বিশেষ
বাংলার প্রাচীনতম দুর্গা পূজা –
বিষ্ণুপুর মল্ল রাজবাড়ীর পুজো
পৃথ্বীশ
সেন
দুর্গাপুজো।
শুনলেই আনন্দ। বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব। শারদোৎসব।
উৎসবের সাজে
সেজে উঠে বাংলার আকাশ বাতাস। নীলাকাশে পেঁজা তুলোর মত মেঘের ভেসে থাকা। কাশফুল
চারিদিকে। রোদের তীব্রতা নেই সেরকম।
সবে মিলে
পুজো পুজো গন্ধ। এই গন্ধ পায়নি এমন বাঙালী বোধহয় নেই।
এক বছরের
পুজো গেলেই পরের বছরের জন্য ক্যালেন্ডার দেখে রাখা। আবার কবে আসছে এই উৎসব।
তবে আজকের
এই দুর্গাপূজায় অন্য একটা প্রশ্ন করছি
বঙ্গের
সবচেয়ে পুরোন পুজো কোনটি?
সবার আঙ্গুল
ঘুরে যাবে কলকাতার দিকে।
কেউ বলবে
বাগবাজার। কেউ বলবে শোভা বাজার রাজবাড়ী। কেউ সুরুচি সংঘ তো কেউ বলবে দেশপ্রিয়
পার্ক।
যাইহোক,
কলকাতার দুর্গাপুজো কিন্তু ৫০০ বছরে পৌঁছয়নি।
উত্তর হচ্ছে
বিষ্ণুপুর রাজবাড়ীর পুজো।
হ্যাঁ,
বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের কুলদেবী মৃন্ময়ী দূর্গাদেবীর পুজো হচ্ছে
বাংলার প্রাচীনতম পুজো।
কত বছরের পুরনো?
প্রায় ১২০০
বছরের পুরনো এই পুজো।
পুরনো কথা:
মল্লরাজা
জগৎ মল্ল ৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে তার রাজধানী এই বিষ্ণুপুরে স্থানান্তরিত করেন।
সেই
উদ্দেশ্য এক শুভক্ষণে নতুন রাজবাড়ীর ভিত্তি স্থাপন করা হয়। মাটি খোঁড়া শুরু হলে
পরে বেরিয়ে আসে এক দেবীমাতার মুখ। সেদিন রাতে রাজা স্বপ্নে দেখেন দেবীকে। এরপর বানানো হয় গঙ্গামাটি
দিয়ে দেবীর অবয়ব। এরপর নিত্য পুজো হতে থাকে দেবীর।প্রাসাদ বানানো শেষ হলে বানানো হয়
দুর্গাদালান। সেখানে প্রতিষ্ঠিত হন দেবী।
দেবী
মহিষাসুর মর্দিনী। তিনি সিংহের উপর দাঁড়িয়ে বধ করছেন মহিষাসুর। তবে এই মূর্তি কিন্তু বেশ আলাদা। দেবীর উপরদিকে রয়েছেন মহাদেব
সাথে নন্দী ভৃঙ্গি। তার নিচে দশ মহাবিদ্যার দশ দেবী।তার নিচে বামদিকে উপরে
কার্তিক, নিচে সরস্বতী ডানদিকে উপরে গণেশ নীচে লক্ষী।
দুর্গাপুজোর
সময় পট পুজো করা হয়। তিন রকমের পট রয়েছে। তিনটি পট নানাবিধ ধাতু দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। তাতে তিনজন দেবীর ছবি রয়েছে। বড়, মেজ এবং ছোট ঠাকরুন।
বড় ঠাকরুনের
পরনে রয়েছে লাল-হলুদ-সাদা শাড়ি। মেজ ঠাকরুনের শাড়ি লাল। এবং ছোট ঠাকরুনের কমলা শাড়ি।
এই পট অঙ্কন
করতেন ফৌজদার পরিবার।একবার এই পট অঙ্কনের সময় ফৌজদার পরিবার ঠিকমতো নিয়ম না পালন
করায় পরিবারের একজনের অকস্মাৎ মৃত্যু ঘটে। তারপর থেকে আর এই পট কেউ অঙ্কনের সাহস
পাননি। আপাতত এই পটগুলো শালু দিয়ে মুড়ে পুজো করা হয়।
এই মৃন্ময়ী
দেবীর মূর্তির কোন অদলবদল হয়নি। যদি রাজপরিবারের কেউ পান স্বপ্নাদেশ তবেই প্রতি পনের থেকে
কুড়ি বছরের মধ্যে একবার রঙ করা হয়। ।
শৈব
মতানুযায়ী একই নিয়ম মেনে পুজো করে আসছিলেন মল্ল রাজারা বংশানুক্রমে।
সময়ের চাকা
ঘুরে চলল। কেটে গেল ৬০০ বছর। সময় এল বীর হাম্বিরের।
তিনি হচ্ছেন
৪৯ তম বংশধর। মল্ল রাজবংশের। বংশের নামানুসারে তাদের জনপদের নাম ছিল মল্লভূম। অধুনা বিষ্ণুপুর ছিল রাজধানী। তার পূর্বসূরি মল্ল রাজারা
