ইতিহাসের পাতা থেকে
‘লাডলী বেগম’, মোগল ইতিহাস-উপেক্ষিতা এক মহীয়সী নারীর খোঁজে
অরণ্যা দাশগুপ্ত
Image Courtesy: Google Image |
(১)
‘তুমি প্রত্যুষের
তারার মতো মহাকাব্যের সুমেরুশিখরে একবারমাত্র উদিত হইয়াছিলে, তার পরে অরুণালোকে আর তোমাকে দেখা গেল না। কোথায় তোমার উদয়াচল, কোথায় বা তোমার অন্তশিখরী তাহা প্রশ্ন করিতেও সকলে বিস্মৃত হইল।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’
প্রবন্ধে লক্ষ্মণপত্নী ঊর্মিলা সম্পর্কে উপরোক্ত মন্তব্যটি করলেও মোগল ইতিহাস
উপেক্ষিতা নুরজাহান-দুহিতা লাডলী বেগম সম্পর্কেও এই মন্তব্যটি প্রযোজ্য। মোগল
ইতিহাসের এক প্রায় বিস্মৃত, ‘ভাগ্যহত’ বাঙালি মেয়ে লাডলী বেগম। অথচ
লাডলীর নাম জড়িত আছে ভারত সম্রাজ্ঞী নুরজাহানের সঙ্গে। যে নুরজাহান ভারতসম্রাট
জাহাঙ্গীরকে নিজের হাতের পুতুল বানিয়ে দীর্ঘ ষোল বছর (১৬১১-১৬২৭) ধরে অবাধে
রাজ্যশাসন করেছিলেন, সেই নুরজাহানের একমাত্র সন্তান লাডলী
বেগমের জীবন সম্পর্কে ইতিহাস প্রায় নীরব। মোগল ইতিহাসের ‘সুমেরুশিখরে’ একান্ত
পার্শ্বচরিত্র হিসাবে লাডলী বেগম এক-দুইবার ‘উদিত’ হলেও ইতিহাসকাররা তার জন্য বেশি
শব্দ খরচ করেননি। সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল এই লাডলী বেগম সম্পর্কে লিখেছেন,
‘লা-জবাব দেহ্লী-অপরূপা আগ্রা গ্রন্থরচনার সময় মুঘলযুগের ইতিহাস
কিছুটা ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়েছিল। তখনই এই মহিমাময়ী নারীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়।
আমার মনে হয়েছিল এই মিষ্টি বাঙালি মেয়েটি ইতিহাস-উপেক্ষিতা।’
(২)
এই ‘মহিমাময়ী’, ‘উপেক্ষিতা’, ‘বাঙালি মেয়েটি’ নিজের মায়ের
ক্ষমতালিপ্সার জন্য আজীবন নিজের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়েছে এবং অবলীলায় ক্ষমা করে
দিয়েছে তার মায়ের তার প্রতি করা সমস্ত অবিচার, এই কাহিনিই
সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল তাঁর ‘লাডলী বেগম’ (১৯৮৬) উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। লেখক
নারায়ণ সান্যাল নিজের এই উপন্যাসটি সম্পর্কে বলেছেন, “লাডলিবেগম
এ-গ্রন্থ আদ্যন্ত ‘উত্তম-নারী’তে (‘চেয়ারম্যান’ ইদানিং ‘চেয়ার-পার্সেন’ হয়েছেন;
তাহলে বৈয়াকরণিকেরা ‘উত্তম-পুরুষ’ শব্দটা বদলাচ্ছেন না কেন?...)
তাঁর কোনও আত্মজীবনী নেই, অন্তত আমি খোঁজ
পাইনি। ফলে উপন্যাস ও ইতিহাস অংশ সাজাতে আমাকে সবটা নায়িকার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে
দেখতে ও দেখাতে হয়েছে।” লাডলীর যে দুঃখভরা জীবনকাহিনি ইতিহাস রচয়িতারা বলার
প্রয়োজন মনে করেননি, সেই কাহিনিই যেন লাডলীর মুখ দিয়ে লেখক
এই উপন্যাসে শুনিয়েছেন।
(৩)
উপন্যাসের প্রথমেই লাডলী
বলেছে নিজের হতভাগ্য পিতার কথা। লাডলীর ভাগ্যবিড়ম্বিত ‘আব্বাজান’-কে পাঠকেরা চিনতে
পারবে না তা যেন নারায়ণ সান্যালের লাডলী বেগম আগে থেকেই জানতো, তাই সে বলে উঠেছে, ‘আমার আব্বাজানের নাম: আলিকুলি
বেগ্ ইস্তাজলু। চিনতে পারলেন না তো?...যেন আমি আমার হতভাগ্য
বাপের আদুরে দুলালী নই, -শুধুমাত্র মায়ের উপেক্ষিতা আত্মজা!’
লাডলী নিজের বাবার কথা বলতে গিয়ে লেখকের কল্পনামুখর চোখ দিয়ে পাঠককে দেখিয়েছে,
নিজের বাবার সঙ্গে কাটানো কিছু মধুর দিনের স্মৃতি। নওরোজ, ঈদ বা মিলাদ-সরিফে লাডলীর বাবা মাজায় ‘লাল-গামছা’ জড়িয়ে রান্না করছে। কিংবা
কোনো এক বসন্তের জোনাকি-জ্বলা সন্ধ্যায় ছয় বছরের ছোট্ট লাডলী নিজের বাবার কোলে বসে
গল্প শুনছে। লাডলীর বাবা আলিকুলি বেগ পারস্য থেকে ভারতবর্ষে এসেছিলেন প্রায় নিঃস্ব
অবস্থায়। ভারতে এসে তিনি মোগল সৈন্যদলে যোগদান করেছিলেন। রবার্ট কাউন্ট তাঁর
দেহকান্তির বর্ণনা দিতে গিয়ে একটিমাত্র শব্দ ব্যবহার করেছিলেন, ‘Indian
Apollo’.
