতের জন্য মৃন্ময়ী আকার দিয়ে যেতে হবে। তাঁর আয়ুষ্কালটি এবার গত হলেও এই রূপেই দেবী চিরদিন ধরা থাকবেন।

আগমবাগীশের ঐশী সাধনার শেষপর্বটি আজ বড়োই যে মধুর সমাপনে চিরউজ্জ্বল হয়ে রইল।

 

বিগলিত কৃষ্ণানন্দ অবশেষে সানন্দে আজ তাঁর কুটিরের পথে পা বাড়ালেন।


Download ALEEK PATA Mobile APP
DOWNLOAD ALEEK PATA ANDROID APP

। নববর্ষ-১৪২৮| Aleekpata.com |
  |ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
|Bengali New Year Issue, 2021 | April -July 2021| 
| Fifth Year  First  Issue |27 th Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |

|a DISHA-The Dreamer Initiative |





 

Main Menu Bar



অলীকপাতার শারদ সংখ্যা ১৪২৯ প্রকাশিত, পড়তে ক্লিক করুন "Current Issue" ট্যাব টিতে , সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

Signature Video



অলীকপাতার সংখ্যা পড়ার জন্য ক্লিক করুন 'Current Issue' Tab এ, পুরাতন সংখ্যা পড়ার জন্য 'লাইব্রেরী' ট্যাব ক্লিক করুন। লেখা পাঠান aleekpata@gmail.com এই ঠিকানায়, অকারণেও প্রশ্ন করতে পারেন responsealeekpata@gmail.com এই ঠিকানায় অথবা আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।

অলীক পাতায় লেখা পাঠান