নীলকণ্ঠেশ্বর
মহাদেব ও চন্দ্রবদনী মন্দির দর্শন
দেবী প্রসাদ
ত্রিপাঠী
|
চন্দ্রবদনী দেবীর মন্দির |
অনেকদিনের
ইচ্ছে ছিল সময় ও সুযোগ ঘটলে উত্তরাখণ্ডের নীলকণ্ঠেশ্বর মহাদেব ও চন্দ্রবদনী
মন্দির দেখে আসার কিন্তু সময় ও সুযোগ হচ্ছিল না। অবশেষে ২০২১ সালের অর্থাৎ এই
বছরের হরিদ্বার পূর্ণকুম্ভে গিয়ে সেই সুযোগ এসে গেল। অবশ্য প্রচলিত কথা আছে
তীর্থের দেবতার আহ্বান না হলে যতই চেষ্টা করি না কেন যাওয়ার সুযোগ ঘটবে না।
কুম্ভমেলাতে
যাবার দুমাস আগে ট্রেনের যাতায়াতের সংরক্ষিত টিকিট কেটে নিশ্চিন্ত হয়েছি।
যাত্রার তারিখ পূর্বে আর দেখিনি, যতদূর সম্ভব মনে আছে যে আমি ৫ই মার্চ তারিখের টিকিট কেটে
ছিলাম এবং সেইভাবে সকল শুভানুধ্যায়ীকে জানিয়েছিলাম। জিনিসপত্র সব গুছিয়ে চার
তারিখে সন্ধ্যের সময় স্ত্রীর সাথে চায়ের টেবিলে বসে ট্রেনের টিকিট বের করে দেখতে
পেলাম সেই দিনেই দুপুর একটাতে আমার
নির্দিষ্ট ট্রেন হাওড়া থেকে চলে গেছে। প্রৌঢ় বয়সের দৃষ্টিবিভ্রম। কি করব, কিভাবে যাব
যখন কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। মনে খুব আঘাত পেলাম এই ভেবে যে সবকিছু পূর্বের থেকে
ব্যবস্থা করেও যাওয়া হলো না। আগেই বলেছিলাম তীর্থদেবতার আহ্বান না হলে কিছুতেই
যাওয়া হবে না। যাইহোক তীর্থদেবতা যেন আমার মনোবেদনা জানতে পারলেন। এই সময় যেন
ঈশ্বরপ্রেরিত দূত হয়ে আমার জ্যেষ্ঠপুত্র শ্রীমান পার্থ তার ওয়ার্কশপ থেকে
বাড়িতে এলো। সে এসে সমস্ত ঘটনা শুনে আমার দুশ্চিন্তার অবসান ঘটালো। আইআরসিটিসি
অ্যাপ বের করে ৫ই মার্চ তারিখের ০২৩২৭ নম্বর ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর শীততাপ
নিয়ন্ত্রিত কোচের একটি টিকিট কেটে আমাকে চিন্তার হাত থেকে মুক্ত করল।
এবারে আমার
যাবার কথা শুনে আত্মীয়-স্বজন শুভানুধ্যায়ীরা নিষেধ করে বলেছিলেন "তিনবার
পূণ্য স্নান হয়েছে এবারে করোনার সময়ে না গেলেই ভালো হয়"। কিন্তু কুম্ভের
কি যে আকর্ষণ জানিনা,
পথে বেরিয়ে পড়লাম। ৫ তারিখে। পরের দিনে নির্দ্ধারিত সময়ের আধ ঘণ্টা আগে
বিকেল তিনটে কুড়ি মিনিটে ট্রেন পৌঁছাল হরিদ্বার স্টেশনে। ভারতীয় রেলের নিয়মানুবর্তিতা এবং ট্রেনের
ভিতরের ও স্টেশনের পরিছন্নতা দেখে খুব ভালো লাগলো। স্টেশন থেকে একটি অটো করে আমি
বিবেকানন্দ সেবা সমিতির শিবিরে বিকেল
চারটার পূর্বে পৌছালাম।
৬ ই মার্চ
আমার বন্ধু শ্রী সুকোমল মণ্ডল সস্ত্রীক হরিদ্বারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল। আমরা
আগেই স্থির করেছিলাম যে হরিদ্বারে গিয়ে ৮ এবং ৯ই মার্চ হরিদ্বার থেকে যথাক্রমে নীলকণ্ঠেশ্বর মহাদেব ও
চন্দ্রবদনী মন্দির দর্শন করতে যাব এবং ১০ই মার্চ তারিখে বিশ্রাম নিয়ে ১১ তারিখে
শাহীস্নান করবো। ৬ তারিখে বিকেলে পৌছালাম
এবং ৭ তারিখে গাড়ির ব্যবস্থা করে স্থির হল ৮ তারিখে একটি 'ট্রাভেরা' গাড়ি করে
আমরা নীলকন্ঠ মহাদেব দর্শন করে ফিরে আসবো এবং ৯ তারিখে একটি 'বোলেরো' গাড়ি করে
চন্দ্রবদনী মন্দির দর্শন করে ফিরব। হরিদ্বারে আমাদের আবাসিক শিবিরে পৌছাবার পরে আরও
চার পাঁচজন আবাসিক আমাদের সাথে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করাতে তাদেরও সঙ্গে নেওয়ার
সিদ্ধান্ত হল। যে দুই তীর্থের দেবতাকে দর্শন করার ইচ্ছা দীর্ঘদিন যাবৎ মনের
সংগোপনে জারিত হয়েছিল সেগুলি আশা করছি এবারে ফলপ্রসূ হতে চলেছে।
৮ই
মার্চ তারিখে অর্থাৎ সোমবার সকাল পৌনে নটাতে আমরা পাঁচজন অর্থাৎ আমি, আমার বন্ধু
শ্রী সুকোমল মণ্ডল ও তার স্ত্রী মালতি, শিবিরে আমার সাথে একই ঘরে আছে
বাবুলাল ও সুভাষ। শিবির থেকে বেরোনোর আগে চা ও জলখাবার খেয়ে নিলাম। কঙ্খলের
