অলীক পাতার অন্যান্য সংখ্যা- পড়তে হলে ক্লিক করুন Library ট্যাব টি
Monday, November 2, 2020
চালচিত্র পর্ব- ছবি-অবসর-পূর্বালী দত্ত
Story-An Interesting neighbor I have had-Debrupa Chakraborty
An Interesting neighbor I have had
Debrupa Chakraborty
(Class IX-DPS, Haridwar)
I never found out whether
our landlady wanted us to accompany her like our cat did. Because if she did we
would never have had enough space on the broom, or did she made some other
arrangements. Well my father got us out of there on the first priority.
I sometimes wonder is our
landlady still flying or making those special sweets of her to get her tenants
fly around with her.
Wednesday, October 21, 2020
অধিবাস পর্ব- গল্প- বুদবুদ -বনবীথি পাত্র
বুদবুদ
বনবীথি পাত্র
-যতই হোক দাদারও তো
মা। একবার বলেই দেখো না! মনে হয় এই বিপদের সময়েও মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারবেন না।
ছোট থেকেই প্রভাত শুনে
আসছে দাদার লেখাপড়ায় মাথা আছে আর ওর নাকি মাথা মোটা। পড়াশুনো হবে না ওর দ্বারা।
ছোটবেলাতে খুব হিংসা হত, যখন
অঙ্কে ছাব্বিশ পাওয়ার জন্য ও বাবার কাছে মার খেত আর ক্লাসে ফার্স্ট হওয়ার জন্য
দাদার ভাগে জুটত অনেক আদর । নিজেকে মা বাবার খারাপ ছেলে ভেবে অন্ধকারে কত কাঁদত
কিন্তু পড়াশুনোটা কিছুতেই মাথাতে ঢুকত না। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝেছে পড়াশুনোটা সত্যি ওর জন্য নয় ।
কোনরকমে উচ্চমাধ্যমিকের গেরোটা পার হয়ে মা সরস্বতীকে প্রণাম জানিয়ে কাজের ধান্দায়
লেগে পড়েছিল। দাদা স্কলারশিপের টাকাতে তখন ব্যাঙ্গালোরে আইটি পড়ছে । বাবা চলে
যাওয়াতে সংসারে তখন পয়সার বড় দরকার ছিল। তবু দাঁতে দাঁত চেপে মা আর প্রভাত লড়াই
করেছিল অভাবের সঙ্গে। মনে একটাই আশা ছিল, দাদা ভালো চাকরী
পেয়ে গেলে তাদের আর কোন কষ্ট থাকবে না। কিন্তু তারপরের ঘটনা ঠিক সিনেমাতে যেমন হয়।
দাদা তার প্রফেসারের আদুরে মেয়েকে বিয়ে করে ব্যাঙ্গালোরেই থেকে গেল। একবার বৌকে
নিয়ে এসেছিল মায়ের কাছে , কিন্তু এই ডার্টি প্লেসে একরাত ও
কাটাতে পারেনি নবাবনন্দিনী। সেই রাতেই বৌকে নিয়ে হোটেলে চলে যেতে হয়েছিল মায়ের
আদরের বড় ছেলেকে। তারপর কেটে গেছে প্রায় পনেরটা বছর, একদিন
ফোন করেও খোঁজ নেয় না মা কেমন আছে। শুধু বিজয়ার পর পাড়ায় এক বড়লোক বন্ধুর বাড়িতে
ফোন করে মাকে ডেকে দিতে বলে। মা গেলে একটা প্রণাম অবশ্য জানায় , তবে জানতেও চায়না কেমন আছে। প্রভাত মোবাইল কেনার পর অবশ্য আর বন্ধুর
বাড়িতে ফোনটা করে না। প্রভাতের মোবাইলেই ফোন করে।
ছেলেটা নতুন ক্লাসে
উঠেছে বই কিনতে হবে । হাজার অভাবেও পাঁচশ টাকা বাঁচিয়ে রেখেছিল মাধবী। সেই বাঁচানো
টাকাটুকু স্বামীর হাতে তুলে দেয় আপাতত কিছু ওষুধ যদি কেনা যায় ! অভিমানী সুরেই বলে,
-তুমি যতই বারণ করো,
আমি আজ দাদাকে ফোন করব। মাকে বাঁচাতে না হয় দাদার কাছে ভিক্ষা চাইব।
দাদার নম্বরটা আমাকে দিয়ে যাও, আমি টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করব
আজ। আমার মন বলছে দাদা নিশ্চয় সাহায্য করবেন ম। দাদার সঙ্গে কথা বলে আমি তোমাকে
জানাবো। তুমি মায়ের অপারেশনের ব্যবস্থা কর।
-মাধবী মা আর নেই...
