কাল যাত্রী
স্বরূপ চক্রবর্তী
Image Courtesy: Google Image Gallery |
(১)
গভীর রাতের দিল্লীগামী
পূর্বা এক্সপ্রেস , শীতের রাতের জমাট অন্ধকার চিরে ঝড়ের
বেগে ধেয়ে চলেছে। সেকেন্ড স্লিপার এর একটি ঠাসাঠাসি ভীড় ভর্তি রিজার্ভড
কম্পার্টমেন্টের জানালার ধারের সিটে জানলায় থুতনি ঠেকিয়ে বসে বাইরের অন্ধকার
দেখছিল অপুর্ব...
সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমা
পাশ করে একটি সংস্থায় সেলসের চাকরি করছে, প্রায় হাফ বেকার , চারিদিকে বিভিন্ন কোম্পানির ঠিকানায় অসংখ্য দরখাস্ত পাঠিয়ে তারপর হঠাৎ সুদূর হিসার, হরিয়ানা থেকে একটি নামি কোম্পানির ডাক এসেছে, প্রথম বছর "ট্রেনি", বেতন
খুবই কম ,
কিন্তু একবছর টিকে থাকতে পারলে বেতন বাড়বে, ওখানে কলেজের এক বন্ধু আগে থেকেই কাজ করে, তার দেওয়া ঠিকানাটা নিয়েই অপুর্ব দরখাস্ত পাঠায়, আজ প্রায় ছয়মাস বাদে দশ দিনের নোটিশে কোম্পানীর তলব এসেছে, ইন্টারভিউ আছে, যাতায়াতের খরচ কোম্পানীর।
সালটা দুহাজার-এক, তখন মোবাইল, ইন্টারনেট কি জিনিষ সাধারণ মানুষ তা জানেনা, পোস্ট অফিসের দৌলতে প্রায় পাঁচ দিন লেট করে চিঠিটি হাতে
এসেছে অপুর্বর। তড়িঘড়ি রেলের টিকিট কাউন্টারে লাইন, রেলওয়ের নীল রঙের ছাপানো ফরম্যাটের ওপর অস্পষ্ট কালো রঙের
ডট ম্যাট্রিক্স প্রিন্টারে সিট সংখ্যা, তারিখ, ট্রেনের নাম ইত্যাদি ছেপে বেরিয়ে এল, হতাশ হয়ে অপুর্ব দেখল 'ওয়েটিং দশ' যেটা দুদিন পর স্টেশনে চেক করিয়ে নিতে বুকিং ক্লার্ক 'আর এ সি দুই' লিখে দিলেন। যুবক অপুর্ব র চোখের মধ্যে শিশুসুলভ উদ্বেগ আঁচ
করে বয়স্ক ক্লার্ক ভাববাচ্যে বললেন,
"দিল্লি কি প্রথম বার?"
অপুর্ব বলল,
" আজ্ঞে, দূরপাল্লার ট্রেনই প্রথমবার, কিন্তু, সীট ছাড়া কি করে..?"
"আরে
বাবা,
ভয় কিসের? আর.এ.সি মানে, শোয়ার না হলেও, বসার জন্য জানলার ধারের একটি সীট অবশ্যই পাওয়া যাবে, অন্য একজনের সাথে শেয়ার করতে হবে,এই যা।"
অতটা পথ...কিন্তু অপুর্ব র উপায় নেই, চাকরি টা ওর খুবই দরকার,সংসারে মা একা, বাবা বলতে ফ্রেমে বাঁধানো কিছু স্মৃতি আর কয়েকটা খেরোর
খাতার বিবর্ণ পাতায় মুক্তার মত হাতের অক্ষরে লেখা কিছু গল্প, একটি
ডায়েরি ,
তাতে কিছু ছোট খাটো ঘটনার বর্ণনা, সময় বদ্ধ নয়, অগোছালো, প্রবন্ধের আকারে লেখা কিছু ভাবনা, আর কিছু আঁকিবুঁকি, যেগুলো
দেখে বোঝা যায় যে , পরলোক, আর
ইহলোকের মধ্যের পর্দাটি বোধহয় উনি মানতেন না, এই দুই লোক ওঁনার কথা অনুযায়ী দুইটি ডাইমেনশন মাত্র, ঠিক যেন দিল্লি আর হাওড়া, ট্রেনে করেই অনায়াসে যাওয়া এবং ফিরেও আসা যায়, শুধু উপযুক্ত ট্রেনের অপেক্ষা।
(২)
তারার আলোর কথা শুনেছিল
কিন্তু আজ প্রথমবার চাঁদ বিহীন শহুরে দূষণ মুক্ত আকাশে অপূর্ব তারার আলো দেখতে পেল
অপুর্ব। বাবার কথা মনে পড়ে যাওয়ায় বুক খালি করা একটা নিঃস্বাস বেরিয়ে এল।
মনে পড়ে ছোট বেলার কথা, তখন লোডশেডিং হলে ওদের ভাড়ার বাড়ীর ছাদে বাবা বসে বসে ওকে
তারা চেনাতেন, অপুর্বর
মন কিন্তু পড়ে থাকত ওদের বাড়ির গা ঘেঁষা
পাশের পুলিশের দারোগা অর্থাৎ বড়বাবুর পরিত্যক্ত কোয়ার্টার টির দিকে। ওখান
থেকে উঠে অপুর্বদের ছাদের উপর প্রায় ঝুঁকে পড়া বিশাল ঝাঁকড়া জাম গাছ, শোনা যায় যে বহু বছর আগে ওই গাছে জাম পাড়তে গিয়ে কোনও এক
বড়বাবুর ছেলে নীচে পড়ে মারা যায়। ওনার স্ত্রী সেই দুঃখে মানসিক রোগী হয়ে যান ও পরে
মারা যান,
এর পর ওই কোয়ার্টারে যখনই কোনও নতুন পরিবার এসেছে তাদের শিশু সন্তান দের সাথে
প্রাণঘাতী মারাত্মক দুর্ঘটনা অথবা অসুখ হয়েছে, বিশাল কালো দৈত্যের মত ওই গাছটি যেন শিশুদের গ্রাস করে
চলেছে,
বার দুয়েক কাটার চেষ্টা করেও গাছটি আজও কাটা যায়নি, প্রতিবারই গাছ কাটার উদ্যোক্তা রা আহত বা অসুস্থ হয়েছে।
কোলের কাছে ঘেঁষে বসা
অপুর্বর মাথায় হাত বুলিয়ে বাবা বলতেন "ভয় পেলি অপু ?"
