অলীক পাতার অন্যান্য সংখ্যা- পড়তে হলে ক্লিক করুন Library ট্যাব টি



। । "অলীক পাতা শারদ সংখ্যা ১৪৩১ আসছে এই মহালয়াতে। । লেখা পাঠানোর শেষ তারিখ ১৫ ই আগস্ট রাত ১২ টা ।.."বিশদে জানতে ক্লিক করুন " Notice Board ট্যাব টিতে"

Showing posts with label ভ্রমণ কাহিনী. Show all posts
Showing posts with label ভ্রমণ কাহিনী. Show all posts

Saturday, October 1, 2022

ভ্রমণ কাহিনী - একটি বিলুপ্ত বন্দর ও ক্যানিং সাহেবের বাড়ি -পায়েল চট্টোপাধ্যায়

 

 ভ্রমণ কাহিনী 

একটি বিলুপ্ত বন্দর ও ক্যানিং সাহেবের বাড়ি
পায়েল চট্টোপাধ্যায়


পথ ডেকেছে...


শিয়ালদা থেকে ট্রেনে ক্যানিং স্টেশন। নীল আকাশ ঝাপটা মারে ট্রেনের জানলায়। ইতিহাস দেখার পথে পা বাড়ালেই মনে হয় টাইম-মেশিনে চেপে বসেছি। ট্রেন বা গাড়িকে তখন নিঃসন্দেহে টাইম মেশিন ভাবা চলে । আসলে ইতিহাস এমন বিলাসী ভাবনার জন্ম দেয়।ক্যানিং স্টেশনে যখন নামলাম একটা ঝিলিমিলি নীল রঙের আকাশ অপেক্ষা করেছিল। তবে নীল রঙের গায়ে লেগেছিল দুঃখের মতো কালো মেঘ । বিস্তৃত আকাশ দেখে মনে হচ্ছিল কালো মেঘ আলগাভাবে জড়িয়ে ধরেছে নীল আকাশকে। রবিবার বলে স্টেশন চত্বর ফাঁকা। তবে ঠিক শূন্য বলা চলে না। রোজগারের তাগিদে একটা রবিবারের গায়েও ব্যস্ততার গন্ধ লেগে যায়।

পথের শেষে অপেক্ষা করে থাকা অতীত

ক্যানিং স্টেশন থেকে খানিকটা এগোলেই একটা বাড়ি। রিক্সা, টোটো হাত বাড়িয়েই রয়েছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। বাড়িটায় পৌঁছলাম সহজেই। বাড়িটি ভগ্নপ্রায়, আগাছায় পূর্ণ। তবুও অতীতের রংমশালের মত জেগে রয়েছে সেই বাড়ি। একে বেমালুম স্মৃতি-ঘর বলা যায়। স্থানীয় মানুষের কাছে এই বাড়ি ক্যানিং হাউস বা ক্যানিং সাহেবের বাড়ি নামেই পরিচিত। ২০১৮সালে এই ক্যানিং হাউসকে ভারতীয় ঐতিহ্য কমিশন হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করেছে। খুব সম্প্রতি এই ভবনের সংস্কারের কাজ শুরুর কথাও শোনা যাচ্ছে। বাড়িটি দ্বিতল। আগাছা আর ফাটল অতীতের মতোই জাপটে ধরে রেখেছে ক্যানিং হাউসকে। ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং-এর নামেই এই বাড়ি। বাড়িতে প্রবেশের আগে রয়েছে একটি সুবিশাল ফটকের ভগ্নাংশ। আগাছা ঘিরে রেখেছে প্রবেশদ্বারকেও । অতীত লাল ইটের মত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে বর্তমানের ক্যানিং হাউসকে।

ইতিহাস-কথা

ক্যানিং হাউস নিয়ে নানান জনশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে। শোনা যায় মাতলা নদীর তীরে বন্দর করে তোলার ইচ্ছে ছিল সেই সময় ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিংয়ের। কিন্তু বিঘ্ন ঘটায় খোদ নদী নিজেই। মাতলা ও বিদ্যাধরী নদীর এলোপাথাড়ি স্রোত, নাব্যতাও অভাব নষ্ট করে দেয় বন্দর। স্মৃতি হিসেবে থেকে যায় এই ভবন।কোনো ঐতিহাসিক বলেন ক্যানিং সাহেবের তৈরি এই অট্টালিকায় সাহেব নিজে থাকতেন। কেউ বলেন বন্দরের প্রশাসনিক কাজকর্মের জন্যেও এই অট্টালিকা ব্যবহার করা হত।

১৮৫৬ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসেবে যোগদান করেছিলেন লর্ড ক্যানিং। ১৮৬২ সালে উনি এই দেশ থেকে চলে গিয়েছিলেন। কথিত আছে এই ভগ্নপ্রায় বাড়ির অদূরেই নাকি আরেকটি বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে লেডি ক্যানিং ছবি আঁকার জন্য আসতেন। স্ত্রীকে সঙ্গ দিতে লর্ড ক্যানিংও এসে থাকতেন ওই বাড়িতে। যদিও বর্তমানে এই অন্য বাড়ির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।

একটি বিলুপ্ত বন্দরের কথা


খিদিরপুর অঞ্চলে সেই সময় ইংরেজরা গড়ে তুলেছিল কলকাতা পোর্ট। কিন্তু পলি জমে যাওয়ার ফলে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ছিল সেই বন্দর। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাঘাত ঘটছিল। প্রযুক্তি তখন একেবারেই অনুন্নত। পলি সরিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ মসৃণ করার কোন উপায় সে সময় খুঁজে পায়নি ইংরেজ সরকার। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ সুগম করতেই ১৮৫৩ সালে ইংরেজ সরকার সুন্দরবন অঞ্চলে একটা বিকল্প বন্দরের কথা চিন্তা করতে শুরু করে। এই চিন্তা-ভাবনার মাঝেই ১৮৫৬ সালে ভারতের বড়লাট হয়ে আসেন লর্ড ক্যানিং। বিদ্যাধরী ও মাতলা নদীর সংযোগস্থলে একটি জায়গা পছন্দ করেছিল ইংরেজ সরকার। লর্ড ক্যানিং-এর নাম অনুসারে ওই অঞ্চলের নাম দেওয়া হয় ক্যানিং।

এদিকে বন্দর তৈরি করার জন্য প্রায় ৮০০ একর জমি আলাদা করে রাখা হয়েছিল। ২০টি জেটি তৈরি করা হয়েছিল। জেটি প্রতি ২টি জাহাজ নোঙর করা যেত। জেটি থেকে দূরের গুদামঘর পর্যন্ত ট্রাম লাইন পাতা হয়। আর এই গুদামঘর থেকে রেললাইন পেতে কলকাতা শহরের সঙ্গে যুক্ত করা হয় ক্যানিংকে। সেসময় শিয়ালদা স্টেশনের অস্তিত্ব ছিল না। বেলেঘাটা থেকে ক্যানিং পর্যন্ত রেল লাইনের কাজ শেষ হয়েছিল। ক্যানিং শহর গড়ে তোলার জন্যেও রাখা হয়েছিল প্রায় ৬৫০ একর জমি। ১৮৬২ সালে স্থাপিত হয় ক্যানিং পৌরসভা। ১৮৬৪ সালে মিস্টার ফার্ডিন‌্যান্ড শীলার মূলধনের যোগান-এর জন্য স্থাপন করেন পোর্ট ক্যানিং ল্যান্ড ইমপ্রুভমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। ১৮৬২ সাল থেকে ক্যানিং বন্দরে কাজ শুরু হয়। মূলত মাঝারি আকৃতির জাহাজ এই বন্দরের মাধ্যমে ভারত থেকে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক চালান করত।

১৮৬৫ সালে প্রথম দুর্ঘটনা ঘটে মাতলা নদীতে। শ্রমিকসমেত একটি জাহাজের সলিলসমাধি হয়। প্রতিবাদ শুরু করে কর্মচারীরা। পোর্ট ক্যানিং থেকে শ্রমিক চালান দেওয়া বন্ধ করা হয় অবশেষে। এদিকে মাতলা নদীর নাব্যতা কমতে থাকে। বড় জাহাজ বন্দরে আসার ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হওয়া শুরু হয়।

এছাড়াও আরো কিছু সমস্যা তৈরি হচ্ছিল। স্থানীয় জেলেদের অসহযোগিতা, শ্রমিক অসন্তোষ পোর্ট ক্যানিং ল্যান্ড ইমপ্রুভমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেডের শেয়ার-এর দাম অনেকটা কমিয়ে দেয়। কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি। ১৮৬৭ সালের ১লা নভেম্বর ভয়াবহ সাইক্লোন আছড়ে পড়ে ক্যানিং বন্দরে। প্রকৃতির রোষের মুখে পড়েছিল সুন্দরবন। আসলে ক্যানিং বন্দর তৈরির জন্য ম্যানগ্রোভ জঙ্গল কেটে ফেলা হয়েছিল। তাই কোন প্রতিরোধ ব্যবস্থাই ছিল না প্রকৃতির কাছে। অসহায় বন্দর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় প্রকৃতির কাছে।

বেঙ্গল গভর্নমেন্টের ১৮৬৭-১৮৬৮ সালের বাৎসরিক রিপোর্ট অনুযায়ী '' দ্য স্টেশন হাউস, গুড শেডস অ্যান্ড দ্যা রেলওয়ে হোটেল ওয়্যার ব্লোন ডাউন।''পুরো এলাকাটি সমুদ্রের নুন এর একটি পুরু স্তরে ঢেকে গিয়েছিল। পানীয় জলের অভাব তৈরি হয়েছিল। বন্দর গড়ার স্বপ্ন তার অভিমুখ হারাতে থাকে সেই সময় থেকেই। তবুও ১৮৭০ সালে আবার বন্দর তৈরির একটা চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু পোর্ট ক্যানিং ইম্প্রুভমেন্ট প্রাইভেট
  লিমিটেডের লিকুইডেশনের ফলে বন্ধ হয়ে যায় ক্যানিং বন্দর। একটি নতুন কোম্পানি তৈরি হয়। 'দ্য পোর্ট ক্যানিং ল্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড'। বর্তমানে স্মৃতি-চিহ্ন হিসেবে থাকা বাড়িটি কোন কোল ঐতিহাসিকের মতে আসলে পোর্ট ক্যানিং ল্যান্ড ইমপ্রুভমেন্ট লিমিটেড এর অফিস। কেউ বলেন লর্ড ক্যানিং এখানে থাকতেন। তবে ক্যানিং-এর স্থানীয় মানুষদের কাছে এই বাড়িটি ক্যানিং হাউস হিসেবেই পরিচিত। ‌পরবর্তীকালে এই বাড়িটি পোর্ট ক্যানিং ল্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের থেকে কিনে নিয়েছিলেন ঈশ্বর জিতেন্দ্র মোহন ঘোষ। দোতলা বাড়িটিতে মোট ২৭টি ঘর রয়েছে, যার মধ্যে ব্যবহারযোগ্য ঘর ২টি। এখন বাড়ির অবস্থা ভগ্নপ্রায়, যদিও সংস্কারের কাজ শুরুর কথা শোনা যাচ্ছে। তবুও ক্যানিং অঞ্চলে আস্ত স্মৃতি হিসেবে জেগে রয়েছে এই ‘ক্যানিং হাউস’।