অধিবাস পর্ব- গল্প- ভাগাড় -উত্তম কুমার পুরকাইত
ভাগাড়
উত্তম
কুমার পুরকাইত
জমিতে সার দিয়ে পুকুর পাড়ে এসে দাঁড়ায় সুহাস। ঝুলে থাকা তালগাছটার উপর পা
রাখে। হাত-পা ধোয়। মুখে জল দিয়ে কোমর থেকে গামছাটা খোলে। মোছে। পাকা রাস্তার ধার
থেকে পচা দুর্গন্ধ ভেসে আসে। মুচিরা ছাল ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে বীভৎস
অবস্থায় পড়ে আছে গরুটা। কয়েকটা কুকুর খুবলে খুবলে খাচ্ছে। হাড়গোড় নিয়ে
টানাটানি করছে।
দৃশ্যটা ভাবলেই তার হোটেলটার কথা মনে পড়ে। মাংস রাখার লম্বা ট্রে-র দিকে
তাকিয়ে কতবার তার শরীর ঘিনিয়ে উঠেছে, মরা পশুর কিংবা মানুষের মাংস নয়তো?
তার হাবভাবে সহকর্মীরা বিরক্ত হয়েছে। ম্যানেজারও বকুনি দিয়েছে, তবু তার সন্দেহ ঘোচেনি।
দ্বিজেন
মামা পেড়েছিল কথাটা। মফস্বলের মানুষ দ্বিজেন মামা বলেছিল ওদের ওখানে কোন ভাগাড়
থেকে গভীর রাতে নাকি মরা পশু লোপাট হয়। সেগুলো মাংস হয়ে প্যাকেটে ভরে শহরের বড়ো
হোটেলে যায়। এমনকি বড়োলোকের বাড়িতেও।
সুহাস
চমকে উঠেছিল। এ গল্প সে বিশ্বাস করেনি। কিন্তু রাজ্য জুড়ে ধরপাকড় হতে দ্বিজেন
মামাদের রেস্টুরেন্টটা সিল হয়েছিল। ওখান থেকেও নাকি বেরিয়ে এসেছিল পচা মাংসের
প্যাকেট।
বেচারা দ্বিজেন মামা! যে রেস্টুরেন্টে কাজ করত, সেটাকে বুঝতে পারল না কোনোদিন। অথচ ওই ওকে পাশের হোটেলের
কাজটা করে দিয়েছিল।
দ্বিজেন মামা কাজ ছাড়ার পর সুহাসও কাজটা ছেড়ে দিয়েছিল। তারপর কত কাজ ধরল ও।
মিস্টিদোকান, সিকুরিটি গার্ড,
ব্যাগ কারখানা, গেঞ্জি কারখানা। কোনো জায়গায়
থিতু হতে পারল না। বাধ্য হয়ে বৌদি বলল, কোনো কাজ তোমার
পোষাচ্ছে না, বাবার জমি-জায়গা নিয়ে থাকো।
সুহাস নাকে হাত চাপে। গন্ধটা সহ্য হয় না। ভাগাড়টা এখন পার্টির দখলে। ক্লাব
হবে। তাই তার বাড়ির কাছে রাস্তার ধারে খালপাড় বরাবর সংকীর্ণ জায়গায় এখন মরা পশু।
দুর্গন্ধ ছড়ায়। তবু কারো হেলদোল নেই। দূরের লোপাট হওয়া ভাগাড়টার দিকে তাকায়
সুহাস। গ্রামের হালচাল এখন ভালো নয়। কেউ প্রতিবাদ করলে ফেঁসে যাওয়ার ভয়।
বাড়ি ফিরে পরিষ্কার জামা-প্যান্টে ছিমছাম বেরিয়ে পড়ে সে। বৌদি বলে, তাড়াতাড়ি ফিরো।
বৌদিকে দেখলে তার করুণা হয়। ছোটোবেলায় মা মারা যাওয়ার পর অসহায় কোনো
মেয়েকে দেখলে যেমন হয়। এ বাড়িতে বৌদির আসা তিন বছর। ঠাকমা তাকে বড় করে স্বর্গে