,"ও সব কিছু গুজব, একটা দুর্ঘটনা আর তার সঙ্গে কিছু সমাপতন, বা কোইনসিডেন্স সব মিলিয়ে আমরা একটা কাল্পনিক বিপদ খাড়া করে
নিই,
কারন, আমরা ওই সব ঘটনার এক্সপ্ল্যানেশন দিতে পারিনা, বা, হয়ত চাইও না।"
মাঝে মাঝে বলতেন ওনার এক
আত্মীয়ের কথা,যাঁর
একমাত্র একটি সাদা কালো অস্পষ্ট ছবি অপুর্বদের দেশের বাড়িতে ও এক কপি ওদের কলকাতার
বাড়ীতে খুব যত্ন করে টাঙানো আছে, কৌপিন পরা জটাজুট ধারী এক যুবক, মুখে দাঁড়ি নেই, নীচে বোধহয় কম্বল বিছানো, আর পাশে মাটিতে পুঁতে রাখা একটি চিমটে। ওই পুরোনো ছবিটিতেও
যা স্পষ্ট বোঝা যায় তা হল ওনার চোখের অন্তর ভেদী দৃষ্টি।
বাবা বলে চলেন,
"উনি সম্পর্কে তোমার দাদু হন, একজন সিদ্ধ পুরুষ, আজও উনি আমাদের সাথে সবসময় আছেন"।
"কিভাবে?” অপুর প্রশ্নের উত্তরে বাবা বলেন “আসলে, আমরা কেউই একা নই, খালি চোখে আমরা আমাদের চারপাশের যে জগৎ টি দেখছি, ঠিক একই রকম আরো অনেক অনেক জগৎ রয়েছে, চলছে সমান্তরাল ভাবে, সময়ের নিরিখে হয়ত কেউ একটু এগিয়ে, কেউ বা পিছিয়ে।"
"ঠিক
বুঝলাম না বাবা", বলল অপু।
"হুমম", বাবা বলে চলেন, "মনে কর তুই, মানে অপু, আজ ষোলোই জুন, উনিশশো সাতাশি, মঙ্গল বার, বাবার সাথে বসে গল্প করছিস আর ভূতের ভয়ে কাঁপছিস, আর , আজকে লোডশেডিংও হয়েছে, কিন্তু আমাদের সমান্তরাল পৃথিবীতে হয়ত এই সমস্তই ঘটবে আর দু দিন বা দু মাস বা
পাঁচ বছর পরে বা আগে, তবে ঘটবে নিশ্চিত, কেউ আটকাতে পারবে না, কারন,
আমরা আমাদের সমান্তরাল আমির দেখা কখনো পাব না, অন্ততঃ এখনকার টেকনোলজির সাহায্যে তো নয়ই, বুঝলি?"
সময় সমান্তরাল ভাবে বয়ে
চলেছে মসৃন কার্পেটের মত বিছিয়ে রাখা
স্পেসের ওপর, তবে
হ্যাঁ, কার্পেট
যদি কুঁচকে যায় তাহলে ওর ওপর দিয়ে বয়ে চলা সময় হয়ত একে অপরের কাছে চলে আসতে পারে, হয়তবা একে অপরকে ছুঁতেও পারে।"
ভ্যাবাচ্যাকা অপুকে বাবা
বুঝিয়ে চলেন "এই সমান্তরাল সময় গুলো
ঠিক সমান্তরাল রেল লাইনের মতোই, কখনো একে অপরের সঙ্গে মিলতে পারে না বটে, কিন্তু যেমন কোনও বড় রেলওয়ে জংশনে দেখবি বিভিন্ন দিকের রেল
লাইন একে অপরকে ক্রস করে, ভেদ করে চলে যায়, আর সেটা কিছু কর্মচারী কিছু বিশেষ
লিভার কে চালিয়ে করে, অপু,আমার বিশ্বাস যে এইরকম কোনও বিশেষ স্থান ও বিশেষ ক্ষমতা
সম্পন্ন মানুষের সঙ্গম হলে সময়কে একে অপরের সাথে মিলিয়ে দেওয়া যায়, যার জন্য স্থান-কাল তথা ব্যক্তির অবদান আছে। যেমন এই রেলওয়ে
জংশন কে স্থান মাহাত্য ও লিভার ম্যান কে ব্যক্তি মাহাত্য বলতে পারিস । কোনও বিশেষ
স্থানে কোনও বিশেষ ব্যক্তি এটা পারলেও পারতে পারে।
জুনের গরম তাড়ানো ঝির
ঝিরে হওয়া আর বাবার একটানা বকে চলার সুরেলা আওয়াজে অপুর চোখে তখন ঘুমের পরী এসে
বসেছে।
(৩)
চোখ বন্ধ থাকলেও যদি
চোখের সামনে আলো জ্বলে ওঠে,তাহলে
বেশ বোঝা যায়, এইরকম
আলো আর ,
অনেকক্ষন লোডশেডিংএর পর আলো এলে পাড়ার সমস্ত বাচ্চাদের সমবেত উল্লাস ধ্বনির
সাথে বেমানান " চা.. এ ....
চা..এ.." শব্দ শুনে অপুর চোখ খুলে
গেল। বোধহয় সারা দিনের ধকলে চোখ জুড়ে
এসেছিল,
অনেক দৌড়ের পর ট্রেন টা একটু হাঁফ নিচ্ছে, এটা একটা মাঝারি মত স্টেশন, নাম জানা নেই, জানার
ইচ্ছেও নেই, হাত
ঘড়ি বলছে রাত ন'টা।
কি কারনে কে জানে অপুর্ব
অনুভব করল কে যেন ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, স্নিগ্ধ, কিন্তু অস্বস্তিকর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি! ব্যাপার টা বোঝার
আশায় সাইড লোয়ারে বসা অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসতে যেতেই মাথাটা কিসে যেন একটা ঠুকে
গেল,
ওপরের বার্থ থেকে কয়েক জোড়া পা ঝুলছে, রোমশ, ধুলোভর্তি। আর, মাথায় যেটা ঠুকল সেটা একটা পেতলের চকচকে ত্রিশূলের নিচের
দিকটা,
গোটা কামরাময় ঝিম ধরা ধোঁয়া, আর মাঝে মাঝেই ব্যোম..ব্যোম..।
বিরক্তি তে ওর চোখ কুঁচকে গেল।
(৪)
নামেই রিজার্ভড কামরা, কিন্তু জসিডি পার হবার পর থেকেই কামরায় দমবন্ধ ভীড়, শুরু হল হাতে চিমটে, ত্রিশূল, লাঠি ইত্যাদি নিয়ে অর্ধনগ্ন জটাজুট ধারীদের কামরা দখল
অভিযান। জিজ্ঞেস করে জানা গেল যে এনারা চলেছেন এলাহাবাদ, ওখানে চলা অর্ধ কুম্ভ মেলায় যোগদান করতে। শিবের চেলা, ফলে টিকিট ফ্রি আর সাথে নির্বিরোধ গঞ্জিকা সেবন । প্রায়
পাঁচ ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল অপু, নিজের সিট , হোক না আর.এ.সি , তাতে এককোনে বসারও সুযোগ নেই। পাটনা স্টেশনে টিটিই এসে সাধুদের ধমকে দেওয়ার পর অপু একটু বসতে
পেয়েছে।
কিন্তু কে ওর দিকে এভাবে
তাকিয়ে আছে? আর
কেনই বা?
