অলীক পাতার অন্যান্য সংখ্যা- পড়তে হলে ক্লিক করুন Library ট্যাব টি



। । "অলীক পাতা শারদ সংখ্যা ১৪৩১ আসছে এই মহালয়াতে। । লেখা পাঠানোর শেষ তারিখ ১৫ ই আগস্ট রাত ১২ টা ।.."বিশদে জানতে ক্লিক করুন " Notice Board ট্যাব টিতে"

Showing posts with label নব বরষে নবীন হরষে. Show all posts
Showing posts with label নব বরষে নবীন হরষে. Show all posts

Sunday, May 8, 2022

গল্প-শিহরণ - শেষ সংকেত- অভীক সাধু

  গল্প-শিহরণ

শেষ সংকেত

অভীক সাধু

Illustration: Swarup Chakraborty
 

আনিশার সাথে রাজেশের অল্প কিছুদিন হলো বিয়ে হয়েছে, জামশেদপুরের মেয়ে আনিশা, বিয়ের পর স্বামীর সাথে কিষাণগঞ্জে চলে আসে। আনিশা জানে তার স্বামী জৈন ট্রান্সপোর্টের একজন সিনিয়ার একাউন্ট্যান্ট, কারণ সম্বন্ধ হবার সময়রাজেশের জীবিকা সম্পর্কে রাজেশের পরিবার আনিশার পরিবারকে সেটাই বলেছিলোআসলে এটা রাজেশের পরিবারও জানতো না যে ট্রান্সপোর্টে কোম্পানির আড়ালে জৈন কোম্পানির আসল ব্যবসা হলো স্মাগলিং! কিষাণগঞ্জ ভারত নেপাল বর্ডারের কাছে হওয়ার জন্য জায়গাটা স্মাগলারদের বেসক্যাম্প ...

 

রাজেশ মাঝে মধ্যেই দুতিনরাত থাকে না,আসলে সে স্মাগলিং গুডস পাচার করতে যায় কিন্তু আনিশাকে বলে যায় কাজে যাচ্ছে, তাকে নাকি ক্লায়েন্টদের হিসাবপত্রের কাজও দেখতে হয়, আনিশা বলে -” তুমি তো জৈনদের কোম্পানিতে একাউন্টসে কাজ করো তাহলে তোমাকে অন্য লোক সে ক্লায়েন্ট হোক বা যেই হোক তাদের হিসাবপত্র দেখতে হবে কেন ?” রাজেশ উত্তর দেয় -”দেখো এটা তো কোনো বড়ো শহর নয় যে কাজের জন্য তুমি লোক চাই বলে হাঁক পাড়লেআর লোক পেয়ে গেলে ! এখানে কাজের লোক পাওয়াই যায় নাতাই আমি ক্লায়েন্টদের কিছু কাজ করে দি আর এতে পয়সাও পাওয়া যায়। এটা সত্যি; আনিশা দেখেছে ছোট শহরে থাকলেও তাদের অভাব তেমন নেই, ডাবল ডোর রেফ্রিজারেটরএ.সি টিভি সবই আছে। বাড়িটার বাইরে থেকে দেখে অবশ্য বোঝা যায় না যে তার মধ্যেকার  বাসিন্দাদের আধুনিক জীবনযাপনের সব উপাদানই মজুত ! তবু আনিশা রাজেশকে অনুযোগ করে যে প্রতি মাসেই অন্তত দুবার দুতিন দিন করে রাজেশের এই বাইরে কাটানো তার মোটেই ভালো লাগে না। রাজেশ হেসে বলে টাকা না থাকলে প্রেম ট্রেম উড়ে যাবে !

 

কিষাণগঞ্জে ঠান্ডা ভালোই পড়েসেবার দিওয়ালির পরেই বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। পুজো আর দিওয়ালি আনিশার সাথে কাটিয়ে রাজেশ তার কাজে বেড়িয়ে যায়, এইবার অবশ্য বাইরে যাবার জন্য রাজেশের অনিশাকে বেশি মানাতে হয়নি কারণ প্রথমতঃলম্বা ছুটিতে রাজেশ তাকে নিয়ে কার্শিয়াং বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলো, ঘোরাটা সত্যিই খুব আনন্দদায়ক ছিল আনিশার কাছে - কেননা এই ভ্রমণ তার কাছে ছিল একঝলক টাটকা বাতাসের মতোযা তার রোজকার একঘেয়েমির থেকে তাকে মুক্তির স্বাদ দিয়েছিলো। বেড়িয়ে ফেরার পথে পুরো একসপ্তাহ রাজেশ ছিল আনিশার বাড়িতেদিওয়ালি এবার তারা জামশেদপুরেই উদযাপন করে, তাই রাজেশের তথাকথিত ক্লায়েন্টের কাজে যাবার কথা শুনে আনিশা খালি বলেছিলোএবার একটু তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করো। রাজেশ তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বলে -” সুন্দরী বৌকে ফেলে ক্লায়েন্টের কাছে যাবার যে কি কষ্ট তা যদি বুঝতে ! কিন্তু সবই পেটের দায় !” আনিশা কপট রাগ দেখিয়ে বলে -”থাক থাকআর আদিখ্যেতা করতে হবে না !”

 

একদিন দুদিন করে  এবার  সাতদিন কেটে গেলো, কিন্তু রাজেশের ফেরার নামই নেই। প্রথম কয়েকদিন যদিও বা রাজেশের সাথে আনিশার মোবাইলে কথা হয়েছিল শেষ দুদিন থেকে রাজেশের মোবাইলে নট রিচেবল আসছে, এবার আনিশা সত্যিই খুব চিন্তিত হয়ে পড়লো, শেষ যেদিন তার সাথে রাজেশের কথা হয়রাজেশের গলার স্বরে উদ্বেগ লক্ষ্য করেছিল আনিশা। সে রাজেশকে জিজ্ঞেস করে তুমি কি কিছু নিয়ে চিন্তায় আছো রাজেশ “ও কিছু না “-বলে এড়িয়ে যায়। এই শহরে তার চেনা জানা বলতে কেউই প্রায় নেই, রাজেশ তাকে  কোনোদিন  নিজের অফিসের কোনো বন্ধুর সাথেও আলাপ করায় নি। তাই নিরুপায় হয়ে আনিশা গেলো তাদের বাড়িওয়ালির কাছে- বাড়িওয়ালি পুনামজী  বিধবা বৃদ্ধা, সারাদিন জপতপ পুজোআর্চা নিয়েই থাকেন, উনি বললেন –“দেখো বেটিরাজেশ মেরে মকান তুম আনেসে একমহিনে পেহেলে কিরায়া পে লিয়া থাআইডেন্টিটি কে লিয়ে রাজেশকা ভোটার কার্ড তো মেরে পাস হ্যায়লেকিন উসসে জ্যাদা মুঝে কুছ নেহি মালুম!”

