অলীক পাতার অন্যান্য সংখ্যা- পড়তে হলে ক্লিক করুন Library ট্যাব টি



। । "অলীক পাতা শারদ সংখ্যা ১৪৩১ আসছে এই মহালয়াতে। । লেখা পাঠানোর শেষ তারিখ ১৫ ই আগস্ট রাত ১২ টা ।.."বিশদে জানতে ক্লিক করুন " Notice Board ট্যাব টিতে"

Showing posts with label ভ্রমণ. Show all posts
Showing posts with label ভ্রমণ. Show all posts

Sunday, January 9, 2022

ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-পর্ব ৩-কৌশিক বসু

 ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী (পর্ব ৩)

কৌশিক বসু

 অলীকপাতা শারদ সংখ্যা ২০২১ থেকে ধারাবাহিক ভাবে শুরু হওয়া আধ ডজন ভ্রমণ কাহিনীর 

তৃতীয় কিস্তি

 আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে ( পর্ব ২)


এবারের পর্ব কুর্গ

এবারে লিখছি আমাদের কুর্গ ভ্রমণ নিয়ে। আগেরদিন বানেরঘাটা ঘুরে রাত্রে মহীশূর থাকার একটি কারণ ছিল কুর্গের দিকে একটু এগিয়ে থাকা যাতে একদিনের সফরে একটু  বেশী সময় হাতে থাকে। খ্রীষ্টমাস ইভ এর দিন অর্থাৎ ২৪ ডিসেম্বর ২০১১, সকাল আট টা নাগাদ হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমরা, বেশ কনকনে ঠান্ডা  লাগছিলো সকালে, এতটা ঠান্ডা আশা করিনি রাস্তায় একটু দাঁড়িয়ে ব্রেকফাস্ট করে নেওয়া হলো। ব্রেকফাস্ট যাকে বলে বেশ গুছিয়েই হয়েছিল, তার পরে রাস্তায় প্রচুর ফলের দোকান দেখলাম, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো কমলালেবু, খুব ইচ্ছে হচ্ছিল কেনার কিন্তু গিন্নী মানা করলো - এক ছেলে গাড়ি নোংরা করবে খেতে গিয়ে আর লম্বা সফর বাকি আরো ৮ দিনের যার মধ্যে বাসে যাওয়া আছে। তাই নিজের তাৎক্ষণিক লেবু খাবার ইচ্ছা দমন করতেই হলো, অগত্যা গোমড়া মুখে চললাম।

 

ছেলে বসেছিল ড্রাইভারের পাশে, ড্রাইভার সাহেব বিশাল চেহারার কানাড়ি ভদ্রলোক, ব্যাঙ্গালোর থেকে আমাদের সঙ্গে আছেন গতকাল থেকে, বাচ্চা ছেলেকে গান শোনাচ্ছিলেন নিজের পেন ড্রাইভ এর স্টক থেকে, তার মধ্যে একটি গান ছিল - ওয়াই দিস কোলাভেরি  দি। শুনে ছেলে মোহিত, ড্রাইভার সাহেবও ছেলেকে খুশি করে প্রথমে খুশি, কিন্তু একটু বাদে বুঝতে পারলো কি ভুল করেছে। একবার করে গান শেষ হচ্ছে আর ছেলে অমনি রিওয়াইন্ড বোতাম টিপে আবার এক গান বাজাচ্ছে। এক গান শুনে কান প্রায় পচে যাওয়ার জোগাড়! এইসব চলতে চলতে প্রায় আড়াই ঘন্টা গাড়িতে লাগলো প্রথম গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে।

 

প্রথম গন্তব্যস্থল আবে জলপ্রপাত। এই শীতকালে জলপ্রপাতে যথেষ্ট জল দেখে লেবু না খাবার দুঃখ বা এক গান শোনা পচা কান নিমেষে ঠিক হয়ে গেল। বেশ ভালোই ভিড় ছিল, যতবার ছবি তুলতে যাই, কেউ ঠিক ফ্রেম এ ঢুকে পড়ে। আমাদের দেশে লোকজন এতো অবুঝ কেন ভাবতে ভাবতে যেভাবে পারি ছবি তুলে ফেললাম পটাপট। একটি ছোট লোহার ব্রিজ রয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য, সেখান থেকে সুন্দর কিছু ছবি তুলে একটু শান্ত হলাম। কালো পাথরের ওপর জলের সাদা ধারা, যদিও প্রায় পুরোটা গাছের ছায়ায় নাহলে হয়তো ছবি আরো ভালো আসত।

 

জলপ্রপাত থেকে আমরা মেডিকেরির দিকে রওনা হলাম, রাস্তায় হরিণ দেখলাম কয়েকবার। প্রথমবার তো গাড়ি দাঁড় করিয়ে রীতিমতো ছবিও তোলার প্রচেষ্টা হলো, কিন্তু হরিণ বড়ই লাজুক, তাই ক্লিক করার আগেই ঝোঁপের মধ্যে ধুলে গেল, অগত্যা জায়গাটারই একটা ছবি তুললাম - সবুজে মোড়া চারদিক, মাঠে গরু চড়ছে। ড্রাইভারসাহেবের কাছে শুনলাম আরো অনেক জন্তু জানোয়ার দেখা যায় উনি নিজে দেখেছেন - হাতি, চিতা, শুয়োর, ইত্যাদি। এরপর আমরা মেডিকেরি  পৌঁছলাম।

 

একদম প্রথমে গেলাম ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরে। প্রথমে মন্দিরে যাওয়ার কারণ কিছুক্ষনের মধ্যে মন্দির দুপুরে বন্ধ হয়ে যাবে। এই মন্দিরটি ভগবান শিবকে উত্সর্গীকৃত একটি প্রাচীন মন্দির। রাজা লিঙ্গরাজেন্দ্র দ্বারা ১৮২০ সালে নির্মিত মন্দিরটির বিশেষত্ব হ'ল এটির নির্মাণ গথিক এবং ইসলামী শৈলীর মিশ্রণকে প্রতিফলিত করে। এটা বিশ্বাস করা হয় যে এখানে প্রতিষ্ঠিত ভগবান শিবকে কাশী থেকে আনা হয়েছিল এবং কাশীতে পূজা করা পাঁচটি শিবলিঙ্গদের মধ্যে অত্যন্ত পবিত্র একজন।

 

এর পরের গন্তব্যস্থল রাজার আসন (Raja’s seat)। তা যে রাজার কারণে এই স্থানের নামকরণ তিনি যে প্রকৃতি প্রেমিক তাতে কোনো সন্দেহ রইলো না এখানে এসে। অনেকটা খোলা জায়গা চারদিকে, বহুদূর অবধি দেখা যায়, তাই দৃশ্যও অতি মনোরম। এখানে নিচে একটি প্রায় অর্ধ বৃত্তাকার বারান্দার মতন আছে আর ওপরে রাজার আসন। এক দিনের না হলেও নিজেকে এক পলকের রাজা মনে করার চেষ্টা করে এই অপরূপ সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করলাম কিছুক্ষণ। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে কিছু ছবিও তুললাম। এখানে একটি অত্যন্ত ছোট টয় ট্রেন আছে জাতীয় চড়ে কাছাকাছি অনেকটা ঘুরে দেখা যায়, সৌভাগ্যবশতঃ খুব একটা বেশিক্ষণের অপেখ্যা করতে হয় এমামদের তার জন্য। কিছুটা রাজার বাগান আর কিছুটা অকৃত্তিম প্রকৃতি ভরা রাজ্য ঘুরে দেখা হলো এই ভাবে।

 

ঘুরতে ঘুরতে দুপুর দুটো বেজে গেছে, খিদেও পেয়েছে প্রচন্ড, তাই খাওয়াটাও হলো রাজকীয়, যে রেস্টুরেন্টে গেলাম সেখানে শুধু খালি পাওয়া যাচ্ছিলো তখন, অগত্যা তাই অর্ডার করলাম। খেয়ে দিয়ে আবার মেডিকেরি দুর্গ জয় করতে এগিয়ে পড়লাম আমরা। দুর্গ  বিশাল বা আহামরি কিছু নয়, কিন্তু এসে যখন পড়েছি তখন ঘুরে দেখলাম। এখানে দশেরা খুব ধুমধাম করে হয়, তার কিছু মূর্তি দুর্গের নিচে রাখা আছে, আর কিছু মূর্তি আছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কালো পাথরের হাতি। আরেকটি উল্লেখযোগ্য জায়গা হলো একটি ছাদের মতো জায়গা যেখান থেকে অনেকটা দেখা যায় দুর্গের।

 

এরপর আমরা পৌঁছলাম দুবারে হাতির ক্যাম্পে, এখানে বুনো হাতি ধরে এনে পোষ মানানো হয়। আমরা পৌছেছি তখন প্রায় সাড়ে তিনটে বেজে গেছে, আমাদের হাতির স্নান দেখার সৌভাগ্য আর হয় নি। পাশ দিয়ে কাবেরী নদী বয়ে চলেছে, সৌভাগ্যবশতঃ শীতকাল হলেও জল ভালোই  ছিল, একটু নৌকোবিহার করলাম, সঙ্গে প্রকৃতিকে উপভোগ করা হলো, ঘন সবুজে ঘেরা চারদিক, দূরে কয়েকটা বকও  দেখা গেল উপরি হিসেবে।

 