ক্রমে সম্রাট আকবরের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন
আলিকুলি। মোগল সাম্রাজ্যের বিশিষ্ট মন্ত্রী মির্জা গিয়াস বেগের কন্যা
মেহেরউন্নিসার সঙ্গে বিবাহ হল আলিকুলি বেগের। বিবাহের সাত বছর পর মেবার অভিযানে
শাহাজাদা সেলিম(জাহাঙ্গীর)-এর সঙ্গে সমরকুশলী আলিকুলি বেগও গেলেন। সেখানে খালি
হাতে একটি বাঘ মারলেন তিনি, তাই শাহাজাদা সেলিম তাঁকে ‘শের আফকন’ উপাধি দিয়েছিলেন। এইসময় আলিকুলি
বেগের বীরত্বকেন্দ্রিক নানা কিংবদন্তীও গড়ে উঠেছিল। এরপরই আলিকুলি বেগ সস্ত্রীক
চলে আসেন বাংলার বর্ধমানে। সামান্য এক মনসবদার আলিকুলি বেগ। এমন মনসবদার তো অনেক
ছিল মোগল সাম্রাজ্যে। তাহলে কেন অচ্ছেদ্যভাবে জুড়ে গেল আলিকুলি বেগ ইস্তাজলুর নাম
মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাসের সঙ্গে? কারণ একটাই। আলিকুলির
স্ত্রী মেহেরউন্নিসা, যে কিনা ভবিষ্যতের নুরজাহান।
কথিত আছে, আলিকুলি ও মেহেরউন্নিসার বিবাহের পূর্বে, পূর্ণচন্দ্রের
সুষমাযুক্ত কিশোরী মেহের-এর রূপে মুগ্ধ হয়ে রাজপুত্র সেলিম পিতা আকবরের কাছে
মেহেরউন্নিসাকে বিবাহ করার অনুমতি চেয়েছিলেন। কিন্তু ততদিনে মেহেরউন্নিসা আলিকুলি
বেগের বাক্দত্তা, তাই
বাদশাহ আকবর সেলিমকে এই বিবাহে অনুমতি দেননি। ঐতিহাসিক ডক্টর বেণীপ্রসাদ,
যিনি জাহাঙ্গীর সম্পর্কে ‘History of Jahangir’ নামক তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থটি রচনা করেছেন, তিনি
মেহেরউন্নিসা ও জাহাঙ্গীরের বিবাহপূর্ব প্রেমের ধারণাটি স্বীকার করেননি। সাহিত্যিক
নারায়ণ সান্যাল লাডলীর জবানীতেই ‘লাডলী বেগম’ উপন্যাসে ডক্টর বেণীপ্রসাদের
যুক্তিগুলি খণ্ডন করে, মেহেরউন্নিসা ও সেলিমের প্রাক্বিবাহ
প্রেমের ধারণাকে স্বীকৃতি দেন। আলিকুলি-মেহেরউন্নিসার দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে
ইতিহাস নীরব। লেখকের কল্পনায় দেখা গেছে শ্যামল, শান্ত-স্নিগ্ধ
বঙ্গদেশে আলিকুলি ও মেহেরউন্নিসার একটি সুন্দর সংসার। কিন্তু অনেক খুশির মধ্যেও
মেহেরউন্নিসার মনে কোথাও যেন একটা খেদ আছে। সেই খেদ চিত্রিত করতে নারায়ণ সান্যাল
সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের মতি বিবির
সঙ্গে মেহেরউন্নিসার কথোপকথনের চিত্রটি ধার করেছেন। লাডলীর জবানীতে উঠে এসেছে সেই
চিত্র, ‘‘একদিন মা তার খাশ্কামরায় বসে তস্বির
বানাচ্ছে।...আগ্রা থেকে যিনি এসেছিলেন তিনি ঠিক মায়ের পিছনেই বসে ছবি আঁকা
দেখছিলেন।...হঠাৎ আম্মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, ‘সেলিম
ভারতবর্ষের সিংহাসনে, আমি কোথায়?’’ এই
আক্ষেপের জন্যই নিজের সংসারে সমস্ত সুখ থাকা সত্ত্বেও মেহেরউন্নিসা সুখী হতে
পারছিলেন না। অন্যদিকে সেলিমও ভুলতে পারেননি মেহেরউন্নিসার জগৎ আলো করা রূপ।
তাই জাহাঙ্গীর ১৬০৬ সালে
সিংহাসনে আরোহণ করেই, বাংলা থেকে সুশাসক মানসিংহকে বিহারে বদলি
করে দেন। তার পরিবর্তে জাহাঙ্গীর বাংলাদেশে পাঠান বিশ্বস্ত কুৎ্বউদ্দিন কোকাকে।
কোকাকে নাকি বলা হয়েছিল, ‘শের আফকন সেখানে রাজবিদ্রোহী-সুলভ
কি সব নাকি করছিলেন। তাঁকেও একটু সমঝে দেওয়া দরকার।’ কিন্তু এই ‘রাজবিদ্রোহী-সুলভ’
আচরণ যে কেবল একটা অজুহাতমাত্র সেকথা ঐতিহাসিক ডক্টর বেণীপ্রসাদও স্বীকার করেছেন,
‘The suspicion of disloyalty thrown on Sher Afkun may have been unjust.’ কুৎ্বউদ্দিন বাংলাদেশে এসেই
প্রথমে ডেকে পাঠালেন আলিকুলি বেগকে। আলিকুলি কেবল দুজন সঙ্গীকে নিয়ে রাজপ্রতিনিধির
সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলেন, কিন্তু আর ফিরলেন না। Sugam
Anand তাঁর ‘History of Begum Nurjahan’ গ্রন্থে
সেইদিন কোকার শিবিরে শের আফকনের হত্যার সম্পূর্ণ বিবরণ দিয়েছেন,
‘…Sher-i-Afgan, accompanied by two sevents, reached Qutubuddin’s camp on April
9, 1607. To his utter surprise, he was immediately surrounded by the Governor’s
troops…he angrily enquired of Qutubuddin as to why he was being treated in that
manner. Qutubuddin proceeded to explain the matter, but the infuriated
Sher-i-Afghan struck the governor with his sword. Qutubuddin’s followers fell
upon Sher-i-Afghan and cut him to pieces.’
যে ‘আব্বাজান’ ‘ছোট্ট’ লাডলীকে পরম মমতায়, আদরে ভরিয়ে রেখেছিল সেই ‘আব্বাজান’-এর মৃত্যুতে লাডলীর হৃদয় হাহাকার করে
উঠল, ‘অনেক অনেক কেঁদেছিলাম সেদিন। আমি একটু ঠোঁট ফুলালেই
আব্বাজান আমাকে কোলে তুলে নিত, চুমায় চুমায় ব্যতিব্যস্ত করে
তুলত। তাতেও যদি আমার অভিমান না ভাঙে, তখন তার দাড়ি ঘষে দিত
আমার নাকে মুখে। সুড়সুড়ি লাগায় আমি খিলখিলিয়ে হাস্তে শুরু করতুম। কিন্তু সেই
বিশেষ সন্ধ্যায় আব্বাজান আমাকে কোলে তুলে নিল না; আদর করল
না। তার লালে-লাল আঙরাখায় যে তার ছোট্ট মুন্নি মাথা খুঁড়ছে, তা
চেয়েও দেখল না একবার!’