ফেরা

বাড়িটির মালিকানা যারই থাকুক, আপাতত অতীতের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবেই আজও রয়েছে এই বাড়ির অস্তিত্ব। ইতিহাসের গন্ধ লেগে রয়েছে এই বাড়ি জুড়ে। সৌখিনভাবে বিদেশি ধাঁচে গড়ে তোলা হয়েছিল এই বাড়ি। আধুনিক যুগের মত হাতল দেওয়া ছিটকিনি ব্যবহার করা হত। প্রায় দেড়শ বছরের ইতিহাস জড়িয়ে থাকা এই বাড়িটির সুরক্ষা ব্যবস্থা ছিল পাকাপোক্ত। তাই ভগ্নপ্রায় দশা হলেও এই ছিটকিনি বা দরজার হাতল এখনো বেশ মজবুত।

পরিত্যক্ত এই বাড়ির চারিদিকে অচেনা মানুষের ভিড়। কেউ ইতিহাসের গন্ধের জন্য এসেছে, কেউ আবার নেহাতই কৌতূহল বশে ছুঁয়ে দিতে এসেছে একটা স্মৃতি-ঘরকে। অতীতের এই স্মৃতিচিহ্ন ঘুরে দেখতে তেমন সময় লাগে না, তবে এই ইতিহাসটুকু অন্তরে আত্তীকরণ করে নেওয়ার জন্য এই বাড়ি একেবারে আদর্শ স্থান। পরিত্যক্ত বাড়িটা থেকে যখন বেরোচ্ছি টুপটাপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। অনেকটা দূর থেকে একটা আস্ত টাইম মেশিনের মতই দেখতে লাগছিল বাড়িটাকে। অতীতের গন্ধ লেগে থাকা ক্যানিং সাহেবের এই বাড়ির জন্যেই ওই অঞ্চল এখনো একটা পর্যটন স্থান। ইতিহাস শুষে নেওয়ার জন্যেই আজও মানুষ এখানে আসে, ছুঁয়ে দিয়ে যায় অতীত।


ক্যানিং সাহেবের বাড়ি...

ক্যানিং সাহেবের বাড়ি...


হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি



ক্যানিং সাহেবের বাড়ি সংক্রান্ত তথ্য

| শারদ সংখ্যা-১৪২৯ | aleekpata.com | 30th Edition |

| ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |

| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |

| Durga Puja , 2022 | July-Oct 2022 | Fifth Year Fourth Issue  |

© All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |

| a DISHA-The Dreamer Initiative |

 



 



Friday, May 6, 2022

ভ্রমণ কাহিনী -পূর্বঘাটের ইয়ারকাদ -সুমি দত্তগুপ্ত

 

ভ্রমণ কাহিনী

পূর্বঘাটের ইয়ারকাদ

সুমি দত্তগুপ্ত

(সঙ্গের ছবিগুলি লেখিকার নিজের তোলা)



 

অনেক বছরের আসা যাওয়া তামিলনাড়ু রাজ্যে। আমার শহরের মতোই ঘুরে বেড়াই তামিলনাড়ুর বিভিন্ন শহরে। গতানুগতিক চেনা গতিপথ রামেশ্বরম, কন্যাকুমারিকা, পন্ডিচেরি, কাঞ্চিপুরম, মহাবলীপুরম ঘুরেও শেষ হয় নি আমার এই রাজ্য পরিক্রমা, ছুটে গিয়েছি ত্রিচি, থানজাভুর, য়েলাগিরি, কোটাগিরি, তুতিকোরিন আরও কতো জায়গায়। দ্রাবিড় সংস্কৃতির সাথে আমার আত্মিক বন্ধন আরও    নিবিড়,দৃঢ় হয়েছে।  স্বজনবন্ধুরা ঠাট্টা করে বলেন, হোমল্যান্ড, আবার কবে যাচ্ছো?

 

অক্টোবর এলেই আর বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করে না। শরতের ওই ঝকঝকে নীল আকাশ, সাদা পুঞ্জ মেঘ, হঠাৎ করে এক পশলা বৃষ্টি সবকিছুর মধ্যেই কেমন একটা পালাই পালাই ভাব, মোটামুটিভাবে সারা ভারতবর্ষের আবহাওয়া এইসময় ভালো থাকে।  এমনই  এক শরতের দুপুরে, ননদের বাড়ী বেঙ্গালুরু থেকে, ডাবল ডেকার উদয় এক্সপ্রেসে, সালেমের উদ্দেশে যখন রওয়ানা হলাম তখন ঘড়িতে সোয়া দুটো বাজে ।  সুন্দর ঝকঝকে ট্রেন, প্যান্ট্রি কার থেকে কফি, স্ন্যাক্স নিয়ে গল্প করতে করতে, একটু ন্যাপও নিয়ে, রাত নটার একটু আগেই নেমে পড়লাম সালেম স্টেশনে। ঝকঝকে স্টেশন, রিটায়ারিং রুমে একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম, ততক্ষণে গাড়ী ঠিক হয়ে গিয়েছে, অতঃপর যাত্রাশুরু ইয়ারকাদের পথে।

  

আলো ঝলমলে স্টিল সিটি সালেম ছাড়িয়ে পাহাড়ে ওঠা শুরু হল।  দুধারে জঙ্গল, কখনও কখনও রাতের আঁধারে বুনো ভালুক, শেয়াল হরিণ গাড়ির সামনে এসে যেতে পারে, আমাদের ড্রাইভার  ইউসুফ ভাই সেই গল্পই বলছিলেন, যদিও অন্ধকারের মধ্যে কোনও জ্বলজ্বলে চোখ খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা করেও পেলাম না, জানেন। সবার ভাগ্যে কি শিকে ছেঁড়ে? পাহাড়ি পথ, যেতে যেতে বুনো ফুলের গন্ধ পাচ্ছি, সুন্দর রাস্তা, রাস্তার দুধারে ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল, পুটুস ফুলের ঝাড় হয়ে আছে, উঠছি, মাঝে মাঝেই হেয়ারপিন বেন্ড। সালেম থেকে ইয়ারকাদ মাত্র 28 কিলোমিটার কিন্তু তাতেই কুড়িটা হেয়ার পিন বেন্ডতাই যাদের অলটিচুড সিকনেস আছে, তাদের এই ঘনঘন  হেয়ারপিন বেন্ডে একটু সমস্যা হতে পারে।

 

       ইয়ারকাদ জনপ্রিয় ভিড়ে ঠাসা শৈলশহর হিসেবে প্রসিদ্ধি পায় নি একথা ঠিক, কিন্তু আস্তে আস্তে সপ্তাহান্তের ভ্রমণে, গাড়ী নিয়ে বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, কাছেপিঠের শহরগুলো থেকে আসা মানুষের সংখ্যা কিন্তু এখন বাড়ছে।  শহরের জনকোলাহল, থেকে অনেক দূরে শান্ত, সমাহিত জনপদ ইয়ারকাদ, জীবন এখানে থমকে গিয়েছে। শান্ত, নিস্তরঙ্গ সেই জীবন।


 

শৈলশহর ইয়ারকাদের প্রতিষ্ঠা ১৮২০ সালে সালেম শহরের জেলা কালেক্টর ডেভিড ককবার্ণের হাতে। তিনি প্রথমেই ওখানে চা, কফি, কমলা,আপেল, ন্যাসপাতির চাষ শুরু করেন। তাকেই এই শৈলশহরের প্রাণপুরুষ বলা হয়। ১৮৪০ সালে পাহাড়ে কৃষিজমি বাড়তে থাকে, নতুন করে শুরু হয় এলাচ, দারু চিনির চাষ।  কফি বাগিচা বাড়তে থাকে, সম্পন্ন মানুষেরা কফি বাগান কিনতে শুরু করেন।  যদিও আধুনিক ইয়ারকাদ প্রাণ পায় ১৮৪২ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির তদানীন্তন গভর্নর থমাস মনরোর হাতে।

 

কিন্তু ইয়ারকাদের ইতিহাস আরও প্রাচীন।  ইয়ারকাদের 5 কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত প্রাচীন মন্দির অন্তত সেই কথাই বলে।  প্রস্তুর যুগের নিদর্শন এখানে পাওয়া গিয়েছে।

 

ইয়েরি বা ইয়ের তামিল শব্দ, অর্থ লেক, আর  কাদু বা কাদ কথার অর্থ জঙ্গল।  ইয়ারকাদ শহরকে ঘিরে রেখেছে ইয়ারকাদ লেক, চারপাশে তার ঘন সবুজ বনানী, দূরে শেভারয় পাহাড়।  শহরের কোলাহলে যখন শরীর, মন ক্লান্ত, তখন এই দূষণহীন, শান্ত, নির্জন  এই শৈল শহরে আপনি নিশ্চিত অবসর পাবেন।

 