ধুস, যত মনের ভুল,
অপুর্ব মনটাকে অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করে।
স্টেশনের দিকে তাকায়, বেশ শীত করছে, গায়ের কাশ্মীরী শালটা ভালো করে জড়িয়ে নেয়। এটা বাবা ব্যবহার
করতেন,
এখনও ওটা গায়ে জড়ালে মনেহয় বাবা ওঁর সর্ব সত্বা দিয়ে আদরের
অপুকে জড়িয়ে আছেন।
এই স্টেশনেও ডজনখানেক
সাধু কামরায় উঠল।
অপুর্ব মনে মনে হাসে, বেশ ভালো কিন্তু, সে ও যদি কৌপিন আর ত্রিশূল ধারণ করে নিতে পারত তাহলে আর
এরকমভাবে পেটের চিন্তায় দৌড়োতে হত না,
শুধু একটাই পিছুটান, "মা"।
"মা", এই ছোট্ট শব্দটি অপুর্বর কানে মন্দিরের আরতির সময় একসাথে
বেজে চলা অনেক গুলি ঘন্টার মত শোরগোল তুলে দিল , সাথে শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, ধুপধুনোর সুগন্ধ , চোখের সামনে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া সাদা আলোর ঝলক , আর ...আর,
আলোর ঝলকানির মাঝে সেই
শীতল স্নিগ্ধ দৃষ্টি, করুণায় টলটলে।
ক্রমে ক্রমে শোরগোল একটু
কমে আসতে লাগল, শুরু
হলো শীত,
অসহ্য সেই শীতের
অনুভূতি , অপুর্ব দেখল সে একটি তুষারাবৃত পর্বতের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা
স্থানে দাঁড়িয়ে, মাটি
বলতে সাদা বরফ, কানের
পাশ দিয়ে হু হু করে বয়ে চলেছে ঝড়ো হাওয়া, হাওয়ার সাথে বরফকুচি উড়ছে আর শরীরে বিঁধছে। বাবার কাশ্মীরী
শাল টা অপুর্ব আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
মোহাবিষ্ট অপুর্ব এতক্ষন
সেই চোখটির দিকে অপলক তাকিয়ে ছিল। এবার দেখল সে চোখের দৃষ্টি বাম দিকে ঘুরল, অনুসরন করে অপুর্ব দেখল সামনে একটি বরফের বেদীর ওপর বসে
আছেন এক কৌপিন এবং জটাজুট ধারী সন্ন্যাসী। আর তার সামনে বরফের ওপর হাঁটু গেড়ে
করজোড়ে মাথা নিচু করে বসে আছে একটি বছর কুড়ির পঁচিশের ছিপছিপে তরুণ সন্ন্যাসী, কোমরের একচিলতে কাপড় লজ্জা নিবারণ করলেও ঊর্ধাঙ্গের
ছেঁড়াখোঁড়া কাপড় টি নিশ্চই শীত আটকাচ্ছে
না,
কিন্তু, যুবকের সেদিকে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই, বোধহয় গুরু শিষ্য, ঝোড়ো হাওয়ায় ওঁদের কথা শোনা যাচ্ছিলনা,কিন্তু কি অদ্ভুত, যেই না একথা ভাবা, অমনি ওঁদের বার্তালাপ অপুর্ব স্পষ্টভাবে শুনতে শুরু করল, কথাবার্তা সব হিন্দিতেই চলছে-
গুরু বলছেন,
" ব্যাটা, তুই মিথ্যে বলেছিস যে তোর কেউ নেই, মাও না, তখনই আমি সব বুঝেছিলাম, কিন্তু এই একটি মিথ্যে ছাড়া তুই আর কোনও ভুল করিসনি, তোর সাধনা ও গুরুভক্তি নিখাদ , তাই, সন্তুষ্ট হয়ে আজ তোকে আমি ডেকেছি কিছু বিশেষ ক্ষমতা দেবার জন্য। কিন্তু, আজই শেষ, এরপর তোর সাথে আমার আর কখনো দেখা হবেনা"।
"ক্ষমা, ক্ষমা করুন গুরুদেব!"
"তুই
বাড়ি ফিরে যা, তোর মা
মুমূর্ষু,
মৃত্যুশয্যায়, তোর জন্য দিন গুনছে, আর তিনদিন পরই ওঁনার মৃত্যু হবে, তুই ফিরে যা, ওঁকে দেখ।"
" কিন্তু হিমালয়ের এই দুর্গম স্থান থেকে বাড়ি পৌঁছতে যে
আমার কয়েক মাস লেগে যাবে প্রভু।"
"চিন্তা
নেই,
আমার প্রদত্ত শক্তির সাহায্যে তুই এক মুহূর্তে যেখানে খুশি
যেতে পারবি"।
এবার তরুণটি মাথা তুললেন, অপুর্ব দেখল ওঁর মুখ,আর, বুকটা ধ্বক করে উঠল, কারন ওই চোখের দৃষ্টি, খুব চেনা, কিন্তু
রহস্যময়।
চোখের সামনে পর্দা নেমে
এল...।
(৫)
অপু ধড়মড়িয়ে উঠে বসল, গলা শুকিয়ে কাঠ , এটা কি ছিল? স্বপ্ন? না, তাহলে, গায়ের
চাদর টা এত কনকনে ঠান্ডা কেন? , আর কেনই বা ভেজা ভেজা! অপুর্বর সব কিছু গুলিয়ে গেছে।
স্টেশনে ট্রেন ঢুকছে ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে,রাত প্রায় বারোটা, স্টেশনের নাম লেখা হলুদ ফলকটি পেরিয়ে গেল,"বক্সার"। অপুর্ব তার এস সেভেন কামরার একত্রিশ নম্বর
সিট ছেড়ে বাথরুমের দিকে গেল, মুখে চোখে জল ছিটিয়ে নেবে বলে, কামরার মধ্যে লোকজন খাবারদাবার খেয়ে শুয়ে পড়েছে, কামরার আলো গুলির প্রায় বেশিরভাগ বন্ধ , ওদিকে বাথরুমের দিকের প্রথম ক্যুপেতে একটি পরিবার বাচ্চা
কাচ্চা নিয়ে উঠেছে, ওখানে আলো জ্বলছে আর, সীট নিয়ে পরিবারটির সাথে সাধুবাবাজিদের একপ্রস্থ বেঁধেছে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে
অপূর্ব নিজের সীটের দিকে ফিরল, যাঁর সঙ্গে ওর সীট শেয়ার করা ছিল তিনি একজন মাঝবয়সী পুরুষ, পাটনায় উঠেছিলেন, এক্কেবারে নির্বিরোধ, ওঠার পর থেকেই একটি হিন্দি মাসিক পত্রিকা নিয়ে পড়ছিলেন, দিল্লি অব্দি সাথে যাবার কথা, ব্যবসায়ী, ছেলে আই আই টি তে
পড়ে, তার
সাথে দেখা করার জন্য প্রায় প্রতি মাসেই দিল্লি যান, ওনার এসব ঝঞ্ঝাটের অভ্যাস আছে, আধঘন্টা আগে টিটিই কে ধরে একটি আস্ত অপার বার্থ জুটিয়ে নিয়ে
ছিলেন,
গুডনাইট বলে এতক্ষনে তিনি শুয়ে পড়েছেন,কামরা প্রায় অন্ধকার, অপূর্ব
নিজের সৌভাগ্যের কথা ভেবে খুশি হচ্ছিল, এবার আরামে বাকি রাত টুকু শোয়া যাবে, অপুর্ব তার একমাত্র লাগেজ একটি পিঠে ঝোলানো ব্যাগ টি মাথার
নীচে নিয়ে বার্থে লম্বা হল।
ট্রেন এখন একটি ঘন
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছে, সীটে লম্বা হয়ে শোবার পর আবার সেই অস্বস্তিটা ফিরে এল, সেই কারও একটা নজরদারির আভাস, তবে, এবার যেন তাতে কোনো স্নিগ্ধতা নেই, যেন হুমকি , যেন অশনিসংকেত, ট্রেনটি যেন তার পেটের ভেতর সবাইকে নিয়ে পাগলের মত
হুড়মুড়িয়ে কোনও এক অজানা নিয়তির দিকে ছুটে চলেছে, যে কোনো মুহূর্তে লাইন শেষ হয়ে যেতে পারে, সমস্ত লোকজন সাথে নিয়ে ট্রেনটি যেন
ঝাঁপ দেবে এক অতল খাদে ! অপুর্বর শিরদাঁড়া বেয়ে একরাশ ঠান্ডা বরফের স্রোত
বয়ে গেল। নাঃ, ঘুম আসবে
না,
হয়ত বাড়ি থেকে মাকে একা
রেখে এতদূর আসার জন্য মাথায় এইসব আসছে, ভুলে থাকার জন্য মাথার দিকের আলোটা জ্বালিয়ে মাথার কাছে
রাখা ব্যাগটা থেকে বাবার ডায়েরি টা টেনে বের করল অপুর্ব, এই ডায়েরি টা সে প্রায়ই পড়ে, বিশেষতঃ ওর সেই সন্ন্যাসী দাদুর কথা, আর, বাবার উদ্ভট চিন্তা ভাবনার কথা, যতবার পড়ে, ততই নতুন মানে বেরোয়।
বাবা লিখেছেন-
" আজ
একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটল, বেশ কিছুদিন ধরেই ঠাকুমার খুব শরীর খারাপ, হয়ত আর বাঁচবেন না, ওনারও আর বাঁচার ইচ্ছে নেই বোঝা যায়, কিন্তু ওঁনার সব থেকে প্রিয় ছেলে, ও
ওঁনার ছোট ছেলে, মানে, আমার ছোটকার কথা উনি প্রলাপের ঘোরে বকে চলেছেন; আজ প্রায় দশ বছর হল ছোটকা নিরুদ্দেশ, কোথায় আছেন বা আদৌ বেঁচে আছেন কিনা কেউ জানেনা। কিন্তু
ঠাকুমার দৃঢ় বিশ্বাস যে ওর ছেলে ফিরে আসবেই, জ্যেঠু, কাকু, পিসিরা সব ঠাকুমার খবর পেয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছে, আমরা ছোটরা ঠাকুমাকে
ঘিরে বসে আছি।
দুপুরের দিকে বাইরের ঘরে
শোরগোল শোনা গেল, দাদু ঠাকুমার আট ছেলে মেয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট শুভ্রা পিসি খবর নিয়ে দৌড়ে ভেতরে
এসে বলল,
"সবাই শোনো ! বাইরের ঘরে একজন
সন্ন্যাসী এয়েছেন, বলছেন যে উনিই আমাদের ছোট ভাই".....
অপুর্ব কয়েক টি পাতা
উলটে গেল,
...বাবা লিখেছেন,
" আজ দশদিন হলো ঠাকুমা চলে গেছেন, মৃত্যু কালে ওঁনার ছোটো ছেলে অর্থাৎ ছোটকা ওঁনার সামনে
ছিলেন,
সেদিনের পর ছোটকা
বাড়ির ভেতরে যাননি, বাইরে খামারের নিকানো উঠোনের পাশে একটি বিশাল তেঁতুল গাছের নিচে ঠাঁই নিয়েছেন, শুধু একটি মাটির বেদী তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, উনি ওখানেই দিনরাত ধ্যান মগ্ন হয়ে থাকেন। আজ ঠাকুমার
শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, সকাল থেকেই বাড়ীতে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান হয়ে চলেছে, বর্ধিষ্ণু ব্রাহ্মণ বাড়ির বৃদ্ধা গিন্নীর সজ্ঞানে পরলোক গমন
বাড়ির লোকজনের জন্য দুঃখের বিষয় হলেও গ্রামের লোকজনের জন্য প্রায় একটি উৎসব বিশেষ, পাত পেড়ে খাওয়া আর সাথে উপরি পাওনা হিসেবে হিমালয় ফেরত
সিদ্ধ সন্ন্যাসীর দর্শন। তখনকার দিনের মানুষজন এসব ব্যাপার সহজেই বিশ্বাস করতেন, তবুও ব্যতিক্রমী সন্দেহবাতিকের অভাবও নেই তারা নিজের চোখে
না দেখে সিদ্ধ পুরুষের মাহাত্য মানতে নারাজ।
ছোট কাকার এসবের কোনো
কিছুতে ভ্রূক্ষেপ নেই, শুধু চোখ বুঁজে ঠায় বসে আছেন বেদীর ওপর।
সকালে আকাশ পরিষ্কার ছিল, কিন্তু বেলা বাড়ার সাথে সাথে আকাশে ঘোর দেখা দিয়েছে,
