আরশোলাটা
শ্রাবণী গুপ্ত সরকার
|
Collage : Swarup Chakraborty |
সমস্যাটা অনেক দিনেরই। রম্যাণি যবে
থেকে নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছে সেই তবে থেকেই। আসলে পুঁচকে রম্যাণি ওরফে টুয়াকে
প্রথমে মায়ের স্কুলেই ভর্তি করানো হয়েছিল। মা ঐ স্কুলে ফাইভ থেকে টেন পর্যন্ত
গার্লস স্কুলের দিদিমণি। একদিন সন্ধ্যাবেলা মা-বাবা টুয়াকে নিয়ে বসে নানারকম
প্রশ্ন করতে করতে লাগলেন। কখনও নাম, বাবার নাম, বাড়ির ঠিকানা, তারপর কয়েকটা ছড়া বলতে বললেন। অতিষ্ঠ হয়ে টুয়া জানতে চাইল, “এসব কি হচ্ছে? আমি তো এগুলো জানিই”। মা বললেন,”বাঃ এবার তো বড় হচ্ছ, স্কুলে ভর্তি হতে হবে না?” পরের দিন শীতের
ভোরে টেনে তুলে তৈরি করিয়ে মা নিয়ে গেলেন তাঁদের স্কুলের নার্সারীতে। সেই স্কুলে
নাম,
বাড়ির ঠিকানা, কয়েকটা ছবি দেখিয়ে সেগুলো কি জিজ্ঞাসা করা, তারপর একটা ছড়া বলতে বলা হলো, শেষে একটা ট্রে ভর্তি চকোলেট সামনে ধরার পর টুয়া একটা
তুলতেই সামনে বসা বড়দিদিমণি বললেন, “আরেকটা নাও”। মায়ের দিকে তাকিয়ে আরেকটা চকলেট নিয়ে, মহানন্দে স্কুলে ভর্তি হয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরেছিল
টুয়া।
তারপর বাবার সাথে গিয়ে স্কুলড্রেস, বইপত্র, সুটকেশ সব কেনা বিরাট মজা। আর সেইসঙ্গে একটা চমৎকার রঙচঙে
জলের বোতল। নাঃ টিফিন বক্স লাগতো না, স্কুল থেকেই সুন্দর টিফিন দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল তো। কোনোদিন
বিস্কুট আর মিষ্টি, কোনোদিন আলুসেদ্ধ আর ডিমসেদ্ধ অবশ্যই নুন গোলমরিচ ছড়িয়ে, কোনোদিন জিভে জল আনা আলুকাবলি, মাসে এক দিন মাংস আর পাঁউরুটি। কি মজার ছোট্ট ছোট্ট আলাদা
ডেস্ক আর চেয়ার প্রত্যেকের। হ্যাঁ, অসুবিধা একটাই ছিল, টিফিনের আগে চোখ বুঁজে আরেকবার প্রার্থনা করা—টুয়ার খালি
মনে হতো ওর খাবারটা বুঝি কেউ খেয়ে নিলো, আসলে সব ঠিকঠাকই থাকতো।
দুষ্টুমি তো করতোই কিন্তু বকা খাবে
বুঝলেই পাঁই পাঁই করে ছুটে ঢুকে পড়তো মায়েদের বসার ঘরটায়। কি যেন নাম,ওই বসার ঘরটার? ও হ্যাঁ-স্টাফরুম। ওর পিছনে ছুটতেন নার্সারীর বেচারী
দিদিমণিরা। ভুলিয়ে ভালিয়ে আবার নিয়ে যেতেন ক্লাসে।
ক্লাস ওয়ানে গিয়ে চমৎকার লাল-সাদা
ইউনিফর্মের বদলে হলো গাঢ় নীল স্কার্ট আর সাদা জামা। দিদিমণিদের সঙ্গে বেশ কজন রাগী
মাষ্টারমশাই। দিদিমণিদের ভালো লাগলেও, বেশীর ভাগ মাষ্টারমশাইরা এমন বকা দিতেন, মোটেও পছন্দ হতো না ব্যাপারটা। তবে হ্যাঁ, মা তো ঐ স্কুলেই পড়ান বড়োদেরকে, কাজেই টুয়া এখন দুষ্টুমিগুলো কম করতো। বারে! বড়ো হচ্ছে তো
না কি?