কড়া শীত পড়ে না ইয়ারকাদে, তবে যারা গরমের হাত থেকে নিস্তার পেতে চান, তারা অনায়াসেই চলে আসতে পারেন এখানে।  সারা বছর অল্প ঠান্ডা, ঝিরঝিরে বৃষ্টি, কফি বাগিচার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়া, কমলার বাগান, দুপাশে ইউকালিপটাসের দীর্ঘ সারি, বাতাসে এলাচ, দারুচিনির সুবাস,  বাড়িগুলোর  আপেল বাগান, ফলন্ত ন্যাসপাতি গাছে, ঝুলে থাকা রসালো ন্যাসপাতি, অক্টোবর মাসে কফি বাগানে লাল টুকটুকে কফি ফলের ভারে ঝুলে থাকা গাছ, কফি ফুলের সুবাস।  একর, একর জমি নিয়ে গড়ে ওঠা এস্টেট, সম্পন্ন গৃহস্থের খামারবাড়ি,  লেক থেকে অনেকখানি আঁকাবাঁকা চড়াই ভেঙ্গে প্যাগোডা পয়েন্টে সূর্যাস্ত দেখতে যাওয়ার সময় দুপাশে পরিত্যক্ত সাহেব বাংলো, প্যাগোডা পয়েন্টে দাঁড়িয়ে অলস বিকেল কাটানো, কাছের কিয়োস্কে দাঁড়িয়ে কফি, ভুট্টাসেদ্ধ খাওয়া, গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে পাহাড়ের বুকে, কমলা সূর্যটা কমলা রঙের বলের মতো হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে নীল পাহাড়ের বুকে, আঁধার নামে পাহাড়ে, ফিরতি পথে, গ্রামের দক্ষিণী স্থাপত্যে গড়ে ওঠা শেভারয় মন্দির দেখে রিসোর্টে ফেরা। প্যাগোডা ছাড়িয়ে আরেকটু এগিয়ে এসে দেখি, ছেলেদের পায়ে তখনও ফুটবল। গুমফার গেট বন্ধ হয়ে গেছে, সন্ধ্যার প্রার্থনা সারা, গ্রামে সরকারী ভ্যান চাল, ডাল, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বিকিকিনি চলছে, সংসারী মুখের ভিড় গাড়ির চারপাশে, পাহাড়ি পথ বেয়ে হাঁটা উৎরাইয়ের পথে, দোকানি বাড়ীর মধ্যেই গাজর, শালগম, ফুলকপি বাঁধাকপি, সেলারি পাতা, পালংশাক, টোম্যাটোর পসরা সাজিয়ে বসেছে, ছোট চায়ের দোকানে আড্ডা চলছে, প্রতিদিনকার সুখ দুঃখের কথা, হাতে চায়ের কাপ, বেকারীর বিস্কুট, আরও এগিয়ে দেখতে পাই বাড়িতেই বেক করা কেক বিস্কুট নিয়ে ছোট্ট আয়োজন নিজেরই বাড়ীর বারান্দায়।  পেছনে ঘন্টা ধ্বনি শুনে দেখি একাকী অরণ্যে ছোট্ট ঘোড়া হেঁটে চলেছে, এগিয়ে চলি, দেখি মস্ত বড়ো ফার্ম হাউসের সামনের অংশ জুড়ে ক্যাফে, পুরোদস্তুর ইংরেজি খানা মিলবে আবার দক্ষিণী দোসা, উত্তাপম ও আছে বইকি। রিসোর্টে ফিরে রুটি, ডাল ফ্রাই, মিক্সড ভেজ, আর চিকেন কারী খেয়ে, সারারাত বৃষ্টির রিমঝিম শুনতে শুনতে কখন ঘুমের দেশে চলে গিয়েছি নিজেই জানিনা।  পরদিন সকালে গাড়ী বলা আছে, শৈলশহর পরিক্রমায় বেরোবো।

 


প্রথমেই লেক, সদ্য বর্ষা গিয়েছে, লেক জলে টইটুম্বুর, লেকের জলে দীর্ঘ ছায়া গাছের,জলে  অপেক্ষমাণ বোট, শান্ত, নির্জন ইয়েরকাদকে আরও গভীরভাবে প্রত্যক্ষণের জন্য কিছুক্ষণ লেকের জলে ভেসে বেড়ানো যায়। লেক থেকে এবার ইকো ট্যুরিজম পার্ক, ঘন জঙ্গল, কিচিরমিচির কত পাখির ডাক, গাছের আড়াল থেকে সুমধুর স্বরে শিস দিয়ে চলেছে অজানা পাখি, কুবোপাখির কুব কুব ডাক, এগিয়ে চলেছি ভিউ পয়েন্টের দিকে, যে ওয়াচ টাওয়ারে দাঁড়িয়ে দূরে সেভ্রয় পাহাড়ের বিয়ার্স কেভ (দুটো শিলা প্রস্তুরের এমন অবস্থান দেখে মনে হয়, ভালুকের গুহা),  হঠাৎ কিচির মিচির শব্দ, না পাখির ছানার নয়, বিরাট জায়গা জুড়ে টেন্ট করা হয়েছে, স্কুলের ইলেভেন টুয়েলভের এর ছেলেমেয়েরা ক্যাম্প করে আছে, নিজের ছেলেবেলার কথা, স্কুলের সাথে বেড়াতে যাওয়ার কথা মনে পড়ে।  ওখান থেকে বেরিয়ে, পরের গন্তব্য লেডিস সিট, জেন্টস সিট।  অনেকটা চড়াই, সবুজ গাছে ঢাকা, রেইন ট্রি র জঙ্গল পেরিয়ে লেডিস সিট, দুটো পাথর এমনভাবে রাখা যেন মনে হয়, ব্যাক রেস্ট সহ একটা চেয়ার, চেয়ারে বসে আরেকটা পা সামনের পাথরে দিয়ে গল্প করুন দুজনে, কেউ তাড়া দেবে না, শুধু পাহাড়ি গাছেরা আপনাদের গল্পকথার নীরব সাক্ষী হয়ে থাকবে। দূরে দেখা যাবে সালেম শহরটা, ভাগ্য সদয় হলে, ঝকঝকে আকাশ থাকলে, মেট্টুর বাঁধ ও দেখা যাবে।  পাশাপাশি জেন্টস সিট দেখা শেষ হলেই, গেটের সামনে আইস ক্রিম, ম্যাগি, চা, কফি  দিয়ে গলা একটু ভিজিয়ে নিয়ে, এবার হোলি ট্রিনিটি চার্চ, কাছেই  মন্টফোর্ড স্কুল, বিরাট প্লে গ্রাউন্ড, ঘন সবুজ ঘাসে ঢাকা, লাল টুকটুকে বাস্কেট বল খেলার বাস্কেট, শিশু যীশুকে কোলে নিয়ে মা মেরি হাসিমুখে আপনাকে স্বাগত জানাবে, এরমধ্যেই হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়া বৃষ্টি, স্কুলের ভেতরেই অনাথ আশ্রমের দাওয়ায় আশ্রয় নিলাম, একদম নিস্তব্ধ, একটা পিন পড়ার আওয়াজ ও শোনা যাবে, স্টেশনারি জিনিসপত্র নিয়ে স্কুলের সামনে এসে দাঁড়ালো একটা ভ্যান, তখন জিনিসপত্র নামানো চলছে বৃষ্টির মধ্যেই, ঘন সবুজ গালিচার মতো মখমলি ঘাসের ওপর ঠিক যেখানে আকাশটা নেমে এসেছে, সেখানেই নীল পাহাড়ের সারি।  বৃষ্টিটা একটু ধরলো, দেরী না করে চার্চের দরজায়।  ছোট্ট শহরের চার্চ, বৃষ্টি ধোয়া আঙিনা  পেরিয়ে  গির্জার প্রবেশদ্বারে সাদা ডেইসি ফুলের ঝাড়, ছিমছাম, শান্ত প্রার্থনা ঘর, গথিক স্ট্রাকচার, লাল, নীল, হলুদ কাঁচের জানলা, প্রার্থনা ঘরে দু দন্ড বসে থাকতে ইচ্ছে করে, কোথাও সময়ের ভ্রূকুটি নেই, স্পট দেখার হুড়োহুড়ি নেই, অখণ্ড অবসর, দূরে ভেসে আসছে, স্কুলের বাচ্চাদের কোলাহল, এবার উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটা শুরু, দল বেঁধে হেঁটে আসছে স্কুল ইউনিফর্ম পরা ছেলেমেয়েদের দল, হাসতে হাসতে হাত নেড়ে যায়। স্কুল ছুটির পর, গল্প করতে করতে হাঁটা, ভালো লাগে দেখতে, আরও কিছুদূর হাঁটি হোমমেইড চকোলেটের সন্ধানে, বাড়ীর বারান্দায় ছোট্ট চকোলেটের দোকান,  বিক্রেতা বাড়িতে তৈরী চকোলেট টেস্ট করান, কিছু কিনি, এমন কিছু ভালো মানের নয়, লোক্যাল ডেলিকেসি হিসেবেই কিনি।  এবার পাহাড়ি পথে কিছুক্ষণ নিজের সাথে নিজেরই হারিয়ে যাওয়ার পালা।  সংবিত ফিরতেই, তাড়াতাড়ি রিসোর্টের পথে, কাল সকালেই চেন্নাই ফেরা।

 


নির্জনতায় দু দন্ড পরিবারের সাথে কাটাতে যারা ভালোবাসেন, তারা দুদিনের জন্য আসতেই পারেন ইয়ারকাদ। তবে, একটা কথা, এখানে এসে কেউ ধ্যানগম্ভীর হিমালয়ের সন্ধানে যাবেন না, কোনও জনপ্রিয় শৈলশহরের সাথে তুলনায় যাবেন না, পূর্বঘাট, পশ্চিমঘাট পর্বতমালার নিজস্ব বর্ণ, গন্ধ আছে, তাই নিয়েই তারা স্বতন্ত্র।  আপনি যদি স্বাতন্ত্রে বিশ্বাসী হন, বৈচিত্রের সন্ধানী হন, তাহলে একটুও দেরী না করে বেরিয়ে পড়ুন, নিরাশ হবেন না।

| বর্ষ বরণ সংখ্যা-১৪২৯ | aleekpata.com | 29th Edition |

| ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |

| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |

| Bengali New Year, 2022 | April-June 2022 | Fifth Year Third Issue |

© All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |

| a DISHA-The Dreamer Initiative |

Tuesday, January 5, 2021

ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী (পর্ব ২ )- ব্যাঙ্গালোর- মহীশূর-কৌশিক রায়

 

ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী (পর্ব ২ )
কৌশিক বসু

 

অলীকপাতা শারদ সংখ্যা থেকে ধারাবাহিক ভাবে শুরু হওয়া আধ ডজন ভ্রমণ কাহিনীর দ্বিতীয় কিস্তি

 

আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এই লিঙ্কে  ( পর্ব ১)

 

এবারের পর্ব ব্যাঙ্গালোর- মহীশূর

 