গৌড়ের পাঠানদের সাথে একরকম সমঝোতা করে চলতেন। রাজস্ব দিতেন। কিন্তু সম্পূর্ণ স্বাধীন
থাকতেন। মল্ল রাজ্যে কোনরকম মুসলিম হস্তক্ষেপ তারা বরদাস্ত করতেন না।
শক্তিশালী
রাজ্য মল্লরাজ্য। এড়িয়ে চলত পাঠানরা। কারনটা ছিল এদিকের জঙ্গল এবং রুক্ষ ভূমি এবং অরণ্যের দুর্ধর্ষ
অধিবাসী। যবনদের একদম পছন্দ করত না তারা। মুখোমুখি হলে প্রাণ যেত। তাই সব মিলিয়ে পাঠানরা কিছু
রাজস্ব নিয়ে খুশি থাকত।
বীর
হাম্বির:
◆◆◆◆◆◆◆◆
মল্ল
রাজাদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। তার সময়ে সভ্যতা সংস্কৃতি কৃষ্টির
সাথে অর্থনৈতিক সামাজিক উন্নতি হয় সারাটা বিষ্ণুপুরের।
১৫৮৬ সালে
সিংহাসনে বসেন বীর হাম্বির। তিনি দুর্গ এবং সেনাবাহিনী বিশেষভাবে সংস্কার করেন। অরণ্যের অধিবাসীদের যুদ্ধরীতি
অনুসরণ করে নিজের বাহিনীকে করে তোলেন শক্তিশালী। জঙ্গলের বাগদি সমাজকেও আধুনিক
যুদ্ধের সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করান। এমনিতেই তার সময়ে রাজ্যের অর্থ ব্যবস্থা উন্নতি লাভ করেছিল।
প্রজারা সবাই ভালোই ছিল তার রাজ্যে।
বিষ্ণুপুরের
বিখ্যাত রাসমঞ্চ তারই তৈরি।
মুন্ডমালার
যুদ্ধ:
◆◆◆◆◆◆◆◆
বীর হাম্বির
তখন মন্দিরে। কুলদেবীর উপাসনায় ব্যস্ত। এই সময়ে তিনি সম্পূর্ণ একলা থাকেন। কোনরকম গোলযোগ তিনি পছন্দ করেন না।
কিন্তু
খবরটা এল তখনই...
Painting Courtesy : Internet By : Zai
উড়িষ্যা এবং
গৌড়ের দখলদার নেতা সুলেমান কার্নানি সমঝোতা করেই চলছিল মল্লরাজ্যের সাথে। কিন্তু তার ছেলে দাউদ খাঁ
কার্নানি'র ইচ্ছে ছিল দখল করবে পুরো দক্ষিণবঙ্গ। দক্ষিণবঙ্গর দখল পেতে গেলে দখল করতে
হবে মল্লরাজ্য।যেমন ভাবনা তেমন কাজ।
লক্ষাধিক
সেনা নিয়ে হুট করে হাজির হল দাউদ খাঁ রানীসাগর নামক জায়গায়। উপদ্রব শুরু করল সেখানে
জনগণের ওপর। কিছুক্ষনের মধ্যেই পাঠান বাহিনীর উপদ্রব চরম আকার নিল। উদ্দেশ্য বিভীষিকার মাধ্যমে
প্রজা সাধারণদের ভয় দেখিয়ে দুর্বল করে ফেলা। আত্মসমর্পণ করতে রাজাকে বাধ্য করা। সেই উদ্দেশ্যে শুরু হয়ে গেল
জোর করে ধর্ম পরিবর্তন। মন্দির নোংরা করা। গৃহিদের ঘরের গরু ছাগল ধান লুট। অর্থ
সম্পদ লুট। মহিলাদের সম্ভ্রম হানি চরম আকার নিল। প্রতিবাদ করছে যেই, টুঁ শব্দটি
করছে তাকে নির্বিচারে হত্যা করছে। মোটকথা রানিসাগরের অবস্থা খুবই খারাপ।
আগেই বলেছি
এই খবর এল যখন প্রাসাদে তখন বীর হাম্বির ব্যাস্ত কুলদেবীর উপাসনায়। মৃন্ময়ী দেবী। পরম শৈব বীর হাম্বির তখন একটি
মহিষ বলি চড়িয়েছেন সবে। সারা শরীরে রক্তের ছিটে। মন্দির ভেসে যাচ্ছে রক্তে। হাতে তখনও রক্তমাখা খড়্গ ধরা
রয়েছে। এই অবস্থায় শুনলেন সব। এরপর বীর হাম্বির সেই রক্তের টিকা মাথায় নিয়ে শপথ করলেন
দেবীর সামনে, যুদ্ধ জিতে এসে নিবেদন করবেন মায়ের পায়ে নরমুন্ড মালা।
পুজো শেষ
করে বীর হাম্বির সমস্ত সেনাদের জমায়েত করলেন। খবর পাঠানো হল জঙ্গলেরঅধিবাসীদের।
যোগ দিল তারাও। বেশিরভাগ বাগদি সম্প্রদায়। সকলে শপথ নিল মৃন্ময়ী দেবীর...