গেলে তার আসা। বৌদি আসার পর বছর না ঘুরতেই ও বেচারির মা-ও মারা যায়। বাবা আবার
বিয়ে করে। সেই থেকে বাপের বাড়ির নাম করে না বৌদি।
ফিরো, একা আমার ভয় করে।
সমবয়সী মেয়ে। না শোনার ভান করে সে বেরিয়ে পড়ে। সোজা ঠাকুর থান। আষাঢ়ের
স্যাঁতসেঁতে ওয়েদারে ব্রজেনদাদু ধর্মপাঠ করছে। ইটের রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে থাকে
সুহাস। ব্যাঙেরা ডাকছে। ওদিকে একটা নেড়িকুত্তাকে ঘিরে কয়েকটা কুকুরের চিৎকার।
ব্রজেনদাদু অস্বস্তি বোধ করে। হঠাৎ তার মুখ থেকে
রাম-রাম ধ্বনি বেরোয়। কে যেন বলে, আহা পাপ পাপ...।
রোজকার মতো শম্ভুদা ধুনুচি আর নারকেল ছোবড়া নিয়ে বসে আছে। একটু পরে বাতাসে
ধুনোর গন্ধ হবে। সব উৎকট গন্ধ মুছে যাবে।
কুকুরগুলো থামে না। মিনিট পনেরো দাঁড়িয়ে থেকে সুহাস বসে। প্রতিদিনের এই
ধর্মপাঠ যে তার ভালো লাগে তা নয়। তবু আসে। সন্ধ্যার পর বাড়িতে তার কাজ নেই। বৌদি
আর সে। ওমন সুন্দর মেয়েটাকে ছেড়ে দাদা কেন যে পালাল! উঠে দাঁড়ায় সুহাস।
শম্ভুদা বলে, বাড়িতে
মন টানছে বুঝি?
জানোই তো সব।
শম্ভুদা মিটিমিটি হাসে। এসবের অর্থ বোঝে সুহাস। বৌদি আর তাকে নিয়ে টিপ্পনী।
সে প্রতিবাদ করে না। হাসাহাসিটাকে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে নিয়ে যেতে ভয়।
সুহাস মোবাইলের আলোয় পথ ফেরে। পুকুর ধারে ডুমুরের পাতায়, ফণীমনসার ঝোপে নিথর হচ্ছে অন্ধকার। দ্রুত
হাঁটে সে। বৌদির রান্নাবান্না হয়তো এতক্ষণ শেষ। দরজা বন্ধ করে গুটিসুটি টিভি
দেখছে নিশ্চয়।
শ্যামসুন্দর ঘোষ হেরে যাওয়ায় এ পাড়ায় আতঙ্ক নেমেছে। পুলিশ টহল দিচ্ছে।
তবুও। মোবাইলের আলোটা ফেলেই তড়াস করে দু'পা সরে আসে সুহাস। মাথায় চাকা দাগ। সাপটা সাঁ বেগে চলে যায়। সে থম মেরে
দাঁড়িয়ে থাকে। কাউকে ডাকে না। মালটা ঝোপের মধ্যে ঢুকে যেতেই সে হাঁটতে থাকে।
মৃত্যুচেতনা পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর মধ্যে। তাই সাপও ভয়ে পালায়। পুকুরে জোনাকিরা
ভেসে বেড়ায়। আকাশের দিকে ও তাকায়। মেঘলা জমিনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গোটা কয়েক
তারা। হঠাৎ একটা নেমে আসে পৃথিবীতে। তারপর হারিয়ে যায়।
সদর দরজায় ঠেলা দিতে খোলে না। কড়া ধরে নাড়তে বৌদি চমকায়, কে? সুহাস?