এতটা বলে পুনামজী একটু থামলেন; তারপর বললেন –“কিষাণগঞ্জমে মেরা চালিস সাল হো গ্যয়া,কিষাণগঞ্জ পোলিশবালা হেল্পফুল হ্যায় - ম্যায়নে তো আজতক কাভি নেহি শুনি, লেকিন মেরে খেয়ালসেফিরভি কাল তুম একবার থানাসে ঘুমকে আও, পোলিশ কো তো ইনফর্ম করনা হি পড়েগা।

সেদিন বিকেল থেকেই খুব বৃষ্টিআর তার সঙ্গে ঝড়, সন্ধ্যে হলে কারেন্টও চলে গেলো। আনিশার ইনভার্টারটা পিঁপ পিঁপ করে দুবার আওয়াজ করে স্তব্ধ হয়ে গেলো। ও বুঝলো যে ব্যাটারিটা হয়তো গেছে। রাজেশ দিওয়ালির সময় একবার বলেছিলো ব্যাটারি চেঞ্জ করতে হবে, কিন্তু শেষ কদিন লোডশেডিং না হওয়াতে আর এইরকম মানসিক অবস্থাতে সে ব্যাটারি চেঞ্জ করার কথা সম্পূর্ণ ভুলে মেরে দিয়েছে, কি আর করা ! দিওয়ালির সময় কেনা পড়ে থাকা একটা ছোট মোমবাতি সে জ্বালালো - তাতে অবশ্য ঘরের অন্ধকার পুরোপুরি কাটেনি, হঠাৎ দরজাতে ধাক্কা ! আনিশা চেঁচিয়ে বলে -”কে?”

আমি রাজেশদরজা খোলো।

আনিশা খুলে দেখে রাজেশের একহাতে ছাতা ছাড়া কিছু নেই। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এতো বৃষ্টিতেও খালি একটা ছাতা থাকলেও রাজেশ ভেজে নি !

রাজেশ দ্রুত দরজা বন্ধ করে অনিশাকে একটা খাম দিয়ে বলে –“আমাকে আরেকবার অফিসে যেতে হবে।

আনিশা বললো -”এই দুর্যোগের রাতে কোথায় যাবে ?”

হটাৎ আনিশার মোবাইল বেজে উঠলো। সে মোবাইল রান্নাঘরে ফেলে এসেছিলো, রান্নাঘরে গিয়ে দ্রুত ফোন ধরে দেখে পার্সোনাল লোনের জন্য কল, বিরক্ত হয়ে ফোন রাখতে না রাখতেই কারেন্ট চলে এলো,বসার ঘরে এসে দেখে - দরজা হাট করে খোলা- রাজেশের চিহ্নমাত্র নেই ! সে বাইরে বেরিয়ে দেখে রাস্তা ফাঁকা। খামের মধ্যে একটা চিরকুট আরেকটা চিঠি। চিঠিতে লেখা আছে-“গিজারের মধ্যে একটা প্যাকেট আছেওটা নিয়ে এখান থেকে পালাও।” সে কিছু বুঝতে পারে না - তার মাথা কাজ করছে না যেন ! তবু সে গিজার খুলে দেখে ভালোভাবে প্যাক করা একটা ছোট বাক্স, বাক্সের মধ্যে সোনার বিস্কুট ! আনিশার বুক কাঁপতে থাকে - এসব কি চিরকুটে দেখে লেখা আছে -মনীশ - আর একটা  মোবাইল নম্বরসে ওইনম্বরে ফোন করে, কিন্তু যাকে আনিশা ফোন করেসে ফোন না ধরে লাইন কেটে দেয় ! তারপর একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসে তার মোবাইলে, সে ফোন ধরলে কোনো সম্বোধন না করে খুব দ্রুত একটা অচেনা কণ্ঠ বলতে থাকে –“ভাবি - আপনার সামনে বিপদ, তাড়াতাড়ি পালান - ওরা রাজেশকে মেরেছে আপনাকেও ছাড়বে না !”

আনিশা চেঁচিয়ে ওঠে –“কি যাতা বলছেন ?”

ওকে থামিয়ে দিয়ে লোকটি বলতে থাকে -” আমিও পালিয়ে বাঁচছি। আপনাকে বোধহয় রাজেশ কিছু বলেনি, আসলে আমরা একটা স্মাগলিং গ্যাঙের হয়ে কাজ করতাম। রাজেশ আর আমি সুস্থভাবে বাঁচতে চাইছিলাম,আমরা একজন পুলিশ অফিসারের সোর্স হিসাবে কাজ শুরু করেছিলাম- কিন্তু সর্ষের মধ্যেই তো ভূত থাকে, থানা থেকে কেউ সেটা আমাদের স্মাগলিং গ্যাঙের লিডারকে জানিয়ে দিয়েছিলো- তাই ওরা রাজেশকে শেষ করে দেয়,আমিও পালাচ্ছি আপনিও পালান।” বলে লাইনটা লোকটি কেটে দেয়।আনিশা হতভম্বের মতো মাটিতে বসে পড়ে, সে যেন কাঁদতেও ভুলে যায় ! তাহলে যে তাকে সাদা খামটা দিয়ে চলে গেলো - সে কে ছিল ?

| বর্ষ বরণ সংখ্যা-১৪২৯ | aleekpata.com | 29th Edition |

| ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |

| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |

| Bengali New Year, 2022 | April-June 2022 | Fifth Year Third Issue |

© All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |

| a DISHA-The Dreamer Initiative |


গল্প- বৈঠকি- শ্যামা- রথীন্দ্রনাথ রায়

 গল্প- বৈঠকি

শ্যামা

রথীন্দ্রনাথ রায়

 

Image Courtesy: Google Image Galley

শ্রাবণ মাসের থই থই নদী । সেই নদীতেই একা ডিঙি নিয়ে বাঁকের মুখে চলে যায় সে । সারারাত জাল পাতা থাকে । তা ‘মাছ পড়ে বৈকি  ? ট্যাঙরা, বোয়াল পাবদা, ভেটকি-আরো কতো কি? দুহাজার সালে যখন সারা রাজ্যে প্রলয়ঙ্করী বন্যা দেখা দেয়, ঠিক সে সময় ওর মা মারা যায় । তখন ওর বয়স মাত্র পাঁচ বছর । চারদিক থেকে তখন শুধুই মৃত্যুর খবর। ডাক্তার নেই, ওষুধ নেই  , পথ্য নেই-কিছু নেই । তখন ও কিন্তু কাঁদেনি জিনিসপত্রগুলোকে গুছিয়ে রাখতেই ব্যস্ত ছিল সেই। আবার যে  ওদের বাঁচতে হবে ।