(৪)
বাবার মৃত্যুর পর লাডলীর জীবনে একটা বড় রকমের
পরিবর্তন ঘটে গেল। আগ্রায় লাডলীর প্রতিপত্তিসম্পন্ন দাদামশাইয়ের মির্জা গিয়াস
বেগ-এর বাড়ি থাকলেও মেহেরউন্নিসা ও তাঁর মেয়ে লাডলীকে নিয়ে আসা হয়েছিল মোগল
হারেমে। মেহেরউন্নিসা ও জাহাঙ্গীরের বিয়ে হয়েছিল আলিকুলি বেগের মৃত্যুর চার বছর
পর। এই বিলম্বের কারণ হিসাবে মনে হতে পারে ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে মেহেরউন্নিসার
মতিবিবি কে বলা কথাগুলি, ‘দাসীর স্বামী জীবিত থাকিতে সে কখনও
দিল্লীশ্বরকে মুখ দেখাইবে না; আর যদি দিল্লীশ্বর কর্ত্তৃক
তাহার স্বামীর প্রাণান্ত হয়, তবে স্বামিহন্তার সহিত ইহজন্মে
তাহার মিলন হইবেক না।’ কিন্তু নিজের ‘স্বামিহন্তা’কে বিবাহ করে মেহেরউন্নিসা
প্রমাণ করে দিয়েছে, ‘মেহের শুধু ভালবেসেছে- নুরজাহাঁকে।’
গৃহবধূ মেহেরউন্নিসার মধ্যে লুকিয়ে ছিল নুরজাহানের কূটবুদ্ধি, প্রতিহিংসা-পরায়ণতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, সর্বগ্রাসী ক্ষমতালিপ্সা, জাহাঙ্গীরের সঙ্গে বিবাহের
পর নুরজাহান নাম নিয়ে এইসব বৈশিষ্ট্য আরো প্রকট হয়ে উঠেছিল। ‘মদ্যপ’, ‘অহিফেন-আসক্ত’ জাহাঙ্গীরকে সিংহাসনে বসিয়ে ঝরোকার আড়াল থেকে সমগ্র
সাম্রাজ্য শাসন করত ‘তপ্তকাঞ্চনবর্ণা’, ‘অনন্ত-যৌবনা’
নুরজাহান, ‘নুরজাহান কখনও মুঘল সিংহাসনে বসেন নি, অথচ দরবার সন্ত্রস্ত হয়ে উঠত, কে জানে কী বিধান আসে
সিংহাসনে-আসীন সম্রাট জাহাঙ্গীরের আড়াল থেকে।’
(৫)
আর নুরজাহানের একমাত্র মেয়ে
লাডলী নিজের একমাত্র সম্বল মাকে ছেড়ে থাকে একটি পৃথক মহলে। নারায়ণ সান্যাল লাডলী
বেগমকে একবারে একা করে দিতে চাননি বলেই হয়ত সৃষ্টি করেছেন মীনাবিবি, আজি-আম্মা এবং রুস্তম শেখ চরিত্রগুলিকে। মোগল হারেমে বন্দিনী লাডলী বেগমের
সঙ্গে বাস করত এক হারেম-বাঁদী মীনাবিবি। ‘হারেম’ শব্দটি একটি আরবী শব্দ, যার অর্থ নিষিদ্ধ। মোগল রাজাদের অধীনস্থ মেয়েদের মহল বা অন্তঃপুরের নাম
ছিল হারেম, ‘... জেনানাখানাকেই
নাম দিয়েছিলেন তাঁরা হারেম। কেননা, একটি শব্দে মনের কথা
বোঝাতে হলে ‘হারেমে’র কোন বিকল্প খুঁজে পাওয়া ভার। হারেম- নিষিদ্ধ এলাকা; নিষিদ্ধ এবং যুগপৎ পবিত্র।’ হারেমে শাহেনশাহ ও শাহজাদাদের পত্নীরা ছাড়াও
ছিল সুলতান ও শাহজাদাদের অসংখ্য সুন্দরী উপপত্নী, এছাড়া ছিল
কিছু বহুভোগ্যা রমণী। সারাহ্-বাঁদী বা হারেমের মুখ্য আধিকারিকাদের মতে এরা
‘বে-ওয়ারিশ্ হুরী’। সারাহ্-বাঁদীর
নির্দেশে এইসব বহুভোগ্যা রমণীরা সম্রাটের অতিথিদেরও মনোরঞ্জন করত, আবার মাঝে মাঝে সম্রাট ও শাহজাদাদের শয্যাসঙ্গিনীও হতে হতো। মীনাবিবিও
এমনই একজন সুন্দরী রমণী। জন্মসূত্রে সে কাশ্মীরী। মোগলসৈন্যরা জোরপূর্বক
মীনাবিবিকে হরণ করে হারেমজাত করেছিল। লাডলীর থেকে মীনা প্রায় সাত-আট বছরের বড়। সে
নিজের ছোটবোনের মতোই সবসময় আগলে রাখত লাডলীকে। লাডলী মীনাকে ডাকত মীনাবহিন বলে।
নিজের নানা অভিজ্ঞতার কথা শোনাত মীনাবহিন, যা শুনে লাডলীর
হৃদয় রোমাঞ্চিত হয়ে উঠত। নিজের জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লাডলীর সঙ্গী হয়ে
থেকেছে এই মীনাবহিন।
আর লেখকের কল্পনায় আজি-আম্মা
লাডলীর ‘দুধ-মা’। তৎকালীন সময়ে সম্ভ্রান্ত বংশের মেয়েরা নিজের সন্তানকে দুধ পান
করাতো না, দুগ্ধবতী কোনো মহিলাই সেই সন্তানের ধাত্রী হিসাবে নিযুক্ত হত।
আজি-আম্মা জন্মসূত্রে রাজপুত। পরবর্তীকালে তিনি ধর্মান্তরিতা হয়েছিলেন। মোগল
হারেমে এসেছিলেন শাহাজাহানের মা জগৎ গোঁসাইয়ের খাশ দাসী হিসাবে। পরে আজি-আম্মা
আলিকুলি বেগের সঙ্গে বর্ধমানে চলে আসেন এবং এই আজি-আম্মাই লাডলীর ‘দুধ-মা’ হিসাবে
নিযুক্ত হয়। মোগল হারেমে লাডলীর রক্ষণাবেক্ষণের ভার ছিল আজি-আম্মার উপর। লাডলীকে
সে ঠিক নিজের মেয়ের মতো ভালবাসত। আজি-আম্মার একমাত্র ছেলে, লাডলীর
দুধভাই রুস্তম শেখ। রুস্তম লাডলীর থেকে এক মাসের বড়। লাডলীর শৈশবকাল থেকেই এই
আজি-আম্মা ও রুস্তম ভাই ছিল তার সঙ্গী। আগ্রায় আসার পর রুস্তম নুরজাহানের দাদা আসফ
খাঁর অধীনস্থ বাহিনীতে সৈনিক পদে যোগদান করে। বাইরের পুরুষরা হারেমের ভিতর আসতে
পারত না, ফলে আগ্রায় আসার পর থেকে রুস্তমের সঙ্গে আর দেখা
হয়নি লাডলীর। একবার হঠাৎ ফতেপুর সিক্রি থেকে আগ্রা যাওয়ার পথে লাডলী বেগমের সঙ্গে
দেখা হয়ে গেল রুস্তমের। লাডলীর চোখের সামনে দিয়ে নিজের একটুকরো ছোটবেলা যেন ঝিলিক
দিয়ে গেল। বর্ধমানের ‘সেই দিগন্ত বিস্তৃত সর্ষে-তিসির ক্ষেত, লেজঝোলা ফিঙের নাচন, স্তব্ধ মধ্যাহ্নে ঘুঘুর ডাক!’