পরের গন্তব্যস্থলের  নাম খুব সুন্দর, নামকরণের তাৎপর্য বুঝতে হলে একবার এখানে আসতেই হবে। তবে রাস্তায় গ্রামগুলিও খুব সুন্দর, গাড়ি দাঁড় করিয়ে কয়েকটা ছবিও তুললাম। যাইহোক, জায়গার নাম নিসর্গধাম, কাবেরী নদীর একটি ব দ্বীপ - আরেকটি দারুন টুরিস্ট স্পট। ঢুকেই প্রচুর হাঁস আর রাজঁহাস দেখা গেল, গেটের মুখ থেকেই অনেকগুলো পাখি আর জন্তুর খোপ আছে ডান দিকে, সেখানে হাঁস ছাড়া ময়ূর আর  খরগোশ। একটা রাজঁহাস তো প্রায় ঠুকরে দিচ্ছিল আরেকটু হলে জালের ফাঁক থেকেই! নদীর ওপর একটি সরু লোহার দড়ির সাঁকো আছে যা দিয়ে নদীর ওপর ঘুরে এলাম, পাশে একটি দড়ির পুরোনো সাঁকো আছে, যাতে ট্যুরিস্টদের উঠতে দেয়া হয়না অবশ্য সতর্কতা হিসেবে। চারদিকে গাছে অনেক বাঁদর রয়েছে, টুরিস্ট দেখে অভ্যস্ত, একটি তো গাছ থেকে সাঁকোর দড়ির ওপর দিয়ে ব্যালান্স করে এগিয়ে এলো। আরেকটি একটু দূরে অপেক্ষা করছে - বোঝা গেল খাবারের আশায় এসেছে। আরেকটু লক্ষণীয় ব্যাপার হলো নদীর নিচে অনেক মাছ ঝাঁক বেঁধে অপেক্ষা করছে ওপর থেকে খাবারের আশায়। এখানে লোহার জালে ঘেরা অনেক হরিণ এবং তাদের খাওয়ানোর ব্যবস্থাও আছে, তাই আমার উৎসাহিত হলাম হরিণ কে খাওয়াতে। পাশেই ১০ টাকার শসার প্লেট বিড়ি হচ্ছিলো, একটা বড় শসাকে ৪ টি লম্বা টুকরো করে কেটে দিচ্ছে, এক প্লেট কিনে নিলাম। একটি করে শসার টুকরো আমি আর ছেলে খাওয়ালাম, গিন্নীর একটু জন্তু জানোয়ারের প্ততি ভয় আছে, সে ফটোগ্রাফার হয়ে ছবি তুললো। এর মধ্যেই একটি ঘটনা ঘটলো - আমি দ্বিতীয় শসার টুকরো খাওয়ানোর চেষ্টা করছি, ছেলের হাতে শেষ টুকরো, হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, সেও শসাতে কামড় বসিয়ে দিয়েছে। শসা তার খুব প্রিয়, তাই আরেকটি টুকরো হরিণকে না খাইয়ে নিজেই খেয়ে নিলো। এখানে হাতির পিঠে চড়ার সুযোগ আছে, যদিও আমরা আর তা করলাম না। হরিণশালার ঠিক পেছনে একটি বাঁশবনও আছে, যা ঘুরে দেখার জন্য ও ছবি তোলার জন্য বেশ ভালো স্পট। একটু হেঁটে চলে গেলাম তাল কাবেরী বলে একটি জায়গায়। তাল কাবেরী কে কাবেরী নদীর উৎস হিসেবে গণ্য করা হয় এবং পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য করা হয়, অনেকে পুজো আর্চা করছিলো দেখলাম। সবমিলিয়ে নিসর্গধাম অভিজ্ঞতা খুবই মনোময়।

 

আমাদের শেষ গন্তব্যস্থল বাইলাকুপপে। এটি কূর্গ বা কোডাগু জেলার অন্তর্গত নয়, মহীশুর জেলার অন্তর্গত। ধর্মশালার পরে তিব্বতের বাইরে বাইলাকুপে ভারতে দ্বিতীয় বৃহত্তম তিব্বতি বসতি, স্থাপিত হয় ১৯৬১ সালে । এখানে আমরা নামড্রোলিং মঠটি দেখতে এলাম যা স্বর্ণ মন্দির নামেও পরিচিত। দলাই লামার ছবি সমেত অনেক বৌদ্ধ মূর্তি দেখার সৌভাগ্য হলো আমাদের। মন্দিরের বিস্তারিত কারুকার্য মুগ্ধ করার মতো, তার সঙ্গে বাইরে শান্ত পরিষ্কার পরিবেশ, বেশ ভালো লাগলো, সঙ্গে উপরি হিসেবে বাগানে পাখি আর ফুল।

 

সেখান থেকে মহীশুর ফিরে আমরা একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে চিকেন চেট্টিনাড আর রুটি দিয়ে ডিনার সেরে হোটেলে ফিরলাম। একদিনের পাওয়ার প্যাকড সফর শেষ করে। ছবি তো প্রচুর তুলিই, কিছু ছবিও পোষ্ট করলাম, কেমন লাগলো জানাবেন।

  

আবে জলপ্রপাত

 

ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরে প্রবেশ করার জন্য জলাশয়ের ওপর কংক্রিট এর সরু ব্রিজ




মন্দিরের প্রবেশ দ্বার



মন্দির প্রাঙ্গণ

 

 রাজার আসন থেকে নৈসর্গিক দৃশ্য



রাজার আসন



টয় ট্রেনে দেখা দৃশ্য  রাজার বাগান

 

 

নিসর্গধামকাবেরী নদীর ওপর লোহার সাঁকো থেকে পুরোনো দড়ির সাঁকো

 

নৌকাবিহার

কূর্গের গ্রাম জীবন

খাবারের আশায় এগিয়ে আসছে
নামড্রোলিং মঠের প্রবেশ দ্বার 
হরিণ কে শসা খাওয়ানো পর্ব



বাঁশবনে কুমফু পান্ডা কে মনে পড়ে গেছে
খাবারের আশায় জলে অপেক্ষা


 
 স্বর্ণ মন্দির

 আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে ( পর্ব ২)

ছবিঃ লেখক

 

 

ফিরুন সূচিপত্রে



| হিম সংখ্যা-১৪২৮| aleekpata.com|
  |ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty|
 Winter , 2021 | August -December 2021 | Fifth Year  Second  Issue |28 th Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |

 


 

 

 

 

 


 


 

 

 





ভ্রমণ-নীলকণ্ঠেশ্বর মহাদেব ও চন্দ্রবদনী মন্দির দর্শন - দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

 

নীলকণ্ঠেশ্বর মহাদেব ও চন্দ্রবদনী মন্দির দর্শন

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী    

  

চন্দ্রবদনী দেবীর মন্দির


অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল সময় ও সুযোগ ঘটলে উত্তরাখণ্ডের নীলকণ্ঠেশ্বর মহাদেব ও চন্দ্রবদনী মন্দির দেখে আসার কিন্তু সময় ও সুযোগ হচ্ছিল না। অবশেষে ২০২১ সালের অর্থাৎ এই বছরের হরিদ্বার পূর্ণকুম্ভে গিয়ে সেই সুযোগ এসে গেল। অবশ্য প্রচলিত কথা আছে তীর্থের দেবতার আহ্বান না হলে যতই চেষ্টা করি না কেন যাওয়ার সুযোগ ঘটবে না।

কুম্ভমেলাতে যাবার দুমাস আগে ট্রেনের যাতায়াতের সংরক্ষিত টিকিট কেটে নিশ্চিন্ত হয়েছি। যাত্রার তারিখ পূর্বে আর দেখিনি, যতদূর সম্ভব মনে আছে যে আমি ৫ই মার্চ তারিখের টিকিট কেটে ছিলাম এবং সেইভাবে সকল শুভানুধ্যায়ীকে জানিয়েছিলাম। জিনিসপত্র সব গুছিয়ে চার তারিখে সন্ধ্যের সময় স্ত্রীর সাথে চায়ের টেবিলে বসে ট্রেনের টিকিট বের করে দেখতে পেলাম সেই দিনেই দুপুর  একটাতে আমার নির্দিষ্ট ট্রেন হাওড়া থেকে চলে গেছে। প্রৌঢ় বয়সের দৃষ্টিবিভ্রম। কি করব, কিভাবে যাব যখন কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। মনে খুব আঘাত পেলাম এই ভেবে যে সবকিছু পূর্বের থেকে ব্যবস্থা করেও যাওয়া হলো না। আগেই বলেছিলাম তীর্থদেবতার আহ্বান না হলে কিছুতেই যাওয়া হবে না। যাইহোক তীর্থদেবতা যেন আমার মনোবেদনা জানতে পারলেন। এই সময় যেন ঈশ্বরপ্রেরিত দূত হয়ে আমার জ্যেষ্ঠপুত্র শ্রীমান পার্থ তার ওয়ার্কশপ থেকে বাড়িতে এলো। সে এসে সমস্ত ঘটনা শুনে আমার দুশ্চিন্তার অবসান ঘটালো। আইআরসিটিসি অ্যাপ বের করে ৫ই মার্চ তারিখের ০২৩২৭ নম্বর ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কোচের একটি টিকিট কেটে আমাকে চিন্তার হাত থেকে মুক্ত করল।

 

এবারে আমার যাবার কথা শুনে আত্মীয়-স্বজন শুভানুধ্যায়ীরা নিষেধ করে বলেছিলেন "তিনবার পূণ্য স্নান হয়েছে এবারে করোনার সময়ে না গেলেই ভালো হয়"। কিন্তু কুম্ভের কি যে আকর্ষণ জানিনা, পথে বেরিয়ে পড়লাম। ৫ তারিখে। পরের দিনে নির্দ্ধারিত সময়ের আধ ঘণ্টা আগে বিকেল তিনটে কুড়ি মিনিটে ট্রেন পৌঁছাল হরিদ্বার স্টেশনে।  ভারতীয় রেলের নিয়মানুবর্তিতা এবং ট্রেনের ভিতরের ও স্টেশনের পরিছন্নতা দেখে খুব ভালো লাগলো। স্টেশন থেকে একটি অটো করে আমি বিবেকানন্দ সেবা সমিতির শিবিরে  বিকেল চারটার পূর্বে পৌছালাম।