এক আধদিন নামতা ভুলভাল হলেও শাস্তি টাস্তি পেতোই না। বেশ
সুখেই কাটছিল ওর দিনগুলো। ও হ্যাঁ এখন অবশ্য বাড়ি থেকেই টিফিন নিয়ে যায়, একটা খুব মিষ্টি মতোন টিফিন বক্স করে।
ক্লাস ফোরের অ্যানুয়াল পর অন্যান্য
বছরের মতো বেড়ানো হলো না – বড়ো স্কুলে ভর্তির পরীক্ষা আছে না! তাই চিড়িয়াখানা
যাওয়া,
মিউজিয়াম বেড়ানো, মামার বাড়িতে গিয়ে থাকা সব বন্ধ। এখানকার অন্য একটা নামকরা
স্কুলে ভর্তি করে দেবেন মা আর বাবা। মায়ের স্কুলে এখন নাকি আর পড়াটা ঠিক নয়। কেনরে
বাবা,
মা পড়াবে বলে? সে তো বাড়িতেও পড়ায়। বড়োদের যত সব প্যাঁচালো চিন্তা!
যাই হোক নতুন স্কুলে ভর্তি হলো
রম্যাণি। এবার আকাশী সাদা ইউনিফর্ম। আর সুটকেশ না, এবার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ , সঙ্গে নতুন বই, টিফিন বাক্স, পেন, পেন্সিল বক্স আর জলের বোতল। নাঃ, পুরোনো স্কুলের একজনও নেই। নেই তো নেই। প্রথম দিনেই বেশ
বন্ধুত্ব হয়ে গেল অনেকের সঙ্গে। নতুন ক্লাসে প্রথম দিনে মায়ের সঙ্গে স্কুল এসেছিল
টুয়া। নাচের স্কুলের পিয়ার মা এই স্কুলের দিদিমণি। তিনি এসে মায়ের সাথে কথা বলে, টুয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলেন। আর একজন দিদিমণি
রোগা মত রাগী রাগী চোখে পাশ দিয়ে যেতে গিয়েই মাকে দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন ও
জিজ্ঞাসা করলেন, “আরে
দিদি,
আপনি এখানে? মেয়ে কি এই স্কুলে ফাইভে ভর্তি হলো? খুব ভালো, আমি দেখে রাখলাম, খেয়াল রাখবো”। প্রণাম করে চলে যেতেই মায়ের আঁচল ধরে টানলো
টুয়া। মা বললেন, “ আমাদের
স্কুলের খুব ভালো মেয়ে গীতিকা। ও এই স্কুলে জীবন বিজ্ঞান পড়ায়। টুয়া মাকে জিজ্ঞাসা
করল,
“ বিজ্ঞান তো বিজ্ঞান--- জীবন
বিজ্ঞানটা কি?” মা
বললেন,
“ পড়ো, সব জানতে পারবে”।
এ পর্যন্ত সবই ঠিক। ইতিহাসের
দিদিমণিকে তো টুয়ার দারুণ পছন্দ। ভূগোল পড়ান পিয়ার মা মিলিদি। বেশ ভালো লাগে। অঙ্ক
করান ঈশানীদি আর বিজ্ঞান শ্বেতাদি। বাংলা পড়ান প্রভাতীদি আর ইংরাজী শ্যামলীদি।
স্কুলের সবাই খুব সম্মান করে বড়দি মায়াদিকে আর মেজদি(অ্যাসিন্টান্ট হেডমিস্ট্রেস)
খুশিদিকে। আর সারা স্কুল ভয় পায় অঙ্কের মিত্রাদির চোখ পাকিয়ে তাকানো আর গীতিকাদির
রাগকে। টুয়া শিঁটিয়ে থাকে থাকে এই বুঝি গীতিকার ক্লাস পড়লো আর ওর মায়ের কাছে নালিশ
গেল।
ফাইভ, সিক্স পেরিয়ে ক্লাস সেভেনে পালে বাঘ পড়লো। একই সঙ্গে