সেই মেয়ে ওই শ্যামা। ভয়ডর বলতে নেই । বাড়ন্ত চেহারার সোমত্ত মেয়েকে নিয়ে পড়শিদের চিন্তা থাকলেও ওর ছিলনা। নদীর তীরে ধানক্ষেত না বলে ধানসিঁড়ি বলাই ভালো। কারণ ধানক্ষেতগুলো ধাপধাপে উঠে গেছে অর্জুনপুরের দিকে। এইরকম সবুজ মাঠে ছাগলের বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ফিরছিল শ্যামা। পড়ন্ত বিকেলের রাঙা রোদ ছড়িয়ে পড়েছে ওর অঙ্গপ্রত্যঙ্গে  হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। স্বরূপদাদা। বড়বাড়ির ছেলে। কলকাতায় থাকে। পড়াশোনা করে। কখনো কখনো গ্রামে আসে। স্বরূপদাদাকে সবাই ভালোবাসে। কতোবড়ো পাশ দিয়েছে। তবু একটুকু দেমাক নেই। যে কারোর প্রয়োজনে সাহায্য করে

-শ্যামা কোথায় গেছলি রে?

-মাঠে। তুমি কখন এয়েচ গো?

-এইতো সকালের দিকে । তোরা ভালো আছিস তো মা  ?

শ্যামা তাড়াতাড়ি চলে যেতে চায়   ও স্বরূপের সামনে দাঁড়াতে পারেনা । কেমন যেন  লজ্জা করে। সে লজ্জার প্রকৃতিটাও যেন কেমন  !

স্বরূপ একেবারে নদীর কিনারায় গিয়ে দাঁড়ায়। এখন ভরানদী। জল যেন উথালপাথাল করছে ।

শ্যামা উৎকণ্ঠার সঙ্গে বলে,  অতো কাছে যেওনি। এখন নদীতে খুব স্রোত

-তাই বুঝি!

হাসে স্বরূপ। শ্যামা ওর মুখের দিকে তাকায়। কিন্তু চোখের ওপর চোখ পড়তেই দৃষ্টিটা নামিয়ে নেয় । খুব চেনা মানুষ । তবু আজ ওকে অচেনা বলে মনে হয় ।

-জানিস, আমার এই গ্রামের পরিবেশ খুব ভালো লাগে এই নদী, গাছপালা, খোলা আকাশ , সবুজ ধানক্ষেত- সবকিছুর মধ্যেই একটা প্রাণের স্পর্শ আছে । কলকাতায় আমার মোটেও ভালো লাগেনা। চারদিকে শুধু কংক্রিটের জঙ্গল ।

শ্যামা অবাক বিষ্ময়ে ওর দিকে চেয়ে থাকে।

ঠিক এই সময়েই নদীর ওপার থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে আসে ।

সচকিত হয় শ্যামা। ওর সই চাঁপার কণ্ঠস্বর। নদীর ওপারে ঝাঁপানপুর গিয়েছিল ডাক্তার দেখাতে । ওর তিনদিন জ্বরৃ। দেরি না করে ছাগলছানাটাকে ছেড়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করে শ্যামা। কিছুটা দূরে ওর নৌকাটা ভিড়ানো ছিল। সেটা খুলে নিয়ে তরতর করে বৈঠা বেয়ে ওপারে চলে যায় ।

স্বরূপ নদীতীরের পাকুড় গাছটার নীচে বসে থাকে। বর্ষার ভরা নদী একটা গোঙানির মতো শব্দ করে বয়ে চলে। অনেকদিন এই নদীর কাছে এসে বসা হয়নি। তাই এই নদীটাকে বড্ড অচেনা বলে মনে হয়। মাথার ওপরে আকাশ ভাঙা মেঘ। কতক্ষণ এভাবে বসেছিল - সময়ের দিকে খেয়াল ছিলনা । হঠাৎ শ্যামার গলা শুনে চমকে ওঠে ।

-ঘর যাবা না ? এখনি বৃষ্টি হবে যি ।

-দেখেছিস, আমার এসব দিকে খেয়ালই ছিলনা। ভাগ্যিস তুই এলি!

-ভাগ্যিস আমি এলুম ! ঠাকুমাকে এবার সব বলে দেব ।

-কি বলবি ?

-এই তোমার কোনও দিকে মন থাকেনা। সবসময় উদাস হয়ে কিসব ভাবো!

-ওঃ এই কথা? তা বলিস ।

কথা বলতে না বলতেই ঝমঝম করে বৃষ্টি এল। পাকুড় গাছটার আড়ালে দাঁড়ালেও ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে ভিজতে হল ওদের ।

-দেখলেন তো, আমার জন্যি আপনাকে ভিজতে হল ।

-কিন্তু তোকেও তো ভিজতে হল ।

-সে হোক । আমার অভ্যেস আচে। এখন আপনার না কিছু হয় ?  মাথাটা মুছে নেন তো দেখি।

শ্যামা নিঃসঙ্কোচে ওর আঁচলটা এগিয়ে দিল।  স্বরূপ এই গ্রাম্য দেহাতি মেয়ের বিশ্বাস আর সারল্য দেখে আশ্চর্য না হয়ে পারেনা । কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি ধরে আসে । শ্যামা আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে নিয়ে বলল , চলুন এবার। বৃষ্টিতে ভিজলেন তো  ? ঠাকুমা এবার আপনাকে খুব বকবে ।

-ভিজলাম আর কৈ ? তুইতো আমায় আঁচল দিয়ে বৃষ্টি থেকে রক্ষা করলি ।

ওরা চলতে থাকে ।

কিছুদূর যেতেই ঘনজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ । চারদিকে ঝোপঝাড় আর নানা রকমের গাছপালা । ভবানী মন্দিরের কাছে আসতেই অন্ধকারটা ঘনিয়ে আসে । এখানে আসতেই পাগলা সন্ন্যাসীর কথা মনে পড়ে ।

পাগলা সন্ন্যাসীর গতিবিধি ও আচার আচরণের কোনও ঠিক ঠিকানা ছিলনা। সম্প্রতি তিনি মারা গেছেন। মারা গেলেও পাগলা সন্ন্যাসীর বিদেহী আত্মাকে ভবানী মায়ের সামনে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় গভীর রাতে কেউ কেউ দেখতে পায়। যদিও এটা গল্প। সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ থাকলেও আজ শরীরটা কেমন যেন শিউরে ওঠে। ভয়ের ব্যাপারটাকে সামলে নেওয়ার জন্য স্বরূপ বলে, শ্যামা তোর পাগলা সন্ন্যাসীর কথা মনে পড়ে  ?

-হ্যাঁ।

-ভয় করেনা  ?

‘না’। কিন্তু মুখে না বললেও বেশ ভয় পেয়ে যায় শ্যামা। স্বরূপের কাছে বেশ কিছুটা সরে এসে বলে, -তুমি না

- আমি কি?