শঙ্করাচার্য চক থেকে আমাদের গাড়ি পূর্বদিকে ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে ব্রহ্মকুণ্ডকে
বাঁ দিকে রেখে ঋষিকেশ যাবার রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। আজ থেকে চোদ্দ বৎসর পূর্বে
এসে দেখেছিলাম হরিদ্বার ও হৃষীকেশের মাঝে অনেক ফাঁকা জায়গা ছিল। কিন্তু বর্তমানে
দুই শহরের বিস্তৃতির ফলে সেই ফাঁকা জায়গাগুলি দেখতে পাচ্ছি রাস্তার দু'পাশে গগনচুম্বী
অট্টালিকার সারিতে ভরাট হয়ে গেছে। রাস্তার দু'পাশে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের
সুসজ্জিত শোরুম। ঋষিকেশ শহর ছাড়িয়ে গঙ্গার উপরে পুল পেরিয়ে গঙ্গা নদীকে বাঁ
দিকে রেখে আমরা নীলকণ্ঠেশ্বর মহাদেবের আবাসস্থল মণিকূট পর্বতের উদ্দেশ্যে ঋষিকেশ
থেকে পাহাড় ও গভীর জঙ্গলের পথে রওনা হলাম। হৃষীকেশের পরে মাঝে মাঝে গঙ্গা নদীকে
বাঁ দিকে দেখতে পাচ্ছি। সুন্দর পিচঢালা রাস্তা, পাহাড়-জঙ্গল এবং মাঝে মাঝে সবুজ
উপত্যকা পেরিয়ে সকাল এগারোটা নাগাদ মণিকূট পর্বতের পাদদেশে যেয়ে পৌছালাম।
গাড়ীকে মন্দিরের এক কিলোমিটার দূরে পার্কিং করতে হলো। এখান থেকে পায়ে হেঁটে যেতে
হবে। শিবরাত্রির পূর্বের সোমবার বলে এখানে খুব ভীড়। কিছুদুর যাবার পরে রাস্তার
উপরে নীলকন্ঠ মহাদেব তোরনদ্বার।
এখন তো আমরা
মন্দিরের নিকট পর্যন্ত গাড়িতে আসতে পারছি। অথচ আজ থেকে প্রায় ১৩১ বৎসর আগে
স্বামী বিবেকানন্দের গুরুভ্রাতা স্বামী সারদানন্দ, স্বামী তুরীয়ানন্দ এবং স্বামী
কৃপানন্দ ১৮৯০ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি শিবরাত্রির দিনে যখন এখানে এসেছিলেন সেই
সময়ে তাঁরা ঋষিকেশ থেকে পদব্রজে এসেছিলেন। স্বামী সারদানন্দ চরিত - তপস্যা ও
পর্যটন গ্রন্থে এখানে আসার যে অভিজ্ঞতা ও পথের বর্ণনা যেভাবে স্বামী সারদানন্দ
মনের আনন্দে শ্রী প্রমদাদাস মিত্রকে লিখিলেন – ‘পথ অতি দুর্গম, পর্বতের
চড়াই অতি উচ্চ পাকদণ্ডী দিয়ে লতাপাতা আঁকড়ে ধরে পাহাড়ে চড়তে হয়েছিল।
নীলকন্ঠের দৃশ্যের কথা আর লিখিয়া কি জানাইব। এমন শান্তিময় স্থান আর কোথাও দেখি
নাই। এখানে নীলকন্ঠ নামে একটি অনাদি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্টিত আছেন। চতুর্দিকে বড় বড়
পর্বত দিয়ে ঘেরা, মধ্যে
একটি ছোট পর্বতের শিখরে মহাদেবের মন্দির। মন্দিরের বিশ-ত্রিশ হাত অন্তরে একটি
নির্ঝর অতি মিষ্ট ঝর্ঝর শব্দ করিয়া চলিয়া যাইতেছে। নানা প্রকার পক্ষী সকল
ডাকিতেছে ও পর্বতের বনরাজি সকল মধ্যে অতি সুমিষ্ট গন্ধ দান করিতেছে। নিবিড়
জঙ্গলের মধ্যে হিংস্র জন্তু থাকা দূরে থাকুক, একটা শিয়াল পর্যন্ত ডাকিতে শুনি
নাই। বন যে কেবল জঙ্গুলে গাছে পূর্ণ তাহা নয় তপোবনসুলভ সুস্বাদু ফল -
আম, পিচ, কলা, লেবু, পেয়ারা
প্রভৃতির গাছ আছে, কন্দও
প্রচুর পাওয়া যায়। স্থানটি এত চিত্তপ্রসাদকর ও মনোহর যে এখানে আসিলে আপনা হইতেই
মনে ধ্যান ও ভাবের উদয় হয়। স্বভাবের সুন্দর দৃশ্য ও নিস্তব্ধতার দরুন মনকে
একেবারে উদাস করিয়া ভয়,
ভক্তি, প্রেম, বিশ্বাস ও
উল্লাসে ডুবাইয়া দেয়। এমন চৈতন্যময় স্থান আর কোথাও দেখি নাই। বোধ হয় যেন
দেবাদিদেব মহাদেব এইমাত্র এখান হইতে তপস্যা করিয়া উঠিয়া গেলেন। অধিক আর কি বলিব
- পর্বত হইতে নামিবার সময় মা গঙ্গার শোভা ও ভাব দেখিয়া আমাদের মনে কান্না আসিল।
ঠিক এই রকম দেখিলাম,
যেন পতিতপাবনী জগজ্জননী গঙ্গা স্বর্গ হইতে নামিয়া কেবল উত্তরাখণ্ডকে পবিত্র ও
ধন্য করিয়া আবার স্বর্গের বাসিনী স্বর্গেতেই ফিরিয়া যাইতেছেন, মর্ত্যলোকে