অনেকটা ভয়, অনেকট সন্দেহ,
অনেকটা আশা। চেনা মানুষের কণ্ঠস্বরও ভুল হয়। ব্রজেনদাদু বলে,
ঘোর কলি। কাউকে চেনা যায় না।
বৌদি আবার হাঁকে, সুহাস?
হ্যাঁ। নিস্পৃহ কণ্ঠস্বর।
দড়াম করে দরজা খুলে যায়। জ্বলজ্বলে চোখে তাকায় বৌদি, তোমাকে তো বলেছি সন্ধের পর বেশি দেরি করবে
না, তাড়াতাড়ি ফিরবে।
আগে এসব বলত না বৌদি। আজকাল বলে। বাধ্য হয়ে বলে।
সুহাস বাধ্য ছেলের মতো ভেতরে ঢোকে। এখন তাড়াতাড়ি খিল-দরজা এঁটে চোখ-কান খোলা
রাখতে হয়। এ গ্রামে এভাবে সবাইকে থাকতে হচ্ছে, অভ্যাস করতে হচ্ছে। সরীসৃপকে জড়িয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে সবাই সাপুড়ে হয়ে যাচ্ছে।
ভাতের থালা সামনে বসিয়ে দিয়ে বৌদি বলে, তুমি তো জানো আমার একা ভয় করে।
কিন্তু কী করবে সুহাস! সারাক্ষণ একটা যুবতী মেয়ের সান্নিধ্যে তারও তো
অস্বস্তি হয়। চারপাশের নোংরামি, টিপ্পনী যে অসহ্য। কিন্তু বৌদির ভয়টাও তো স্বাভাবিক। তার ঘর থেকে দেখা
যায় নবীন-মুকুন্দদের বাড়ি। যে রাতে ওরা খুন হলো, একটাও
কুকুর ডাকেনি গ্রামে। বোমার পর বোমা। দিনকয়েক পুলিশ এসে তোলপাড় করল
এবাড়ি-ওবাড়ি। আসামি খোঁজার বাহানায় তাদের বাড়িতেও ঢুকল এক সন্ধ্যায়। সুহাস
ছিল না। বৌদি ভয় পেয়েছিল। প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, সন্ধের
পর আর বাইরে থেকো না।
আলটপকা সুহাস বলেছিল, এবার
থেকে কি বাড়ির চৌকিদার হয়ে থাকব?
কেমন গম্ভীর হয়ে তাকিয়েছিল বৌদি। স্থির কন্ঠে বলেছিল, চৌকিদার তো পুরুষ মানুষদের হওয়ার কথা।
'পুরুষ' শব্দে সে কাঁপে। এসব আর আলোচনা করতে চায়নি।
কতই বা বয়স তার! এখন কেন হবে সে পুরুষ! কেন বৌদির চোখ তার যৌবনে আলোড়িত হবে? কেন সে একটু একটু করে মরবে?
দাদা পাশের বাড়ির এক বৌদি সম্পর্কের মহিলার সঙ্গে চলে যাওয়ার ঠিক আগে বৌদি
হেলথের কাজটা পেয়েছিল। ছোটখাটো চাকরি। গ্রামের পাড়ায়-পাড়ায়, বাড়ি-বাড়ি ঘুরে ওষুধ বিলি আর প্রসূতি
মায়েদের খবর নেওয়ার কাজ। এটাকে অবজ্ঞা করে চলে যেতে পারল না। নইলে অল্প শিক্ষিত
হলেও বৌদি আধুনিকা। বাড়িতে কোনোদিন কাপড় পরে না। নাইটি নয়তো চুড়িদার। তার পক্ষে
অন্য ছেলে জোটানো কঠিন নয়।
সুহাস তোমার কিছু লাগবে না তো আর?