‘জানিনা’। দাঁড়ায়না শ্যামা। প্রায়ান্ধকার জঙ্গলের মধ্য দিয়েই ছুটতে থাকে ।

স্বরূপ কিছু বুঝতে পারেনা। হঠাৎ কি এমন ঘটল যে শ্যামা এমন করে ছুটে চলে গেল ?

'দিনের জন্য বাড়ি এসেছে স্বরূপ। তাই ঠাকুমা গায়ত্রী দেবীর চিন্তার অন্ত নেই। কলকাতায় কি আর এখানকার মতো খাঁটি জিনিষ পাওয়া যায় ? শুধু ভেজাল আর ভেজাল। ভেটকি আর পাবদা নিয়ে এসেছে শ্যামা। স্বরূপের বেশ প্রিয়। কখন যেন কথা প্রসঙ্গে শ্যামাকে একথা বলেছিলেন, গায়ত্রী দেবী। শ্যামা সেকথা ভোলেনি ।

-ঠাকুমা, কোথায় তুমি?

ঘর থেকে বাইরে আসতেই শ্যামাকে দেখে আশ্চর্য হয় স্বরূপ। বলে, কি ব্যাপার ?

- তোমার ল্যেগে মাছ এনেছিলুম?

- কিন্তু রাঁধবে কে? বুড়ি ঠাকুমাকে কষ্ট দেওয়াটা কি ঠিক হবে ?

শ্যামা কিছু বলতে পারেনা । শাড়ির আঁচলটা খুঁটতে থাকে। কেমন যেন লজ্জা পায় । আর স্বরূপদাও যেন কেমন! কিচ্ছু বোঝেনা ।

পরদিন বিকেলে নদীর ধারে এসে বসেছিল স্বরূপ। কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। আকাশটা এখন পরিষ্কার হলেও গাছগাছালির মাথা থেকে তখনো বৃষ্টির রেখা মুছে যায়নি। তারই ওপরে সূর্যের কিরণ পড়ায় ওগুলো যেন মুক্তোর আকার ধারণ করেছে। আর নদীটাও যেন কিছুটা ফুলে উঠেছে । ছোট ছোট আবর্ত তৈরি এগিয়ে চলেছে সমুদ্রের সন্ধানে ।

-স্বরূপদাদা, তুমি এখেনে?

স্বরূপ পিছন ফিরতেই দেখে শ্যামা। তণ্বী, কিশোরী। কাঁখে আধ ভর্তি ঘাসের ঝুড়ি।

শ্যামা কাছে এসে ঘাসের ঝুড়িটা নামায়। ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলে, তুমি এখেনে আসো কেনে গো?

-কেন? এই নদী, গাছপালা-এসবকে ভালো লাগে বলেই।

-আর কাউকে ভালো লাগেনা?

-না।

শ্যামা আর বসেনা। ঘাসের ঝুড়িটা নিয়ে চলতে থাকে। ক্রমে গাছগাছালির মাঝে অদৃশ্য হয়ে যায়। স্বরূপ ক্রমশ ভাবনার গভীরে ডুবে যায়। শ্যামা হঠাৎ অন্য কাউকে ভালো লাগার কথা বলল কেন? তবে কি? না,না। তা কি করে হয়? কি বিরাট দূরত্ব ওদের মধ্যে! কিন্তু শ্যামার কণ্ঠটাকে যেন কিছতেই ভুলতে পারেনা। গাছগাছালির মধ্য থেকে, নদীর স্রোতের মধ্য থেকে শুধু যেন একটা কথাই ভেসে আসে-অন্য কাউকে ভালো না, অন্য কাউকে-

সন্ধ্যের দিকে বৃষ্টিটা ঘনিয়ে এল। একসময় মনে হয়েছিল বৃষ্টিটা বুঝি ছেড়ে যাবে। কিন্তু না। রাত যত বাড়তে থাকে, বৃষ্টিও বাড়তে থাকে। কলকাতায় বর্ষণমুখর শ্রাবণসন্ধ্যাকে উপভোগ করা যায়না। চারদিকের আধুনিকতার ছোঁয়ায় বৃষ্টির শব্দ সেখানে আবহ সৃষ্টি করতে পারেনা। ঝিঁঝিঁর একটানা ডাক, ভেকের গর্জন, বৃষ্টির রিমঝিম, ঝমঝম-এগুলো যেন এতকাল সাহিত্যের বিষয় ছিল। হঠাৎ সেগুলোকে উপলব্ধি করতে পেরে এক বিজাতীয় খুশিতে উদ্বেল হয়ে ওঠে তার মন। যেন এক অদ্ভুত ভালো লাগা ছড়িয়ে পড়েছে তার দেহে মনে। যদিও অবিরাম বর্ষণের মধ্যেও দুপুরের ভাবনাটা থেকেই গিয়েছিল। শ্যামা বুঝি তার মনের কোণে একটু হলেও জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু ঠাকুমা কিছুতেই মেনে নিতে পারবেনা। বাবা মার মৃত্যুর পর ঠাকুমা ছাড়া তার যে আর কেউ নেই। সেই ঠাকুরমাকে কাঁদিয়ে সে কখনো সুখী হতে পারবেনা। বড্ড অবুঝ মেয়েটা।