আর নামিলেন না। মায়ের জলেরও যে কত বাহার দেখিলাম তা আর কি লিখিব - যেন উজ্জ্বল
হীরার ধারা, রজতের
ধারা, অনুপম।‘ পথে তাঁরা শ্রী বীরভদ্রও দর্শন করেছিলেন। ঋষিকেশ তখন সত্য সত্যই ঋষিসেবিত স্থান ছিল -
শান্ত, নির্জন, মৌন। স্বামী সারদানন্দের দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল মা গঙ্গার রূপের কত বাহার, গভীর
অরণ্যানীর বিটপীগুলি ফলভারে নম্র, কোথাও হিংস্র জন্তুর আওয়াজ নেই, ডালে ডালে
পাখির কূজন, মৌন
পর্বত - যেন সত্য সত্যই মহাদেবের আবাসস্থল। প্রকৃতির সেই উন্মুক্ত আবাসস্থলে
শিবরাত্রির দিন স্বামী সারদানন্দ এক শিলাখণ্ডের উপরে সারারাত্রি ধ্যানে মগ্ন
ছিলেন।
নীলকন্ঠেশ্বর
পৌঁছাবার আগে নীলকন্ঠ মহাদেব সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য পাঠকের কাছে উপস্থাপনা করছি।
সমুদ্র মন্থনে অমৃত লাভ করে দেবতা ও অসুরেরা যখন বিবাদগ্রস্ত সেই সময়ে
বাসুকিনাগের তীব্র বিষের জ্বালায় ত্রিজগতের সমস্ত প্রাণী জগৎ ও প্রকৃতিতে এক
অস্থির অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। জলের প্রাণীরা ডাঙ্গাতে ছটফট করে মারা যাচ্ছে, বৃক্ষ সকল
শুকিয়ে যাচ্ছে, মানবকূল
বিষের জ্বালাতে আর্তনাদ করে প্রাণত্যাগ করছে। ত্রিজগতের এরূপ অবস্থা দেখে
দেবাদিদেব মহাদেব হলাহল পান করে নীলকন্ঠ হলেন। এদিকে বাসুকিনাগের শরীরের সমস্ত
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভেঙে এক মাংসপিন্ডে পরিনত হয়েছে। তিনি অর্ধমৃত হয়ে পড়ে রইলেন।
সবাই যে যার স্বার্থ ফুরিয়ে যেতে পালিয়ে গেলেন অথচ যে বাসুকিনাগ স্বেচ্ছায়
দেবগনের উপকারের কথা ভেবেছিলেন তার দিকে আর কেউ ফিরেও দেখলেন না। মহাদেব তখন
বাসুকিনাগকে তাঁর পার্বণীর রাজপ্রাসাদে নিয়ে যেয়ে সেবা শুশ্রূষা করে সুস্থ করে
দিলেন এবং ঋষিকেশের উত্তরে বিষ্ণুকূট, ব্রহ্মকূট এবং মণিকূট উপত্যকার
মণিকূট পর্বতে নীলকন্ঠ মহাদেব রূপে বিরাজ করতে লাগলেন। প্রবাদ সমুদ্রমন্থনের গরল
পান করে ভগবান এখানেই নীলকন্ঠ মহাদেব হয়েছিলেন এবং তারপরে ষাট হাজার বৎসর এখানে
তপস্যা করে বিষমুক্ত হয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ করা যায় যে মহাদেব যখন বিষ পান
করেছিলেন সেই সময়ে মা পার্বতী মহাদেবের গলা চেপে ধরেছিলেন যাতে বিষের প্রভাব গলার
নিচে নামতে না পারে।
নীলকন্ঠ
মহাদেব তোরনদ্বারে আমরা পুজোর জন্য জল, দুধ, ফুল, বেলপাতা, নৈবেদ্য
ইত্যাদি কিনে ধীরে ধীরে এগোচ্ছি। অগণিত ভক্ত পায়ে হেঁটে এগিয়ে চলেছেন। পাহাড়ি
রাস্তা উপরের দিকে যাচ্ছে,
মাঝে মাঝে উচ্চতার জন্য সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করে যেতে হচ্ছে যার ফলে জোরে
হাঁটা যাচ্ছে না। প্রায় ৪৫ মিনিট হাঁটার পরে আমরা মন্দিরের নিকটে এসে পৌছালাম।
এখান থেকে সরু রাস্তার দু'পাশে
এলাকার অধিবাসীদের বাড়িঘর এবং পূজার উপকরণ ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে দোকানীরা বসে
আছেন। ভক্তদের যাবার জন্য রাস্তার দুই পাশে লোহার রেলিং, মাথার উপরে
আচ্ছাদন। একসময় পথ শেষ হয়ে মন্দিরের গর্ভগৃহের সামনে উপস্থিত হলাম। গর্ভগৃহের
দিকে মুখ করে বসে আছেন নন্দীশ্বর। গর্ভগৃহের দরজার সামনে পূজারীরা বসে আছেন।
নিরাপত্তারক্ষীদের প্রচণ্ড ব্যস্ততা। উল্লেখ্য যে নীলকণ্ঠেশ্বর মহাদেবের গর্ভগৃহ
যেখানে সুদৃশ্য লিঙ্গ বিরাজিত সেই গর্ভগৃহটি আয়তনে এতই ছোট যে সেখানে তিন-চারজনের
বেশি ভক্তের স্থান সংকুলান হয় না যার জন্য গর্ভগৃহের দুই দিকের প্রবেশপথের উপরে
পিতলের যোনিপীঠসহ লিঙ্গের উপরে জল অভিষেক করার ব্যবস্থা আছে। সেখানে দুধ,জল ঢাললে
সেই দুধ,জল