দুপুর হয়ে এসেছে, খাওয়া শুরু হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই, কিন্তু মেঘের অবস্থা ভালো নয়।
আর,যার ভয় ছিল, ঠিক তাই হলো, বাড়ির সামনের খামারে আসন পেতে ভোজের ব্যবস্থা হয়েছিল, কিন্তু পরিবেশন শুরু করার আধঘন্টার মধ্যেই শুরু হল টিপটিপ ও
তার পর বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি। বড়রা সকলে হায় হায় করে উঠল , অনুষ্ঠান পণ্ড হয়ে যায় আর কি, কিন্তু সকাল থেকে নিস্পৃহ হয়ে বসে থাকা ছোটকাকা এবার উঠে
বসলেন ও তাঁর হাতের চিমটেটি দিয়ে খামার সহ বাড়ির চারিদিক ঘিরে একটি রেখা টানতে
শুরু করলেন, লোকজন
আমোদ পেয়ে ওঁকে ঘিরে ধরল, আর ,
শুরু হলো আকাশভাঙ্গা বৃষ্টি। আর, গ্রামের
প্রায় দুইশত লোকের ছানাবড়া চোখের সামনে ঘটল এক অপার্থিব ঘটনা, সমস্ত গ্রাম জলে ভেসে গেলেও কাকার গন্ডি কেটে ঘেরা জায়গায়
এক ফোঁটা জল ঢুকল না, অনুষ্ঠানে কোনও বিঘ্ন হল না।“
অপু পড়ে চলে...”এই ঘটনার
কথা জানাজানির কয়েক দিনের মধ্যেই আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের লোকজনের কাছে ছোটকাকা
একজন বিশেষ আকর্ষণ হয়ে উঠলেন, সবাই তাঁকে পায়ে হাত দিয়ে ছুঁতে চায়, আশীর্বাদ নিতে চায়, কাকা বিরক্ত হন। কিন্তু নিরুপায়। বাবা, ও অন্যান্য জ্যেঠুদের মধ্যে ছোটকাকা আমার বাবাকে বেশি ভালো
বাসতেন,
হয়ত পিঠোপিঠি ভাই বলে নয়ত সবার আগে দাদা বলে চিনতে পারার
জন্য,জানিনা কেন।“
বাবা আরও লিখেছেন, “এই ব্যাপার টা আমার বাবার মুখে শোনা, একদিন রাতের দিকে লোকজন চলে যাবার পর ছোটকাকা বাবাকে নিজের
কাছে ডাকলেন , জানালেন
তাঁর মনের কথা, বললেন,আমি আমার গুরুকে মিথ্যে বলে পাপ করেছিলাম, আর, মায়ের কাজের দিন লোকজনের সামনে আমার ক্ষমতা প্রদর্শন করে ফেলেছিলাম, ওটা আমার ভুল ছিল, আর সেই পাপে আমি ধীরে ধীরে সংসারে নিমজ্জিত হয়ে চলেছি, তুমি, আমার দাদারা ও অন্যান্য বড়রা আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে থাক, আমি আরো পাপের ভাগী হই, এবার আমায় মুক্তি দাও, আমি বেনারস যাব, সঙ্গমে কুম্ভ মেলা চলছে , আমায় ওখানে যেতেই হবে। আমার ডাক এসেছে।
আমায় চারিদিকে দিনরাত লোকজন ঘিরে রাখে, আমি চাইলে হঠাৎ
অদৃশ্য হতে পারি, কিন্তু আর না, আর কোনও শক্তি প্রদর্শন নয়, আমি লুকিয়ে পালাতে চাই, তুমি সাহায্য করো।
বাবার সাহায্যে ছোটকাকা
লুকিয়ে চলে যান, যাবার
আগে বলে যান যে ' দাদা,
তোমার পরিবারের ওপর আমার আশীর্বাদ সর্বদা থাকবে’”।
(৬)
এই অব্দি পড়ে অপুর্ব
ডায়েরি টা বন্ধ করল, ট্রেন নিজের মত করে ছুটে চলেছে, হাত ঘড়িতে সময় পৌনে বারোটা, অপুর্ব র চোখে ঘুম নেমে আসছে...
কতক্ষন এভাবে কেটেছে কে
জানে,
অপুর্ব দেখল যে সে পাখির মত, না তুলোর মত হালকা, ভারহীন হয়ে উড়ে চলেছে, হীরে, মুক্তোর মত তারারা সব আকাশের গায়ে লেগে আছে, চারিদিক শান্ত, কোনও চিন্তা, রাগ, দুঃখ,
কিছু নেই, একটা হালকা অনুভূতি, পরমানন্দের অনুভব।
এমন সময় আবার সেই
স্নিগ্ধ,নরম, করুণায় আদ্র দৃষ্টি , অবয়বহীন, কিন্তু
প্রখর তার উপস্থিতি, সেই দৃষ্টি এবার অপুর্বর মাথার মধ্যে বলে উঠল, তোমার গন্তব্য এসে গেছে, এবার ট্রেন ছেড়ে নীচে নেমে এসো। সত্যিই একটি ঝুপসি অন্ধকার
স্টেশনে ট্রেনটি দাঁড়িয়ে আছে, অপুর্ব দেখল একমাত্র সে ছাড়া আর সবাই ঘুমোচ্ছে, মন থেকে না চাইলেও অপুর্ব কেমন যেন মোহাবিষ্ট হয়ে ওর
একমাত্র ব্যাগটি নিয়ে স্টেশনে নেমে গেল। যেন ওকে নামাবার জন্যই ট্রেন টি দাঁড়িয়ে
ছিল,
ও নামা মাত্রই একটি চাপা আর্তনাদের মত হুইসেল বাজিয়ে
ট্রেনটি চলতে শুরু করল।
অপুর্বর সম্বিৎ ফিরল
ট্রেন চলে যাবার পর।
পুরো স্টেশন একটি
অপার্থিব নৈঃশব্দ্য আর জমাট অন্ধকারে ঢাকা, চারপাশের
অন্ধকার যেন অপুর্ব কে চেপে ধরল।
প্ল্যাটফর্ম বোধহয় এই একটাই, আর সেটাও
আধাখ্যাঁচড়া, পায়ের নিচে কাঁচা মাটি ,
মাথার ওপর কোনও শেড নেই।
অপুর্বর বুকটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল, এই জনমানব শূন্য স্টেশনে সে নামল কেন! আর ওই দৃষ্টির মালিকই
বা কে?