পরদিন সকালে বৃষ্টি ছেড়ে যেতেই আবার রোদ উঠল। বড্ড ভারাক্রান্ত মন ছিল অবুঝ মেয়েটার। সারারাত কেঁদেছে। দুচোখে অনেক বর্ষণ হয়েছে। মনকে বোঝাতে চেয়েও পারেনি। শুধু কেঁদেছে। এখন নদীতীরে এসে দাঁড়াল। এই নদীই তো তার সব। নদীর সঙ্গেই তার কথাবার্তা, সখ্যতা, ভালোমন্দের বিনিময় সবকিছু। উথালপাথাল বইছে নদী। আজ আর মাছ ধরতে যাওয়া যাবেনা। তাই চুপ করে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। প্রায় তীর ঘেঁষে একটা মাছ ধরা ডিঙি নৌকো এগিয়ে আসছিল। ওপারের শোভন মাঝির ছোট ছেলে রতন ছিল সেই নৌকোয়। হঠাৎ নৌকাটা পড়ল একটা দয়ের মাঝে। তীব্র ঘুর্ণি স্রোত সেখানে। ঘুরতে থাকল নৌকাটা। রতন পারলনা নৌকাটাকে ঠিক রাখতে। চিৎকার করল রতন, বাঁচাও । নৌকাটা ক্রমশ মাঝ নদীর দিকে চলে যেতে থাকল। অনেকেই জলের কাছে এসে কলরব শুরু করল। কিন্তু রতনকে সাহায্য করার জন্য কেউ জলে নামার সাহস দেখাতে পারলনা। উল্টে গেল নৌকাটা। গভীর জল থেকে সাঁতরে তীরে আসার চেষ্টা করেও ক্রমশ গভীর জলে চলে যেতে থাকল রতন। এতক্ষণ তীরে দাঁড়িয়ে দেখছিল শ্যামা। এবার আঁচলটাকে কোমরে জড়িয়ে পাশে পড়ে থাকা একটা দড়ি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে। ডাকাবুকো মেয়েটা লড়াই শুরু করল স্রোতের সঙ্গে। প্রায় মাঝনদীতে রতন একবার ডুবছিল আবার ভাসছিল। প্রাণপণে চেষ্টা করছিল নিজেকে ভাসিয়ে রাখতে। এবার ডুব সাঁতার দিল শ্যামা। সবাই মনে করল এবার বুঝি শ্যামাও জলের তোড়ে হারিয়ে যাবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে রতনের কাছে গিয়ে বলল, ধর এটা। রতন দড়ির একপ্রান্ত ধরে রইল। শ্যামা অপর প্রান্ত বেঁধে নিল নিজের কোমরে তারপর সে এক অবিশ্বাস্য লড়াইয়ের শেষে রতনকে ঘাটে এনে তুলল শ্যামড়। লোকেরা ধন্য ধন্য করল। বলল, সাহস আছে মেয়েটার। কিন্তু শ্যামা নিরুত্তর। চারদিকে খুঁজল শুধু একজনকেই। কিন্তু কোথাও তার দেখা পেলনা।

বাড়িতে বসেই ওদের কাজের লোক হারান কাকার কাছে ডাকাবুকো শ্যামার কথা শুনল স্বরূপ। মনে মনে খুশি হল। না, মেয়েটার সাহস আছে! সেদিন বিকেলে নদীতীরের সেই পাকুড়গাছটার নিচে এসে বসল সে। শ্যামা নিশ্চয় ওর সঙ্গে দেখা করতে আসবে। একটা গোলাপ এনেছে ওর জন্য। বেলা গড়িয়ে এল। বিদায় বেলার লাল সূর্যের কিরণ ছড়িয়ে পড়ল ভরা নদীর উথালি পাথালি ঢেউয়ের মাঝে। আশঙ্কা বাড়তে থাকল। তাহলে কি? ক্রমে অন্ধকার নেমে আসছিল দৃশ্যপটে। স্বরূপের চোখদুটোও জলে ঝাপসা হয়ে আসছিল। শ্রাবণী চতুর্দশীর চাঁদ উঠল আকাশে। ফিরে আসবে এমন সময় দেখে শ্যামা এগিয়ে আসছে ।

-তোর জন্য একটা গোলাপ এনেছি ।

-দাও ।

-আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারবিনা?

ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিল শ্যামা ।

দূরে কোনও গৃহস্থ বাড়িতে শাঁখ বেজে ওঠে ।

| বর্ষ বরণ সংখ্যা-১৪২৯ | aleekpata.com | 29th Edition |

| ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |

| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |

| Bengali New Year, 2022 | April-June 2022 | Fifth Year Third Issue |

© All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |

| a DISHA-The Dreamer Initiative |


Friday, May 6, 2022

গল্প- বৈঠকি- হুর - অলভ্য ঘোষ

 গল্প- বৈঠকি

হুর

অলভ্য ঘোষ

চিত্র ঋণ -গুগল ইমেজ গ্যালারী

 

কয়েক হাজার লোক জড়ো হয়েছে; সাদা সাদা টুপি পরা মাথা গুলো অনেক ওপর থেকে পাখির চোখে দেখলে মনে হবে জান্নাতে দুধের নহরলম্বা লম্বা বাঁশে বাঁধা নানা রঙের জরির ঝিল্লি দিয়ে সাজানো পতাকা গুলো যেন জান্নাতে ডালিমের গাছ।

 কিন্তু হুর কোথায়?সাদা ধবধবে ফর্সা;গোলাপের পাপড়ির মত গায়ের রং।

 তামাম মুসলমান জান্নাতে গিয়ে এই হুর পাবার জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে?

 এসব প্রশ্ন যারা করে নাস্তিক না হয় বিধর্মী ইসলাম বিরোধী। জাহান্নামেও এদের ঠাঁই হবে না। দোযখের আগুনে পুড়ে মরবে।

 মাহফিলে বেহেস্তে যেতে উপচে পড়া ভিড়ে একজনও জেনানা নেই। তারা বাইরে বের হবে কোন দুঃখে!তাদের বাইরে বেরোনো গুনা পরওয়ারদিগারের জিকিরে নামাজ, রোজা রাখুক; মশগুল থাকুক খানা পাকাতে ছেলে মেয়ে মানুষ করতে। তাতেই তাদের জান্নাত নসিব হবে।

 -জান্নাত দেখার পরই সঠিকভাবে বোঝা যাবে যে জান্নাত কত বিশাল এবং তার নেয়ামত কত অসংখ্য। আল্লাহ্‌ তা'আলা বলেন, “তুমি যখন দেখবে তখন দেখতে পাবে ভোগ বিলাসের নানান সামগ্রী আর এক বিশাল রাজ্য।” (সূরাহ আদ্‌-দাহ্‌রঃ ২০)”জান্নাতে একটি বৃক্ষের ছায়া এত লম্বা হবে যে কোন অশ্বারোহী ঐ ছায়ায় শত বছর পর্যন্ত চলতে পারবে। দুনিয়ার চেয়ে দশগুণ বড় জান্নাত! জান্নাতের অট্টালিকাসমূহ সোনা-রূপার ইট দিয়ে নির্মিত। তার গাঁথুনি হল সুগন্ধযুক্ত মেশক আম্বর। তার কংকর মোতি ও ইয়াকুতের। তার মাটি জাফরানের। যে ব্যক্তি সেখানে প্রবেশ করবে সে জীবন উপভোগ করবে, তার কোন কষ্ট হবে না। চিরকাল জীবিত থাকবে, মৃত্যু হবে না। জান্নাতিদের কাপড় কখনো পুরানো হবে না। আর তাদের যৌবন কখনো বিনষ্ট হবে না”। (তিরমিজী- কিতাবুল জান্নাহ) জান্নাতিদের প্রত্যেকের অট্টালিকায় তাঁবু থাকবে যেখানে হুরেরা অবস্থান করবে। আল্লাহ্‌ তা'আলা বলেন,”তাঁবুতে সুরক্ষিত থাকবে সুলোচনা সুন্দরীরা।” (আর রাহমান - ৭২)জান্নাতের প্রত্যেক জান্নাতির পছন্দমত সর্ব প্রকার ফলমূল মজুদ থাকবে। জান্নাতের ফলের ছড়া অনেক বড় হবে। জান্নাতের নদীসমূহের পানির রং ও স্বাদ সর্বদা একই রকমের থাকবে। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ্‌ তা'আলা বলেন,মুত্তাক্বীদেরকে যে জান্নাতের ও'য়াদা দেয়া হয়েছে তার উপমা হল: তাতে আছে নির্মল পানির ঝর্ণা, আর আছে দুধের নদী যার স্বাদ অপরিবর্তনীয়, আছে পানকারীদের জন্য সুস্বাদু মদের নদী আর পরিশোধিত মধুর নদী। (সূরাহ মুহাম্মদঃ ১৫)

 -আউরতের জন্য বাহাত্তর জন হুর সুরার নদী এসব কি কাজে লাগবে?

 -যে চার আয়াতে হুর শব্দের উল্লেখ আছেহুর দ্বারা পরুষ বা স্ত্রী কোনটাই নির্দিষ্ট করে বোঝানো হয় না। সুতরাং পুরুষদের জন্য মহিলা হুর এবং মহিলাদের জন্য পুরুষ হুর থাকবে।

 বড় হাঁড়িতে বসেছে বিরিয়ানি সকলের জন্য। ম ম করছে গন্ধ।আর যিনি এই ওয়াজ মাহফিলের মূল আকর্ষণ হয়ে  সব প্রশ্নের উত্তর করছেন। সেই হুজুরের  জন্য আছে একটা আস্ত মুরগির; মুরগি মুসল্লম।

 -বোলো মারহাবা বোলো মারহাবা ।

 শেরওয়ানি, সুফিয়ানী দাড়ি, মাথায় সোনালি কাজ করা টুপি; মঞ্চ আলোকিত করে বসে আছে বারেলি জামা মসজিদের ইমাম হুজুর মুফতি খুরশিদ আলম সাহাব।এ ধরনের মাহফিল খানাপিনা ওয়াজের জন্য যারা মোটা অংকের টাকা নজরানা দেয় তাদের জন্য শোকরানা আদায় করে আল্লাহর কাছে দোয়া চায় ইমাম সাহাব।তাদের কামাই হালাল না হারাম একবারও ভেবে দেখে না!

 -কিছুই সঙ্গে যাবে না।সঙ্গে যাবে কি ইমান।কবরে আমাদের শরীর থেকে মাংস খসে খসে পড়বে।এত যত্নের শরীরটা পচে গলে যাবে পোকায় খাবে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না দান-খয়রাত করেন না হলে সব মাটি হবে।

 এক বুড়ো ইমাম সাহেবের কানে কানে ফিসফিস করে মনে করিয়ে দিল ফতোয়ার কথাটা।যার জন্য এত আয়োজন তা ভুললে চলে।কোনও ওষুধ নেই, কোন নামাজ নেই,তার জন্য কোন কবর নেই;তার জন্য কেবল অপেক্ষা করে আছে ফতোয়া।

 কে সে? নূর না হুর?পুরুষের বেহেশতের পরী হুর সে নয়;নূর ও সে নয় তবে ফতোয়া  হত না। তবে কি হুর নয় Whore? বেশ্যা...রেন্ডি...?

 তিন তালাকের শিকার ও সমালোচক নিদা খান; বছর তিনেক আগে নিদার সঙ্গে উস্মান রেজা খানের  বিয়ে হয়। মাত্র এক বছরের মাথায় ঘর ভাঙে। তিনবার তালাক উচ্চারণ করতেই সব সম্পর্ক শেষ করেন উস্মান। ধর্মপ্রাণ বিশিষ্ট পরিবারের উস্মান নিদা কে এমন মারাত্মকভাবে মারধর করতো যে একদিন তার গর্ভস্রাব ঘটেছিল। নষ্ট হয়ে গেছিল পেটের সন্তানটি।

 -পশুর পেটে বাচ্চা থাকলে ওই অবস্থায় ঐ পশুও কুরবানি করা জায়েজ কি?

 -পেটে বাচ্চা থাকা অবস্থায় পশু কুরবানি করায় শরী ‘আতে কোন বাধা নেই। এছাড়া উক্ত পশুর গোশত খাওয়া যাবে। এমনকি রুচি হ’লে পেটের বাচ্চাও খেতে পারে। আবু সাঈদ খুদরী বলেন, আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল! আমরা উটনী, গাভী ও ছাগী যবেহ করি এবং কখনো কখনো আমরা তার পেটে বাচ্চা পাই। আমরা ঐ বাচ্চা ফেলে দিব, না খাব? রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তোমাদের ইচ্ছা হ’লে খাও। কারণ বাচ্চার মাকে যবেহ করা বাচ্চাকে যবেহ করার শামিল’ (আবুদাউদ হা/২৮২৮; মিশকাত হা/৪০৯১-৯২)।

 কুরবানির মূল শিক্ষা হল আত্মত্যাগ। এ কোন কুরবানি এ কোন আত্মত্যাগ। বনের পশুর সাথে মনের পশুকে কোরবানি করাই হচ্ছে এর শিক্ষা। আমাদের মনে পশুত্ব-সুলভ যে স্বভাবগুলো রয়েছে তা পুষে রাখা কি কোরবানি?

 এই সব ঘটনাকে জীবনের নিয়তি বলে মানতে রাজি হয়নি নিদা। আদালতে মামলা করেছে তিন তালাক বিরোধিতা করে। জিতেও গেছে উস্মানের বিরুদ্ধে।আর এখানেই আঘাত পেয়েছে স্পর্শকাতর ইসলামের ধ্বজাধারীরা।এ যে ইসলামকে অপমান শরিয়তের অপমান।আসল কথা সবাই যদি হুজুর দের বিচারে সন্তুষ্ট না হয়ে সিভিল কোর্টে ছোটে; হুজুর দের ব্যবসা লাটে উঠবে প্রভাব থাকবে কই।

 চিৎকার করে ওঠে ইমাম সাহেব;

-ওই আউরত যা করেছে তা ইসলাম বিরোধী! তার সাথে আমাদের কোনও সম্পর্ক থাকবে না আজকের পর থেকে।যদি সে অসুস্থ হয়ে পড়ে কেউ তাকে ওষুধ খাওয়াতে যাবে না।যদি সে মারাও যায় তার 'জানাজা' য় নামাজ অর্পণ করাও কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।মরার পর সে কোনও কবরস্থানে এক তিল মাটি পাবে না।

 মরার আগে যারা কিছুই পেল নামরার পরে কি তাদের নিথর দেহটার পাবার কিছু বাকি থাকে।

 ইমাম সাহেব আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠল মাইক ভেদ করে সেই চিৎকার যেন উপবিষ্ট অনুরাগীদের অন্তর অবধি কাঁপিয়ে দিতে লাগলো।

-আর যে বা যারা তাকে আমার কথা অমান্য করে সহায়তা বা সমর্থন করবে তাদের শাস্তি হবে একইরকম।

 নিজের অনুগামীদের উপর তার অগাধ আস্থা রেখেই সুর একটু নরম করেন হুজুর মুফতি খুরশিদ আলম সাহাব।

-তবে যদি সে ‘ইসলাম বিরোধী’ কাজের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চায় তাহলে অবশ্য ফতোয়া প্রত্যাহার করার ব্যাপারে ভাবনা চিন্তা করা হবে।

 সে পথে হাঁটার আউরত নিদা নয়। আদালত তাঁর পক্ষে রায় দেওয়ার পর থেকে জনসচেতনতা  বাড়ানোর কাজ শুরু করেছেন তিনি। শুধু তিন তালাক নয় নিকাহ হালালার বিরুদ্ধেও সুর চড়িয়েছেন।সারা ভারতবর্ষের সংবাদ মাধ্যম গুলো র প্রশ্নের মুখে এখন নিদা খান। উত্তর প্রদেশের বারেলি জামা মসজিদের ইমাম হুজুর মুফতি খুরশিদ আলম সাহাব তার বিরুদ্ধে যে ফতোয়া জারি করেছেন সে প্রসঙ্গে কিছু বলুন নিদা ...

 নিদা খান বলতে শুরু করে;

-এ ধরনের কাজ যারা করে তাদের পাকিস্তানে চলে যাওয়া উচিত। ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে কেউ কারও বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করতে পারে না। আর কে অপরাধী সেটা বিচারের অধিকার আল্লা ছাড়া আর কারও নেই।

 তবে কে বিচারের ভার নিজে হাতে তুলে নিচ্ছে ধর্ম নাকি ধর্মের মাতব্বরেরা। নিদা খান বেহেশতে পুরুষের উপভোগ্য হুর নয়;সে নারীবাদী;মানবতাবাদী জীবনের ওপারে একটা জান্নাতের আকাঙ্ক্ষায় সে তার গোটা জীবন কাটাতে চায় না;বরং এ জীবনেই দুনিয়ার মালিকের দোয়ায় এই নষ্ট পৃথিবীটাকে জান্নাত বানাতে চায়। সে মুসলমান মেয়েদের মানুষের মত বাঁচার অধিকার চায়। আর যে অধিকার আল্লাহ্‌ তা'আলা দিয়েছেন তা ছিনিয়ে নেবার অধিকার দুনিয়ার কারো নেই।

| বর্ষ বরণ সংখ্যা-১৪২৯ | aleekpata.com | 29th Edition |

| ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |

| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |

| Bengali New Year, 2022 | April-June 2022 | Fifth Year Third Issue |

© All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |

| a DISHA-The Dreamer Initiative |


গল্প- বৈঠকি -সর্বজ্ঞ - তপন তরফদার

 গল্প- বৈঠকি

সর্বজ্ঞ 

তপন তরফদার 

Illustration: Swarup Chakraborty
 

   সর্ব ঘটে কাঁঠালি কলা। সব পাড়াতেই ওই দুয়েকটি  মানুষ আছে যারা জন্মতিথি থেকেই সর্বজ্ঞ। সব বিষয়ে জ্ঞানেন্দ্রিয় সোচ্চার। এরা জলের মত মিশে যেতে জানে। মোক্ষম সময়ে মন্ত্রীর চাল দিয়ে কিস্তিমাত করে দিতে ওস্তাদ। সব মহল্লাতেই কম করে এক দু পিস  সবজান্তাদের দেখা পাওয়া যায়। সমস্যা হয় যখন ভুলকেই  ঠিক বলে চালিয়ে  দিয়ে  নাম  কিনতে চায়। আমি ও একজন  সর্ব ঘটে কাঁঠালি কলা মার্কা  ছেলে। তবে হাটে বাজারে  তা প্রকাশ করিনা। আমি সি আই ডি ডিপার্টমেন্ট এর করণিক, সব কিছুর খোঁজ  রাখতে হয়। কিন্তু খবর  ওগলানো চলবেনা। আমি চাকরির  কথা সবসময় মাথায় রাখি। আমাদের কাজ খবর সঠিকভাবে ওপরওয়ালেকে জানান। আমার বসরা কখনো খোলা মেলা হয়ে  আমাদের সঙ্গে মেশেনা। এই  অলিখিত নিয়ম গুলি সবই চাকরির স্বার্থে, ইংরাজিতে বলে “প্রোটোকল”।

 

    বর্তমান অফিসার জয়ন্ত ফাদিকার কিন্তু আমার সঙ্গে বন্ধুর মতোই মেশেন এবং কথা ও বলেন। আমার মত ধুরন্ধর সর্বজ্ঞও  কারণটা ধরতে পারলাম না। বসের চিন্তা ধারা কিন্তু  খুবই  প্রগতিশীলউনি ওই বস- কেরাণির ভেদাভেদ দুরে সরিয়ে আমার সঙ্গে গল্পগুজব করেন। আমাকে ওনার বাড়িতে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণও করলেন। কি করা উচিত। অনেক ভাবলাম বসের বাড়িতে গেলে জানাজানি হবে। অফিসের অনেকেই  বাঁকা কথা শোনাবে, “এখন তেল মারতে বসের বাড়িতে  ছুটছে। ঘোর কলি কাল।” ওদের মুখ  বন্ধ করতে পারবোনা। কথা বলার জন্য ট্যাক্স দিতে হয় না। আমার সর্বজ্ঞ মন বললো ক্ষতি কি? একবার দেখাই  যাক না। কোথাকার জল কোথায় দাঁড়িয়ে যায়।

 

     রবিবার  ছুটির  দিন সূর্য্যটা  সবে ডুবেও ডোবেনি। অকাশে তখনও চলছে এক অপরূপ সুক্ষ্ম লাল সোনালী রঙের খেলা। এই সন্ধিক্ষণকেই আমার সর্বজ্ঞ মন বললো গোধুলি লগ্ন। বসের বাড়ি যাচ্ছি একটু  মিষ্টি না নিয়ে গেলে ওই প্রটোকল ঠিক মত থাকেনা। আমার হাতে জলভরা কড়া পাকের সন্দেশের বাস্ক।

 

     বসের বাড়িতে ঢোকার সামনের দেওয়ালটাই দেখার মতো। এখনো সবুজের যুগ। গাছ লাগাও গাছ বাঁচানোর যুগ। প্রগতিপন্থী বস যুগের সঙ্গে চলে। ঘরের সামনের দেওয়ালটা ঘন সবুজ রং করে নয় আগাছায় নয় দেওয়াল জুড়ে লাগানো হয়েছে লেমনগ্রাস,রোজমেরি হার্ব দিয়ে হার্ব গ্রিন ওয়াল। সুস্থতা ও সামাজিকতাার হার্ট থ্রব আমার বস। মনে পড়ে গেল আজ ৫ই জুন বিশ্ব প্রকিৃত দিবস। তালেগোলে ভালো দিনেই প্রকৃতি প্রেমী বসের বাড়িতে এসেছি। অতিসুখকর পরিবেশ।

 

       দুধ সাদা কলিং বেলটা টেপা মাত্র শাড়ি পরা মাথা ঢাকা বিরাট ঘোমটা দেওয়া এক মহিলা দরজা খুলে দিলো। বস বসার ঘর থেকেই বললো এ ঘরে এসো। ঘরে ঢুকতেই নজরে পড়লো যামীনি রায়ের আঁকা মা ও মেয়ের রেপ্লিকা। বস প্রথমেই বললো মিষ্টির কোনো দরকার ছিলনা। এরপর হাসি মাখা মুখে টুকটাক কথা শুরু হয়ে গেল। কাঁসার বগি থালা ভর্তি ফুলকো লুচি কালোজিরে দেওয়া আলুর ছেঁচকি, বড়ো বড়ো  দুটি ছানার রাজভোগ। ছোট টেবিলটায় নামিয়ে রাখলো সেই ঘোমটা দেওয়া মহিলা। আমার একটু কেমন খটকা লাগলো। প্রগতিশীল মানুষ অথচ নিজের ঘরের মেয়েদের পর্দার অন্তরালে রাখেন। মন বলছে এ নিশ্চয়ই কাজের লোক অন্য রাজ্য থেকে এনেছে  যারা সবসময় ওই লম্বা ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে রাখে। টিভি সিরিয়ালে দেখেছিলাম।

 

          বস বললো খেয়ে নাও। ভালো লাগবে ও ভালোই রান্না করে। মুখে কিছু বললাম না। মনে মনে বললাম ঠিকই ধরেছি কাজের লোক। কথা গড়গড় করে এগিয়ে চলেছে। বস বলে বসলো তুমি বলেছিলে তবলা বাজাতে জানো। আমি জাঁতাকলে পড়ে গেলাম। ছোটবেলায় তবলা কিছুদিন শিখে ছিলাম। ওই সর্বজ্ঞ হওয়ার জিন আমার শরীরে মনের ঘোরে গল্প করে ছিলাম। সবজান্তাদের দলে আমি। নিজের ফেলা জালে নিজেই জড়িয়ে পরলাম। ধামাচাপা দিতে বললাম এখন কোনো রেওয়াজ  নেই। জয়ন্ত ফাদিকার আমার বস, আমাকে এক হাটে কিনে অন্য হাটে বিক্রি করার ক্ষমতা রাখে। বস বললো শুধু  মাত্র ঠেকা দিলেই কাজ হবে। আমার মুখে বিরাশী সিক্কার চড় পড়লো। কিছু উত্তর না দিয়ে ঘাড়টা কাত করতেই হলো। হারমোনিয়াম তবলা বস লাল-সবুজ কার্পেটের উপর সাজিয়ে দিয়ে ডাকলো সুলগ্না -এসো।

 

       আমি  অবাক হয়ে গেলাম মাথায় ঘোমটা দেওয়া মহিলাটি হারমনিয়ামে বসলো। আমার সবজান্তা মন আগেই  বলেছিল, এরা মুখে প্রগতিশীল কাজে নয়। বাড়ির লোকজনকে সেই দাসীদের মত রাখবে মুখে বড়ো বড়ো বিপ্লবের কথা বলে। সুল্গনা বসলো, হাত জড়ো করে নমস্কার করলো। ঘোমটাটা একটুও সরলোনা। বসের এই সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবের জন্য বসের প্রতি একটা ঘৃণা জেগে উঠলো। সুলগ্না মামুলি সহজ “আলো আমার আলো” রবীন্দ্র সংগীত ধরলো ওটা দাদরা তালের গান, আমি জানি। আমার বাজাতে কোনো অসুবিধা হলো না। গানটা সবে শেষ হয়েছে এই সময় কলিং বেলটা বেজে উঠতে ধড়মড় করে  উঠতে গিয়ে বেকায়দায়  তবলার হাতুড়িটায় পা পড়ে যায়। পিছলে যায় শরীর। সুলগ্না চিৎ হয়ে বসেরই কোলে পড়ে যায়। সুলগ্নার ঘোমটা খুলে গেছে। আমি একি. দেখছি,নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিনা। হরোর সিনেমায় যেমন রাক্ষসী, পেতনীদের দেখায় ঠিক সে রকম মুখ। ডান দিকের পোড়ানো মাংস থলথল করে ঝুলঝে নাকের হাড়টায় লাল লাল ছোপ। আমি বাজি রেখে বলতে পারি অনেকেই এই ক্ষণেই জ্ঞান হারাতো।

 

        আমার বস পরিস্থিতি সামলে নিয়ে বললো তুমি কি ভাবছো। আমি উত্তর  দেওয়ার আগেই  বলতে শুরু  করলো-  সুলগ্না ডি এ ভি স্কুলের শিক্ষিকা ছিল। একদিন ওর সহকর্মীর স্বামী  স্কুলে  ঢোকার সময় আ্যসিড ছোঁড়ে ওই সহকর্মীকে মারার জন্য। সুলগ্না সহকর্মীকে  ধাক্কা মেরে  সরিয়ে দেয়। সহকর্মী রক্ষা পায়। সুলগ্নার মুখ  ঝলসে যায়। ও আমার থেকে দুরে সরে যায়। লুকিয়ে থাকে অমি যেন ওর সন্ধান না পাই। আমি আমার  প্রেমিকাকে খুঁজে বার করি, বিয়ে করে মনের সুখেই সংসার করছি।

 

      আমি সর্বজ্ঞ হয়ে  ও বোবা হয়ে গেলাম।

| বর্ষ বরণ সংখ্যা-১৪২৯ | aleekpata.com | 29th Edition |

| ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |

| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |

| Bengali New Year, 2022 | April-June 2022 | Fifth Year Third Issue |

© All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |

| a DISHA-The Dreamer Initiative |


Main Menu Bar



অলীকপাতার শারদ সংখ্যা ১৪২৯ প্রকাশিত, পড়তে ক্লিক করুন "Current Issue" ট্যাব টিতে , সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

Signature Video



অলীকপাতার সংখ্যা পড়ার জন্য ক্লিক করুন 'Current Issue' Tab এ, পুরাতন সংখ্যা পড়ার জন্য 'লাইব্রেরী' ট্যাব ক্লিক করুন। লেখা পাঠান aleekpata@gmail.com এই ঠিকানায়, অকারণেও প্রশ্ন করতে পারেন responsealeekpata@gmail.com এই ঠিকানায় অথবা আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।

অলীক পাতায় লেখা পাঠান