পাইপের সাহায্যে যেয়ে অনাদি লিঙ্গকে অভিষিক্ত করছে। আমরাও সেখানে দুধ, জল ঢেলে ফুল
বেলপাতা নিবেদন করলাম। পূজারীর হাতে নৈবেদ্য দিতে তিনি শিবলিঙ্গ স্পর্শ করিয়ে
আমাদের হাতে দিয়ে দিলেন। মন্দিরে এত ভীড় যে সেখানে এক মিনিটের বেশি দাঁড়ানো
যাচ্ছে না, নিরাপত্তা
রক্ষীরা ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছেন।
মন্দির থেকে
বেরোবার পরে নিরাপত্তারক্ষীরা একটি সহজ রাস্তা দেখিয়ে দিলেন যাতে দশ মিনিটের
মধ্যে আমরা যাবার সময়ে যে সরু রাস্তা দিয়ে গিয়েছিলাম সেই রাস্তায় না যেয়ে মূল
রাস্তাতে এসে পৌছালাম। গাড়ির কাছে আসতে আরো আধঘণ্টা সময় লাগলো। সবাই এসে পৌঁছাতে
গাড়ি ছাড়লো বেলা দেড়টার সময়। এখান থেকে আমাদের গন্তব্য স্থল ৩২ কিলোমিটার
দূরের ঋষিকেশ। ঋষিকেশ বর্তমানে একটি জনবহুল শহরে পরিণত হয়েছে যার ফলে আমাদের
গাড়ি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে মিনিট
পঁচিশ হেঁটে আমরা যেয়ে পৌছালাম লছমনঝুলা ব্রিজের অপরপাশে চোদ্দো তলার কৈলাসানন্দ
মিশন আশ্রমের মন্দিরে। হেঁটে যেতে হবে বলে সুকোমল ও মালতি গাড়ির কাছেই থেকে গেল।
মন্দিরের চোদ্দো তলা পর্যন্ত উঠে সমস্ত কিছু দেখে সুভাষ এবং বাবুলাল গীতাভবন ও
রামঝুলা দেখতে গেল। আমি আর ওদের সাথে গেলাম না। সবাই একত্রিত হওয়ার পরে বিকেল
পাঁচটায় গাড়ি ছাড়লো। হরিদ্বারে আমাদের
আবাসিক শিবিরে এসে পৌছালাম সন্ধ্যা সাতটায়।
পরের দিনে
অর্থাৎ ৯ই মার্চ তারিখে সকলে সকাল আটটাতে শিবির থেকে চা, বিস্কুট
খেয়ে একটি বোলেরো গাড়ি করে আটজনে রওনা হলাম চন্দ্রবদনী দেবীস্থান দর্শনের
উদ্দেশ্যে। আগের দিনের আমরা পাঁচজন এবং
শিবিরের অন্য তিন আবাসিক শিবানী গাঙ্গুলি, চন্দনা দত্ত এবং তার সাথী। আগের
দিনের একই রাস্তাতে ঋষীকেশ পৌঁছে সকাল দশটায় সেখান থেকে ৫৮ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে
আমাদের দেবপ্রয়াগে যাবার রাস্তা। রাস্তার ক্রসিংয়ে উত্তরাখণ্ড পুলিশের
ব্যারিকেড। জিজ্ঞেস করে জানা গেল দেবপ্রয়াগের রাস্তাতে পাহাড় থেকে ধ্বস নামার
জন্য রাস্তা বন্ধ। অগত্যা আমাদের ঘুরপথে অর্থাৎ নরেন্দ্রনগর, তেহরীবাঁধ
হয়ে যেতে হবে। পথের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘায়িত হোল। উপায় নেই, এখান থেকে তো
আর ফিরে যাওয়া যাবেনা। দেবপ্রয়াগ থেকে কুড়ি কিলোমিটার যাবার পরে নরেন্দ্রনগর।
পাহাড় জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ক্রমশ উপরের দিকে গাড়ি উঠছে। যাবার পথে আমাদের গাড়ির
ড্রাইভার পলক সিং দেখিয়ে দিলেন রাস্তার বাঁদিকে নরেন্দ্রনগরের পূর্বতন রাজার প্রাসাদ।
আমাদের যথেষ্ট দেরি হয়েছে তারপরে পথের দৈর্ঘ্য বেড়ে গেছে যার জন্য রাজপ্রাসাদ
দেখার ইচ্ছা হলেও আমরা প্রকাশ করলাম না। ক্রমশঃ উপরের দিকে গাড়ি উঠছে।
নরেন্দ্রনগর থেকে তেহরি বাঁধ প্রায় ৬৫ কিলোমিটার রাস্তা। আগর, ফাকোট, চম্বা হয়ে
দুপুর বারোটার পরে আমরা পাহাড়ঘেরা নীল জলের তেহরি বাঁধের নিকটে গিয়ে পৌঁছলাম।
দুই পাহাড়ের মাঝখানে ভাগীরথী নদীতে বাঁধ দিয়ে জলস্রোতের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সেচের ও
পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়েছে বিস্তীর্ণ অববাহিকা অঞ্চলে। যেহেতু নদীবাঁধ
নির্মাণের সময় রাজনৈতিকভাবে ভারতবর্ষ উত্তাল হয়েছিল এবং যার জন্য বাঁধটির
নির্মাণকার্য সম্পূর্ণ হতে নির্ধারিত সময়ের থেকে বিলম্ব ঘটেছিল সেই জন্য তেহরি
বাঁধ নির্মাণের আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি।
আন্দোলনের
কারণ ছিল হিমালয়ের এই অঞ্চলের ভঙ্গুর শিলার গতি-প্রকৃতির জন্য এবং সব থেকে বড়