এবারে ফিরছি আবার সেই হঠাৎ প্ল্যান করে বেরিয়ে পড়া নিয়ে - আমাদের ব্যাঙ্গালোর আর মহীশূর বৃত্তান্ত। সকাল সাড়ে সাত টা নাগাদ কলকাতা থেকে ফ্লাইট ছিল ব্যাঙ্গালোরের, পৌঁছলাম সকাল দশটা নাগাদ। একটু সময় লেগেছিলো গাড়ি পেতে, এয়ারপোর্টও ব্যাঙ্গালোর শহর থেকে একটু দূরে, তার ওপর ব্যাঙ্গালোরের কুখ্যাত ট্রাফিক, মাঝখানে গাড়ি বদল, লাঞ্চের জন্য একটু দাঁড়ানো - সবমিলিয়ে বানেরঘাটা পৌঁছতে ভালোই সময় লেগে গেল - দুপুর প্রায় দেড়টা।

 

পৌঁছে আগেই টিকিট কেটে সাফারি বাসের লাইন এ দাঁড়ালাম আমরা। বাস এ যখন উঠলাম পেলাম একদম পেছনের শেষ সিট। মুখ চুন করে বসে আছি  এই ভেবে আর কি ছবি তুলবো তখন বাস এর ড্রাইভার আর হেল্পার এলো, হেল্পার ভাইয়ের আমার চুন করা মুখ দেখে  আর কোলে ছোট ছেলে দেখে বোধ হয় দয়া হলো, আমাকে ড্রাইভার এর পাশে নিজের সিট ছেড়ে দিয়ে বললো বাচ্চা নিয়ে সামনে আসতে। গিন্নী পেছনের সিটের জানলার ধারেই থাকতে চাইলো, আমি ও ছেলে সামনে চলে এলাম ড্যাং ড্যাং করে, বাকি লোকজনের ঈর্ষার পাত্র হয়ে। অনেক ধন্যবাদ জানালাম তাকে ও ড্রাইভারকে। বাস থেকে নামার পর ভালো বাকশিস ও দিয়েছিলাম। অনেক ছবিও তুলেছিলাম, ছেলেও মহানন্দে জন্তু জানোয়ার দেখলো জানলায় বসে - কালো ভাল্লুক, হরিণ, সিংহ, বাঘ, সাদা বাঘ। এবং এটাই ছিল আমার প্ল্যান প্রথমে ছেলের মনমতো জিনিস দেখিয়ে বাকি ট্রিপ সেই নিয়ে গল্প করতে করতে কেটে যাবে। তারপরে পাখির আলয় এ  গেলাম আমরা, কিন্তু তখন প্রায় সন্ধে হয়ে যাচ্ছিল তাই পাখি বিশেষ ভালো দেখা গেল না ছবি তোলার মতো।

 

ওখান থেকে বেরিয়ে আমরা মাইসোরের বা মহীশূর এর জন্য রওনা দিলাম। মহীশূর পৌঁছতে রাত নটা বেজে গিয়েছিল, আর আমাদের হোটেল ছিল একটু ভিতরে, তবে রাস্তায় আলোকিত প্যালেস দেখে দাঁড়িয়ে একটি ছবি তুললাম। এক অনেক ভোরে উঠে এতটা এসেছি, তার ওপর পরের দিন সারাদিনের প্ল্যান কুর্গ ঘোরার, তাই আর বেশি দাঁড়ায়নি। পরের দিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম কুর্গ জয় করতে, তবে তা পরে বিশদে লিখবো। পরের দিন সকালে ব্যাঙ্গালোর ফিরে আলেপ্পির বাস ধরা বিকেলে, সময় হাতে ছিল, তাই রাস্তায় একটু প্যালেস এর সামনে দাঁড়িয়ে সিকিউরিটি গার্ডকে অনুরোধ করে গেটে ঢুকে কয়েকটা ছবি তুলে  ফেললাম । গিন্নী ও আমি আগে মহীশূর প্যালেস দেখেছি, তাই অর্ধেক দিন খরচ করে দেখার প্ল্যান ছিল না। ব্যাঙ্গালোর পৌঁছে গেলাম কয়েক ঘন্টা পরে , সেখানে এক পুরোনো বন্ধুর বাড়িতে গুছিয়ে লাঞ্চ, আর কি চাই!

 

কিছু ছবিও পোষ্ট করলাম, কেমন লাগলো জানাবেন।

 

দিবানিদ্রা


 

চলো একটু হেঁটে আসি



গোপন আলোচনা



ভীত চিঙ্কারা


দম্পতি


 
রাজা ও মন্ত্রী




চিন্তান্বিত মন্ত্রীমশাই


 

 সকালে মহীশূর প্যালেস এর আরেকটি গেট

 

আলোকিত মহীশূর প্যালেস


একটু উঁকি মেরে প্যালেস দেখা



ছবিঃ লেখক

আগামী পর্বে – কুর্গ...

Download ALEEK PATA Mobile APP
DOWNLOAD ALEEK PATA ANDROID APP
| শিশির সংখ্যা -১৪২৭।
| Aleekpatamagazine.blogspot.com |
  |ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Special Winter Issue, 2020 | December-February 2020 -21| 
| Fourth Year  Fourth Issue |25 th Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |





 

 



ভ্রমণ কাহিনী-রেশম পথের বাঁকে...-শঙ্খসাথি পাল

 

রেশম পথের বাঁকে, বরফ পাহাড় ডাকে
শঙ্খসাথি পাল

  

"One touch of nature makes the whole world kin"



  

 

দিন: ১ (২৫/১২/২০১৮)

 

"People don't take trips, trips take people.”

 

 

৩.৫০-এর শিয়ালদহ কাটোয়া লোকালে শুরু হয়েছিল যাত্রা। গন্তব্য — সিল্ক রুট ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় এহেন অফবিট ডেস্টিনেশনের ঝুঁকি নিতে বারণ করেছিল বেশিরভাগ মানুষ — তবুও পিছিয়ে আসতে মন সায় দেয়নি। সুতরাং, পিঠে রুকস্যাক নিয়ে লোকাল ট্রেনের দমবন্ধ ভিড়ে, আমার যাত্রা হল শুরু। শিয়ালদহ পৌঁছে গেলাম ৮ টা নাগাদ-জীবনে প্রথমবার এভাবে একা একা এতদূরে চললাম, ভয়, রোমাঞ্চ, ভালো লাগা সব মিলিমিশে পিওর খিচুড়ি ফিলিংস। তখনও জানি না, বাকি সঙ্গী কারা! ট্রাভেল এজেন্সির ট্যুর করার এহেন অনেক সমস্যাই থাকে — তবুও একা মানুষ হিসেবে বেছে নিতে হয়েছিল এই অপশন। রাত ১০.০৫এর দার্জিলিং মেলে যাওয়া হবে — ৯.২০ নাগাদ দেখা মিলল ট্যুর গাইডের। ৯.৩৫ নাগাদ ট্রেনে উঠেই আলাপ হল তিন সহযাত্রীর সাথে-আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লাস ওয়ানের নন্টি হয়ে উঠল আমার পার্টনার, সমস্ত ট্যুরের জন্যই। ট্রেন ছাড়ার আগেই আলাপ হল আরও এক পরিবারের সঙ্গে — যদিও তাদের গন্তব্য ছিল দার্জিলিং।

১০.৩০ নাগাদ মাটন বিরিয়ানি দিয়ে  জঠরের আগুন শান্ত করা হল।

এরপর যে যার মতো শোবার তোড়জোড় শুরু হল। লোয়ার বার্থে ঘুম আসে না কিছুতেই। বর্ধমান স্টেশনে ট্রেন থামা অবধি সুনীতাদিদির সাথে শুয়ে শুয়ে চলল আড্ডা। তারপর কখন যে চোখ লেগে এসেছে নিজেও জানতে পারিনি।

 

 

দিন :২(২৬/১২/২০১৮)

 

"Just living is not enough... one must have sunshine, freedom, and a little flower."

 

ভোর ভোর ঘুম ভেঙে উঠে দেখি বাকিরা তখনও ঘুমোচ্ছে। ব্রাশ করে ফ্রেশ হতে হতেই বাকিরাও উঠে গেছে। চা খেয়ে একটু গল্প গুজব করতে করতেই এনজিপি পৌঁছে গেল ট্রেন। স্টেশন থেকে বেরিয়ে নির্ধারিত গাড়িতে তুলে ফেলা হল লাগেজ। বাকিদের সাথে আলাপ পরিচয়, সাথে গরম চা। পাশেই এক যুবক হাতে ঘুঙুর বেঁধে ঢোল বাজিয়ে গেয়ে চলেছে সুপার হিট সব হিন্দি সিনেমার গান। মন খারাপ হয়ে গেল — কত প্রতিভা তার যোগ্য মর্যাদা পায় না এ দুনিয়ায় ! যাই হোক, খানিক পরেই পথ চলা শুরু হল — যদিও বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গেছে এক পরিবারের সদস্যদের কিছু ব্যক্তিগত কাজ সম্পাদনের জন্য। জ্যামেও আটকে থাকতে হল বেশ কিছুটা সময়। কিছুটা এগিয়ে একটা ধাবায় ব্রেকফাস্টের বিরতি। জায়গাটি সুন্দর — সামনে তাকালেই পাহাড়, দূরে ট্রেন যাচ্ছে ব্রীজের ওপর দিয়ে। আলুপরোটা খাওয়া হল। দুর্দান্ত বানিয়েছিল। তারপরে কফি। আবার শুরু সফর।আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে গাড়ি খাড়াই পথে উঠছে একটু একটু করে। কিছু পরেই আমদের সঙ্গী হল তিস্তা। তিস্তা নদী নয়, নদ। আমি বরাবরই তিস্তাকে দেখে মুগ্ধ হই — এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ফটো তোলার ইচ্ছে হলেও চলন্ত গাড়ি থেকে সে শখ পূরণ হচ্ছিল না। অবশেষে তিস্তা ব্রীজ আসতেই গাড়ি থামানো হলো — ক্যামেরাবন্দী করা হল তিস্তার অপরূপ সৌন্দর্য।

 