 

৬ ই মার্চ আমার বন্ধু শ্রী সুকোমল মণ্ডল সস্ত্রীক হরিদ্বারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল। আমরা আগেই স্থির করেছিলাম যে হরিদ্বারে গিয়ে ৮ এবং ৯ই মার্চ  হরিদ্বার থেকে যথাক্রমে নীলকণ্ঠেশ্বর মহাদেব ও চন্দ্রবদনী মন্দির দর্শন করতে যাব এবং ১০ই মার্চ তারিখে বিশ্রাম নিয়ে ১১ তারিখে শাহীস্নান করবো।  ৬ তারিখে বিকেলে পৌছালাম এবং ৭ তারিখে গাড়ির ব্যবস্থা করে স্থির হল ৮ তারিখে একটি 'ট্রাভেরা' গাড়ি করে আমরা নীলকন্ঠ মহাদেব দর্শন করে ফিরে আসবো এবং ৯ তারিখে একটি 'বোলেরো' গাড়ি করে চন্দ্রবদনী মন্দির দর্শন করে ফিরব। হরিদ্বারে আমাদের আবাসিক শিবিরে পৌছাবার পরে আরও চার পাঁচজন আবাসিক আমাদের সাথে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করাতে তাদেরও সঙ্গে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হল। যে দুই তীর্থের দেবতাকে দর্শন করার ইচ্ছা দীর্ঘদিন যাবৎ মনের সংগোপনে জারিত হয়েছিল সেগুলি আশা করছি এবারে ফলপ্রসূ হতে চলেছে।    

 

       ৮ই মার্চ তারিখে অর্থাৎ সোমবার সকাল পৌনে নটাতে আমরা পাঁচজন অর্থাৎ আমি, আমার বন্ধু শ্রী সুকোমল মণ্ডল ও তার স্ত্রী মালতি, শিবিরে আমার সাথে একই ঘরে আছে বাবুলাল ও সুভাষ। শিবির থেকে বেরোনোর আগে চা ও জলখাবার খেয়ে নিলাম। কঙ্খলের শঙ্করাচার্য চক থেকে আমাদের গাড়ি পূর্বদিকে ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে ব্রহ্মকুণ্ডকে বাঁ দিকে রেখে ঋষিকেশ যাবার রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। আজ থেকে চোদ্দ বৎসর পূর্বে এসে দেখেছিলাম হরিদ্বার ও হৃষীকেশের মাঝে অনেক ফাঁকা জায়গা ছিল। কিন্তু বর্তমানে দুই শহরের বিস্তৃতির ফলে সেই ফাঁকা জায়গাগুলি দেখতে পাচ্ছি রাস্তার দু'পাশে গগনচুম্বী অট্টালিকার সারিতে ভরাট হয়ে গেছে। রাস্তার দু'পাশে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সুসজ্জিত শোরুম। ঋষিকেশ শহর ছাড়িয়ে গঙ্গার উপরে পুল পেরিয়ে গঙ্গা নদীকে বাঁ দিকে রেখে আমরা নীলকণ্ঠেশ্বর মহাদেবের আবাসস্থল মণিকূট পর্বতের উদ্দেশ্যে ঋষিকেশ থেকে পাহাড় ও গভীর জঙ্গলের পথে রওনা হলাম। হৃষীকেশের পরে মাঝে মাঝে গঙ্গা নদীকে বাঁ দিকে দেখতে পাচ্ছি। সুন্দর পিচঢালা রাস্তা, পাহাড়-জঙ্গল এবং মাঝে মাঝে সবুজ উপত্যকা পেরিয়ে সকাল এগারোটা নাগাদ মণিকূট পর্বতের পাদদেশে যেয়ে পৌছালাম। গাড়ীকে মন্দিরের এক কিলোমিটার দূরে পার্কিং করতে হলো। এখান থেকে পায়ে হেঁটে যেতে হবে। শিবরাত্রির পূর্বের সোমবার বলে এখানে খুব ভীড়। কিছুদুর যাবার পরে রাস্তার উপরে নীলকন্ঠ মহাদেব তোরনদ্বার।

 

এখন তো আমরা মন্দিরের নিকট পর্যন্ত গাড়িতে আসতে পারছি। অথচ আজ থেকে প্রায় ১৩১ বৎসর আগে স্বামী বিবেকানন্দের গুরুভ্রাতা স্বামী সারদানন্দ, স্বামী তুরীয়ানন্দ এবং স্বামী কৃপানন্দ ১৮৯০ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি শিবরাত্রির দিনে যখন এখানে এসেছিলেন সেই সময়ে তাঁরা ঋষিকেশ থেকে পদব্রজে এসেছিলেন। স্বামী সারদানন্দ চরিত - তপস্যা ও পর্যটন গ্রন্থে এখানে আসার যে অভিজ্ঞতা ও পথের বর্ণনা যেভাবে স্বামী সারদানন্দ মনের আনন্দে শ্রী প্রমদাদাস মিত্রকে লিখিলেন – ‘পথ অতি দুর্গম, পর্বতের চড়াই অতি উচ্চ পাকদণ্ডী দিয়ে লতাপাতা আঁকড়ে ধরে পাহাড়ে চড়তে হয়েছিল। নীলকন্ঠের দৃশ্যের কথা আর লিখিয়া কি জানাইব। এমন শান্তিময় স্থান আর কোথাও দেখি নাই। এখানে নীলকন্ঠ নামে একটি অনাদি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্টিত আছেন। চতুর্দিকে বড় বড় পর্বত দিয়ে ঘেরা, মধ্যে একটি ছোট পর্বতের শিখরে মহাদেবের মন্দির। মন্দিরের বিশ-ত্রিশ হাত অন্তরে একটি নির্ঝর অতি মিষ্ট ঝর্ঝর শব্দ করিয়া চলিয়া যাইতেছে। নানা প্রকার পক্ষী সকল ডাকিতেছে ও পর্বতের বনরাজি সকল মধ্যে অতি সুমিষ্ট গন্ধ দান করিতেছে। নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে হিংস্র জন্তু থাকা দূরে থাকুক, একটা শিয়াল পর্যন্ত ডাকিতে শুনি নাই। বন যে কেবল জঙ্গুলে গাছে পূর্ণ তাহা নয় তপোবনসুলভ  সুস্বাদু ফল -  আম, পিচ, কলা, লেবু, পেয়ারা প্রভৃতির গাছ আছে, কন্দও প্রচুর পাওয়া যায়। স্থানটি এত চিত্তপ্রসাদকর ও মনোহর যে এখানে আসিলে আপনা হইতেই মনে ধ্যান ও ভাবের উদয় হয়। স্বভাবের সুন্দর দৃশ্য ও নিস্তব্ধতার দরুন মনকে একেবারে উদাস করিয়া ভয়, ভক্তি, প্রেম, বিশ্বাস ও উল্লাসে ডুবাইয়া দেয়। এমন চৈতন্যময় স্থান আর কোথাও দেখি নাই। বোধ হয় যেন দেবাদিদেব মহাদেব এইমাত্র এখান হইতে তপস্যা করিয়া উঠিয়া গেলেন। অধিক আর কি বলিব - পর্বত হইতে নামিবার সময় মা গঙ্গার শোভা ও ভাব দেখিয়া আমাদের মনে কান্না আসিল। ঠিক এই রকম দেখিলাম, যেন পতিতপাবনী জগজ্জননী গঙ্গা স্বর্গ হইতে নামিয়া কেবল উত্তরাখণ্ডকে পবিত্র ও ধন্য করিয়া আবার স্বর্গের বাসিনী স্বর্গেতেই ফিরিয়া যাইতেছেন, মর্ত্যলোকে আর নামিলেন না। মায়ের জলেরও যে কত বাহার দেখিলাম তা আর কি লিখিব - যেন উজ্জ্বল হীরার ধারা, রজতের ধারা, অনুপম।‘  পথে তাঁরা শ্রী বীরভদ্রও দর্শন করেছিলেন।  ঋষিকেশ তখন সত্য সত্যই ঋষিসেবিত স্থান ছিল - শান্ত, নির্জন, মৌন।  স্বামী সারদানন্দের  দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল মা গঙ্গার রূপের কত বাহার, গভীর অরণ্যানীর বিটপীগুলি ফলভারে নম্র, কোথাও হিংস্র জন্তুর আওয়াজ নেই, ডালে ডালে পাখির কূজন, মৌন পর্বত - যেন সত্য সত্যই মহাদেবের আবাসস্থল। প্রকৃতির সেই উন্মুক্ত আবাসস্থলে শিবরাত্রির দিন স্বামী সারদানন্দ এক শিলাখণ্ডের উপরে সারারাত্রি ধ্যানে মগ্ন ছিলেন।   

 