মিত্রাদির অঙ্ক আর গীতিকাদির জীবন বিজ্ঞান। টুয়া অঙ্কে কাঁচা, তবে মিত্রাদি খুবই ভালো অঙ্ক করান তাই ভয় পেলেও অসুবিধা হয়
না খুব একটা। আর গীতিকাদিও চমৎকার পড়ান কিন্তু তার চেয়েও ভালো বকেন। ওনার ভয়ে টুয়া
খুব যত্ন করে আঁকাগুলো তৈরী করে খাতায়।
একদিন গীতিকাদি আরশোলা পড়াতে গিয়ে ম্যান্ডেবল, ম্যাক্সিলা দেখানোর জন্য বলে দিলেন পরের দিন আরশোলা নিয়ে
আসতে। এটা তো টুয়ার কাছে খুবই সোজা কাজ। পোকামাকড়ে ওর কস্মিনকালেও ভয় নেই। খপাখপ ডেঁয়ো পিঁপড়ে, ফড়িং, উচ্চিংড়ে ধরে, আরশোলাও—এমন কি কায়দা করে শুঁয়োপোকাও ধরতে পারে। কাজেই একটা
আরশোলা ধরে ঠাকুরমার জর্দার কৌটায় ভরে নিয়ে চললো স্কুলে।
ক্লাসে এসেই গীতিকাদি বললেন, “কই, আরশোলা কই?” টুয়া
সটান গিয়ে কৌটা খুলে টেবিলে ছেড়ে দিল। আরশোলাটাকে। এবার একটা কান্ড হল। চলমান
আরশোলা দেখেই গীতিকাদি চেয়ার টেয়ার উলটে
দাঁড়িয়ে গেলেন দেওয়াল ঘেঁষে। “এটা তো জ্যান্ত”। “হ্যাঁ দিদি, হাওয়াই চটি দিয়ে মারলে তো ম্যান্ডেবল, ম্যাক্সিলা চেপ্টে যাবে। আর অন্য কি ভাবে মারবো জানি না
তো”। “ওঃ!ওটাকে ধরলে কেমন করে?” এবার রম্যাণি খপ করে মুঠিতে ধরে বললো, “এই তো, এই রকম করে”।রীতিমত আঁতকে উঠলেন দিদিমণি। “যাও, ওটাকে ফেলে হাত ধুয়ে এসো”। লক্ষী মেয়ের মতো কৌটো বন্দী করে
আরশোলাটাকে মাঠ অবধি নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিল টুয়া। তারপর হাত ধুয়ে ক্লাসে। গীতিকাদি
বললেন,
“খুব সাহস তো তোমার”। এরপর থেকে
গীতিকাদির রাগটা একটু কমল। কথায় কথায় বকেন না কাউকে। আর টুয়াও বাঁচলো। ভাগ্যিস
সেদিন আরশোলাটাকে এনেছিল স্কুলে!
ঢং করে টিফিন শেষের ঘন্টাটা পড়তেই ছোটবেলার
সুমধুর জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এলেন রম্যাণি সেন—হ্যাঁ, সেই বিচ্ছু ছোট্ট মেয়েটা এখন তো নিজেই দিদিমণি। তবে স্কুলের
শিক্ষাটা সে মনে রেখেছে। সব সময় হাসি মুখে থাকার অভ্যাসটা করে নিয়েছে। নিজের মেজাজ
খারাপ রেখে জীবনকে উপেক্ষা করার মানসিকতা তার একদমই তৈরী হয় নি। ছোটবেলাটাকে
সযত্নে ধরে রেখেছে বুকের মধ্যে। কাজেই এই দ্বিতীয় বিদ্যালয় জীবন রম্যাণি চুটিয়ে
উপভোগ করে চলেছে।
| Aleekpatamagazine.blogspot.in |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
|ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |
|Special Puja Issue,2019 | September-October, 2019 |
| Third Year Third Issue |20Th Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |