কালাপানির দেশ আন্দামান (পর্ব-৪)
তৃপ্তি মিত্র
সংখ্যা -২৬, (১৭ ই আগস্ট , ২০১৮) |
যথা সময়ে ডিগলিপুর পৌঁছে গেলাম ৷ অতীতের পোর্ট কর্নওয়ালিস হল বর্তমানের " ডিগলিপুর " ৷ অঞ্চলটি বাঙালি অধ্যুষিত ৷ এখানকার নাম করা হীরা হোটেল বাঙালি পর্যটকদের খুব প্রিয় ৷ গাইডের কথা মতো এখানেই প্রাতরাশ সারলাম হিংএর কচুরি ছোলার ডাল সহযোগে ৷ প্রাতরাশেই বাজি মাত ওফ কি অপূর্ব তার স্বাদ ৷ যেন কোলকাতার শ্রীহরির সেই চেনা স্বাদ ৷ এ অভিজ্ঞতা আমাদের বাঙালিদের জীবনে ঘটে নি হলফ করে বোধহয় কেউ বলতে পারবে না ৷ বিদেশ বিভুয়ে ঘুরতে গিয়ে চেনা পরিচিত স্বাদ খুঁজে পাওয়া মানে হাতে চাঁদ পাওয়ার সমান ৷ যাইহোক দিপ্রাহরিক খাবারের অর্ডারও করে দিলাম ৷ দুপুর একটা দেড়টার মধ্যে চলে আসবো কথা দিয়ে সোজা চলে গেলাম " রস ও স্মিত " আইল্যান্ড ৷
প্রতিবারের মত আধার কার্ড দেখাতে হয় সঙ্গে যে কয়জন আছি সবারই ৷ আমরা মোট আটজন ছিলাম , দুটো স্পিড বোট পেলাম , এক একটি বোটে চারজন ৷ নিয়ম মাফিক লাইফ জ্যাকেটে সবাই সেজে উঠলাম ৷ আমাদের আগে আরো বেশ কয়েকটি বোট রওনা দিল ৷ সবকটি বোটই নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলছে ৷ এ কয়দিনে সমুদ্র আর বোটকে খানিকটা আপন করে ফেলেছি ৷ বোটে যেতে যেতে লক্ষ্য করলাম দুদিকে দুটো আইল্যান্ড মনে মনে ভাবছি এখানে কি এমন দেখার আছে ৷ সে ভ্রম ভাঙ্গল খানিক পরে ৷ বোট অনেকটা আগে আমাদের নামিয়ে দিল মানে যতটা জল ছিল ৷ এরপর বালির চরা হেঁটেই এগোছি দূরে রোপোলি বালুর পাহাড় ৷ বালুপাহাড়ে এসে যা দেখলাম জানিনা কতটা ভাষায় প্রকাশ করতে পরবো ৷ এখানের জলের সোভা দেখলে মন প্রাণ সব জুড়িয়ে যাবে ৷ কি অপরূপ তার সোভা ৷ খুব কাছে সবুজ , একটু দূরে ফিরোজা ,আরো দূরে তিব্র কালচে নীল ৷ এরপর আকাশের নীল আর সমুদ্রের নীল মিঁলেমিশে একাকার ৷ কোনটা সমুদ্রের নীল কোনটা আকাশের নীল আলাদা করার উপায় নেই ৷ অনেকক্ষন ধরে সমুদ্র স্নান করলাম ৷ চেঞ্জরুম আছে যদিও তেমন উন্নত মানের কিছু নয় ৷ যাইহোক পাওয়া গেল এটাই সান্তনা ৷
কথা মতো হিরা হোটেলে ফিরে দূপুরের আহার আলুরচোখা , ডাল , পার্সে মাছের ঝাল সঙ্গে দেশি মুরগি ৷ খুব চেটে পুটে খেয়ে মন ভরে গেল ৷ সঙ্গে উপরি পাওনা যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে যাওয়া আমার এক দিদিকে পেলাম ৷ মাধ্যম একটা ফোন নাম্বার দিদিকে শেষবার দেখেছি আমি তখন ক্লাস ওয়ান হব হয়ত ৷ ফোনে কথা অনুযায়ী জামাইবাবু হিরা হোটেলের সামনে এসে দাঁড়ায় ৷ ওখান থেকে দিদির বাড়ি ৷ এরপর যা হয় দিদি বোন গলা জড়িয়ে অঝোরে কান্না ৷ কত গল্প , হাসাহাসি ৷ রাত্রে বিশেষ কিছু খাব না জাননো সত্বেও দিদি , জামাইবাবু ছাড়ল না ৷ রাত্রে "বি . ডি " লজে ফিরতেই হল ৷ কারণ পরবর্তী গন্তব্য " হ্যাভলক " ৷ দিদির কান্না ভেজা মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো ৷ দিদির তিন মেয়ে কারোর সঙ্গে দেখা হল না ৷ বড় ,ছোট মেয়ে পোর্টব্লেয়ারে থাকে পড়াশুনার জন্য ৷ মেজো কোলকাতায় এমফিল পড়ছে ৷ আন্দামানের প্রতিটি স্কুল কেন্দ্রীয় মধ্য শিক্ষা ( C.B.S.E ) দ্বারা অনূমোদিত ৷ মহাবিদ্যালয় গুলি পন্ডিচেরি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পলিটেকনিক মহাবিদ্যালয় নিউদিল্লী দ্বারা অনুমোদিত ৷ ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়াশুনা এখানে বাধ্যতামুলক ৷
আন্দামান ভ্রমনে ট্যুর এজেন্সির সাহায্য নেওয়াটাই শ্রেয় ৷ আমাদের এজেন্সির তত্বাবধানে ম্যাক্রুস জাহাজে চেপে হ্যাভলকের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম ৷ সমুদ্রের সোভা দেখতে দেখতে দু ঘন্টার মধ্যে হ্যাভলক পৌঁছে গেলাম ৷ এটি মুলত দেশ ভাগের সময় সর্বস্ব হারানো বাংলা দেশি মানুষের উপনিবেশ ৷এই দ্বীপটি সকল পর্যটকের অত্যন্ত প্রিয় ৷ এখানের " রাধানগর " বিচ ২০০৪ সালে বিশ্বের সেরা বিচে সন্মানিত হয় ৷ দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশি , শুভ্র বালুতট এই বিচের সৌন্দর্য্য কে করে তুলেছে আরো মোহময়ী ৷ জলের রং পান্না সবুজ ৷আন্দামানের সব বিচ স্নানের উপযোগী নয় ৷ রাধানগর তেমনই বিচ যা স্নানের উপযোগী ৷ ঢেউ এর আকর্ষনে আর থাকতে পারলাম না নেমে পড়লাম ৷ দীর্ঘক্ষণ সমুদ্র সোহাগ উপভোগ করলাম ৷ স্নান শেষে সমুদ্র লাগোয়া ধাবায় আহার সারলাম ৷ হ্যাভলকের এলিফ্যানটা বিচে সমুদ্র ক্রিড়ার পসরা সাজানো ৷ আমরাও সেই দলে ভিড়ে গেলাম ৷ এরপর নীল দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম ৷ ধীরে ধীরে হ্যাভলকের সব কিছু মিলিয়ে গেল ৷ একসময় সব মিলিয়ে জল আর জল ৷ প্রায় দেড় ঘন্টার মধ্যে সর্বগ্রাসী নীলের মাঝখান ছেড়ে পৌঁছে গেলাম " নীল আইল্যান্ডে " ৷
নীল একটি ছোট্ দ্বীপ ৷ এখানে ও সর্বস্ব হারানো বাংলাদেশি মানুষের আধিপত্য ৷ দ্বীপটি সবুজ বনানীতে ঘেরা ৷ শান্ত , স্নিগ্ধ , নির্জন সাগর তট ৷ আর ফসলে ভরপুর ৷ এখানে ও সমুদ্র ক্রিরায় সাজানো পসরা ৷ ভরতপুর বিচে গ্লাস বোটে চড়ে রং বেরং এর প্রবাল , রঙ্গীন মাছ দেখলাম ৷ সিওয়াক ,স্নরকেলিং , স্কুবা ডাইভিং করার পক্ষে উপযুক্ত ৷ বিচ লাগোয়া দোকানিরা প্রচুর পসরা নিয়ে বসেছে ৷
এবার ফেরার পালা ৷ জাহাজ যতো তার গতি বাড়াছে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ যেন গিলে খেতে আসছে ৷ আবহাওয়া খুব খারাপ ৷ মাঝে মাঝে বৃষ্টি ৷ অসম্ভব ঢেউ এর আছাড় আর দুলুনি সহ্য করতে না পেরে অনেকেই বমি করে ফেলছে ৷বার বার ঘড়ি দেখছি আর ঠাকুর কে স্মরন করছি ৷ সময় কিছুতেই পার হতে চাইছে না ৷ অবশেষে ঘোষনা করল আর মাত্র ৩০মি সময় লাগবে ৷ এবার ধড়ে প্রাণ ফিরে পেলাম ৷ দূর থেকে পোর্টব্লেয়ারের আলো দেখতে পেলাম ৷ জাহাজ থেকে নামতে না নামতে আবার ভিজলাম ৷ পরের দিন সকাল ১০ ফ্লাইটে কোলকাতার রওনা দিলাম ৷ আর সঙ্গে করে নিয়ে আসলাম আন্দামান দর্শনের তৃপ্তির স্বাদ ৷ যে স্বাদ আস্বাদন করতে দেশ বিদেশ থেকে বহু পর্যটক ছুটে আসে ৷ আমিও সেই দলে সামিল হলাম ৷
সমাপ্ত