নীলকন্ঠেশ্বর পৌঁছাবার আগে নীলকন্ঠ মহাদেব সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য পাঠকের কাছে উপস্থাপনা করছি। সমুদ্র মন্থনে অমৃত লাভ করে দেবতা ও অসুরেরা যখন বিবাদগ্রস্ত সেই সময়ে বাসুকিনাগের তীব্র বিষের জ্বালায় ত্রিজগতের সমস্ত প্রাণী জগৎ ও প্রকৃতিতে এক অস্থির অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। জলের প্রাণীরা ডাঙ্গাতে ছটফট করে মারা যাচ্ছে, বৃক্ষ সকল শুকিয়ে যাচ্ছে, মানবকূল বিষের জ্বালাতে আর্তনাদ করে প্রাণত্যাগ করছে। ত্রিজগতের এরূপ অবস্থা দেখে দেবাদিদেব মহাদেব হলাহল পান করে নীলকন্ঠ হলেন। এদিকে বাসুকিনাগের শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভেঙে এক মাংসপিন্ডে পরিনত হয়েছে। তিনি অর্ধমৃত হয়ে পড়ে রইলেন। সবাই যে যার স্বার্থ ফুরিয়ে যেতে পালিয়ে গেলেন অথচ যে বাসুকিনাগ স্বেচ্ছায় দেবগনের উপকারের কথা ভেবেছিলেন তার দিকে আর কেউ ফিরেও দেখলেন না। মহাদেব তখন বাসুকিনাগকে তাঁর পার্বণীর রাজপ্রাসাদে নিয়ে যেয়ে সেবা শুশ্রূষা করে সুস্থ করে দিলেন এবং ঋষিকেশের উত্তরে বিষ্ণুকূট, ব্রহ্মকূট এবং মণিকূট উপত্যকার মণিকূট পর্বতে নীলকন্ঠ মহাদেব রূপে বিরাজ করতে লাগলেন। প্রবাদ সমুদ্রমন্থনের গরল পান করে ভগবান এখানেই নীলকন্ঠ মহাদেব হয়েছিলেন এবং তারপরে ষাট হাজার বৎসর এখানে তপস্যা করে বিষমুক্ত হয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ করা যায় যে মহাদেব যখন বিষ পান করেছিলেন সেই সময়ে মা পার্বতী মহাদেবের গলা চেপে ধরেছিলেন যাতে বিষের প্রভাব গলার নিচে নামতে না পারে।    

 

নীলকন্ঠ মহাদেব তোরনদ্বারে আমরা পুজোর জন্য জল, দুধ, ফুল, বেলপাতা, নৈবেদ্য ইত্যাদি কিনে ধীরে ধীরে এগোচ্ছি। অগণিত ভক্ত পায়ে হেঁটে এগিয়ে চলেছেন। পাহাড়ি রাস্তা উপরের দিকে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে উচ্চতার জন্য সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করে যেতে হচ্ছে যার ফলে জোরে হাঁটা যাচ্ছে না। প্রায় ৪৫ মিনিট হাঁটার পরে আমরা মন্দিরের নিকটে এসে পৌছালাম। এখান থেকে সরু রাস্তার দু'পাশে এলাকার অধিবাসীদের বাড়িঘর এবং পূজার উপকরণ ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে দোকানীরা বসে আছেন। ভক্তদের যাবার জন্য রাস্তার দুই পাশে লোহার রেলিং, মাথার উপরে আচ্ছাদন। একসময় পথ শেষ হয়ে মন্দিরের গর্ভগৃহের সামনে উপস্থিত হলাম। গর্ভগৃহের দিকে মুখ করে বসে আছেন নন্দীশ্বর। গর্ভগৃহের দরজার সামনে পূজারীরা বসে আছেন। নিরাপত্তারক্ষীদের প্রচণ্ড ব্যস্ততা। উল্লেখ্য যে নীলকণ্ঠেশ্বর মহাদেবের গর্ভগৃহ যেখানে সুদৃশ্য লিঙ্গ বিরাজিত সেই গর্ভগৃহটি আয়তনে এতই ছোট যে সেখানে তিন-চারজনের বেশি ভক্তের স্থান সংকুলান হয় না যার জন্য গর্ভগৃহের দুই দিকের প্রবেশপথের উপরে পিতলের যোনিপীঠসহ লিঙ্গের উপরে জল অভিষেক করার ব্যবস্থা আছে। সেখানে দুধ,জল ঢাললে সেই দুধ,জল পাইপের সাহায্যে যেয়ে অনাদি লিঙ্গকে অভিষিক্ত করছে। আমরাও সেখানে দুধ, জল ঢেলে ফুল বেলপাতা নিবেদন করলাম। পূজারীর হাতে নৈবেদ্য দিতে তিনি শিবলিঙ্গ স্পর্শ করিয়ে আমাদের হাতে দিয়ে দিলেন। মন্দিরে এত ভীড় যে সেখানে এক মিনিটের বেশি দাঁড়ানো যাচ্ছে না, নিরাপত্তা রক্ষীরা ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছেন।      

 

মন্দির থেকে বেরোবার পরে নিরাপত্তারক্ষীরা একটি সহজ রাস্তা দেখিয়ে দিলেন যাতে দশ মিনিটের মধ্যে আমরা যাবার সময়ে যে সরু রাস্তা দিয়ে গিয়েছিলাম সেই রাস্তায় না যেয়ে মূল রাস্তাতে এসে পৌছালাম। গাড়ির কাছে আসতে আরো আধঘণ্টা সময় লাগলো। সবাই এসে পৌঁছাতে গাড়ি ছাড়লো বেলা দেড়টার সময়। এখান থেকে আমাদের গন্তব্য স্থল ৩২ কিলোমিটার দূরের ঋষিকেশ। ঋষিকেশ বর্তমানে একটি জনবহুল শহরে পরিণত হয়েছে যার ফলে আমাদের গাড়ি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে  মিনিট পঁচিশ হেঁটে আমরা যেয়ে পৌছালাম লছমনঝুলা ব্রিজের অপরপাশে চোদ্দো তলার কৈলাসানন্দ মিশন আশ্রমের মন্দিরে। হেঁটে যেতে হবে বলে সুকোমল ও মালতি গাড়ির কাছেই থেকে গেল। মন্দিরের চোদ্দো তলা পর্যন্ত উঠে সমস্ত কিছু দেখে সুভাষ এবং বাবুলাল গীতাভবন ও রামঝুলা দেখতে গেল। আমি আর ওদের সাথে গেলাম না। সবাই একত্রিত হওয়ার পরে বিকেল পাঁচটায় গাড়ি ছাড়লো।  হরিদ্বারে আমাদের আবাসিক শিবিরে এসে পৌছালাম সন্ধ্যা সাতটায়।

 

পরের দিনে অর্থাৎ ৯ই মার্চ তারিখে সকলে সকাল আটটাতে শিবির থেকে চা, বিস্কুট খেয়ে একটি বোলেরো গাড়ি করে আটজনে রওনা হলাম চন্দ্রবদনী দেবীস্থান দর্শনের উদ্দেশ্যে।  আগের দিনের আমরা পাঁচজন এবং শিবিরের অন্য তিন আবাসিক শিবানী গাঙ্গুলি, চন্দনা দত্ত এবং তার সাথী। আগের দিনের একই রাস্তাতে ঋষীকেশ পৌঁছে সকাল দশটায় সেখান থেকে ৫৮ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে আমাদের দেবপ্রয়াগে যাবার রাস্তা। রাস্তার ক্রসিংয়ে উত্তরাখণ্ড পুলিশের ব্যারিকেড। জিজ্ঞেস করে জানা গেল দেবপ্রয়াগের রাস্তাতে পাহাড় থেকে ধ্বস নামার জন্য রাস্তা বন্ধ। অগত্যা আমাদের ঘুরপথে অর্থাৎ নরেন্দ্রনগর, তেহরীবাঁধ হয়ে যেতে হবে। পথের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘায়িত হোল। উপায় নেই, এখান থেকে তো আর ফিরে যাওয়া যাবেনা। দেবপ্রয়াগ থেকে কুড়ি কিলোমিটার যাবার পরে নরেন্দ্রনগর। পাহাড় জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ক্রমশ উপরের দিকে গাড়ি উঠছে। যাবার পথে আমাদের গাড়ির ড্রাইভার পলক সিং দেখিয়ে দিলেন রাস্তার বাঁদিকে নরেন্দ্রনগরের পূর্বতন রাজার প্রাসাদ। আমাদের যথেষ্ট দেরি হয়েছে তারপরে পথের দৈর্ঘ্য বেড়ে গেছে যার জন্য রাজপ্রাসাদ দেখার ইচ্ছা হলেও আমরা প্রকাশ করলাম না। ক্রমশঃ উপরের দিকে গাড়ি উঠছে। নরেন্দ্রনগর থেকে তেহরি বাঁধ প্রায় ৬৫ কিলোমিটার রাস্তা। আগর, ফাকোট, চম্বা হয়ে দুপুর বারোটার পরে আমরা পাহাড়ঘেরা নীল জলের তেহরি বাঁধের নিকটে গিয়ে পৌঁছলাম। দুই পাহাড়ের মাঝখানে ভাগীরথী নদীতে বাঁধ দিয়ে জলস্রোতের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সেচের ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়েছে বিস্তীর্ণ অববাহিকা অঞ্চলে। যেহেতু নদীবাঁধ নির্মাণের সময় রাজনৈতিকভাবে ভারতবর্ষ উত্তাল হয়েছিল এবং যার জন্য বাঁধটির নির্মাণকার্য সম্পূর্ণ হতে নির্ধারিত সময়ের থেকে বিলম্ব ঘটেছিল সেই জন্য তেহরি বাঁধ নির্মাণের আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি।            

 