কেনই বা সে বার বার ওকে এভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে? আর অন্য আর একটি দৃষ্টি, সেই ঘৃণা ভরা চোখ, সেটার মালিকই বা কে? অপুর্ব যুবক, বিজ্ঞানের ছাত্র, ব্যায়াম করা শরীর, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তার মনের সাহস জবাব দিতে শুরু করেছে, আতঙ্ক বুকের মধ্যে দামামা পিটে চলেছে, এখন মনে হচ্ছে গোটা পৃথিবীতে সে একা, বিধবা মায়ের মুখটা বারবার ভেসে উঠছে চোখের সামনে, নাঃ, মানুষ একা বাঁচতে পারে না,এবার তার মাথার মধ্যে একটানা একটি গুমরানো আওয়াজ শুরু হল, যেন শতাব্দী প্রাচীন কোন সুদীর্ঘ টানেলের মধ্যে দিয়ে একটি
ট্রেন ছুটে চলেছে, একটি ক্ষীণ তীক্ষ্ণ শব্দ তাকে অভিসম্পাত করে চলেছে। আতঙ্কে এদিক ওদিক তাকিয়ে
অপুর্ব দেখল
প্রায় একশ মিটার দূরে একমাত্র একটি ল্যাম্প পোস্ট
আর তাতে মিটমিট করে জ্বলছে একটি হলদেটে আলো। আর তার ঠিক নিচে একটি ছায়া মূর্তি
দাঁড়িয়ে,
গোটা শরীরটি সম্ভবতঃ কম্বলে ঢাকা, বেশ অস্বস্তি হলেও অপুর্ব প্রায় দৌড়ে এগিয়ে গেল , গোটা
স্টেশনের একমাত্র প্রানের চিহ্নের অর্থাৎ সেই ছায়াটির দিকে ।
কাছে পৌঁছে দেখল একটি
লোক সমস্ত শরীর ও মাথা কালো কম্বলে ঢেকে অন্যদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, লোকটির সমগ্র উপস্থিতি টাই যেন অস্বস্তিকর, অপুর্ব
হিন্দিতে তাকে স্টেশনের নাম জিজ্ঞেস করতেই লোকটি ঘুরে দাঁড়াল, গোটা শরীর ঢাকা থাকলেও চোখের কাছটা খোলা , কিন্তু, সেই চোখে মনির বদলে আগুনের ভাঁটা জ্বলছে,আর সেখান থেকে ঘৃণা, রাগ যেন উপছে পড়ছে, অপুর্ব আর পারল না, অজ্ঞান হয়ে সেখানেই পড়ে গেল।
(৭)
জ্ঞান ফিরতে সে দেখল যে
একটি সিমেন্টের ধাপের ওপর শুয়ে আছে, ঠান্ডা ঝির ঝিরে হাওয়া শরীরের ওপর দিয়ে মায়ের হাতের মত
স্পর্শ করে চলে যাচ্ছে, আকাশের একটা দিকের অন্ধকার সামান্য ফিকে হয়ে এসেছে, অপুর্বর রাতের কথা মনে পড়ে গেল , ধড়মড়িয়ে উঠে বসতেই সামনের অনির্বচনীয় দৃশ্য মনের সব গ্লানি
মিটিয়ে দিল, সামনে
আদিগন্ত বিস্তৃত জলধারা শান্ত লয়ে বয়ে চলেছে, আর, সেই জলের মধ্যে গোড়ালি অব্দি ডুবিয়ে এক দীর্ঘদেহী গেরুয়া বসন ধারী অপুর্বর
দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছেন, কাঁধ অব্দি কুচকুচে কালো চুল,
বোধহয় সূর্য্য প্রনাম
করছিলেন,
অপুর্বর মন এখন একদম ভাবনা শূন্য, সত্যি , মিথ্যে,
সম্ভব, অসম্ভব সব গুলিয়ে গেছে , অপুর্বর শব্দ পেয়ে সন্ন্যাসী ওর দিকে ফিরলেন, কাছে এসে দাঁড়াতে অপু দেখল, হ্যাঁ , স্পষ্ট দেখল সেই করুণা ময় দৃষ্টি, কিন্তু, এখন তার একটি অবয়ব আছে।
সন্ন্যাসী অপুর সামনে
এসে স্মিত হেসে দাঁড়ালেন।
" আপনি
কে?
আপনিই কি সারা রাস্তায় আমার সঙ্গে ছিলেন? আমার
প্রাণও কি আপনিই বাঁচিয়েছেন? আমি এখন কোথায়? আমি কি স্বপ্ন দেখছি? " অপুর্বর এক নিঃশ্বাসে এত প্রশ্নের উত্তরে আরেকবার হেসে
সন্ন্যাসী ধীরে ধীরে ধাপ বেয়ে উঠতে শুরু করলেন,মাথার মধ্যে যেন সন্ন্যাসী বলে উঠলেন “আজ আমারও পরীক্ষা”
উৎসাহবশে অপুর্ব সন্ন্যাসীর পিছু নিল, অনেকগুলি ধাপ পেরোনোর পর সঙ্কীর্ণ গলিপথ, দুধারে উঁচু উঁচু বাড়ির দেওয়াল দিয়ে ঘেরা, এসব পেরিয়ে ওরা একটি চওড়া রাস্তায় এসে পড়ল, রাস্তার দুধারে কেরোসিনের আলোওয়ালা ল্যাম্পপোস্ট , কিছু আলো জ্বলছে, তেল শেষ হয়ে কিছু নিভে গেছে, যেগুলো জ্বলছে সে রকম একটি আলোর স্তম্ভ একটি বন্ধ দোকানের সামনে
আলো ছড়াচ্ছে, বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে অপুর্ব দেখল হিন্দিতে লেখা দোকানের নাম, আর নীচে লেখা রাস্তার নাম আর তার পাশে জ্বলজ্বল করছে শহরের
নাম " বানারস " অর্থাৎ ' বেনারস'।
(৮)
ইতিমধ্যে সেই সন্ন্যাসী
কখন যেন গায়েব হয়ে গেছেন। ধীরে ধীরে আলো আরও বাড়ছে, হাত ঘড়ি বলছে এখন সকাল পাঁচটা বাজে, রাস্তা দিয়ে লোক চলাচল শুরু হয়েছে, অপুর্বর
পাশ কাটিয়ে কিছু লোক হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল, নিজেদের মধ্যে কোনও একটি বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে তুমুল তর্ক
চলছে,
সব কেমন যেন অদ্ভুত, লোকগুলোর পোশাক, চুলের স্টাইল, খালি পা ,এসব কিছুই ফেলে আসা দিন মনে করায়, এমন দিন, যখন অপুর জন্ম হতে আরো কমসে কম চল্লিশ পঞ্চাশ বছর বাকি আছে, তবে, এটা যদি বেনারস হয় তাহলে অবাক হবার কিছুই নেই, কারন, অপু জানে যে বেনারস পুরাতন সময়েই থমকে দাঁড়িয়ে আছে, তবে কিছুক্ষণ পরেই
উদ্দেশ্য হীন ভাবে এগিয়ে চলা অপুর সামনে পড়ল কিছু লাল পাগড়ীওয়ালা পুলিশ, আর, তাদের নেতৃত্বে একটি লালমুখো সাহেব, ঘোড়ার পিঠে বসে কদমতালে এগিয়ে চলছে,ভ্যাবাচ্যাকা অপু এগিয়ে গেল একটি চায়ের দোকানের দিকে, কিছু মুটে মজুর শ্রেণীর লোকজন গুলতানি করছে আর চা খাচ্ছে, অপু ভয়ে ভয়ে তাদের গিয়ে হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করল,
" ভাইযা, আজ দিন কৌন সা হ্যা?"