ডাল দিয়ে আর কত ভাত খাব?
বৌদি রাগ করে, পুকুরে
জাল ফেলে তো একটা মাছ তুলতে পারতে।
সুহাস সাড়া করে না। বৌদি এবার হাসে, তুমি তো নিজেই নিরামিষাশী হওয়ার মতলবে আছো। আগে মাংস খেতে, সেটাও ছাড়ছ। কী হয়েছে বলো তো, সাধু হবে?
মাংসের কথা শুনলে ভাগাড়কে সে এড়াতে পারে না। প্যাকেটে জমানো মাংস। বমি পায়।
কী করে যে মানুষ পচা মাংস খায়? এসব
কথা সে অনেকবার বলেছে বৌদিকে। তবু কেন যে বৌদি সেই মাংসের কথা খুঁচিয়ে তোলে?
কতদিন মাংস খাইনি, আনো না
একদিন।
ঝকঝকে চোখে জ্যান্ত মুরগির মতো বৌদির অঙ্গখানা হঠাৎ দুলে যায়। সুহাস সেই
দৃশ্যে কেমন শিউরে যায়। আগে অনেকবার ভেবেছে, তার জায়গায় অন্য কেউ হলে জোর করে টুটি চেপে এই মুরগিকে ছিঁড়ে খেত। পরক্ষণে সে চমকে উঠেছে। লজ্জায় আধমরা
হয়েছে।
কিন্তু এখন তার নিজেকে যেন ভিজে মোরগের মতো লাগে।
মাথা নিচু করে খাওয়ার চেষ্টা করে সুহাস। পারে না। নিজের কামনা-বাসনা চেপে
একদিন সে ভরত কবিরাজের কাছে গিয়েছিল। নিজের লিঙ্গস্খলনের কথা বলেছিল। সব শুনে
কবিরাজ বলেছে, শরীরের উত্তেজনা
কমানোর সহজ উপায় নিরামিষ ভোজন।
অর্থাৎ ডিম-মাংস ছাড়া। সে থতমত
খেয়েছে, এই বয়সে নিরামিষ! আমি কি সাধু?
কবিরাজ হেসেছে, সাধু
হওয়া কি খারাপ? সুস্থ রুচির মানুষের খাওয়ার জন্য কোনোদিন
মাংস লাগে না।
আর কি কোনো উপায় নেই? সব
ছাড়লে শরীরে প্রোটিন পাব কীভাবে?
হো হো করে হেসেছে ভরত কবিরাজ। হাসির দমক থামলে তার গায়ে হাত বুলিয়ে বলেছে, উপায় একটা আছে। তাড়াতাড়ি বিয়ে কর।
কিন্তু কী করে সে বিয়ে করবে? বিয়ে
করলে বৌদি কি থাকতে পারবে এ বাড়িতে? বরং বৌদি তো পারে বিয়ে
করে অন্য ঘরে যেতে।
খেতে খেতে কী ভাবছ?