আন্দোলনের কারণ ছিল হিমালয়ের এই অঞ্চলের ভঙ্গুর শিলার গতি-প্রকৃতির জন্য এবং সব থেকে বড় কথা এই অঞ্চল ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। ১৯৯১ সালের অক্টোবর মাসে উত্তরকাশীতে যে ভূমিকম্প হয়েছিল তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই অঞ্চল থেকে ৫৩ কিলোমিটার ব্যাসার্দ্ধের মধ্যে। এছাড়াও পরিবেশবিদরা আশঙ্কা করেছিলেন এই বাঁধ নির্মাণ হিমালয়ের এই অঞ্চলের জীবনযাত্রা, পরিবেশ ও প্রাণী বৈচিত্রে আঘাত হানবে। যে অঞ্চলে বাঁধটির নির্মাণকার্য হয়েছে ভূতাত্ত্বিকদের মতে সেই অঞ্চলটি মধ্য হিমালয়ের ভূকম্পন এলাকায় অবস্থিত, যদিও নির্মাণ বিশেষজ্ঞদের মত ছিল বাঁধটির নির্মাণকার্য এমনভাবে হয়েছে যে ৮.৪ রিখটার স্কেলের ভূকম্পন প্রতিহত করার ক্ষমতা আছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মত ছিল হিমালয়ের এই অঞ্চল এমন এক জায়গাতে অবস্থিত যেখানে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা বেশি। ১৯৯১ সালের উত্তরকাশী ভূমিকম্পের পরে ২৭শে অক্টোবর থেকে ৪ঠা নভেম্বর পর্যন্ত আইআইটি কানপুরের বৈজ্ঞানিকরা স্থানটি পরিদর্শন করে তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন সন্নিহিত অঞ্চলের ১২৯৪টি গ্রামের প্রায় তিন লক্ষ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, ৭৬৮ জন নিরীহ  গ্রামবাসী মারা গেছলেন, ৭৫০৩টি বাড়ি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল এবং আরো অসংখ্য বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল ছিল গঙ্গোত্রী এবং তেহরি অঞ্চল।      

 

তেহরি বাঁধ আন্দোলন প্রথম শুরু করেন শ্রী বীরেন্দ্র দত্ত সাকলানি নামে একজন আইনজ্ঞ, যিনি তেহরি বাঁধ নির্মাণ বিরোধী কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। শ্রী সাকলানি আন্দোলনের মাধ্যমে জনসাধারণের দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করার পরে নেতৃত্বে আসেন পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম নেতা শ্রী সুন্দরলাল বহুগুণা, জন্মসূত্রে যাঁর পূর্বপুরুষেরা পশ্চিমবঙ্গের বন্দোপাধ্যায় ব্রাহ্মণ।  ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত শ্রী বহুগুণা তেহরি বাঁধ নির্মাণ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন। পরিবেশরক্ষা আন্দোলনকারীদের সমস্ত প্রকার আন্দোলনকে অগ্রাহ্য করে ১৯৭৮ সালে যে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল দীর্ঘ ২৮ বৎসর পরে ২০০৬ সালে সেই বাঁধের নির্মাণকার্য শেষ হয়েছিল। তেহরি বাঁধ ভারতের উচ্চতম এলাকার নদীবাঁধ। বাঁধটি লম্বায় ১৮৮৬ ফুট, চওড়ায় ৬৬ ফুট উপরের অংশ বা শীর্ষদেশ , নিচের অংশ বা তলদেশ ৩৭০১ফুট, উচ্চতায় ৮৫৫ ফুট, জলধারনের ক্ষমতা পাঁচ লক্ষ উনপঞ্চাশ হাজার কিউবিক ফুট। এছাড়াও এখানে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে যার সাহায্যে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, চন্ডিগড়, জম্মু-কাশ্মীর, রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ এবং দিল্লির বিস্তীর্ণ এলাকা আলোকিত। খালের সাহায্যে জল পাঠানো হচ্ছে দু লক্ষ সত্তর হাজার হেক্টর জমিতে। পানীয় জল সরবরাহ করা হচ্ছে উত্তরাখণ্ড,



পানীয় জল সরবরাহ করা হচ্ছে উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ ও দিল্লিতে। বাঁধ নির্মাণে খরচ হয়েছে ১০০ কোটি ডলার। রিজার্ভার ক্যাপাসিটি ৩২ লক্ষ একর ফুট বা চার কিউবিক কিলোমিটার। রাশিয়ার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বাঁধটি সম্পূর্ণ নির্মিত হয়েছে ২০০৬ সালে। তেহরিতে যেখানে বাঁধ নির্মাণ হয়েছে তার থেকে বাইশ কিলোমিটার নীচে ভাগীরথীর উপরে ২০২৯ ফুট উচ্চতায় কোটেশ্বর বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। সেটি লম্বায় ৯৮৪ ফুট, উচ্চতায় তিনশো কুড়ি ফুট,
টিহরি বাঁধ
জলধারণক্ষমতা ৭২০৭২ একর ফুট। জলের স্রোতে টারবাইন বসিয়ে এখানে ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে। তেহরি বাঁধটি কোনক্রমে ভেঙ্গে গেলে অববাহিকা অঞ্চলের প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এখানে দশ মিনিটের বিরতি। গাড়ি থেকে নেমে প্রত্যেকে পাহাড়ের কোলে ভাগীরথীর নীল জলরাশি দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন এবং বিভিন্ন আঙ্গিকে ফটো তোলায় ব্যস্ত হলেন। যেখানে টিহরি বাঁধ নির্মিত হয়েছে সেখান থেকে চন্দ্রবদনী মন্দিরের দূরত্ব প্রায় ৭৫ কিলোমিটার। বেশি সময় এখানে অতিবাহিত না করে আমাদের গাড়ি সাড়ে বারোটায় ছাড়ল। পাহাড় জনপদ পেরিয়ে গাড়ি চলেছে। দেবপ্রয়াগে না যেয়ে তার আগে জামনিখাল থেকে সাত কিলোমিটার পেরিয়ে আমরা চন্দ্রকূট পাহাড়ের পাদদেশে পৌছালাম দুপুর দুটো পনেরোতে। এখানে গাড়ির স্ট্যান্ড, কয়েকটি দোকান আছে যেখানে পূজোর সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও চার-পাঁচটি চায়ের দোকান আছে যেখানে বললে খাবার পাওয়া যায়। এখান থেকে সিঁড়ির ধাপ করা আছে চন্দ্রকূট পাহাড়ের উপরে চন্দ্রবদনী মন্দির পর্যন্ত। প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করে মন্দিরে যেয়ে পৌছালাম পৌনে তিনটার সময়। দর্শনার্থী প্রায় নেই, মন্দির চত্বর ফাঁকা। মন্দিরের সামনের চত্বর থেকে দূরের গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, কেদারনাথ, বদ্রিনাথ পর্বত শৃঙ্গগুলি আকাশ পরিষ্কার থাকলে দেখা যায়।

 

এখানে এসে মন চলে গেল অতীতে। আজ থেকে একশো একত্রিশ বছর আগে অর্থাৎ ১৮৮৭ সালে যখন স্বামী বিবেকানন্দের গুরুভ্রাতা স্বামী অখন্ডানন্দ গঙ্গোত্রী থেকে উত্তরকাশী হয়ে টিহরিতে আসার পরে উদরাময়ে আক্রান্ত হয়ে অবস্থান করার পরে চন্দ্রবদনী মন্দির দর্শন করতে এসেছিলেন। স্বামী অখন্ডানন্দ রচিত  'হিমালয়ের আকর্ষণে' যেভাবে বর্ণনা করা আছে সেটি এইরূপ -  ‘চন্দ্রবদনী পীঠস্থান দর্শনমানসে নিবিড় অরণ্য পথে যাত্রা করিলেন। উচ্চ গিরিচূড়ায় দেবীর মন্দিরটি হিমালয়ের এক অপূর্ব সৌন্দর্য কেন্দ্র। যেন মনে হয় গিরিরাজ সগর্বে জগন্মাতার মন্দিরটি ধারণ করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন, আর প্রকৃতিদেবী নানাবিধ ফল পুষ্প দ্বারা ভক্তি বিনম্রচিত্তে নিত্য মায়ের পূজা করিয়া ধন্য হইতেছেন। কিন্তু পর্বতটি দুরারোহ। গঙ্গাধর পথভ্রান্ত হইয়া পড়িলেন। কোনক্রমে পাহাড়টি প্রদক্ষিণ করিতে করিতে কোন প্রকারে আরোহন করিতে লাগিলেন। সন্ধ্যার প্রাক্কালে দেবীর মন্দিরে পৌঁছালেন। নির্জন গিরিমন্দিরের মহা নিস্তব্ধতা অনুভব করিয়া তাঁহার মন যে বিমল আনন্দে পরিপূর্ণ হইল তাহা তাঁহার নিজের ভাষায় এইরূপে বর্ণিত হইয়াছে। "এখানে পৌছিলে মনে হয় যেন চরাচর ব্রহ্মাণ্ড অনন্ত মৌনব্রত ধারণ করিয়া রহিয়াছে। উত্তরে অপার ও অগম্য শুভ্র চিরহিমানী হইতে যেন অনন্তজ্যোতি বিকীর্ণ হইয়া জগতকে আলোকিত করিতেছে। না জানি কি মহান সৌন্দর্য রাশির ঘনীভূত মূর্তি এই অনন্তভাবসম্পন্ন চিরহিমানী। এখানে সকলেই মহা নিস্তব্ধ, কাহারও সাড়াশব্দ নাই। মনে হয় যেন সমগ্র জগৎ এক অনন্তের ধ্যানে সমাধিস্থ। আমি হিমালয়ের বিরাট দেহে অনন্তরূপিনী মহামায়ার আবির্ভাব দর্শন করিয়া ধন্য হইলাম"।  চন্দ্রবদনী দেবীর ধ্যানে মহা-আনন্দে দুই রাত্রি কাটাইয়া মাতৃ চরণে পুনরাগমন বাসনা জানাইয়া গঙ্গাধর নামিতে লাগিলেন। কিন্তু পূর্বের মতো এবারও পথহারা হইয়া চুপ করিয়া বসিয়া পড়িলেন। তাঁহার জীবন সংশয় হইল। এই সময়ে তাঁহার মনে হইতে লাগিল 'এ দিব্য দেবীস্থান, যেখানেই থাকি মায়ের কোলে রহিয়াছি'। কিছুক্ষণ পরে 'জয় মা' বলিয়া আপনমনে এক দিকে নামিতে লাগিলেন। প্রায় গড়াইতে গড়াইতে পর্বতের পাদদেশে নিরাপদ সমতলে পৌঁছিয়া দেখেন কৃষকেরা গম পোড়াইয়া খাইতেছে। কৃষকেরা একটি সাধুকে ঐরূপে আসিতে দেখিয়া বিস্ময় বিমুগ্ধ হইয়া বলিল "তুমি কোথা থেকে এলে? এ পথে কেউ কোনদিন আসেনি। নিশ্চয় চন্দ্রবদনী মা হাত ধরে তোমাকে নিয়ে এসেছেন"। এখান থেকে সরকারী পথ ধরে তিনি তার পরে শ্রীনগরে পৌঁছে কেদারনাথ দর্শনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন।