"শুক্কর"
,
ছোট্ট জবাব দিয়ে
নিজেদের মধ্যে মত্ত হয়ে গেল ওদের একজন।
" আউর
তারিখ?"
"তেইস
জানওয়ারী,
উনিসসো আটতাল্লিস,আউর কুছ?", বিরক্তির সাথে জবাব ছুঁড়ল একটি ছোকরা।
মাথার ওপর পর পর এত
অবিশ্বাস্য দৃশ্য আর ইনফর্মেশন অপুকে
প্রায় পাগল করে তুলল। সে কোনও রকমে চায়ের দোকানের একটি বেঞ্চে বসে পড়ল থম মেরে।
মিনিট পনেরো লোকগুলোর
আলোচনা শুনে সে বুঝল যে শহরে কোনো সিদ্ধ পুরুষ এসেছেন, যদিও, এদের কথা অনুসারে প্রতি কুম্ভেই একরকম কোনও না কোনও চমৎকারী
বাবা এসেই থাকেন, কিন্তু এই বাবা বাঙ্গালী, ইনি উঠেছেন কাশীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি সুন্দরলাল তেওয়ারির বাড়ীতে, ওনার বারো বছরের একমাত্র ছেলে কোনও এক অজানা রোগে রোগে আজ প্রায় দেড় মাস শয্যাশায়ী। বাঙ্গালী
বাবাজী আসার পর দাবী করেছেন যে তিনি তিন দিনের মধ্যে ছেলেকে সরিয়ে তুলবেন, বাবাজীর
শর্ত হ'ল যদি তিনি সফল হন তাহলে তেওয়ারীজি কে বাঙ্গালী টোলার পাঁড়ে
হাভেলী বা পাঁড়ে হাওলি এলাকায় সকল সুবিধা সম্পন্ন ও সুরক্ষিত একটি বিধবা আশ্রম
তৈরি করে দিতে হবে। তেওয়ারী কাশীর মধ্যে হনুমানজির শ্রেষ্ঠ ভক্ত বলে বিখ্যাত,ওনার বাড়িতেই হনুমানজির বিশাল মন্দির, তেওয়ারী নিজেই পুজো করেন , তিনি সেই হনুমানজির, ' কিরা' করেছেন যে বাবাজির শর্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন হবে, তবে, যদি উনি বিফল হন তাহলে বাবাজী কাশী থেকে গাধার পিঠে চড়ে বিদায় নেবেন।
বাবাজী নিজেকে হনুমানজির
মন্দিরে বন্ধ করে নিয়েছেন, বলেছেন তিনদিন এর আগে যেন দরজা খোলা না হয়।
(৯)
আজ তৃতীয় দিন, কাশীর কিছু প্রতিপত্তিশালী
বৈদ্য আর বিশেষ করে পুরাতন পন্ডিতরা, যাদের রমরমা আশ্রম আর
ধর্মশালা চলছে তারা সবাই আজ চায় এই বাঙ্গালী বাবাজির হার হোক।
আজ সবাই তাই চলেছে সুন্দরলাল তেওয়ারীর হাভেলীর দিকে।
চায়ের দোকানের সামনে
রাস্তায় ভীড় বাড়ছে ধীরে ধীরে, অপুর্ব এখন আর প্রতিবাদ করছে না, নিজেকে ঘটনা পরম্পরার সাথে জুড়ে দিয়েছে, ছেড়ে দিয়েছে । সে পথ চলতি মানুষের সাথে চলতে শুরু করল।
কিছুক্ষণের মধ্যে জনস্রোতের সাথে অপুর্ব ভেসে পৌঁছল হাভেলীর সামনে , সত্যি দর্শনীয়, আরও দর্শনীয় শিব-হনুমান মন্দিরটি, মন্দিরের সামনে বিশাল খোলা জায়গা ,সকাল প্রায় সোয়া ছটা, মন্দিরের চূড়ায় সূর্য্যের সোনালী আলো যেন ঈশ্বরের অভিষেক
করছে।
নদীর স্রোত যেমন কলকল
করতে করতে সাগরে এসে মিলে যায়, এক্কেবারে নীরব , ধীর ,স্থির হয়ে যায়, ঠিক সেই রকম ভাবেই খোলা জায়গাটির বিভিন্ন দিক থেকে সংকীর্ন গলীপথ বেয়ে আসা
কল্লোল মুখর ভীড় প্রাঙ্গনে পড়ে হঠাৎ নিশ্চুপ হয়ে যাচ্ছে। অত ভীড়ের মাঝেও অদ্ভুত
নীরবতা,
লোকজন খুবই মৃদু ভাবে কথা বলছে। বেশ কিছুক্ষণ পর ভীড়ের
গুঞ্জন বাড়ল, অপু
দেখল তেওয়ারীজি এলেন,সাথে
ওনার স্ত্রী, আর দুজন
লোক,
বোধহয় আত্মীয় বা কর্মচারী স্নান করা রক্তাম্বর পরিহিত
তেওয়ারিজি কে খুবই ক্লান্ত লাগছিল। ওদের পিছু পিছু একটি দোলায় করে একটি বাচ্চা
ছেলেকে নিয়ে আসা হল বোঝা গেল সেই রুগী , তেওয়ারীর সাথের দুই জন লোক দর্প ভরে হনুমানজির মন্দিরের
রুপার কারুকার্য করা দরজার ভারী পাল্লা দুটো ধীরে ধীরে খুলে দিল, সকলের উৎসুক চাহনি অনুসরণ করে অপুর্ব দেখল এক দীর্ঘদেহী
গেরুরা ধারী সন্ন্যাসী হাতে লাড্ডু নিয়ে হনুমানজির প্রায় পনের ফুট উঁচু মুর্তির
দিকে কেবলই তাকিয়ে আছেন, আর দুই চোখ দিয়ে জলের ধারা অবিরল বয়ে চলেছে, সবার মধ্যে উশখুশ ভাব, আর কাশীর পন্ডিতদের আচরণে বিজয়ীর ভাষা, তেওয়ারী হুঙ্কার ছাড়ল, " পন্ডিত জি! আজ তিসরা দিন হ্যায়, লেকিন অভি তক মেরা বেটা ঠিক নেহি হুয়া, আপনে কোই দাওয়াই ভি নহী দিয়া! কাশী সে নিকলনে কে লিয়ে তৈয়ার
হো যাইয়ে "
এমন সময় ঘটল সেই ঘটনা, তেওয়ারীর হুঙ্কার বাতাসে মিলিয়ে যাবার আগেই সকলের বিস্মিত
চোখের সামনে পাথরের মূর্তি সজীব হয়ে উঠল, আর , সন্ন্যাসীর হাতে ধরা লাড্ডু নিয়ে মুখে তুলে নিল।