ঘন্টা তিন - সাড়ে তিনের মধ্যে কালিম্পঙে পৌঁছে যাওয়া যায়। এখানে দেখে নেওয়া যেতে আর্টস অ্যান্ড ক্রাফ্ট সেন্টার, যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহৃত নানান জিনিস আছে। কালিম্পংয়ে অনেক বৌদ্ধ মনাস্ট্রি রয়েছে। এর মধ্যে জাং ঢোক পালরি ফোডাং মনাস্ট্রিটি বিখ্যাত।আছে বেশ কিছু চার্চও। তবে এতকিছু যাওয়ার পথে একসাথে দেখার সময় হল না । বরং  যাওয়ার পথে দেখে নেওয়া যাক ডেলো পাহাড়। পার্কিং থেকে হেঁটে উঠতে হল বেশ খানিকটা । কালিম্পঙের সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছে গেলাম । ডেলো ভিউ পয়েন্ট থেকে দেখা যায় পুরো কালিম্পঙ শহর। আরও দেখা যায় পাহাড়ের সারি-এমনকি ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখাও মিলতে পারে।যদিও সে সৌভাগ্য ঘটেনি এবারে। প্যারাগ্লাইডিং করার বন্দোবস্ত আছে — তবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে।তাই সে ইচ্ছাও অপূর্ণ থেকে গেলো। আছে ঘোড়ায় চেপে গোটা চত্বর ঘুরে নেওয়ায় সুযোগও। কালিম্পঙের ফুল ও ক্যাকটাসের বাহার মনে থেকে যাবে চিরকাল।



এরপর আর দেরি না করে সিলারিগাঁও যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। ১৭-১৮কিমি যেতে হবে আরও। ঘড়িতে আড়াইটা পেরোতে চলল। রাস্তায় কোথাও মিলল না খাবার। অগত্যা ঠিক হল সিলারিগাঁও পৌঁছেই লেট লাঞ্চ করা হবে। পেটে ছুঁচোয় ডন দিলেও পাহাড়ি পথে পাইন গাছের সারি আর পাহাড়ের গায়ে মেঘের লুকোচুরি দেখতে দেখতে মনের খিদে মিটে গেল। তবে শেষ ৬কিমি পথ অত্যন্ত দুর্গম, বনের মধ্যে পাথরের উপর দিয়ে গাড়ি উঠবে। এই পথের ড্যান্সিং রোড বলা হয় তাই। প্রায় এক ৪৫ মিনিট ধরে পাথরের পথ শেষে পৌঁছে গেলাম সিলারিগাঁও-এ বুক করে রাখা হোম স্টে, "সুমিস্কা" তে।আজকের মতো এখানেই রাত্রিযাপন হবে।



 হাত মুখ ধুয়েই খেয়ে নিলাম আগে - স্যালাড, গরম ভাত, ডাল, টম্যাটো পিঁয়াজ, ধনেপাতা, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মাখা আলু সেদ্ধ, ডিমের ডালনা, পাঁপড় পোড়া - উফফ, জাস্ট অমৃত।  ততক্ষণে ৪.৩০ বেজে গেছে — বাতিল করতে হল ইছাগাঁও যাওয়ার প্ল্যান। অতৃপ্তির কাঁটা খচখচ করতে লাগল মনের মধ্যে। ট্যুর প্ল্যানারের কথায় আর কাজে অমিল অশনির সংকেত নিয়ে উপস্থিত হল এভাবেই। অথচ সেই মুহূর্তে একলা অচেনা এমন পরিবেশে মেনে নেওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। অতঃপর, ফ্রেশ হওয়ার তাগিদে বাকেটে গরম জল নিয়ে বাথরুমে প্রবেশ 'জয় মা' বলে। "ওরে বাবা রে"! হাত পা কেটে পড়ে গেল মনে হল জল ঢালতেই। কিছুক্ষণ অসাড় থাকার পর শুরু হল কাঁপুনি। কাঁপতে কাঁপতে শুকনো মাথায় স্নান সারা হল।আহ, বেরিয়েই দেখি গরম চা উইথ পকোড়া।ঠান্ডাটা একটু সইয়ে নিয়ে ব্যালকনিতে এসে বসলাম জমিয়ে — সবাই মিলে আড্ডা দিতে। ততক্ষণে সন্ধ্যা নামছে আস্তে আস্তে। সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য-পাহাড়গুলো কেমন যেন অন্ধকারের কম্বল মুড়ে পাশ ফিরে শুচ্ছে, ঘুমাবে বলে।রাত বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঠান্ডার প্রকোপ — ভিজে ভিজে হাওয়া। ছিল বনফায়ারের ব্যবস্থা — ১২০০টাকার বিনিময়ে। তো হল কি, আমাদের পাশেই আরও কিছু ট্যুরিস্ট ছিলেন - তারা রাজি হয়ে গেল — আর আমরা ব্যালকনিতে বসে ফ্রি ওয়ার্মিং জোনের মজা পেলাম।৮.৩০ বাজতেই রুটি আর মুরগি কষা খেয়ে লেপের তলায়। ফোনে কোনো নেটওয়ার্ক নেই — সুতরাং ওটা এখন এলার্ম ক্লক।

 

 

দিন :৩ (২৭/১২/২০১৮)

 

"Each morning we are born again. What we do today is what matters most."

 

আমি ইউজুয়ালি লেট রাইজার-তাতে যদি কানের পাশে মায়ের মধুর বাক্যবর্ষণ না থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। বাট সামটাইমস মিরাকল হ্যাপেনস; এদিন ঘুম ভেঙে গেল অ্যালার্ম বাজারও আগে। বিছানা থেকেই হাত বাড়িয়ে সরিয়ে দিলাম পর্দাগুলো-আহ, অন্ধকার থেকে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে পাহাড়ের সারি। নাহ, সূর্যের দেখা নেই, বাকি সঙ্গীসাথীদের বেরোনোর কোনো তাগিদ নেই — এমনকি দেখা নেই ট্যুর গাইডের। কি আশ্চর্য! অথচ করারও কিছু নেই। একাই এসে বসলাম ব্যালকনিতে। খানিক পরেই মেঘ কেটে গেল হঠাৎ — চোখের সামনে জেগে উঠল সাদা ঝলমলে কাঞ্চনজঙ্ঘা। বুঝতেই পারলাম না কি করে এই ম্যাজিক হয়ে গেল।ব্যালকনিতে এসেছিলাম যখন তখন মোবাইল বা ক্যামেরা কিছুই আনিনি সাথে। এটা মনে আসতেই দুদ্দাড় করে ছুটলাম ঘরের মধ্যে। ও মা — মোবাইলটা নিয়ে একছুট্টে বেরিয়ে এসেই বেবাক বোকা বনে গেলাম। কোথায় সেই পাহাড়চূড়ো! চারিদিকে ঘন মেঘ। ততক্ষণে সৌমেন দা, অশোকতরু আঙ্কেলও এসে হাজির হয়েছে বাইরে। চা দিতে বলে গেলাম গরমজলের কথা বলতে। ওখানেই জানতে পারলাম গতকাল রাতের তাপমাত্রা ছিল ১° 😨 চা খেতে খেতে আরেক ঝলক দেখা মিলল কাঞ্চনজঙ্ঘার। ততক্ষণে গরম জল পৌঁছে দিয়ে গেছে রুমে।স্নানটা সেরে ফেললাম — ক্রমশ তো আরও ওপরে আরও ঠান্ডায় যেতে হবে — জানি না কি ভয়ংকর ঠান্ডা অপেক্ষা করে আছে। সুতরাং স্নানে আপডেট করে রাখবো —  যতক্ষণ সাধ্যে কুলোবে।ব্রেকফাস্টে ছিল পুরি আর আলুর দম।এরপর লাগেজ নীচে পাঠিয়ে খানিক ফটো তোলা হল। আলাপ হল একটি বাচ্চা মেয়ের সাথে — নাম তার সুমিস্কা; বুঝলাম এর নামেই হোমস্টের নাম।সুন্দরী সিলারিগাঁও-কে টা টা জানিয়ে রওনা দিলাম ঋষিখোলা-র উদ্দেশ্যে, সময় তখন ১০টা।



 



পাহাড়ী পাকদন্ডী বেয়ে যাওয়ার রোমাঞ্চই আলাদা — র‌্যাদার বেটার টু সে, এই রোমাঞ্চ উপভোগ করার জন্যই পাহাড়ে যাওয়া বারবার। পথের প্রতিটি বাঁকে অপেক্ষা করে থাকে নতুন কিছু না কিছু। এভাবেই পথ চলতে চলতে এগোতে থাকা। ওয়েদার সেদিন খুবই ভালো। রোদ ঝলমলে — চারিদিকের সবুজ ধুয়ে দিচ্ছে সোনার বৃষ্টি। ঋষি (মতান্তরে রেষি) নদীর দেখা মিলেছে অনেকক্ষণই ।সাথে সাথে চলছি আমরা তারই টানে। একটা ব্রীজ পেরিয়ে পথ বেঁকেছে নদীর মতোই — তারপরেই থামল আমাদের গাড়ি। ছোট্ট একটা দোকান — পাওয়া যাচ্ছে চিপস, জল, এমনকি চা। জানতে পারলাম পাশের সংকীর্ণ যে পাথরের রাস্তা(?) নীচে নেমে গেছে - সেটা দিয়ে নেমে গেলে ছুঁয়ে দেখা যাবে ঋষি মশাই-কে। অগত্যা , পা বাড়ালাম সেই পথেই।কিছুটা নেমে আবার সেই পাথর ধরেই ওপরে উঠে এলাম — নিশ্চিত এ রাস্তা নীচ অবধি পৌঁছয় নি।

ওপরে এসে স্থানীয় মানুষের কাছে আবার জিজ্ঞেস করে নিলাম। ও মা! ওটাই নাকি যাওয়ার একমাত্র পথ।

আবার নতুন উদ্যমে নামতে শুরু করা।নাহ - অবশেষে নদীর পাড়ে এসে পড়লাম খানিক পরেই। উফফ — এরপর এক টুকরো বাঁশের সাঁকো।ওপারে যেতে হলে ওই বাঁশের সাঁকোই ভরসা। আমি অ্যাক্রোফোবিয়ার রোগী —  অথ কিম্?

"আজ ম্যায় উপর আসমান নীচে

আজ ম্যায় আগে জমানা হ্যায় পিছে"

চলেছি সামনে, পা টিপে টিপে। হঠাৎ মচমচ...বাঁশের ফাঁক দিয়ে বাঁ পা-টা ঢুকে গেল গেল...

 

নাহ, ভাঙে নি সাঁকো, কিংবা আমার পা...