আর এই সেই খেলার সাথী রুস্তম। দীর্ঘসময় পর দেখা হওয়ার আনন্দে, আবেগে রুস্তম লাডলীকে বলে ফেলেছিল, ‘-তুমি তোমার
মায়ের চেয়েও সুন্দর!’ যে লাডলী নিজের মায়ের ‘মেহ্দিরঞ্জিত রাতুল চরণেই’ বিকিয়ে
দিয়ে এসেছে ‘গোটা জিন্দেগী- তার চেয়েও বড় কথা, গোটা জওয়ানী।’
সেই লাডলী রুস্তমের সঙ্গে সাক্ষাতে জীবনের প্রথম প্রেম ও যৌবনের শিহরণ অনুভব করল।
এই অংশে নারায়ণ সান্যাল বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাস থেকে
অভিরামস্বামী চরিত্রটিকে নিয়ে এসেছেন। রুস্তম লাডলীকে নিয়ে গিয়েছিল এক সন্ন্যাসীর
কাছে লাডলীর ভবিষ্যৎ গণনা করবার জন্য, সন্ন্যাসীর নাম
অভিরামস্বামী। নারায়ণ সান্যাল লিখেছেন, ‘আভিরামস্বামীকে
দেখলে এখন চেনা যায় না। মানে, জগৎ সিংহ-দুর্গেশনন্দিনী দেখলে
চিনতে পারতেন না। এই বিশ বছরে তাঁর যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে। ষাট বছর থেকে আশি।’ সাহিত্যসম্রাট
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সৃষ্ট মতিবিবি ও অভিরামস্বামী চরিত্রদুটিকে ‘লাডলী
বেগম’ উপন্যাসে নিয়ে এসে নারায়ণ সান্যাল নিজের সৃষ্টি করা চরিত্রগুলির সঙ্গে
বঙ্কিমসৃষ্ট চরিত্রগুলির সাক্ষাৎ ঘটিয়েছেন। যেন একই সময়ের পটভূমি নিয়ে রচিত দুজন
রচয়িতার দুটি উপন্যাসের চরিত্রগুলি যেন হঠাৎ করেই মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।
এরপর কেটে গেছে প্রায় এক বছর।
নুরজাহানের সঙ্গে জাহাঙ্গীরের বিয়ের পর নুরজাহান, গিয়াস বেগ,
আসফ খাঁ ও খুররম(পরবর্তীকালে শাহজাহান)- এই চারজন মিলে একটি
চতুর্ভুজ জোট গঠন করেছিলেন যা নুরজাহান জুন্তা নামেও পরিচিত। জাহাঙ্গীরকে
সিংহাসনে বসিয়ে মূলত এই জোটই রাজ্যশাসন করত। জোটের বাকি তিনজনেরই আস্থা ছিল
শাহজাদা খুররমের উপর, ‘তাঁদের আশা জাহাঙ্গীর ফৌত হলে এ ছেলেই
সন্তানের উপযুক্ত কাজ করবে। প্রথমেই বানাবে বাপের জন্য এক বিশাল মক্বরা আর তারপর
ত্রয়ী-শক্তির নির্দেশে হিন্দুস্থান শাসন করতে থাকবে।’ নুরজাহানের সহায়তায়
উপর্যুপরি সাফল্য লাভ করতে শুরু করল খুররম। আর তখনই সে নিজের মুখোশ খুলে ফেলল।
নুরজাহান বুঝল খুররমকে হাতের পুতুল বানিয়ে রাজ্যশাসন করা সম্ভব নয়। খুঁজতে হবে এমন
একজনকে যাকে সিংহাসনে বসিয়ে রেখে সব ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেওয়া যায়। পাওয়াও গেল
একজন উপযুক্ত মানুষ, জাহাঙ্গীরের ছোট ছেলে শাহরিয়ার। তখনই নুরজাহানের
মনে পড়ে গেল হারেমের এক কোণায় পড়ে থাকা নিজের হতভাগ্য অনুঢ়া মেয়েটার কথা। ষোল
বছরের রুগ্ন, জড়বুদ্ধি শাহরিয়ারের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করলেন তেইশ
বছর বয়স্কা লাডলীর। লেখক কল্পিত আজি-আম্মা ও রুস্তম লাডলীকে এই পরিস্থিতি থেকে
উদ্ধার করতে চেয়েছিল, রুস্তম বিয়ে করতে চেয়েছিল লাডলীকে।
গভীর রাতে আজি-আম্মা লাডলীকে ছদ্মবেশে যমুনা নদীর ধারে পাঠিয়ে দিল। সেখানেই
দাঁড়িয়ে থাকার কথা রুস্তমের। তারা নৌকা বেয়ে পালিয়ে যাবে অনেক দূরে। কিন্তু লাডলী
ভোর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেও রুস্তম এলো না। আর আজি-আম্মাও নিরুদ্দেশ হয়ে যায়
রহস্যজনকভাবে। লাডলীর বিয়ে হয়ে যায় শাহরিয়ার এর সঙ্গে।
এর অনেক বছর পর
মৃত্যুপথযাত্রী নুরজাহান লাহোরের এক ছোট্ট কুটিরে শুয়ে নিজের মেয়ের কাছে উন্মোচন
করেছিল সেই রহস্য, ‘...মনে আছে তোর? আগ্রা
কিল্লার জাহাঙ্গীরী মহলের দক্ষিণে একটা বকুলগাছ ছিল?...আজি-আম্মা
নিরুদ্দেশ হয়নি। সে শুয়ে আছে ঐ বকুলগাছের তলায়। একা নয়...অনন্তকাল ধরে সে শুয়ে
থাকবে তার একমাত্র সন্তানকে বুকে জড়িয়ে;’ নিজের
ক্ষমতালিপ্সার জন্য দুটি মানুষকে শেষ করে দিয়েছিল নুরজাহান, আর
তার সঙ্গেই শেষ করে দিয়েছিল নিজের মেয়ের জীবনের খুশির রেখাটুকু। নারায়ণ সান্যাল
বর্ণিত এই ঘটনাপ্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় Tanushree Podder-এর ‘Nur
jahan’s Daughter’ উপন্যাসে লাডলী এক তরুণ শিল্পী ইমরানকে
ভালোবেসেছিল কিন্তু নুরজাহান তাকে গোপনে হত্যা করে এবং জীবনের শেষ মুহূর্তে এই
হত্যার কথা নুরজাহান লাডলীর কাছে স্বীকার করেছে, ‘‘Yes, Imraan. I could
never have allowed you to wed a commoner Laadli,’ Meherunnisa said agitatedly.