 

আমরা ওখানে গিয়ে যে সময়ে পৌঁছেছি তখন পাহাড়গুলির উপর চারিদিকে কুয়াশার আস্তরণ পড়তে শুরু করেছে যার জন্য পরিষ্কারভাবে শৃঙ্গগুলি দৃষ্টিগোচর হলো না। মন্দির চত্বরের নিচের দোকান থেকে আমরা পূজার সামগ্রী-  মায়ের বস্ত্র, ফুল, নারকেল, মিষ্টান্ন ইত্যাদি কিনে নিয়ে মন্দিরে গেলাম। পূজারী নিষ্ঠা সহকারে পূজা করে দিয়ে প্রসাদী বস্ত্রখণ্ড, নারিকেল আমাদের ফেরত দিলেন। মন্দিরটি কোনকালে নির্মিত হয়েছে কেউ বলতে পারেন না তবে প্রবাদ যে আজ থেকে পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন এই মন্দির। চন্দ্রকূট পাহাড়ের শীর্ষদেশে একখণ্ড জমি সমতল করে বর্তমানের মন্দিরটি শ্বেতমার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। মন্দিরের পৃথক কোন গর্ভগৃহ নেই। যেখানে মায়ের শ্রীযন্ত্র স্থাপিত তার সামনে বসে পূজারী পূজা করেন এবং তার সামনে  গ্রিলের রেলিং দেওয়া আছে। রেলিংয়ের বাইরে দিকে ভক্তেরা বসে পূজার উপকরণ পূজারীর হাতে তুলে দেবার পরে তিনি সেগুলি শ্রীযন্ত্রে স্পর্শ করে পুনরায় ভক্তকে ফেরত দেন। নিস্পৃহ পূজারী, অর্থের প্রতি কোন লোভ নেই। ভক্তেরা  যা দক্ষিণা দেন তিনি সেটি মায়ের কাছে রেখে দেন। দশমহাবিদ্যায় ত্রিপুরাসুন্দরীর স্থান তৃতীয় অর্থাৎ কালী, তারা ও ত্রিপুরাসুন্দরী এই তিনজনের মধ্যে তিনি প্রাচীন। ত্রিপুরসুন্দরীর  যন্ত্রের নাম শ্রীযন্ত্র। সাধককুলের কাছে এই যন্ত্রের সাধনা হল শ্রেষ্ঠ বৈদান্তিক সাধনা। শ্রীযন্ত্রের সাধনার ফলে সাধকের চতুর্বর্গ অর্থাৎ ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ লাভ হয়। আদি শঙ্করাচার্য ত্রিপুরাসুন্দরী মায়ের উপাসক ছিলেন। কেদারনাথ, বদ্রিনাথ যাওয়ার পথে শঙ্করাচার্য দেবপ্রয়াগ থেকে চন্দ্রবদনী মন্দিরে এসে শ্রীযন্ত্রের উপাসনা করেছিলেন। মন্দির প্রাঙ্গণে শিব-পার্বতী, গণেশ, কালী ও হনুমানের পৃথক পৃথক প্রকোষ্ঠে মূর্তি স্থাপিত আছে। মা দুর্গার অন্য একরূপ চন্দ্রবদনী। প্রবাদ দক্ষযজ্ঞে সতীর দেহত্যাগের পরে নারায়ন যখন সতীর মৃতদেহ সুদর্শন চক্র দ্বারা খন্ড খন্ড করে দিয়েছিলেন সেই সময় সতীর শরীরের ধড় এখানে এসে পড়েছিল এবং তাঁর হাতের অস্ত্র গুলি ও এখানে পড়েছিল। চতুর্দিকে অনেকগুলি ত্রিশূল দেখতে পাওয়া যায় যেগুলিকে সতীদেবীর হাতের অস্ত্র বলে জনমত বা প্রবাদ। চন্দ্রবদনী মায়ের মন্দিরে কোনও মূর্তি নেই কিন্তু শিলাখণ্ডের উপরে শ্রীযন্ত্র আছে। চৈত্র মাসে নবরাত্রির সময়ে পূজারী শ্রীযন্ত্রের উপরে হাতবন্ধ অবস্থায় একটি সামিয়ানা বা চন্দ্রাতপ বেঁধে দেন। শ্রীযন্ত্রের চতুর্দিক লাল কাপড়ে ঢাকা, কেবলমাত্র শিলাময়ী মায়ের মুখমণ্ডলটি দেখা যায়। চৈত্র নবরাত্রি, আশ্বিন মাসের নবরাত্রি, বিজয়াদশমী ও দীপাবলীতে এখানে আড়ম্বর সহকারে পূজা হয় এবং সেই সময়ে উত্তরাখণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অসংখ্য ভক্ত এখানে এসে সমবেত হন। দেবপ্রয়াগ থেকে টিহরি যাবার রাস্তায় জামনি খাল পেরিয়ে, অনুরূপভাবে শ্রীনগর থেকে লছমোলিহিসারিয়া খাল পেরিয়ে চন্দ্রবদনী মন্দির যাবার রাস্তা। দুর্গম পথ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই এবং ব্যাপক প্রচার লাভ করেনি, যার জন্য পর্যটকরা এখানে খুব কম সংখ্যায় আসেন। কিন্তু চন্দ্রকূট পাহাড়ের শীর্ষদেশে যেখানে মন্দির সেখান থেকে চারিদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপূর্ব। নিকটবর্তী রেলস্টেশন ঋষিকেশ অথবা দেরাদুন। দেবপ্রয়াগ থেকে বা শ্রীনগর থেকে গাড়িতে করে এখানে আসা যায়, দূরত্ব কম বেশি চল্লিশ কিলোমিটার।

 


উপর থেকে নিচের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে যখন নেমে এলাম ঘড়ির কাঁটা তখন সময় নির্দেশ করছে পৌনে চারটা। এখানে একটি খাবারের দোকানে আটার রুটি ও সবজি খেয়ে ক্ষুধার নিবৃত্তি হলো। সকালে হরিদ্বারের আবাসিক শিবির  থেকে আসার সময় টিফিন করা হয় নি এবং সমস্ত রাস্তাতে খাবার খাওয়ার মতন সেরকম সময় বা সুযোগ হয়নি। বিকেল চারটার সময় এখান থেকে গাড়ি ছেড়ে পাঁচটার সময় গিয়ে পৌছালাম দেবপ্রয়াগের ভাগীরথী ও অলকানন্দার সঙ্গমস্থলে। রাস্তার উপর থেকে দেখা যাচ্ছে বাঁ দিক থেকে ভাগীরথীর নীল জল এবং ডান দিক থেকে অলকানন্দার চন্দন বর্ণের জল এক জায়গায় মিলিত হয়েছে। ইচ্ছে ছিল ভগীরথ শিলা ও দেবপ্রয়াগের মন্দিরগুলি দর্শন করার কিন্তু সময় অভাবে মনের সেই ইচ্ছা পূরণ হলো না। এখান থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় বেরিয়ে পথিমধ্যে দেবপ্রয়াগ থেকে বেরোনোর আধঘন্টা পরে রাস্তায় ধসের জন্য পুনরায় দেরি হল। ঋষিকেশ হয়ে হরিদ্বারে যখন পৌঁছলাম তখন রাত্রি নটা বেজে গেছে। সারাদিনের ভ্রমণজনিত ক্লান্তিতে হরিদ্বারে আবাসিক শিবিরে যখন পৌঁছালাম তখন আমরা শারীরিক দিক দিয়ে পরিশ্রান্ত ও বিধ্বস্ত ।  

 

১১ ই মার্চ শিবরাত্রির দিনে সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত সাধু-সন্ন্যাসীদের স্নানের জন্য ব্রহ্মকুণ্ডে সাধারণের স্নান সরকার থেকে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে।  সকাল ন'টায় আবাসিক শিবির থেকে শিবিরের আবাসিকদের সাথে যেয়ে ব্রহ্মকুণ্ডের বিপরীত তীরে বাঁধানো ঘাটে শিকল ধরে নেমে তিন ডুব দিয়ে শাহীযোগের স্নান করে পুণ্য লাভ করলাম কিনা জানিনা কিন্তু মনের শান্তি হলো। বহুদিনের তীর্থ দর্শনের ইচ্ছে পূরণ হয়েছে।