কিন্তু বেশ ভয় পেয়ে গেছিলাম। ওই সাঁকোতে দাঁড়িয়েই কিছু ফটো তোলা — কিছু ওপারে গিয়ে। ঠান্ডায় জলে নামার ইচ্ছা সংবরণ করতে হল — এখনও অনেকটা পথ যেতে হবে — জিন্সটি ভেজালে ভালোই সমস্যায় পড়তে হব।।তবে না নেমেও বোঝা যাচ্ছে কি স্বচ্ছ জল, এমনকি জলের তলায় একটা সাপের খোলস অবধি পরিষ্কার দেখতে পেলাম। পাথরের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে  জলধারা, আর পাথরে বাধা পেয়ে ছোট ছোট অনেক স্রোত তৈরি হচ্ছে। ভয়ে ভয়ে ওপারে পৌঁছে যেতেই মনে হল পুরো ছবিটাই পাল্টে গেল। পাহাড়ের এমনটাই জাদু, সর্বত্র নতুনত্ব, হাজারো তার রূপ।ঋষিখোলার এই জায়গাটা সহস্রধারার মতো কিছুটা — তবে ওখানে যে ধারাপ্রপাতের জন্য সহস্রধারা নাম হয়েছে, এখানে সেরকম কিছু নেই। তাছাড়া ঋষিখোলা অনেক বেশি শান্ত, স্নিগ্ধ।ফেরার পথে পাথর ভেঙে উঠতে কষ্ট তুলনামূলক বেশি, নামার সময়ের থেকে। তবে ওঠার পথের চারপাশে অনেক অনেক গাছ, আর তাতে নানান রকমের বাহারি ফুল — চোখ জুড়িয়ে যায়। তবে একটা জিনিস বড্ড খারাপ লাগলো, অনেক গাছের গোড়ায় মদের খালি বোতল পড়ে আছে। প্রকৃতির অমলিন মাধুর্যের মাঝে বড় বেমানান।ওপরে এসে একটু চা-পান। তারপর আবার চলা শুরু।

আরিতার হয়ে রোংলি পৌঁছে জানতে পারলাম পারমিট বের করতে খানিকটা সময় লাগবে। আমরা সেই সুযোগে চলে এলাম একটু মার্কেটিং করতে। বেশ কিছু উলেন, ঘর সাজাবার জিনিস নেওয়া হল। তবে দরদাম করতে হবে, নাহলে ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর।আর কোথাও না থেমে একেবারে পদমচেন-মান্ডালা হোমস্টে, আজকের রাতের ঠিকানা। রাস্তা থেকে একটা ভয়ংকর খাড়াই নেমে মান্ডালা।সেখান থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে দোতলার রুমে আমাদের বুকিং ছিল। আহা, ঘর থেকেই পাহাড় দেখা যাচ্ছে।আজও লেট লাঞ্চ — ফ্রেশ হয়ে খেতে খেতে বিকাল ৪টে-তখন তাপমাত্রা ৩°

সন্ধেবেলা নীচের তলায় গেলাম গল্প করতে — যারা হোম-স্টের হোস্ট, তাদের সাথে। জানতে পারলাম ওখানে অনাথ বাচ্চাদের পড়াশোনা করানো হয়। ওদের ডাইনিং হলে বসে গল্প হচ্ছিল। ওখানে টিন দিয়ে ঘেরা একটা খুব ফায়ার প্লেস করা রয়েছে, সাথে ধোঁয়া বেরোনোর ব্যবস্থা। আগুনের উত্তাপে উষ্ণ হতে হতেই বুঝলাম, বাইরে বৃষ্টি শুরু হল। আগামীকাল নাথাং যাওয়ার কথা — জানি না কি আছে কপালে।

৮.৩০-এর মধ্যে ডিনার করে লেপের তলায়। ঘুম আসছে না কিছুতেই। এখানে বৃষ্টি মানেই ওপরে স্নোফল-কাল কি আদৌ আমরা রাস্তা খোলা পাবো?!

 

 

দিন :৪ (২৮/১২/২০১৮)

 

Mountains are the beginning and the end of all natural scenery

সকাল থেকে আকাশের মন খারাপ — মন খারাপ আমাদেরও। জানি না সবথেকে আকর্ষণীয় গন্তব্য আদৌ অধরা রয়ে যাবে কিনা। গতকাল রাতেই আমরা ব্রেকফাস্টের জন্য হাক্কা নুডলস বলে রেখেছিলাম। তো হাক্কা নুডলস হিসেবে যেটা সার্ভ করা হল-সত্যি বলছি, দেখে কান্না পাচ্ছিল।নিরুপায়, তাই ওই ম্যাগির ঝোল খেতে হল সোনামুখ করে। তারপর রওনা হতে হবে । আহা, হালকা হালকা রোদ উঠেছে। রওনা হওয়ার মুখেই দেখি একটা গাড়ি মান্ডালাতে এসে পৌঁছালো — গাড়ির মাথায়, বনেটে বরফ ভর্তি। জানা গেল, গতকাল রাতে নাথাং - এ স্নোফল হয়েছে ভালোই। টেনশনের পারদ চড়ছে, কি হয় কি হয়!

পারমিট পাওয়া যেতেই সবার মন ফুরফুরে। কেউখোলা ওয়াটার ফলস্ থেকে ১৮কিমি গেলেই জুলুক। পাহাড়ি নির্জন এক গ্রাম — সেনা ছাউনি ছাড়া জনসংখ্যা খুব বেশি ৭৫০ মতো। তবে বেশ কিছু হোম-স্টে গড়ে উঠেছে, অনেকেই রাত কাটিয়েছে সেখানে বোঝা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ থেমে শুরু হল ওপরে ওঠা।

জুলুকের রাস্তা শুরু হতেই মনে হল এক অন্য পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছি। মেঘগুলো সব লুকোচুরি খেলছে যেন। ৯৫টা হেয়ার পিন আছে জিগজ্যাগ রোডে। কি চূড়ান্ত শান্ত, স্তব্ধ অপার্থিব সৌন্দর্য। প্রথম কয়েকটা বাঁক পেরোনো অবধি কাউন্ট করেছিলাম — তারপর ঘেঁটে গেলুম বেমালুম। রাস্তায় কিন্তু ভালো মতোই বরফ জমে আছে গতকাল রাতের। ঠান্ডাও হাড় কাঁপানো ।এভাবেই বেশ অনেকটা চলার পর সামনে গাড়ির লম্বা লাইন। সামনে রাস্তা বন্ধ, গাড়ি আর যাবে না। ততক্ষণে কিন্তু ভালোই রোদ উঠেছে - কিন্তু গতকাল রাতের বরফ জমে আছে পুরু হয়ে। অধিকাংশ গাড়িই ব্যাক করছে। নাথাং থেকে কিছু গাড়ি আসছে অবশ্য, যদিও ম্যাক্সিমাম যাত্রী ছাড়া। সেই ড্রাইভাররাও বারণ করছে এগোতে। অনেকেই গাড়ি থেকে নেমে বরফের রাস্তা ধরে হেঁটে আসছে খানিক — চলছে ফটো তোলা। আমার কিন্তু চোখ ভরা জল।



 

সবার মতো আমিও অগত্যা নামলাম গাড়ি থেকে, ফিরে যখন যেতে হবে এখান থেকেই তখন এইটুকুই উপভোগ করে নেওয়া যাক। অজস্র গাড়ি দাঁড়িয়ে, মানুষের ভিড়, চিৎকার চেঁচামেচি। প্রকৃতির রূপ নির্জনে উপভোগ্য। তাছাড়া আমি চিরকালই ঘন মাথা সহ্য করতে পারি না। বিরক্তই লাগছিল। খাদের দিকে ভিড় কম — বরফে পিছল খেয়ে দুদ্দার ওল্টাচ্ছে, সেই ভয়েই হয়ত বা। আমি পা টিপে টিপে ওই খাদের দিকের এক পাথরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আহা, কি দেখলাম। পাহাড়ের নীচ থেকে কুন্ডলী পাকিয়ে উঠে আসছে দুধ-সাদা মেঘ। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না,বাকিদের ডাকাডাকিতে ফিরতে হল।হেঁটে সামনের বাঁক পেরিয়ে খানিকটা ওপরে ওঠা হল — কিন্তু রীতিমত দম লাগছে বরফের ওপর দিয়ে খাড়াই পথে উঠতে।

আর এগোনো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সমস্ত গাড়িই ব্যাক করছে। শুধু শুধু যেসব গাড়িতে চেন ছিল তারা চাকায় বেঁধে বেরিয়ে গেল। ড্রাইভার আর ট্যুর গাইডের সাথে ভালো মতো কথা কাটাকাটি শুরু হল। আমি যাওয়ার আগে সেই জায়গা সম্পর্কে মোটামুটি পড়াশোনা করে যাই। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে এই এলাকায় স্নোফল স্বাভাবিক ঘটনা। ওই রুটের গাড়িতে চেন রাখে, চাকায় বেঁধে গেলে খুব সহজেই এবং সুরক্ষিতভাবেই বরফ কেটে এগোনো যায়। অথচ গাড়িতে চেন রাখে নি-চেনের আলাদা ভাড়া লাগে, তেলও বেশি পোড়ে। ট্যুর কোম্পানি বেশি লাভ করবে বলে কম পয়সায় গাড়ি ঠিক করেছে। জাস্ট খাদের ধারে নিয়ে গিয়ে ছুড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছিল ট্যুর গাইডকে। ফেরার পথে হঠাৎ ড্রাইভার বলল, ওর দাদা আসছে নীচ থেকে ফাঁকা গাড়ি নিয়ে। তার কাছে এক্সট্রা চেন আছে। ১৫০০ টাকা দিলে সেই চেন পাওয়া যাবে। সবাই সব পেয়েছির আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। ঠিক হল, পদমচেনে নেমে মান্ডালাতে লাঞ্চ করে নিতে নিয়ে আবার উঠবো। যতদূর যাওয়া যাবে গিয়ে ওই গাড়ির অপেক্ষা করবো, বাকি রাস্তাটুকু চেন লাগিয়ে যাবো। ড্রাইভারকে শুরু থেকেই ভাইয়া বলেছি, আজ সে বলল "ইয়ে এক ভাইয়া কা ওয়াদা ছোটি বহিন সে-জান সে খেলকর ভি আজ তো আপ লোগো কো নাথাং পৌছকে রহেঙ্গে।"

 