‘I... did you know that I had him killed?’’
(৬)
শাহরিয়ারের সঙ্গে বিবাহের আগে
নুরজাহান লাডলীর বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন খসরৌর সঙ্গে। খসরৌ বা খসরু
জাহাঙ্গীরের বড় ছেলে। বাদশাহ আকবরের বিশ্বস্ত অনেক আমীর-ওমরাহ লক্ষ্য করেছিলেন, ‘মহামতি আকবরের একাধিক গুণ বর্তেছে একজমানা ডিঙিয়ে খস্রৌর চরিত্রে।’
অপরদিকে সেলিম ছিলেন মদ্যপ, ইন্দ্রিয়াসক্ত। তাই খসরৌর
জনপ্রিয়তা ছিল তাঁর বাবার থেকে অনেক বেশি। আকবরের মৃত্যুর পর তাই অনেকে উদারচেতা
খসরৌকে সিংহাসনে বসাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু খসরৌর বিপক্ষে যা সবচেয়ে বেশি কাজ করেছিল
তা হল বাদশাহ আকবরের শেষ ইচ্ছা, তিনি নিজের ছেলে সেলিমকেই
পরবর্তী বাদশাহ হিসাবে নির্বাচন করেছিলেন। তাই খসরৌ ও জাহাঙ্গীরের যুদ্ধে
জাহাঙ্গীরের সমগ্র মোগল বাহিনীর কাছে খসরৌর মাত্র দশহাজার সৈন্য খুব সহজেই পরাজিত
হয়েছিল। এরপরই শুরু হয়েছিল অপরিসীম নৃশংসতা। শাহজাদা খসরৌ বন্দী হলেন। খসরৌর দুই
সেনাপতি আবদুর ও হুসেন বেগেকে যে শাস্তি দেওয়া হল তা প্রায় নজিরহীন বীভৎসতার
উদাহরণ, ‘একটা মৃত ষাঁড়ের গোটা চামড়া খুলে নিয়ে তার মধ্যে
হুসেন বেগকে জোর করে ঢুকিয়ে চারিদিক বেশ শক্ত করে সেলাই দেওয়া হল। আবদুরকে ঢুকিয়ে
দেওয়া হল একটি গাধার খোলসের মধ্যে।...সেই অবস্থায় শোভাযাত্রা করে দুজনকে লাহোরের
রাস্তায় ঘোরানো হল।’ খসরৌর সাতশো অনুচরকে রাস্তার দুপাশে পোঁতা সাতশো শূলে বিদ্ধ
করা হয়েছিল। আর সেই রক্তরাঙা রাস্তায় খসরৌকে নিয়ে আসা হয়েছিল এইসব বীভৎস দৃশ্য
দেখানোর জন্য। এরপর আমীর-ওমরাহদের অনুরোধে খসরৌকে প্রাণে মারা না হলেও, তপ্ত লৌহশলাকা চোখে বিদ্ধ করে
তাঁকে অন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। খসরৌ হয়তো সেদিন সত্যিই চিন্তা করেছিল, ‘কেন খোদাতালা সাতটা দিন আগে অন্ধ হবার সুযোগ তাঁকে দেননি!’
জাহাঙ্গীর হয়তো সিংহাসনে বসে
নিজের যৌবনকাল অর্থাৎ শাহজাদা সেলিমকে ভুলে গিয়েছিলেন, ভুলে গিয়েছিলেন পিতা আকবরের বিরুদ্ধে নিজের বিদ্রোহ। যুদ্ধে সেলিম আকবরের
কাছে পরাজয় স্বীকার করলে আকবর ‘হিড় হিড় করে ওকে টেনে নিয়ে গেলেন গোসলখানায়। একজন
হাকিম, একজন নাপিত ও একজন খিদ্মদগারের জিম্মায় ঐ ঘরে আবদ্ধ
করলেন শাহজাদাকে। বিশ্বস্ত প্রহরীকে ডেকে বললেন, দশ দিন
কারাগার! এর মধ্যে কারও সঙ্গে যেন দেখাসাক্ষাৎ করতে না পারে।...এই দেউড়ির ভিতর
একফোঁটা মদ অথবা এক দানা আফিং ঢুকেছে খবর পেলে তোমাদের তিনজনকেই হাতির পায়ের তলায়
পিষে ফেলব।’ দুটি বিদ্রোহ প্রায় একই রকম, কিন্তু শাস্তিদুটির
মধ্যে কি ভীষণ বৈপরীত্য! একটা ক্ষমতাবানের ক্ষমতাহীনের প্রতি অত্যাচার, আর একটা পিতার নিজের সন্তানকে শাসন।
লাডলীকে বিবাহ করার প্রস্তাব
প্রত্যাখ্যান করেছিল খসরৌ কারণ, ‘‘খসরৌ ‘একপত্নিত্বে বিশ্বাসী’’
ইতিহাসও এই তথ্য সমর্থন করছে, ‘…Khusrau refused his stepmother Nurjahan’s
proposal to marry her daughter Ladli Begum…he could have easily chosen a life
of luxury and perhaps become the Emperor of India. However, he refused that
respecting the faithful affection and companionship of his wife.’
‘লাডলী বেগম’ উপন্যাসটি পড়ে জানা যায় লাডলী এই সময় এই মহৎ মানুষটির সংস্পর্শে
এসেছিল। শত দুঃখের মধ্যেও চরম সৌভাগ্যবানের মতো খুশি থাকেন তিনি। অন্ধ হলেও
পৃথিবীর কোনো রূপ, রস, গন্ধের একটুও
তিনি উপভোগ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন না। তাই লাডলীর মনে হয়েছিল, ‘এই আগ্রা কিল্লার পঙ্ককুণ্ডেও নজর করলে দেখতে পাবে সহস্রদল মেলা পদ্মফুল।
তবে ঐ! চক্ষুষ্মান হওয়া চাই।...দেখতে পাবে- শাহ্জাদা খস্রৌর মতো চক্ষুষ্মান
হলে!’