 

শিবরাত্রির দিন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে দক্ষ প্রজাপতির মন্দির, বীরভদ্রেশ্বর শিব মন্দির, কঙ্খলের গঙ্গা আরতি, সতীর দেহত্যাগের স্থান প্রভৃতি দর্শনের উদ্দেশ্যে গেলাম। প্রত্যেকটি মন্দির ও আশ্রম আলোকমালায় সুসজ্জিত, রাস্তায় খুব ভিড়। এখানে মন্দিরগুলি দেখে সামান্য দূরে আনন্দময়ী মায়ের আশ্রমে সন্ধ্যারতি দেখে আমাদের শিবিরে ফিরে এলাম। পরের দিন বিকেলে রামকৃষ্ণ মিশন, মিশন পরিচালিত হাসপাতাল যা হরিদ্বারে বাঙালি হাসপাতাল নামে পরিচিত এবং মিশনের পাশে হরিহর আশ্রমের রুদ্রাক্ষ বৃক্ষ, পারদ শিবলিঙ্গ দর্শন করার সুযোগ হয়েছিল।

 

১৩ই মার্চ তারিখে হরিদ্বার থেকে রাত্রের ট্রেনে চেপে ১৫ তারিখ সকাল ন'টায় এসে মেদিনীপুরে  পৌছালাম।

 

 

তথ্যসূত্র –

১। Google website -  উইকিপিডিয়া          

২। হিমালয়ের আকর্ষণে - স্বামী অখন্ডানন্দ।   

৩। স্বামী সারদানন্দ চরিত - তপস্যা ও পর্যটন  

Tuesday, October 13, 2020

ছুটি ছুটি- ভ্রমণ - হঠাৎ বেরিয়ে পড়া আলেপ্পীতে- কৌশিক বসু



হঠাৎ বেরিয়ে পড়া আলেপ্পীতে
কৌশিক বসু



  

অনেক ফোরামে এত সুন্দর ভ্রমণ কাহিনী পড়ে আমারও লেখার একটু ইচ্ছে হলো হঠাৎ করা ট্রাভেল প্ল্যান এবং কিছু চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা নিয়ে, বছর আষ্টেক আগের । সত্যি কথা বলতে এভাবে কোনোদিন লিখিনি, তাই কোনরকম ভূলভ্রান্তি মার্জনা করে দেবেন দয়া করে । 

 

অফিসের এক সহকর্মীর  সঙ্গে পরিবার সহ আগে বেড়িয়ে এসেছি কাজিরাঙ্গা আগের বছর তাই দুর্গা পূজার আগেই অফার এলো কানহা যাওয়ার - ডিসেম্বরের শেষের দিকে। কিন্তু অফিস থেকে আমাকে বলে রাখা হয়েছে যে কোন সময়ে ইংল্যান্ড যেতে হবে, তাই কানহা যাত্রা কানা করতে হলো। কিন্তু নভেম্বরের শেষের দিকে উপলব্ধি হলো যে ইংল্যান্ডের যাওয়া জানুয়ারির আগে হচ্ছে না, তখন একটা শেষ চেষ্টা করলাম কানহা যাত্রার, কিন্তু  পাওয়া গেলো না ট্রেন বা হোটেল বুকিং। অগত্যা নিজেই কিছু করার একটা শেষ প্রচেষ্টা করলাম। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ অফিস এর একটি গেষ্ট হাউস খালি পেয়ে গেলাম মুন্নার এ দুদিনের জন্য, নেহাৎ ভাগ্যের জোরে বলতে হয় - সঙ্গে সঙ্গে বুক করে ফেললাম। এখানে একটু উল্লেখ্য হলো আমাদের ভ্রমণে একটু পাহাড় না থাকলে গিন্নীর মুখ ভার হয়ে থাকে, তাই মুন্নার নিয়ে গিন্নীর  ভেটো জুটবে না তা জানতাম। কিন্তু মুন্নার অনেক দূর, ট্রেনে যাওয়া মানে চার পাঁচদিন বেরিয়ে যাবে, অত ছুটিও পাওয়া যাবে না, তাই ফ্লাইট বুকিং করবো ভাবলাম। কাছাকাছি বিমানবন্দর কোচিন কিন্তু কলকাতা থেকে ভাড়া দেখে মাথা ঘুরে গেল। অগত্যা ম্যাপ ঘেঁটে দেখলাম ব্যাঙ্গালোর থেকে যাওয়া যেতে পারে, বাস আছে মুন্নার যাওয়ার। কিন্তু ক্রিসমাসের সময় টিকিটের দাম আগুন, তাই দুদিন এগিয়ে একটু ঠিকঠাক দামের টিকিট বুক করে ফেললাম - ২৩ সে ডিসেম্বরের এ যাওয়া আর ১ লা জানুযারি ফেরা। এবারে বাকি দিনগুলো ভরার কাজ। কেরলে যখন যাচ্ছি তখন আরেকটু কেরল কেমন হয়? গিন্নীকে কয়েকটা জায়গার নাম দিলাম, উঠে এলো আলেপ্পী এবং বুকিং হলো হোটেল এবং বাস ব্যাঙ্গালোর থেকে। পড়ে রইলো আরো তিনদিন। ব্যাঙ্গালোর এর ভিড়ভাট্টা ছেড়ে ঠিক করলাম থাকবো মাইসোর এ, একটি দিন কূর্গ ঘুরে আসবো, তারপরে ব্যাঙ্গালোর এ ফিরে এসে বাসে করে আলেপ্পী। গিন্নী ছাড়া আমার চার বছরের ছেলে তাই তার দিকটাও ভাবতে হবে, তাই ঠিক করলাম প্রথমে বানের ঘাটা দেখে মাইসোর যাবো। এই হলো প্ল্যানিং বৃত্তান্ত। 

 

এরপরে আলেপ্পী নিয়ে একটু লিখতে চাই।  গিন্নীর ইচ্ছে ছিল হাউসেবোট এ থাকা, কিন্তু তার জলে ভয় আছে সেটা জানি ভালো করে। তাছাড়া অফিসের এক সহকর্মীর কাছে জানলাম যে হাউসবোট দিনের বেলা চলে, সন্ধে হলে পাড়ে বাঁধা থাকে, যার মানে সন্ধ্যে থেকে আটকে থাকা। তাই ঠিক করলাম পম্বা নদীর পাড়ে কোন হোটেলে থাকবো। একটু ঘাঁটাঘাঁটি করে একটি হোটেলের সন্ধান পেলাম। যা অনবদ্য মনে হলো যে একটি ১৫০ নছরের পুরনো সেগুন কাঠের তৈরী ধানের গোলা কে একটু পরিবর্তন করে হোটেলের ঘর বানিয়েছে। কনসেপ্ট টা দারুণ লাগলো, বুকও করে দিলাম। হোটেল ম্যানেজার এর সঙ্গে কথা কয়েকবার হয় দুদিনের প্ল্যান করতে। ম্যানেজার বলে দিয়েছিল যে ব্যাঙ্গালোর থেকে আলেপ্পীর সব বাস ত্রিভান্দ্রাম যায়, তাই বাসে উঠেই ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতে, বুঝিয়ে দেবে কোথায় নামতে হবে, কারণ হোটেলটি ছিল আলেপ্পী শহরের বাইরে ত্রিভান্দ্রাম যাবার রাস্তায়। আমরা ব্যাঙ্গালোর বাস স্ট্যান্ড পৌঁছে গেছি বিকেল ৪ টের মধ্যে, ৬ টায় বাস ছাড়বে, সারারাত বাসে কাটাতে হবে ভোরবেলা ৬ টা নাগাদ  আলেপ্পী পৌঁছনোর কথা। কাছাকাছি দোকানে একটু খাবার কিনতে বেড়িয়েছি বাসে খাবার জন্য হঠাৎ দেখি বাসের এজেন্সির একজন আমাকে এসে বললো এখুনি বাসে উঠতে হবে কারণ আগামীকাল কেরল বন্ধ, তাই সব বাস কে ত্রিভান্দ্রাম ৬ টার মধ্যে পৌঁছতে হবে, অতএব তাড়াহুড়ো করে বাসে উঠে পড়লাম, মাঝখানের দিকে সিট পেলাম। জানতে পারলাম রাত ৩ টে নাগাদ আলেপ্পী পৌঁছবে। যাইহোক বাসে উঠেই মোবাইলে ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিয়েছি ম্যানেজার বাবুর, ভাষা বিন্দু বিসর্গ বুঝলাম না, তারপরে ম্যানেজার বাবু বলে দিলেন একটি গাড়ি থাকবে আমাদের পিকআপ করতে। বাসে যাইহোক সময় কাটছে কোনরকমে, কোচিন এর পর আলেপ্পী আসবে, তাই কোচিন আসছে দেখেই ড্রাইভারের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। সেখানেই চমক - গিয়ে দেখি ড্রাইভার অন্য একজন! আমি জিজ্ঞেস করতে ড্রাইভার বললো সে জানে কোথায় নামাতে হবে, কোচিন এলে অনেকে নামবে তাই সামনের দিকে চলে আসতে। ক্রিসমাসের রাত, মধ্য কেরল ক্রিশ্চান অধ্যুষিত, তাই প্রায় প্রত্যেক বাড়ি সুন্দরভাবে আলোকিত। কিন্তু মনের মধ্যে একটু চিন্তা হচ্ছে, গিন্নীর মুখেও চিন্তার ভাঁজ। আলেপ্পী এলো এরপর, আরো কয়েকজন নামলো, কিন্তু ড্রাইভার দাদা আমাকে ইশারায় বসতে বললো। তার একটু পরে প্রায় রাত সাড়ে ৩ টে নাগাদ হঠাৎ বাস দাঁড়িয়ে পড়লো আর ড্রাইভার এবারে বললো নামতে। এই শেষরাতে প্রায় ভয়ে ভয়ে মালপত্র নিয়ে নামলাম, হালকা আলো রাস্তায়, এদিক ওদিক দেখছি, একটা ব্রীজের পাশে নামিয়েছে, নিচে পম্বা নদী বয়ে চলেছে, হঠাৎ লক্ষ্য করলাম একটা মারুতি গাড়ি দাঁড়িয়ে আর একজন বেরিয়ে এলো। কি হবে ভাবছি তখন নিজের নাম শুনলাম, পরিচয় দিলেন নিজের, তিনিই ম্যানেজার। এত রাতে ড্রাইভার আসবে না বলে উনি নিজেই এসেছেন। 

 

আশ্বস্ত হয়ে গাড়িতে উঠে পরলাম। একটু গিয়েই নদীর পাড়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়লো । দেখি নদীর ঘাটে একটি দেশী নৌকো রয়েছে, সেখানেই আমাদের মালপত্র তোলা হলো। ভাবছি যদি নৌকো উল্টোয় তাহলে তো বাকি টুর মায়া হবে এই জিনিসপত্রের সঙ্গে! এর মধ্যে ম্যানেজার বাবু বললেন আমাদের নৌকোয় উঠতে। আমি গিন্নীর দিকে তাকালাম প্রতিক্রিয়া দেখতে, সে তো আঁতকে উঠলো, না এত ছোট নৌকোয় উঠবো না, ভয় করছে। তখন ম্যানেজার বাবু বললেন তাহলে একটু ট্রেক করতে হবে মিনিট ১৫ র মতো। গাড়ি গ্যারেজে রেখে আমরা হাঁটা শুরু করলাম, ধানক্ষেতের আল দিয়ে হেঁটে কিছুক্ষণ বাদে পৌঁছলাম হোটেল। 

হোটেলে পৌঁছে আতিথেয়তায় মন ভরে গেল, ওই সময়ে ভোরের আলোও ফোটে নি ঠিক করে - সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হোটেলের ঘরে কফি আর বিস্কুট চলে এলো ম্যানেজার বাবুর গিন্নীর হাতে হাসি মুখে, ছেলের জন্য দুধ বা কমপ্ল্যান ইত্যাদি । তখন বুঝলাম সত্যি অন্যরকম হোটেল - ম্যানেজার পরিচয় দেওয়া ভদ্রলোক আসলে মালিক, ওদের বাড়ির ধানের গোলাকে ৪ টে বেশ বড় ঘর বানিয়েছে এটাচড টয়লেট সহ, ঘরে টিভি, ওয়াইফাই, এসি সব কিছু আছে। ঘরের ওপরে সেগুন কাঠের সিলিং, তার ওপর টালির ছাদ। ব্রেকফাস্ট থেকে ডিনার সবই প্যাকেজ এর মধ্যে। তিনি থাকেন মা, বাবা, স্ত্রী ও দুই সন্তান ও ভাগ্নেকে নিয়ে।  

 

ঘরে বসে একটু টিভি চালিয়ে কফিতে চুমুক দিয়েছি, হঠাৎ গিন্নীর ডাক টয়লেট থেকে। গিয়ে দেখি কিছুটা শেড দেওয়া আর স্নান করার জায়গাটায় শাওয়ার লাগানো তবে চারদিকে নুড়ি পাথর মেঝেতে আর কিছু গাছও রয়েছে।  তবে গিন্নীর ডাকের আসল কারণটা দেখলাম ওপরের দিকে তাকিয়ে, কিছুটা আকাশ দেখা যাচ্ছে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে।  ভালো করে চারদিক সার্ভে করে দেখে নিলাম, কোনো বাড়িঘর নেই, গিন্নীকে বললাম কেউ থাকবে না কয়েকটা পাখি ছাড়া। নিজে যখন স্নান করলাম ব্যাপারটা বেশ মজার লাগলো। 

 

একটু ঘুমিয়ে উঠলাম, আরেকপ্রস্থ  কফি ঘুম কাটানোর জন্য, সঙ্গে ব্রেকফাস্টে আর লাঞ্চে কি খাব তা জিজ্ঞেস করা হলো বিকল্পের সাথে - খাঁটি কেরালীয় খাবার এবং অত্যন্ত সুস্বাদু,আণ্টি অর্থাৎ মালিকের মা র হাতে। ৯ বছর হয়ে যাওয়ায় সব খাবারের নাম মনে নেই, তবে ব্রেকফাস্টে ডিমের তরকারি দিয়ে আপ্পাম আর কারিমিন (পমফ্রেট মাছের একটা অনবদ্য খাবার)  এই দুটো মনে আছে। তাদের ব্যবহারের আন্তরিকতা এমনই ছিল যে  কিছুক্ষণের মধ্যে মনে হলো যেন কোন নিকট আত্মীয় বাড়ীতে এসেছি। ছেলেকে ঘরে আর পাওয়া যাচ্ছে না, মিশে গেছে ওদের বাচ্চাদের সঙ্গে, আমি রাজিব অর্থাৎ ম্যানেজার বা তার বাবার সঙ্গে গল্প করছি,আমার গিন্নী রাজীবের গিন্নীর সঙ্গে। 

 

ঘুরে দেখেছি সকালে পম্বা নদীতে নৌকাবিহার করে বিখ্যাত ব্যাকওয়াটারস। আর বিকেলে দেশী নৌকোয় চড়ে আয়ুর্বেদিক মালিশ করতে যাওয়া, পূর্ব অভিজ্ঞতার জেরে রাজিব ও বুঝে গেছিল আমার গিন্নীর জলে বীরত্ব, তাই দুটো প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আমরা গেলাম আর ফিরলাম আর সারা নৌকোবিহারে উপলব্ধি করলাম অনেকেই পাড় থেকে তা উপভোগ করছিল, তাদের কৌতুক ভরা মুখে যা বোঝা যাচ্ছিল। পরের দিন আলেপ্পি শহর আর সমুদ্র সৈকত দর্শন করলাম আর বাকি সময় প্রকৃতির সান্নিধ্যে বিশুদ্ধ ল্যাদ।

 

পরেরদিন সকালে আমরা যখন চলে যাচ্ছি কোচিন এর উদ্দেশ্যে তখন সত্যি মনে হচ্ছিল ছেড়ে চলে যাচ্ছি নিকট আত্মীয়র কাছ থেকে। ছেলের মুখও দেখলাম থমথমে। তবে যাওয়ার আগের দিন সন্ধেবেলা নিজের কৌতুহল আর না চেপে রেখে রাজিবকে জিজ্ঞেস করলাম এই কিছুটা খোলা বাথরুমের পটভূমি। মুচকি হেঁসে বলল ওদের এই হোটেল কয়েকবছর হয়েছে, তার আগে সন্ধেবেলা হাউসবোট ওদের বাড়ির পাশে লাগিয়ে রাখতো, তখন কিছু যাত্রী নেমে ওদের বাথরুম ব্যবহার করার অনুরোধ করতো, সেখান থেকেই ওরা হোটেল করার প্ল্যান করে। এবং এই প্রকৃতিযুক্ত বাথরুমের পরিকল্পনা আসে এই যাত্রীদের মতামতের ভিত্তিতে, বিশেষতঃ বিদেশী পর্যটকদের কাছ থেকে।

 

কিছু ছবিও পোষ্ট করলাম, কেমন লাগলো জানাবেন।

 


 ভোরের প্রথম আলোয় পম্বার জল





এরকম একটি নৌকো এসেছিলো আমাদের মালপত্র নিতে





নৌকাবিহার






 নৌকাবিহার




 নৌকাবিহার





 নৌকাবিহার





ছোট ব্রিজের তলা দিয়ে এলাম





 হাউসবোট, যেখানে থাকিনি আমরা





চলমান ডাবের দোকান





সেগুন কাঠের ধানের গোলা কে হোটেলে রূপান্তরিত





 ধানক্ষেতে সূর্যোদয়





তাজা দোলনচাঁপা ফুল






 তাজা রঙ্গন ফুলের থোকা   

 




গাছে কচি ডাব






ল্যাদ





 আলেপ্পীর মন্দিরে





লাইটহাউস , সমুদ্রসৈকতে






আলেপ্পীর বিচ এ আমরা




বড়দিনের সাজানো চার্চ - বাইরে






চিল্লার পার্টি






বিদায় নেওয়ার আগে 

Download ALEEK PATA Mobile APP

DOWNLOAD ALEEK PATA ANDROID APP

| Aleekpatamagazine.blogspot.com |

  |ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Special Puja Issue, 2020 | October-November 2020 | শারদ সংখ্যা -১৪২৭।
| Fourth Year Third Issue |24 th Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |
পড়া শেষ? পত্রিকা বন্ধ করুন



Main Menu Bar



অলীকপাতার শারদ সংখ্যা ১৪২৯ প্রকাশিত, পড়তে ক্লিক করুন "Current Issue" ট্যাব টিতে , সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

Signature Video



অলীকপাতার সংখ্যা পড়ার জন্য ক্লিক করুন 'Current Issue' Tab এ, পুরাতন সংখ্যা পড়ার জন্য 'লাইব্রেরী' ট্যাব ক্লিক করুন। লেখা পাঠান aleekpata@gmail.com এই ঠিকানায়, অকারণেও প্রশ্ন করতে পারেন responsealeekpata@gmail.com এই ঠিকানায় অথবা আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।

অলীক পাতায় লেখা পাঠান