মান্ডালাতে লাঞ্চের কথা বলা ছিল না, আর ওপরে নেটওয়ার্ক ছিল না। তাই এসে খাবারের ব্যবস্থা করা হল - ঘন্টা খানেক লাগলো সেসব করতে। আমাদের আটজনের দলের মধ্যে চারজন ওই রিস্ক নিয়ে নাথাং যেতে রাজি হল না। অথচ পদমচেনে কোনো রুম পাওয়া যাচ্ছে না। শেষমেষ তারা রোংলি নেমে গেল - কথা হল পরের দিন ফেরার পথে আমরা ওদের পিক করে নেবো। এই সব করতে করতে প্রায় দু'টো বেজে গেল। আবহাওয়া আবারও খারাপ হতে শুরু করেছে। আমরা চাইছিলাম আরও খারাপ কিছু হওয়ার আগেই ওপরে উঠে যেতে। জাস্ট গাড়ি স্টার্ট করতেই বৃষ্টি শুরু হল। আমরা তাতেও থামতে রাজি নই। মিনিট পনেরো সময় গেছে, একটা দু'টো চড়াই-এর বাঁক পেরিয়েছি মাত্র - শুরু হল তুষারপাত। আমার এই আঠাশ বছরের জীবনের সেরা রোমাঞ্চকর মুহূর্ত সেটা। তুলোর মত দুধ-সাদা তুষার ঝরছে অবিরাম - আর তার মধ্যে দিয়ে ছুটে চলছে আমাদের গাড়ি। চারিদিকের সবকিছু, কালো পাহাড়, সবুজ গাছ - বরফের কুচিতে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। স্বর্গ কি এর থেকেও সুন্দর হয়? আমার তো বিশ্বাস হয় না। জুলুক ছাড়িয়ে আমরা চলেছি জিগজ্যাগ রোড ধরে নাথাং - এর দিকে। রাস্তায় আর কোনো গাড়ি নেই - বুঝতে পারছি কি ভয়ংকর ঝুঁকি নিয়েছি আমরা। গাড়ি চাকা স্কিড খরছে, বাঁকের মুখের চড়াই বেশি হলে এগোতে গিয়ে পিছিয়ে আসছে আর পেছনেই অতল খাদ। আগামী বাঁকেই হয়ত মৃত্যু অপেক্ষা করে আছে। অথচ পথ আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে - আয় আয় আয়।

 

আগের বারের থেকে অনেকটাই ওপরে উঠে এসেছি, চেন ছাড়াই... আসলে আর্মির বেশ কিছু গাড়ি যাতায়াত করায় বরফ কেটে রাস্তা মত তৈরি হয়েছে। তবুও চেন ছাড়া যাওয়া উচিত নয়। কিন্তু যে ড্রাইভারের চেন দেওয়ার কথা সে এখনো পৌঁছায়নি আমাদের কাছে। অগত্যা, একটা ছোট্ট ক্যান্টিন মত পেয়ে সেখানে কফি খেতে খেতে গল্প। খানিক স্নোফলের ভিডিও তোলা, এনজয় করা।

কয়েকজন ব্রান্ডি কিনল, আমাদেরও নিতে বলছিল.. নইলে নাথাং-এ রাত কাটানো সমস্যাদায়ক হবে। তবুও নিতে মন থেকে সায় পেলাম না।খানিক পরে এল সেই গাড়ি। দুই গাড়ির ড্রাইভারের মধ্যে কথাবার্তা শেষে আবার যাত্রা শুরু হল। রাস্তায় বরফ বাড়ছে — কিন্তু চেন তো কই লাগাচ্ছে না! যতবার বলা হচ্ছে, ড্রাইভার বলছে "বেফিকর রহিয়ে।আপকো নাথাং জরুর পহছ দেঙ্গে।" শেষে কড়া ধমক দিতে বেরিয়ে এল এক মারাত্মক ভয়াবহ তথ্য। ওই গাড়ির ড্রাইভার রাস্তায় অন্য একজনকে চেন ভাড়া দিয়ে দিয়েছে বেশি টাকার লোভে। আমাদের ড্রাইভার সেকথা গোপন করে যাচ্ছে শুধুমাত্র আমাদের নাথাং পৌঁছে দেবে কথা দিয়েছে বলে।সব শুনে তো আমাদের মাথায় হাত। ততক্ষণে সূয্যিমামা পাততাড়ি গুটোতে শুরু করেছে। এরপরই অন্ধকারে মুড়ে যাবে পাহাড়।কথায় আছে "জোশ মে আকর হোঁশ মৎ খোনা".. এরপরও এগিয়ে যাওয়া আত্মহত্যারই সামিল হবে। তাই বাকি গন্তব্য অধরাই রয়ে গেল, এবারের মত। ফিরে আসছি, কোথায় জানি না. কারণ পদমচেনে ঘর অ্যাভেলেবল নেই জানি - রোংলি একমাত্র ভরসা। ফেরার সময় দেখি খানিকক্ষণ আগেই যে রাস্তা দিয়ে গেছি সেই রাস্তাতেই এখন বরফ জমাট বাঁধতে শুরু করেছে — যা আরও বিপজ্জনক।

মন খারাপ, ভীষণ খারাপ। ড্রাইভারের কাছেই জানতে পারলাম, আর দুটো বাঁক পেরোতে পারলেই পৌঁছে যেতাম থাম্বি ভিউ পয়েন্ট। একটু নেমে গাড়ি থামানো হল। ওখান থেকে কিছু ফটো নেওয়া হল জিগজ্যাগ রোডের। মন ভরলো না। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে না।

  


শীতের সন্ধ্যা, তার ওপর ওই রকম আবহাওয়া। হাড় অবধি কেঁপে যাচ্ছে।রাস্তায় জনপ্রাণী নেই। হেডলাইটের আলোয় অন্ধকার চিরে নামছে গাড়ি। সর্পিল পাহাড়ি উতরাই পথ এই অন্ধকারে অত্যন্ত বিপজ্জনক।

পদমচেনে আবারও ঘরের খোঁজ করা হল —  কিন্তু পাওয়া গেল না। অগত্যা রোংলি। প্রায় সাড়ে সাতটা নাগাদ পৌঁছানো গেল রোংলি। বাজারের কাছে যতো হোটেল, সব ভর্তি-ঘর নেই কোথাও। অবশেষে অনেক খুঁজে রংপো ব্রিজ পেরিয়ে এক হোমস্টেতে ঘর পাওয়া গেল। এক্কেবারে গ্রামের শেষ প্রান্তে নির্জনে সেই হোম-স্টে। সত্যি বলতে কি, থাকতে রীতিমত ভয় করছিল। সেদিন খুব তাড়াতাড়ি ডিমের কারি আর হাতরুটি দিয়ে ডিনার সেরে শুয়ে পড়া হল। মন খারাপ সকলের। এই ট্রিপের মূল আকর্ষণ ছিল নাথাং - তাই হয়ে উঠল না আল্টিমেটলি।গতকাল থেকে ফোনে নেটওয়ার্ক ছিল না - কচ্চিৎ নেটওয়ার্ক এসেছে, কিন্তু ফোন কানেক্ট হয়নি সেভাবে। বাড়িতে ফোন করলাম শুয়ে শুয়েই। শুনলাম নাথাং-এ নাকি গতকালের ট্যুরিস্টরা আটকে আছে। নামার রাস্তাও বন্ধ অনির্দিষ্টকালের জন্য। ভয়ানক তুষারপাত আর ঠান্ডায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অনেকেই — সেনাছাউনিতে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে তাদের।

ফোনটা রেখে ভাবতে ইচ্ছে হল - তবে কি কখনও কখনও স্বপ্ন পূরণ না হওয়াও মঙ্গলসূচক!

 

 

দিন :৫(২৯/১২/২০১৮)

 

The purpose of life is to live it, to taste experience to the utmost, to reach out eagerly and without fear for newer and richer experience "

 

সারা রাত ঘুমের মধ্যেও অস্বস্তি; নাথাং-এর অধরা হাতছানি। আজ নাথাং থেকে ফিরে আরিতার যাওয়ার কথা ছিল, প্ল্যানিং অনুযায়ী। আরিতারে দেখার মতো আরিতার লেক, নেচার ভিউ। ফেরা তারও পরের দিন। কিন্তু নাথাং থেকে ফেরার সময়টুকু অতিরিক্ত এখন, সুতরাং দেড় দিন আরিতারে কাটাতে হবে।আমাদের ইচ্ছা আরিতার না গিয়ে গ্যাংটক বেরিয়ে যাওয়ার - তাতে খানিকটা অন্যরকম আনন্দ করা যাবে। কিন্তু ট্যুর এজেন্ট রাজি নয়। অনেক আলোচনা পর্যালোচনা করার পর রাজি হল, অবশেষে।প্রায় তখন দশটা। গরম গরম পুরি আর আলুর দম খেয়ে গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে বেরোনো হল। আজকের আবহাওয়া একদম ঝকঝকে। তবে ছাঙ্গু, নাথাং, নাথুলা, লাচেন লাচুং-কোনো কিছুরই পারমিট দিচ্ছে না। যাঁরা ওপরে আটকে আছে, তাদের হেলিকপ্টার করে নীচে নামানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।গ্যাংটকের রাস্তায় সবসময়ই সঙ্গ দেয় পাহাড় আর নদী। "সচমুচ, দিল খুশ হো যাতা হ্যায়"!

 

গ্যাংটক যাওয়ার পথে দেখা মিলল বরফ ঢাকা পাহাড়চূড়ার। তিন - সাড়ে তিন ঘন্টার রাস্তায় এক মুহূর্তের জন্য গতকালের মনখারাপের ছায়া প্রভাব ফেলতে পারেনি। পাহাড়ের জাদু বোধহয় এমনটাই ।

গ্যাংটকে পৌঁছে রুমটেক ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে নামতেই চোখ জুড়িয়ে গেল কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ আরও কয়েকটি পর্বতের সারি। সামান্যই দেখা যায় ওখান থেকে - তবুও তাতেই মন ভরে যায়।ওখান থেকে অন্য গাড়িতে পৌঁছলাম হোটেল পাইন লিফ। গ্রাউন্ড ফ্লোরে আমাদের রুম। সামান্য ফ্রেশ হয়ে নিলাম সকলে, স্নান তো সকালে রোংলিতে করে এসেছি। এরপর ঝটপট ডিনার সেরেই বেরিয়ে পরলাম গ্যাংটক শহর ঘুরতে। কিন্তু বেশ দেরি হয়ে গেছে — জানি না কতগুলো জায়গা কভার করা যাবে। গ্যাংটক আমি আগেও গেছি — তাই মোটামুটি আইডিয়া আছে।

প্রথমেই যাওয়া হল রোপওয়েতে। বীভৎস লাইন। আশেপাশের সব জায়গায় যাওয়ার পারমিট বন্ধ - তাই গ্যাংটক এখন সরগরম। প্রায় এক ঘণ্টা লাইন দিয়ে চাপতে পেলাম। রোপওয়ে থেকে দেখতে পাওয়া যায় গ্যাংটক শহর, চারপাশের পাহাড় এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা। বেশ ভালো লাগলো পড়ন্ত বিকালের আলোয় এইসব কিছু দেখতে।