শত্রুর মাথা তাদের চাইই চাই।
তখন
বিষ্ণুপুরের ছিল বারটি দরজা। এক একটি দরজার কাছে এক একটি দুর্গ। এরম একটি দূর্গ ছিল মুন্ডমালা দূর্গ। যুদ্ধ শুরু হল সেই মুন্ডমালা
দূর্গের কাছেই। ভয়ানক সেই যুদ্ধে শোচনীয় হার হয় পাঠানদের।লাশের পাহাড় জমে যায় পূর্ব দরজায়।
যুদ্ধ শেষে
বন্দি হয় দাউদ খাঁ। হত অন্যান্য সেনাপ্রধানদের মাথা কেটে নিলেন বীর হাম্বির। তারপর সেই মাথাগুলো
দিয়ে বানানো হয় একটি মালা। নিবেদন করেন দেবীকে।কথিত রয়েছে সেই মুন্ডমালাতে মুন্ড সংখ্যা ছিল
১০৮।
যেখান থেকে
এই মাথা সংগ্রহ করেছিলেন হাম্বির সেখানে জমে যায় মুন্ডহীন পাঠানদের শরীর। কারন সৈন্যরা প্রত্যেকেই
কেটেছিলেন কম করে একটি মাথা। মুন্ড সংগ্রহ করা হয়েছিল তাই সেই দুর্গের নাম পরবর্তীতে
হয়ে যায় মুন্ডমালা ঘাট বা দুর্গ।
বিপত্তারিণী:
●●●●●●●●●●
বিপদ তারণ
করে দেন এইদেবী। তাই আরেক নাম বিপত্তারিণী । জনশ্রুতি রয়েছে বঙ্গের বিপত্তারিণী পুজোর
দিনটি আসলে সেই দিনটি যেদিন রাজা হাম্বির দেবীর আশীর্বাদে শত্রু পরাজিত করে দেবী
চরণে সমর্পণ করেছিলেন মুন্ডমালা।
শৈব পুজো
থেকে বৈষ্ণব পুজো:
◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆
তবে এই
ঘটনার বেশ কিছুদিন পর এক বৈষ্ণব গুরুর কথায় বীর হাম্বির শাক্ত থেকে হন বৈষ্ণব। তখন থেকে মৃন্ময়ী মাতার পুজো
হতে থাকে বৈষ্ণব মতে। তারপর থেকে মন্দিরে বলি হয়না। শোনা যায় মায়ের সেই রনচন্ডী মুখ বদলে বর্তমান এই শান্ত রূপের
প্রতিষ্ঠা হয় সেই বৈষ্ণব গুরুর সহায়তায়। তবে কোন এক গোপন জায়গায় পুজো হয় সেই আসল রনচন্ডী মূর্তির।
পুজো
বৈশিষ্ট্য:
●●●●●●●●●●
এই
দুর্গাপুজো চলে উনিশ দিন ধরে। আট দিন থাকে শুক্লপক্ষ। এগার দিন কৃষ্ণপক্ষে। এই পুজো এখনও মল্ল
রাজপরিবারের পুজো। প্রতি বছর একই নিয়মনিষ্ঠার সাথে পুজো করা হতে থাকে। যা এখনও চলছে। এই পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে। অষ্টমীর দিন কামান দাগা। এবং দশমী থেকে দ্বাদশীর
রাবনকাটার নাচ।
দশমীর দিন
রঘুনাথ জিউ মন্দিরে হয় শ্রীরাম-সীতা-লক্ষণের পুজো। এরপরে বেরোয় শ্রীরামের বাহিনী। পথে নামে মুখোশ পরা হনুমান
জাম্বুবান সুগ্রীব এবং অন্যান্য বানরসেনা। এই দলকে বলা হয় রাবনকাটার দল। এই দল
রাস্তায় বেরোয় নাচতে নাচতে। ছোট বাচ্চাদের মায়েরা রাস্তার দুপাশে ভীড় জমান। নিজের
বাচ্চাদের এদের কোলে তুলে দেন। এরা একটু নাচিয়ে ফেরত দেয় সেই বাচ্চাকে। মায়েদের বিস্বাস এর ফলে এই
বাচ্চারা হবে নীরোগ এবং শক্তিশালী।
এই উৎসব চলে
দুদিন। দশমীর দিন হয় কুম্ভকর্ণ বধ। একাদশীর দিন হয় মেঘনাদ বধ। দ্বাদশীর দিনে হয় রাবন বধ। রাবন বধের সাথে সাথে হয় ১৯
দিন ধরে চলা এই উৎসবের সমাপ্তি। আবার অপেক্ষা একটি বছরের।
উল্লেখ্য:
এই পুজো
দেখতে এসেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ।
তিনি
মৃন্ময়ী দেবীর মধ্যে জগৎজননীকে দেখতে পেয়েছিলেন।
| শারদ সংখ্যা-১৪২৯ | aleekpata.com | 30th Edition |
| ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Durga Puja , 2022 | July-Oct 2022 | Fifth Year Fourth Issue |
| © All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |
| a DISHA-The Dreamer Initiative |