সুহাস চমকে ওঠে। পরক্ষণে মাথা নিচু করে খায়। মনে মনে ভাবে তার মতো বৌদিও কি
রুচি হারাচ্ছে? নিজেকে কেমন অপরাধী
লাগে।
থালা-বাটি সমেত তার সামনে মেঝেতে থেবড়ে বসে বৌদি। হঠাৎ তার দিকে বীভৎস তাকায়।
কেটে কেটে বলে, না পশু-পাখির মাংস
না মানুষের। কী যে হলো তোমার? বিয়ে করলে অন্তত বুঝতে মাংসের
স্বাদ।
এতদিনে কদাচিৎ ইয়ার্কি করেছে বৌদি। আজ হঠাৎ যেন তার ঘাড় ধরে ঝাঁকায় মেয়েটা।
অবাক হয়ে চেয়ে থাকে সুহাস। বৌদি কি পাগল হলো! অচেনা লাগছে কেন? খ্যাপাটে লাগছে কেন? আকাশটা
হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে।
শোনো, তোমার দাদা চলে যাওয়ার পর আমি একা একজন
মেয়েমানুষ, কতদিন এভাবে চলবে বলো! আমার সঙ্গে থাকতে তোমার
অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। চারদিকে এই খুনখারাপি, আতঙ্ক অসহ্য!
কেঁপে যায় সে। ভিতরটা কিলবিলিয়ে ওঠে। এমন অলীক হচ্ছে বৌদি, কী করবে সে?
কোনোরকমে দুটো খেয়ে পালায় সুহাস। উঠানে জামরুল গাছের নিচে দাঁড়ায়। একটা
চামচিকে ঝুলছে ডালে। পাঁচিলের ওপার থেকে ঝুলে পড়া বাঁশের পাতায় পাতায় কর্কশ
ধ্বনি।
রাত এখন ন'টা। শুলে ঘুম আসার
নয়। বৌদির যেমন বাইরের ভয়, তার তেমনি ভিতরে। একই ঘরে তারা
উপর-নিচে। তবুও।
নবীন-মুকুন্দ খুন হওয়ার পরের দিন রাতে নিজের ঘর থেকে উঠে এল বৌদি, ও-ঘরে আমার খুব ভয় করছে, তোমার ঘরে থাকব।
আমতা আমতা করে সুহাস বলেছিল, বেশ
তো উপরে থাকো। আমি নিচে থাকছি।
বৌদি বয়সে বছর তিনের বড়ো। অনেকটা বড়ো দিদির মতো। কিন্তু সেভাবে তাকায় না কোনোদিন। কেমন ধারালো, তকতকে দুই চোখ। দৃষ্টি নামিয়েছিল সুহাস।
বৌদি এক পলক তাকে দেখল। সুযোগ পেয়ে খেলাটা বুঝি মুঠোয় নিল।
আমি কাছে থাকলে ভয়?
আঁতকে উঠেছিল সে। শিকারীর হাতে গুলতি। যেন কোনো পাখিকে নয়, তার হৃদপিণ্ডকে ঘিরে। কোনো জবাব না দিয়ে
একটা চাদর আর বালিশে সে নিচে নেমেছিল।
ঘুম হয়নি রাতে। রোমকূপের নিচে চিতলের মতো ঘাই মেরে নাড়াচাড়া করল কেউ। কাছে
এল বৌদি। ওকে ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুখের উপর মুখটা চেপে ধরল হঠাৎ।
ছিটকে গিয়েছিল সুহাস। চটাস করে চড় মারল বৌদি, একই ঘরে কম বয়সী নারী-পুরুষ এভাবে থাকতে পারে!
সুহাস হাঁপাচ্ছিল। বৌদি চোখে চোখ রেখে বলল, এদ্দিন একই বাড়িতে আছি, তোমার মনের খবর আমি বুঝি না?
কথাগুলো বলে তার কাঁধে খামচাল, তুমি জানো ঘরে
যার বর থাকে না, বাপের বাড়িতে মা নেই, বাবা দ্বিতীয় পক্ষকে নিয়ে মেয়ের কথা ভুলে যায়, তারা
কত নিরাশ্রয়! নবীনরা মরার পরদিন পুলিশগুলো বাড়িতে ঢুকে ইনকোয়ারির নামে যেভাবে
আমাকে টর্চার করল, যদি আমার ইজ্জত নিত, তোমার কি কোনো দায় থাকত না? ভয় পাচ্ছ আমাকে নিয়ে
এক ঘরে থাকতে?