এরপরের এলাম do drul chorten মনেস্ট্রি। ১৯৪৫ সালে Trulshik Rinpoche নির্মাণ করেন এটি। ১০৮ টা প্রেয়ার হুইল আছে, আছে একটা কাচ ঘেরা জায়গায় অজস্র প্রজ্বলিত দীপ (১০৮ টার বেশি বলেই মনে হল)। গুরু Rinpoche এর দু'টি মূর্তি আছে। তখন প্রার্থনা চলছিল, খানিকক্ষণ দেখলাম। নানারকম বাদ্যযন্ত্র সহযোগে প্রার্থনা করছে বৌদ্ধরা। ওখানে থেকে বেরিয়ে মশলা মুড়ি খেতে খেতে এলাম কাছেই অবস্থিত মিউজিয়ামে। কিন্তু চারটে বেজে গেছে, মিলল না প্রবেশ অনুমতি।এরপরের গন্তব্য গণেশ টক বা গণেশ মন্দির।



 গ্যাংটকের রাস্তা দেখলে মনে হয় বিদেশে আছি। এত নিয়ম মেনে চলে সব কিছু, সত্যি গর্ব হয়।হঠাৎ বাঁ-দিকে তাকিয়ে দেখি কাঞ্চনজঙ্ঘা, সূর্যের শেষ আলো মেখে অভূতপূর্ব সে শোভা। কোনোবার সূর্যোদয়ের সময় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাইনি — এমনই কপাল। এইভাবে হঠাৎ করেই যে সূর্যাস্ত দেখতে পাবো ভাবতেই পারিনি।মাঝরাস্তায় গাড়ি থামানো সম্ভব হল না —তাই এই অমূল্য মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দী করার সৌভাগ্য হল না।গণেশ টকে পৌঁছলাম যখন তখন ভালো মত সন্ধ্যা নেমেছে, আলোয় আলোয় শহর এখন ঝলমলে। খানিকক্ষণ ঘুরে ফিরে দেখা হল চারিদিক, কেনাকাটাও হল একপ্রস্থ।এরপর তাশি ভিউ পয়েন্ট। কিন্তু অন্ধকার ভালো মতো। দেখা গেল না কিছুই — অথচ সময়ে আসতে পারলে এখান থেকে দেখা যেত গ্যাংটক শহর, নানান শৃঙ্গ।মন খারাপ। নিচে নেমে খাওয়া হল বঢ়াপাও আর কফি।এরপর আমাদের ড্রাইভার ভাই দু'টো ঝর্ণা দেখালো, তবে অন্ধকার বলে যাওয়া গেল না, দূর থেকেই দেখতে হল।এবার ফিরতে হবে।

আমরা যদিও ম্যালের কাছে নেমে গেলাম। এরপর প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে চলল কেনাকাটা। গণেশ টকে যে পার্স আর উইশ চেন কিনেছি - ম্যালে তার দাম কম।বেশ কিছু জুয়েলারি, উলেন নেওয়া হল। ফিরতি পথে নেওয়া হল এখানের স্পেশাল কিছু চকলেট।অবশেষে হোটেলে ফেরা।

সকালে আমাদের ইচ্ছে ছিল রুমটেক মনেস্ট্রি যাওয়ার। কিন্তু ওদিকের রাস্তায় কাজ চলছে —আটকে গেলে সময়ে ফেরা যাবে না, এমনটাই জানালো ড্রাইভার ভাই। আমাদের এন জি পি ফিরতে হবে, রাতের ট্রেনে টিকিট করা আছে। তাই রুমটেক না গিয়ে লিংদাম যাওয়ার প্ল্যানিং হল।

ব্যাস, এরপর ভাত, ডাল, পাঁপড় পোড়া, ফুলকপি আলু পোস্ত, চিকেন, চাটনি দিয়ে ডিনার সেরে সোজা কম্বলের তলায়। টেম্পারেচার ১°

সুতরাং...দে ঘুম।

 

 দিন :৬ (৩০/১২/২০১৮)

 

 

"Loneliness expresses the pain of being alone and solitude expresses the glory of being alone."

 

আজ একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠলাম ৭.৩০ নাগাদ। ফ্রেশ হয়ে একেবারে স্নান করে নিলাম। ততক্ষণে ব্রেকফাস্টের জন্য তাড়া দিচ্ছে সবাই। সুতরাং খেতে গেলাম উপরে। আসলে হোটেল পাইন লীফের খাওয়ার জায়গাটা দোতলায়। উপরে উঠে দেখি বেশ হইচই — ব্যাপার কী?! খোঁজ নিতে গিয়ে চমকে চ হয়ে গেলাম। ব্যালকনি থেকে  তাকালেই শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম জাস্ট ।ফোন ক্যামেরা সব নীচে রেখে এসেছি চার্জে —ততক্ষণে খাবার সার্ভ করে দিয়েছে। ঝটপট খেয়ে নিয়েই দৌড়োলাম নীচে - ফোন,  ক্যামেরা আনতে। ব্যালকনি থেকে কিছু ফটো তুলে চললাম ছাদে, সেখান থেকে আরও কিছু ফটো নিলাম। ওখান দাঁড়িয়ে দেখা যায় হেলিকপ্টারের আনাগোনা, ওটা নাকি পাহাড়ের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে আনে। বেশ ভালো ব্যবস্থা। ও মা, ছাদে দেখি একটা কিউট কুকুর ছানা-পোষা নিশ্চয়ই হোটেল মালিকের। তো যাই হোক, দিলাম আচ্ছা করে চটকে।এরপরেই বেরোনোর তাড়া, গাড়ি এসে গেছে। চললাম লিংদাম মনেস্ট্রি ।দিনেরবেলায় শহরের ব্যস্ততা চোখে পড়ে। পাহাড়ের মানুষরা কি কঠোর পরিশ্রমী, দেখে অনুপ্রাণিত হতেই হয়। ঘন্টা খানেক পাহাড়ের কোল বেয়ে পথ চলার পর রাস্তা খাড়াই ও নির্জন হতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে দেখতে পেয়েছি প্যারাগ্লাইডিং।আরও বেশ কিছুক্ষণ পর পৌঁছলাম লিংদাম মনেস্ট্রি। এর আরেক নাম রাংকা মনেস্ট্রি। ১৯৯৯ সালে তৈরি-অন্যতম সুন্দর মনেস্ট্রি। পার্কিং থেকে একটু হাঁটলেই প্রবেশ পথ। কিছুটা উঠান মতো পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে হয়।  সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এর দেওয়ালে দারুণ সব ছবি। উপরে প্রার্থনা সভায় ঢুকলে দেখা যায় সোনালী বিশাল বুদ্ধমুর্তি, পুঁথি, নানান মুর্তি, ল্যাম্প। দুপাশে সার দিয়ে বসার জায়গা, সম্ভবত প্রার্থনার সময়ের জন্য। দুটো বিশাল ড্রামের মত বাদ্যযন্ত্র চোখে পড়ে।




এরপর আশপাশে ঘুরে দেখা। প্যাগোডা টাইপ বিল্ডিং। চোখে পড়ে নানান বয়সী লামাদের। চারিদিকে তাকালে শুধু পাহাড় আর ঘন বন। কি অদ্ভুত সুন্দর নির্জন সৌন্দর্য। নীচে নেমে ঘোরা হল আশেপাশের সব কিছু।

এবার আবার হোটেলে ফেরা। গিয়েই নিউ জলপাইগুড়ির জন্য রওনা দিতে হবে।

 

 

পাইন লীফ থেকে চেক আউট করে বেরোতে ১.৩০টা বাজলো।একটা হোটেলে লাঞ্চ করা হল — ৬দিন পর মাছ খেলাম। আদ্যপান্ত মাছে ভাতে বাঙালি কিনা।

এরপর ফেরার পালা। গাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে নিচ্ছে।কিন্তু রাস্তার দু'ধারে তখনও পাহাড় সাথে সাথে চলেছে, তার হাতছানি ফেলে কি ঘুমানো যায়! তিস্তা ব্রীজ পেরিয়ে চা পানের বিরতি।তারপর আবার চলা।ক্রমশ নামছে সমতলে, তাপমাত্রা সহনশীল এখন। শিলিগুড়িতে বীভৎস জ্যাম। সাড়ে ছ' টা থেকে সাতটা দশ আটকে রইলাম চুপচাপ। সাড়ে সাতটা নাগাদ স্টেশনে পৌঁছানো হল।তারপর একবার।হংকং মার্কেটে ঢু মারার ইচ্ছা ছিলো — কিন্তু রবিবার বন্ধ। অগত্যা, কাছেপিঠের দোকানগুলোতে চক্কর কাটা হল।সাড়ে আটটা নাগাদ পদাতিক এক্সপ্রেসে উঠে যে যার জায়গা খুঁজে নিতে হল।

 

 

দিন :৭ (৩১/১২ /২০১৮)

 

There is a kind of magic about going far away and then coming back all changed"

 

 

ভোর পাঁচটাতে বর্ধমান নেমেই ৫. ০৫ এর কাটোয়া লোকাল পেয়ে গেলাম একটু দৌড় দিতেই। ব্যাস,৬. ৩০ তে কাটোয়া - ৭টায় বাড়ি ।

ছবিঃ লেখিকা

Download ALEEK PATA Mobile APP
DOWNLOAD ALEEK PATA ANDROID APP
| শিশির সংখ্যা -১৪২৭।
| Aleekpatamagazine.blogspot.com |
  |ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Special Winter Issue, 2020 | December-February 2020 -21| 
| Fourth Year  Fourth Issue |25 th Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |


















Main Menu Bar



অলীকপাতার শারদ সংখ্যা ১৪২৯ প্রকাশিত, পড়তে ক্লিক করুন "Current Issue" ট্যাব টিতে , সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

Signature Video



অলীকপাতার সংখ্যা পড়ার জন্য ক্লিক করুন 'Current Issue' Tab এ, পুরাতন সংখ্যা পড়ার জন্য 'লাইব্রেরী' ট্যাব ক্লিক করুন। লেখা পাঠান aleekpata@gmail.com এই ঠিকানায়, অকারণেও প্রশ্ন করতে পারেন responsealeekpata@gmail.com এই ঠিকানায় অথবা আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।

অলীক পাতায় লেখা পাঠান