আগ্রায় আসার পর থেকে লাডলীর
কাছে সবচেয়ে খুশির দিনগুলির মধ্যে অন্যতম হল খসরৌর পরিবারের সঙ্গে কাটানো একটা
দিন। এইদিন লাডলী দেখেছিল দুটি অদ্ভুত জিনিস একটি খেলা ‘লুডুস’, যা ঠিক বর্তমানকালের লুডোরই প্রাথমিক অবস্থা। আর দেখেছিল একটা
‘বিচিত্র-দর্শন’ যন্ত্র, যার নাম ঘড়ি। বর্তমান সময়ে এই
বস্তুদুটি খুবই স্বাভাবিক হলেও পঞ্চদশ শতকে এই বস্তুগুলি খুবই অসাধারণ। এই দুটি
বস্তু স্যার টমাস রো উপহার স্বরূপ খসরৌকে দিয়েছিলেন বলে ‘লাডলী বেগম’ উপন্যাসে
উল্লেখ পাওয়া যায়। বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থ থেকেও জানা যায় স্যার টমাস রো
জাহাঙ্গীরের শাসনকালে ভারতবর্ষে এসেছিলেন ভারতে বাণিজ্যসংক্রান্ত কিছু সুবিধালাভের
জন্য। এইসময় তিনি মোগলসম্রাটকে ইংরেজ দূত টমাস রো দিতেন বিচিত্র ধরণের নানা উপহার।
ফলে নারায়ণ সান্যাল বর্ণিত খসরৌকে স্যার টমাোর রো-এর ওই দুটি উপহার দেওয়ার ঘটনা
যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত ও ইতিহাসাশ্রয়ী।
নারায়ণ সান্যাল সৃষ্ট লাডলী
বেগম এই খসরৌর মধ্যে যেন নিজের হারানো
বাবাকে খুঁজে পেয়েছে, তাই লাডলী মীনা-বহিনকে বলেছে, ‘আজ সারাটি দিন মনে হচ্ছিল আমি যেন সেই ছোট্টটি হয়ে গেছি। আর আমার আব্বাজান
যেন তেমনটিই আছেন! শাহ্জাদা খস্রৌর ভিতর আজ আমি খুঁজে পেয়েছি আমার হারানো বাপ্কে।’
এই খসরৌ নিজের ভাই শাহজাহানের দাক্ষিণাত্য বিজয়ে সঙ্গী হয়েছিলেন সরল
বিশ্বাসে। তাঁকে যে একটা গভীর ষড়যন্ত্র সফল করার করার জন্য আনা হয়েছে তা তিনি
বুঝতেই পারেন নি। কিছুদিন বাদে বুরহানপুর কেল্লা থেকে খবর এসেছিল খসরৌ মারা গেছেন
অম্লশূলের ব্যথায়। কিন্তু ইতিহাস বলে খসরৌ সেদিন খুন হয়েছিলেন শাহজাহানের ক্রীতদাস
আলি রেজ্জার হাতে, নারায়ণ সান্যাল সেই মতকে সমর্থন করে
লিখেছেন, ‘‘ক্রীতদাস আলি রেজ্জা। দানবাকৃতি এক নিষ্ঠুর
হত্যাকারী।...পেশীবহুল দুটি থাবা অতর্কিতে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরল শাহ্জাদার
কণ্ঠনালী।...মিনিট তিনেকের মধ্যে হয়ে গেল শেষ। সম্রাট জাহাঙ্গীরের জ্যেষ্ঠপুত্র
খস্রৌ লুটিয়ে পড়লেন পাষাণ চত্বরে।...চরিত্রবান, বিজ্ঞ,
সর্বজনস্নেহধন্য মহান খস্রৌ ‘অম্লশূলে’র আক্রমনে প্রাণত্যাগ
করলেন।’’ খসরৌর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে লাডলী যেন দ্বিতীয়বার পিতৃহারা হয়েছে।
(৭)
লাডলীর বিবাহ হয়েছিল শাহজাদা শাহরিয়ারের সঙ্গে।
লাডলীর দাম্পত্যজীবন সম্পর্কে ইতিহাস নীরব। লাডলীর স্বামী শাহরিয়ারের সম্পর্কেও
ইতিহাস গ্রন্থগুলি থেকে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। নারায়ণ সান্যাল শাহরিয়ারের
বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘শাহ্জাদা শাহ্রিয়ার! ষোল বছরের বালক।
জড়ভরত। বাঁ-হাতটা পঙ্গু।...কথায় জড়তা আছে; মুখ দিয়ে ক্রমাগত
লালা ঝরে।’তিনি পঙ্গু ছিলেন কিনা এই বিষয়টি না জানা গেলেও বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থ
থেকে জানা যায় শাহরিয়ারের একটি বিরল রোগের কথা, ‘…Shahryar had been seized
by a strange illness. The once handsome prince had lost his luxuriant crop of
hair. Even the neatly trimmed beard and eyelashes had fallen out in bunches.
The skin had turned a weird white, with prominent red patches in some places.
তা সত্ত্বেও নারায়ণ সান্যাল
লাডলীর দাম্পত্য জীবন এঁকেছেন লাডলীর ‘নিরবিচ্ছিন্ন ব্যর্থতার জীবনে এক বিন্দু
সাফল্য’ হিসাবে। লাডলী পেয়েছিল মাতৃত্বের স্বাদ। শাহরিয়ার ও লাডলীর কোল জুড়ে
এসেছিল এক কন্যাসন্তান। যে শাহরিয়ার পৃথিবীর কাছে ছিল ‘ন-সুদনী’, ‘অপদার্থ’, ‘হতভাগ্য’, লাডলীর
সান্নিধ্যে এসে সেই শাহরিয়ার খুঁজে পেয়েছিল আত্মবিশ্বাস। ১৬২৮ সালের ১৯-এ জানুয়ারী
শাহাজাহানের রাজ্যাভিষেক হয়। তার পরদিনই জাহাঙ্গীরের বংশের প্রায় সকল পুরুষকে
হত্যার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়। পঞ্চাশোর্ধ্বা, স্থিরযৌবনা,
ক্ষমতাহীন, সদ্যবিধবা নুরজাহান শাহজাহানের
অনুচর পার্স্ত খাঁ-এর কাছে নিজের জামাইয়ের প্রাণভিক্ষা চায়, ‘শাহ্রিয়ারকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই! সে কোনোদিন বিদ্রোহ করবে না! সে তো
জড়ভরত। একটা...একটা অবোধ পশু...’ কিন্তু শাহরিয়ার আর নিজেকে ‘জড়ভরত’ বা ‘জানবার’
মনে করল না। সে একজন মানুষ, ঠিক আর পাঁচজন মানুষের মতোই।
মৃত্যুকে সদর্পে আলিঙ্গন করে শাহরিয়ার বুঝিয়ে দিয়েছিল, ‘লাডলী
বেগমের স্বামী ‘ন-সুদনি’ ছিল না।’
(৮)
লাডলী বেগমের চরিত্রটিতে নারায়ণ সান্যাল দিয়েছেন