চারিদিকে র কান ফাটানো
উল্লাসের শব্দে সন্ন্যাসী চোখ খুলে জনতার দিকে তাকালেন , আর ! অবাক বিস্ময়ে অপুর্ব দেখল তার মুখ, আর চোখের দৃষ্টি, যেটা সে দেখেছে ট্রেনে আসতে আসতে, সেই ভয়ঙ্কর স্টেশনে, আর, আজ সকালে গঙ্গার ঘাটে আর.... হ্যাঁ , তাদের দেশের বাড়িতে ঝোলানো অস্পষ্ট সাদাকালো ছবিতে।
সন্ন্যাসী ঠিক তার দিকেই হাসিমুখে তাকিয়ে
আছেন ।
সেই ঘোর লাগা অবস্থাতেই
অপুর্ব স্টেশনে পৌঁছল, স্টেশনে ঢোকার পরই ভীত সন্ত্রস্ত লোকজনের আলোচনার মাধ্যমে শুনল যে ,গত রাতের দিল্লীগামী পূর্বা এক্সপ্রেস এলাহাবাদ স্টেশনে
ঢোকার মাইল দশেক আগে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে , লাইন ভাঙ্গা থাকার কারনে কিছু বগী উল্টে গেছে, আর একটি বগির প্রায় সকলেই মারা গেছে, আর ...সেটি হল..."এস সেভেন", অপুর শিরদাঁড়া বেয়ে আতঙ্কের শিহরন খেলে গেল, চারিদিকে তাকিয়ে সে বুঝল যে তেইশে জানুয়ারী উনিশশো আটচল্লিশ
থেকে সে সিধে দুহাজারএক এর তেইশে জানুয়ারীতে এসে পৌঁছেছে। এখন সে আর কিছুতেই অবাক
হচ্ছে না। স্টেশনের প্ল্যাটফরমে টাঙানো টিভিতে বলছে , যে আজ থেকে ঠিক আটচল্লিশ বছর আগে, এই একই দিনে, কুম্ভ মেলা চলার সময় প্রায় এই ভাবেই ঘটেছিল দুর্ঘটনা, যাতে অনেক যাত্রী হতাহত হয়েছিলেন। দুর্ঘটনা স্থল থেকে ছবি
আসছে,
আর, আসছে হতাহতদের নাম, এমনই অনেক নামের সাথে একটি নাম আসছে, অপুর্ব চক্রবর্তী, কলকাতা।
অপুর মনে পড়ল মায়ের কথা, এই ধরনের খবর আগুনের মত ছড়ায়, মা, মা এই খবর শোনেনি তো? যদি শোনে? তাহলে
মা কে আর বাঁচানো যাবেনা, অপু দৌড়ে স্টেশনের বাইরের
(১০)
একমাত্র এস টি ডি ডি
বুথটার কাছে পৌঁছল, লম্বা লাইন, সবাই
উৎকণ্ঠিত,
ভীড় সামলাতে রেল পুলিশের সাথে সাধারণ পুলিশও কাজে লেগেছে, কোনও
ক্রমে প্রায় মিনিট পঁয়তাল্লিশ পর তার নম্বর এল, বুথের মালিক জানিয়ে দিলেন, " ব্যস দো মিনট, জ্যাদা নহী",
সেই দুই মিনিটই এখন ওর
কাছে মহার্ঘ্য,
রিং হবার পর ওপাশে
বোধহয় প্রতিবেশী মহিলার কন্ঠ শোনা গেল, অপু বলল" মনি মাসি? আমি অপুর্ব বলছি!"
"কে!অপু?"
বোধহয় মা কাছেই ছিলেন ,ফোনটা ছিনিয়ে ভাঙা অবরুদ্ধ কণ্ঠে চিৎকার করে বললেন।
"অপু!
একি সত্যিই তুই বাবা? " বলে ফোনেই অঝোরে কেঁদে ফেললেন।
অপুর্ব কোনও ক্রমে মা কে
বলল,
মা, আমি বেঁচে আছি, সুস্থ আছি, তবে
কিভাবে বেঁচেছি সেটা এখন বলতে পারছি না, কারন আমি নিজেই জানিনা, তবে, বাড়ি ফিরে সব বলছি তোমায়।"
সময় হয়ে গিয়েছিল, ফোনটা ছাড়তে হল।
এরপরের ঘটনা খুবই
সামান্য , কোনও ক্রমে ধুম জ্বর গায়ে অপুর্ব ফেরার ট্রেন ধরে। সারা
রাস্তায় ভাবতে ভাবতে কিছুটা পরিষ্কার হয় ঘটনা টা, সন্ন্যাসী দাদুর কুম্ভ মেলায় যাওয়া, সেই
অজানা স্টেশনে ও ট্রেনের মধ্যে সেই জিঘাংসা ভরা দৃষ্টির মালিক, সে কে? সে কি নিয়তি? যে অপুকে টেনে নিতে এসেছিল মৃত্যুর গহ্বরে? রেগে গিয়েছিল শিকার হাতছাড়া হওয়াতে? আর সেই স্নিগ্ধ দৃষ্টি, সে তো দাদুরই,এবার সব পরিষ্কার হচ্ছে, বাবার থিওরি অনুসারে সময়ের বাঁক নেওয়া ও একে অপরের সাথে
মিলে যাওয়া,স্থান, কাল, পাত্রের মাহাত্ম্য, স...ব। আচ্ছা, তাহলে কি সেবার সেই দুর্ঘটনায় সন্ন্যাসী দাদুও ...? নাহ, তা কি করে সম্ভব ? তা হলে কাশীতে তেওয়ারীর বাড়িতে দেখা ঘটনা , সেটা কোন সময়ের? না কি সন্ন্যাসী দাদু কে আগেই কেউ ট্রেন থেকে নামিয়ে
দিয়েছিল? যেমন ভাবে উনি অপুর্ব কে ট্রেন থেকে নামিয়ে বাঁচিয়ে
ছিলেন ?
বাড়িতে ফিরে সন্ন্যাসী
দাদুর ছবির সামনে দাঁড়ায় অপুর্ব , উনি যেন বলছেন "আমি আছি দাদা, তোমার পরিবারের সাথে, সব সময়, সব কালে, কারন , আমি... " কাল যাত্রী"।
সমাপ্ত
| Aleekpatamagazine.blogspot.com |
|ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Special Monsoon Issue,2020 | July-September 2020 |রিমঝিম সংখ্যা।
| Third Year Sixth Issue |23 rd Edition|