কথা এই অঞ্চল ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। ১৯৯১ সালের অক্টোবর মাসে উত্তরকাশীতে যে
ভূমিকম্প হয়েছিল তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই অঞ্চল থেকে ৫৩ কিলোমিটার ব্যাসার্দ্ধের
মধ্যে। এছাড়াও পরিবেশবিদরা আশঙ্কা করেছিলেন এই বাঁধ নির্মাণ হিমালয়ের এই অঞ্চলের
জীবনযাত্রা, পরিবেশ
ও প্রাণী বৈচিত্রে আঘাত হানবে। যে অঞ্চলে বাঁধটির নির্মাণকার্য হয়েছে
ভূতাত্ত্বিকদের মতে সেই অঞ্চলটি মধ্য হিমালয়ের ভূকম্পন এলাকায় অবস্থিত, যদিও
নির্মাণ বিশেষজ্ঞদের মত ছিল বাঁধটির নির্মাণকার্য এমনভাবে হয়েছে যে ৮.৪ রিখটার
স্কেলের ভূকম্পন প্রতিহত করার ক্ষমতা আছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মত ছিল হিমালয়ের এই
অঞ্চল এমন এক জায়গাতে অবস্থিত যেখানে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা বেশি। ১৯৯১ সালের
উত্তরকাশী ভূমিকম্পের পরে ২৭শে অক্টোবর থেকে ৪ঠা নভেম্বর পর্যন্ত আইআইটি কানপুরের
বৈজ্ঞানিকরা স্থানটি পরিদর্শন করে তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন সন্নিহিত
অঞ্চলের ১২৯৪টি গ্রামের প্রায় তিন লক্ষ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, ৭৬৮ জন
নিরীহ গ্রামবাসী মারা গেছলেন, ৭৫০৩টি
বাড়ি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল এবং আরো অসংখ্য বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সর্বাধিক
ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল ছিল গঙ্গোত্রী এবং তেহরি অঞ্চল।
তেহরি বাঁধ
আন্দোলন প্রথম শুরু করেন শ্রী বীরেন্দ্র দত্ত সাকলানি নামে একজন আইনজ্ঞ, যিনি তেহরি
বাঁধ নির্মাণ বিরোধী কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। শ্রী সাকলানি আন্দোলনের মাধ্যমে
জনসাধারণের দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করার পরে নেতৃত্বে আসেন পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম নেতা
শ্রী সুন্দরলাল বহুগুণা,
জন্মসূত্রে যাঁর পূর্বপুরুষেরা পশ্চিমবঙ্গের বন্দোপাধ্যায় ব্রাহ্মণ। ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত শ্রী বহুগুণা
তেহরি বাঁধ নির্মাণ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন। পরিবেশরক্ষা আন্দোলনকারীদের
সমস্ত প্রকার আন্দোলনকে অগ্রাহ্য করে ১৯৭৮ সালে যে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল
দীর্ঘ ২৮ বৎসর পরে ২০০৬ সালে সেই বাঁধের নির্মাণকার্য শেষ হয়েছিল। তেহরি বাঁধ
ভারতের উচ্চতম এলাকার নদীবাঁধ। বাঁধটি লম্বায় ১৮৮৬ ফুট, চওড়ায় ৬৬
ফুট উপরের অংশ বা শীর্ষদেশ , নিচের অংশ বা তলদেশ ৩৭০১ফুট, উচ্চতায় ৮৫৫ ফুট, জলধারনের
ক্ষমতা পাঁচ লক্ষ উনপঞ্চাশ হাজার কিউবিক ফুট। এছাড়াও এখানে এক হাজার মেগাওয়াট
বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে যার সাহায্যে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, চন্ডিগড়, জম্মু-কাশ্মীর, রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল
প্রদেশ এবং দিল্লির বিস্তীর্ণ এলাকা আলোকিত। খালের সাহায্যে জল পাঠানো হচ্ছে দু
লক্ষ সত্তর হাজার হেক্টর জমিতে। পানীয় জল সরবরাহ করা হচ্ছে উত্তরাখণ্ড,
পানীয় জল
সরবরাহ করা হচ্ছে উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ ও দিল্লিতে। বাঁধ নির্মাণে খরচ হয়েছে ১০০ কোটি
ডলার। রিজার্ভার ক্যাপাসিটি ৩২ লক্ষ একর ফুট বা চার কিউবিক কিলোমিটার। রাশিয়ার
আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বাঁধটি সম্পূর্ণ নির্মিত হয়েছে ২০০৬ সালে। তেহরিতে
যেখানে বাঁধ নির্মাণ হয়েছে তার থেকে বাইশ কিলোমিটার নীচে ভাগীরথীর উপরে ২০২৯ ফুট উচ্চতায়
কোটেশ্বর বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। সেটি লম্বায় ৯৮৪ ফুট, উচ্চতায়
তিনশো কুড়ি ফুট,
|
টিহরি বাঁধ |
জলধারণক্ষমতা
৭২০৭২ একর ফুট। জলের স্রোতে টারবাইন বসিয়ে এখানে ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন
হচ্ছে। তেহরি বাঁধটি কোনক্রমে ভেঙ্গে গেলে অববাহিকা অঞ্চলের প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ
মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এখানে দশ
মিনিটের বিরতি। গাড়ি থেকে নেমে প্রত্যেকে পাহাড়ের কোলে ভাগীরথীর নীল জলরাশি দেখে
বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন এবং বিভিন্ন আঙ্গিকে ফটো তোলায় ব্যস্ত হলেন। যেখানে টিহরি
বাঁধ নির্মিত হয়েছে সেখান থেকে চন্দ্রবদনী মন্দিরের দূরত্ব প্রায় ৭৫ কিলোমিটার।
বেশি সময় এখানে অতিবাহিত না করে আমাদের গাড়ি সাড়ে বারোটায় ছাড়ল। পাহাড় জনপদ
পেরিয়ে গাড়ি চলেছে। দেবপ্রয়াগে না যেয়ে তার আগে জামনিখাল থেকে সাত কিলোমিটার
পেরিয়ে আমরা চন্দ্রকূট পাহাড়ের পাদদেশে পৌছালাম দুপুর দুটো পনেরোতে। এখানে
গাড়ির স্ট্যান্ড, কয়েকটি
দোকান আছে যেখানে পূজোর সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও চার-পাঁচটি চায়ের দোকান
আছে যেখানে বললে খাবার পাওয়া যায়। এখান থেকে সিঁড়ির ধাপ করা আছে চন্দ্রকূট
পাহাড়ের উপরে চন্দ্রবদনী মন্দির পর্যন্ত। প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা সিঁড়ির ধাপ
অতিক্রম করে মন্দিরে যেয়ে পৌছালাম পৌনে তিনটার সময়। দর্শনার্থী প্রায় নেই, মন্দির
চত্বর ফাঁকা। মন্দিরের সামনের চত্বর থেকে দূরের গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, কেদারনাথ, বদ্রিনাথ
পর্বত শৃঙ্গগুলি আকাশ পরিষ্কার থাকলে দেখা যায়।
এখানে এসে
মন চলে গেল অতীতে। আজ থেকে একশো একত্রিশ বছর আগে অর্থাৎ ১৮৮৭ সালে যখন স্বামী
বিবেকানন্দের গুরুভ্রাতা স্বামী অখন্ডানন্দ গঙ্গোত্রী থেকে উত্তরকাশী হয়ে টিহরিতে
আসার পরে উদরাময়ে আক্রান্ত হয়ে অবস্থান করার পরে চন্দ্রবদনী মন্দির দর্শন করতে
এসেছিলেন। স্বামী অখন্ডানন্দ রচিত 'হিমালয়ের
আকর্ষণে' যেভাবে
বর্ণনা করা আছে সেটি এইরূপ - ‘চন্দ্রবদনী
পীঠস্থান দর্শনমানসে নিবিড় অরণ্য পথে যাত্রা করিলেন। উচ্চ গিরিচূড়ায় দেবীর
মন্দিরটি হিমালয়ের এক অপূর্ব সৌন্দর্য কেন্দ্র। যেন মনে হয় গিরিরাজ সগর্বে
জগন্মাতার মন্দিরটি ধারণ করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন, আর প্রকৃতিদেবী নানাবিধ ফল পুষ্প
দ্বারা ভক্তি বিনম্রচিত্তে নিত্য মায়ের পূজা করিয়া ধন্য হইতেছেন। কিন্তু পর্বতটি
দুরারোহ। গঙ্গাধর পথভ্রান্ত হইয়া পড়িলেন। কোনক্রমে পাহাড়টি প্রদক্ষিণ করিতে
করিতে কোন প্রকারে আরোহন করিতে লাগিলেন। সন্ধ্যার প্রাক্কালে দেবীর মন্দিরে
পৌঁছালেন। নির্জন গিরিমন্দিরের মহা নিস্তব্ধতা অনুভব করিয়া তাঁহার মন যে বিমল
আনন্দে পরিপূর্ণ হইল তাহা তাঁহার নিজের ভাষায় এইরূপে বর্ণিত হইয়াছে। "এখানে
পৌছিলে মনে হয় যেন চরাচর ব্রহ্মাণ্ড অনন্ত মৌনব্রত ধারণ করিয়া রহিয়াছে। উত্তরে
অপার ও অগম্য শুভ্র চিরহিমানী হইতে যেন অনন্তজ্যোতি বিকীর্ণ হইয়া জগতকে আলোকিত
করিতেছে। না জানি কি মহান সৌন্দর্য রাশির ঘনীভূত মূর্তি এই অনন্তভাবসম্পন্ন
চিরহিমানী। এখানে সকলেই মহা নিস্তব্ধ, কাহারও সাড়াশব্দ নাই। মনে হয় যেন