কোমল হৃদয় আর অদ্ভুত ক্ষমাশীলতা, অপরিসীম সহ্যশক্তি। সে প্রায়
সারাজীবন হারেমের এক কোণে নিতান্ত অনাদৃতভাবে কাটিয়ে দিয়েছে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
তাঁর ‘নূরজাহান’ নাটকে পার্শ্বচরিত্র হিসাবে নুরজাহানের মেয়ের চরিত্রটি নিয়ে
এসেছেন। নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল নুরজাহানের মেয়ের নাম দিয়েছেন লয়লা, যদিও ইতিহাস অনুযায়ী নুরজাহানের মেয়ের নাম লাডলী। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লয়লা
চরিত্রটিকে অনেক প্রতিবাদী করে গড়ে তুলেছেন। যখন নুরজাহান জাহাঙ্গীরকে বিবাহ
করেছেন তখন লয়লা নিজের মাকে তিরস্কার করে বলেছে, ‘...বীভৎস
ব্যাভিচার!...আমার মা সাম্রাজ্যের লোভে বিবাহ করেছেন তাঁর পতিহন্তাকে! যখন সেই
জল্লাদ এসে তোমায় হাতে ধ’রে প্রেয়সী ব’লে ডাকে, তখন বল্বো
কি মা- আমার সর্ব্বাঙ্গে বৃশ্চিক দংশনের জ্বালা হয়!’ দ্বিজেন্দ্রলাল রায় খসরৌর
মৃত্যুর জন্য নুরজাহানকে দায়ী করেছিলেন। আর দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লয়লা রাজদরবারে
সবার সামনে নিজের মা কে খসরৌকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করেছে, ‘আমি এই প্রকাশ্য দরবারে তোমাকে কুমার খসরুর হত্যার জন্য অভিযোগ করি। সাধ্য
হয় ত অস্বীকার কর।’ দ্বিজেন্দ্রলালের লয়লা অনেক ব্যক্তিত্বময়ী কিন্তু নারায়ণ
সান্যালের অন্তরালবাসিনী, মুখচোরা লাডলীকে অনেক বেশি বাস্তব
বলে মনে হয়।
(৯)
শাহরিয়ারের মৃত্যুর পর লাডলীর
জীবন কেটেছে ‘প্রাক্তন’ নুরজাহানের সান্নিধ্যে। জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর ‘জগতের
আলো’ নুরজাহান হারেমের এক কোণে উপেক্ষিতার মতো পড়ে থাকতেন। দাসী, বাঁদী যারা আছে তারা আর যত্ন করেনা আগের মতো। ‘সন্ধ্যায় চিরাগ জ্বালাতে
মাঝে মাঝে ভুল হয়ে খিদ্মৎগারের। তখন দেখা যায় পাষাণ অলিন্দে এক বৃদ্ধা মেহেজবীন
তসবির-ছড়া হাতে নিয়ে নতনেত্রে পায়চারি করেন। মাঝে মাঝে তাঁর হাঁক শোনা যায়: কোই
হ্যায়? নূর-মহলের আর্ক-ব্রুতবে প্রতিধ্বনিত হয়ে শব্দটা ফিরে
আসছে: হায়!...হায়!’ ক্ষমতা হারিয়ে
নুরজাহানের সমস্ত জীবনটাই যেন খালি হয়ে গেছে। আগ্রা মহলে যার এককালে এত
প্রতিপত্তি ছিল সেই নুরজাহান সেই একই জায়গায় এমন লাঞ্ছনা সহ্য করতে না পেরে আগ্রা
ছেড়ে মেয়ে লাডলী, নাতনী ফিরোজা (ইতিহাস অনুযায়ী আর্জানি
বেগম) ও মীনাবহিনকে নিয়ে পাঞ্জাবের রাভী নদীর তীরে শাহদারার উদ্দেশ্যে যাত্রা
করেন। এখানেই নুরজাহান নিজের স্ত্রীধন দিয়ে তৈরি করছিলেন নিজের স্বামী জাহাঙ্গীরের
জন্য সমাধিসৌধ। রাভী নদীর তীরে একটি কুটিরে থাকে এককালের ভারতসম্রাজ্ঞী নুরজাহান।
এখানে নারায়ণ সান্যাল দেখিয়েছেন লাডলীর মেয়ে ফিরোজার সঙ্গে জাহাঙ্গীরের সমাধিসৌধের
তরুণ কারিগর ইসমাইলের সঙ্গে একটা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বহুদিন আগে যেমন
লাডলীকে রুস্তম বলেছিল, তেমন করেই ফিরজাকে ইসমাইল বলেছে,
‘তুমি তোমার মায়ের চেয়েও সুন্দর।’আসলে রূপ তো কেবল কোনো মানুষের
বহিরঙ্গের সৌন্দর্যেই থাকে না, ‘আধখানা যে গচ্ছিত থাকে
রূপদর্শীর চোখের তারায়।’ জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর ক্ষমতাহারা নিভৃতবাসী নুরজাহানের
মনে যে একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে তা বোঝা যায় যখন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নুরজাহান
নিজের নাতনির সঙ্গে এক সাধারণ শিল্পীর বিবাহ দেন। একদিন এই নুরজাহানই নিজের মেয়েকে
রুস্তমের মতো সাধারণ সৈনিকের সঙ্গে বিয়ে দেবেন না বলে রুস্তমকে হত্যা করেন।
জাহাঙ্গীরের সমাধি তৈরির কাজ
সমাপ্ত হলে আগ্রায় পত্র লিখে জাহাঙ্গীরের মৃতদেহযুক্ত কফিনটি শাহদারায়
স্থানান্তরিত করার অনুমতি চাওয়া হল। আগ্রা থেকে উত্তর এলো ‘একমাত্র ঐ শর্তেই শাহ্জাঁহা
অনুমতি দেবে- তার পিতার মৃতদেহ আগ্রা থেকে এই পাঞ্জাবে স্থানান্তরিত করতে। যদি তার
চক্ষুশূল বিমাতা স্বীকৃতা হয়- জাহাঙ্গীরের পাশের কবরটি শাহ্জাঁহার গর্ভধারিণীকে
ছেড়ে দিতে।’ এই প্রস্তাব শুনে লাডলী জাহাঙ্গীরের সমাধি চত্বরেই নিজের স্ত্রীধন
দিয়ে মায়ের জন্য, নিজের জন্য ও নিজের স্বামী শাহরিয়ারের জন্য
তিনটি নিতান্ত অনাড়ম্বর তিনটি সমাধিসৌধ তৈরি করায়। দুটি পাশাপাশি কবর মা ও মেয়ের
আর একটু দূরের কবরটা জামাই শাহরিয়ারের। যে মা লাডলীর সারাজীবন ঘিরে ছিল, ‘যেন বিচিত্রবর্ণা দুর্লভ একটি বামাবর্ত শঙ্খ! ঘিরে আছে একটা ধুক্পুক
প্রাণকে।’ যার অঙ্গুলিহেলনে লাডলীর ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়েছে, মৃত্যুর পরেও কি তাঁকে ছেড়ে থাকতে পারবে
লাডলী? তাই পাশাপাশি দুটি কবরে মা নিজের মেয়েকে জড়িয়ে
ধরে শুয়ে থাকবে অনন্তকাল। সেই জোড়া কবরের গায়ে উৎকীর্ণ করা আছে কবি নুরজাহান রচিত
একটি ফারসি বায়েত যা তাঁর বেদনা-বিধুর হৃদয়ের একান্ত আর্তির মতো ফুটে উঠেছে। দরদী
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত সেই বায়েতটির অনুবাদ করেছেন এইরকম,
‘গরীব-গোরে দীপ জ্বেল
না, দিও না কেউ ফুল ভুলে।
শ্যামাপোকার না পোড়ে পাখ, দাগা না পায় বুলবুলে।।’
সত্যিই ধীরে ধীরে সবাই ভুলে
গেছে নিতান্ত অনাদৃত কবরে শুয়ে থাকা জাহাঙ্গীরের প্রিয়তমা পত্নী ভুবনমোহিনী
নুরজাহানের কথা। বুহুবছর পর দিল্লীশ্বরী নুরজাহানের অবহেলিত কবরের দিকে তাকিয়ে কবি
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন ‘কবর-ই-নূরজাহান্’ কবিতাটি,
‘সত্যি তোমার কবরে আর
দীপ জ্বলে না, নূরজাহান্।
সত্যি কাঁটার জঙ্গলে আজ
পুষ্পলতার লুপ্ত প্রাণ।
নিঃস্ব তুমি নিরাভরণ ধূসর
ধুলির অঙ্কেতে,
অবহেলার গুহার তলায় ডুবছ
কালের সঙ্কেতে।
ডুবছে তোমার অস্থিমাত্র-
স্মৃতি তোমার ডুববে না,
রূপের স্বর্গে চিরনূতন রূপটি
তোমার যায় চেনা।’
এখনও শ্রেষ্ঠ ছয়জন
মোগলসম্রাটের সঙ্গে সম্রাজ্ঞী হিসাবে নাম উল্লেখ করা হয় সুন্দরীশ্রেষ্ঠা নুরজাহানের। আর লাডলী? তার আত্মজীবনী তো শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু তার একেবারে
শেষ ট্র্যাজেডিটা বাকি ছিল। নিজের মৃত্যুর
পর লাডলী নিজের মায়ের পাশের কবরটায় শুয়ে থাকতে চেয়েছিল, কিন্তু
বিধাতা এই হতভাগ্য মহিলার শেষ আশাটুকু পূরণ করলেন না। লাডলীর মৃত্যুর পর ঔরঙ্গজেবের আমীর-ওমরাহরা নিজেদের
বিবেচনামত নুরজাহানের মেয়েকে শুইয়ে দিয়েছিলেন তার দাদামশাই-দিদিমার কাছে অর্থাৎ
মির্জা গিয়াস বেগ ও আসমত বেগমের কাছে আগ্রার ইতমদ্উদ্দৌল্লায়। ‘সেটাই লাডলীর
জীবনে ‘আখেরি আঁসু’- সান্ত্বনা এটুকুই যে, সে কথাও হতভাগিনী
জেনে যায়নি।’
‘লাডলী বেগম’ উপন্যাসে
লাডলীর জীবনের একটা সামগ্রিক চিত্র অঙ্কন করেছিলেন নারায়ণ সান্যাল। কল্পনা,
ইতিহাস মিলিয়ে মিশিয়ে উপন্যাসের সব চরিত্রগুলিকে রক্ত-মাংসের মানুষ
হিসাবে গড়ে তুলেছেন। যে লাডলীকে সবাই তুচ্ছ বলে অবজ্ঞা করেছিল, এমনকি ইতিহাসও যার খবর রাখেনি অথচ যে জীবনে বারবার মহানতার নিদর্শন দিয়ে
গেছে সেই লাডলী এই উপন্যাসের নায়িকা। ঊর্মিলা যেমন বাল্মীকির রামায়ণে উপেক্ষিতা,
পত্রলেখা যেমন ‘কাদম্বরী’ কাব্যে উপেক্ষিতা লাডলী বেগম তেমন মোগল
ইতিহাসে উপেক্ষিতা। নারায়ণ সান্যালের ‘লাডলী বেগম’ উপন্যাসে এই উপেক্ষিতা লাডলীকে
করে তুলেছেন চির জাজ্বল্যমান নক্ষত্রের মতো।
তথ্যসূত্র
আকর গ্রন্থ:
১) নারায়ণ সান্যাল। ‘লাডলী
বেগম’। ৩য় সং। কলকাতা,
দে’জ পাবলিশিং, জানুয়ারী
২০০৫।
সহায়ক গ্রন্থ:
১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
‘রবীন্দ্র-রচনাবলী’(পঞ্চম খণ্ড)। ২য় সং। কলকাতা, বিশ্বভারতী, আষাঢ় ১৩৬২।
২) নারায়ণ সান্যাল।
‘অনির্বচনীয়া’। ৫ম সং। কলকাতা, দে’জ পাবলিশিং, সেপ্টেম্বর ২০২০।
৩) সুকন্যা। ‘নুরজাহান’। ১ম
সং। কলকাতা, করুণা
প্রকাশনী, আশ্বিন
১৩৩৭।
৪) দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। ‘দ্বিজেন্দ্র রচনাবলী’
(দ্বিতীয় খণ্ড)। ৭ম সং। কলকাতা, সাহিত্য সংসদ, এপ্রিল ২০১৭।
৫) শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ‘কপালকুণ্ডলা’।
কলকাতা, নুতন
সংস্কৃত যন্ত্র, ১৯২৩।
৬) শ্রীপান্থ। ‘হারেম’। ২য়
সং। কলকাতা, দে’জ
পাবলিশিং, মে
১৯৯৯।
৭) নারায়ণ সান্যাল। ‘লা-জবাব
দেহ্লী অপরূপা আগ্রা’। ২য় সং। কলকাতা, অজন্তা প্রিন্টার্স, আগস্ট
১৯৮৫।
৮) অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়।
‘রবীন্দ্রানুসারী কবিসমাজ’। ১ম সং। কলকাতা, এ, মুখার্জী অ্যাণ্ড কোং প্রাঃ লিঃ, অগ্রহায়ণ
১৩৬৬।
৯) Podder, Tanushree. ‘Escape from
Harem’. First Edition, New Delhi, Roli
Books Pvt Ltd, 2013.
১০) Anand, Sugam. ‘History of Begum
Nurjahan’. NEW DELHI, RADHA PUBLICATIONS, 1992.
১১) Podder, Tanushree. ‘NUR JAHAN’S
DAUGHTER’. Third Edition, New Delhi,
Rupa Publications India Pvt. Ltd, 2011.
পত্রিকা:
১) Dubey, Mahesh Chandra & Rawat, Sugandha. ‘TWO TRAGIC LIVES REVISISTED: KHUSRAU MIRZA AND LADLI BEGUM’. Review of Research, May 2019
| বর্ষ বরণ সংখ্যা-১৪২৯ | aleekpata.com | 29th Edition |
| ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Bengali New Year, 2022 | April-June 2022 | Fifth Year Third Issue |
| © All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |
| a DISHA-The Dreamer Initiative |