সমগ্র জগৎ এক অনন্তের ধ্যানে সমাধিস্থ। আমি হিমালয়ের বিরাট দেহে অনন্তরূপিনী
মহামায়ার আবির্ভাব দর্শন করিয়া ধন্য হইলাম"। চন্দ্রবদনী দেবীর ধ্যানে মহা-আনন্দে দুই রাত্রি
কাটাইয়া মাতৃ চরণে পুনরাগমন বাসনা জানাইয়া গঙ্গাধর নামিতে লাগিলেন। কিন্তু
পূর্বের মতো এবারও পথহারা হইয়া চুপ করিয়া বসিয়া পড়িলেন। তাঁহার জীবন সংশয়
হইল। এই সময়ে তাঁহার মনে হইতে লাগিল 'এ দিব্য দেবীস্থান, যেখানেই
থাকি মায়ের কোলে রহিয়াছি'।
কিছুক্ষণ পরে 'জয়
মা' বলিয়া
আপনমনে এক দিকে নামিতে লাগিলেন। প্রায় গড়াইতে গড়াইতে পর্বতের পাদদেশে নিরাপদ
সমতলে পৌঁছিয়া দেখেন কৃষকেরা গম পোড়াইয়া খাইতেছে। কৃষকেরা একটি সাধুকে ঐরূপে
আসিতে দেখিয়া বিস্ময় বিমুগ্ধ হইয়া বলিল "তুমি কোথা থেকে এলে? এ পথে কেউ
কোনদিন আসেনি। নিশ্চয় চন্দ্রবদনী মা হাত ধরে তোমাকে নিয়ে এসেছেন"। এখান
থেকে সরকারী পথ ধরে তিনি তার পরে শ্রীনগরে পৌঁছে কেদারনাথ দর্শনের উদ্দেশ্যে রওনা
হয়েছিলেন।
আমরা ওখানে
গিয়ে যে সময়ে পৌঁছেছি তখন পাহাড়গুলির উপর চারিদিকে কুয়াশার আস্তরণ পড়তে শুরু
করেছে যার জন্য পরিষ্কারভাবে শৃঙ্গগুলি দৃষ্টিগোচর হলো না। মন্দির চত্বরের নিচের
দোকান থেকে আমরা পূজার সামগ্রী- মায়ের
বস্ত্র, ফুল, নারকেল, মিষ্টান্ন
ইত্যাদি কিনে নিয়ে মন্দিরে গেলাম। পূজারী নিষ্ঠা সহকারে পূজা করে দিয়ে প্রসাদী
বস্ত্রখণ্ড, নারিকেল
আমাদের ফেরত দিলেন। মন্দিরটি কোনকালে নির্মিত হয়েছে কেউ বলতে পারেন না তবে প্রবাদ
যে আজ থেকে পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন এই মন্দির। চন্দ্রকূট পাহাড়ের শীর্ষদেশে
একখণ্ড জমি সমতল করে বর্তমানের মন্দিরটি শ্বেতমার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
মন্দিরের পৃথক কোন গর্ভগৃহ নেই। যেখানে মায়ের শ্রীযন্ত্র স্থাপিত তার সামনে বসে
পূজারী পূজা করেন এবং তার সামনে গ্রিলের
রেলিং দেওয়া আছে। রেলিংয়ের বাইরে দিকে ভক্তেরা বসে পূজার উপকরণ পূজারীর হাতে
তুলে দেবার পরে তিনি সেগুলি শ্রীযন্ত্রে স্পর্শ করে পুনরায় ভক্তকে ফেরত দেন।
নিস্পৃহ পূজারী, অর্থের
প্রতি কোন লোভ নেই। ভক্তেরা যা দক্ষিণা
দেন তিনি সেটি মায়ের কাছে রেখে দেন। দশমহাবিদ্যায় ত্রিপুরাসুন্দরীর স্থান তৃতীয়
অর্থাৎ কালী, তারা
ও ত্রিপুরাসুন্দরী এই তিনজনের মধ্যে তিনি প্রাচীন। ত্রিপুরসুন্দরীর যন্ত্রের নাম শ্রীযন্ত্র। সাধককুলের কাছে এই
যন্ত্রের সাধনা হল শ্রেষ্ঠ বৈদান্তিক সাধনা। শ্রীযন্ত্রের সাধনার ফলে সাধকের
চতুর্বর্গ অর্থাৎ ধর্ম,
অর্থ, কাম
ও মোক্ষ লাভ হয়। আদি শঙ্করাচার্য ত্রিপুরাসুন্দরী মায়ের উপাসক ছিলেন। কেদারনাথ, বদ্রিনাথ
যাওয়ার পথে শঙ্করাচার্য দেবপ্রয়াগ থেকে চন্দ্রবদনী মন্দিরে এসে শ্রীযন্ত্রের
উপাসনা করেছিলেন। মন্দির প্রাঙ্গণে শিব-পার্বতী, গণেশ, কালী ও হনুমানের পৃথক পৃথক প্রকোষ্ঠে
মূর্তি স্থাপিত আছে। মা দুর্গার অন্য একরূপ চন্দ্রবদনী। প্রবাদ দক্ষযজ্ঞে সতীর
দেহত্যাগের পরে নারায়ন যখন সতীর মৃতদেহ সুদর্শন চক্র দ্বারা খন্ড খন্ড করে
দিয়েছিলেন সেই সময় সতীর শরীরের ধড় এখানে এসে পড়েছিল এবং তাঁর হাতের অস্ত্র
গুলি ও এখানে পড়েছিল। চতুর্দিকে অনেকগুলি ত্রিশূল দেখতে পাওয়া যায় যেগুলিকে
সতীদেবীর হাতের অস্ত্র বলে জনমত বা প্রবাদ। চন্দ্রবদনী মায়ের মন্দিরে কোনও মূর্তি
নেই কিন্তু শিলাখণ্ডের উপরে শ্রীযন্ত্র আছে। চৈত্র মাসে নবরাত্রির সময়ে পূজারী
শ্রীযন্ত্রের উপরে হাতবন্ধ অবস্থায় একটি সামিয়ানা বা চন্দ্রাতপ বেঁধে দেন।
শ্রীযন্ত্রের চতুর্দিক লাল কাপড়ে ঢাকা, কেবলমাত্র শিলাময়ী মায়ের
মুখমণ্ডলটি দেখা যায়। চৈত্র নবরাত্রি, আশ্বিন মাসের নবরাত্রি, বিজয়াদশমী
ও দীপাবলীতে এখানে আড়ম্বর সহকারে পূজা হয় এবং সেই সময়ে উত্তরাখণ্ডের বিভিন্ন
অঞ্চল থেকে অসংখ্য ভক্ত এখানে এসে সমবেত হন। দেবপ্রয়াগ থেকে টিহরি যাবার রাস্তায়
জামনি খাল পেরিয়ে, অনুরূপভাবে
শ্রীনগর থেকে লছমোলিহিসারিয়া খাল পেরিয়ে চন্দ্রবদনী মন্দির যাবার রাস্তা। দুর্গম
পথ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই এবং ব্যাপক প্রচার লাভ করেনি, যার জন্য
পর্যটকরা এখানে খুব কম সংখ্যায় আসেন। কিন্তু চন্দ্রকূট পাহাড়ের শীর্ষদেশে যেখানে
মন্দির সেখান থেকে চারিদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপূর্ব। নিকটবর্তী রেলস্টেশন
ঋষিকেশ অথবা দেরাদুন। দেবপ্রয়াগ থেকে বা শ্রীনগর থেকে গাড়িতে করে এখানে আসা যায়, দূরত্ব কম
বেশি চল্লিশ কিলোমিটার।
উপর থেকে
নিচের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে যখন নেমে এলাম ঘড়ির কাঁটা তখন সময় নির্দেশ করছে পৌনে
চারটা। এখানে একটি খাবারের দোকানে আটার রুটি ও সবজি খেয়ে ক্ষুধার নিবৃত্তি হলো।
সকালে হরিদ্বারের আবাসিক শিবির থেকে আসার
সময় টিফিন করা হয় নি এবং সমস্ত রাস্তাতে খাবার খাওয়ার মতন সেরকম সময় বা সুযোগ
হয়নি। বিকেল চারটার সময় এখান থেকে গাড়ি ছেড়ে পাঁচটার সময় গিয়ে পৌছালাম
দেবপ্রয়াগের ভাগীরথী ও অলকানন্দার সঙ্গমস্থলে। রাস্তার উপর থেকে দেখা যাচ্ছে বাঁ
দিক থেকে ভাগীরথীর নীল জল এবং ডান দিক থেকে অলকানন্দার চন্দন বর্ণের জল এক
জায়গায় মিলিত হয়েছে। ইচ্ছে ছিল ভগীরথ শিলা ও দেবপ্রয়াগের মন্দিরগুলি দর্শন
করার কিন্তু সময় অভাবে মনের সেই ইচ্ছা পূরণ হলো না। এখান থেকে বিকেল সাড়ে
পাঁচটায় বেরিয়ে পথিমধ্যে দেবপ্রয়াগ থেকে বেরোনোর আধঘন্টা পরে রাস্তায় ধসের
জন্য পুনরায় দেরি হল। ঋষিকেশ হয়ে হরিদ্বারে যখন পৌঁছলাম তখন রাত্রি নটা বেজে
গেছে। সারাদিনের ভ্রমণজনিত ক্লান্তিতে হরিদ্বারে আবাসিক শিবিরে যখন পৌঁছালাম তখন
আমরা শারীরিক দিক দিয়ে পরিশ্রান্ত ও বিধ্বস্ত ।
১১ ই মার্চ
শিবরাত্রির দিনে সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত সাধু-সন্ন্যাসীদের স্নানের জন্য
ব্রহ্মকুণ্ডে সাধারণের স্নান সরকার থেকে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। সকাল ন'টায় আবাসিক শিবির থেকে শিবিরের
আবাসিকদের সাথে যেয়ে ব্রহ্মকুণ্ডের বিপরীত তীরে বাঁধানো ঘাটে শিকল ধরে নেমে তিন
ডুব দিয়ে শাহীযোগের স্নান করে পুণ্য লাভ করলাম কিনা জানিনা কিন্তু মনের শান্তি
হলো। বহুদিনের তীর্থ দর্শনের ইচ্ছে পূরণ হয়েছে।
শিবরাত্রির
দিন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে দক্ষ প্রজাপতির মন্দির, বীরভদ্রেশ্বর শিব মন্দির, কঙ্খলের
গঙ্গা আরতি, সতীর
দেহত্যাগের স্থান প্রভৃতি দর্শনের উদ্দেশ্যে গেলাম। প্রত্যেকটি মন্দির ও আশ্রম
আলোকমালায় সুসজ্জিত,
রাস্তায় খুব ভিড়। এখানে মন্দিরগুলি দেখে সামান্য দূরে আনন্দময়ী মায়ের
আশ্রমে সন্ধ্যারতি দেখে আমাদের শিবিরে ফিরে এলাম। পরের দিন বিকেলে রামকৃষ্ণ মিশন, মিশন
পরিচালিত হাসপাতাল যা হরিদ্বারে বাঙালি হাসপাতাল নামে পরিচিত এবং মিশনের পাশে
হরিহর আশ্রমের রুদ্রাক্ষ বৃক্ষ, পারদ শিবলিঙ্গ দর্শন করার সুযোগ হয়েছিল।
১৩ই মার্চ তারিখে হরিদ্বার
থেকে রাত্রের ট্রেনে চেপে ১৫ তারিখ সকাল ন'টায় এসে মেদিনীপুরে পৌছালাম।
তথ্যসূত্র –
১। Google website - উইকিপিডিয়া
২। হিমালয়ের আকর্ষণে -
স্বামী অখন্ডানন্দ।
৩। স্বামী সারদানন্দ চরিত -
তপস্যা ও পর্যটন