ওর চোখের উপর চোখ হানল বৌদি, আমি
জানি আমার জন্য তোমার শরীর নাচে। তুমি ভরত কবিরাজের কাছে যাও। জানি না ভেবেছ?
তোমার ওষুধ আমার চোখে পড়েনি?
কথাগুলো বলে বৌদি কেমন বেসামাল হয়ে পড়েছিল। অনেকক্ষণ পরে মাথাটা নিচু করে
উপরে বিছানায় ফিরে মর্মভেদী কন্ঠে বলেছিল, এরপরে যদি না চাও তাহলে দুজনের মৃত্যু ছাড়া কিছু নেই।
মৃত্যু! দুজনের! বুকের ভিতরে চড়াৎ করে একটা ফাটল নেমে এল। সে তো বাঁচতে চায়।
সুস্থ শরীরে, সুস্থ মনে।
পরের দিন বৌদিকে কেমন শান্ত দেখায়। বলল, কাল রাতের জন্য ক্ষমা কোরো। চারদিকে এত খুন-জখম, নোংরামি
হলে মাথার ঠিক থাকে না। তাছাড়া তুমি তো জানো আমি খুব আপডেটেড মেয়ে। রাখঢাক নেই,
কুসংস্কার নেই, নিজের বরটার থেকে কিছু না
পেয়ে খুব বেহায়া বুঝলে। একটু চুপ থেকে হাসল বেচারি, তোমার
কাছাকাছি থাকতে থাকতে তার কথা ভুলতে বসেছি। এটা আমার অন্যায়, তাই না?
সুহাস চমকে উঠেছিল। মেয়েটা সম্পর্কে তার বৌদি। সে জানে তার দাদা চরম অপরাধ
করেছে। তার কাছে যা প্রেম, বৌদির কাছে তা লজ্জা। একটা শবদেহকে ঘিরে
তাদের মরণ। সে কেঁপে ওঠে।
পাকা রাস্তার গন্ধটা এই উঠান থেকেও টের পাওয়া যায়। সুহাসের গা ঘুলিয়ে ওঠে।
তবু এখন অনেকক্ষণ সে নাকে সইতে পারে। ভরত কবিরাজের টোটকা কি তাকে সবার থেকে আলাদা
করে দিল? নিষ্কাম, নির্লোভ...
বৌদির জন্য মায়া হয়। অনেকদিন মারা গেছে বিদ্যাসাগর, তবুও এদেশে বিধবা কিংবা স্বামী পরিত্যাক্তা
সধবাদের পুনর্বিবাহ হলে চোখ বাঁকায় মানুষ। বৌদিকে ও সম্ভ্রমের চোখে দেখে। তাই
নিজেকে বাঁধে। এসব হয়তো তার নিজের মতো করে ঘরোয়া সংস্কারকে ধরে রাখার মরিয়া
চেষ্টা কিংবা বিশ্বাস। কিন্তু এই বিশ্বাসের ভাঙচুরটা আজকাল সে টের পায়।
খোলা উঠানে জলজ হাওয়ার স্পর্শ পায় সুহাস। মনে তার কু ডাকে। অনেকদিন আগে যতনদার
মুদি দোকানে খবরের কাগজে একটা তথ্য দেখেছিল। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আঘাতের পর
আমেরিকার বাজারে কনডমের হু-হু সেল। মৃত্যুভয়কে নাকি বেমালুম করে দিতে
পারে যৌনাচার। এখন মনে হয়, ঠিক।
চারদিকে জীবনের অস্থিরতা, সন্ত্রাসের কারণে সমাজের
আনাচে-কানাচে চলছে অবাধ, অবৈধ শারীরিক মগ্নতা। মনের চেয়ে
শরীরের চাওয়া-পাওয়া বুঝি তৃপ্তির। বৌদি সংস্কারমুক্ত মেয়ে। কিন্তু সুহাস?
শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সে টের পায় নগ্ন না হতে পারার জ্বালা। তাই
সবাইকে লুকিয়ে সে ভরত কবিরাজের কাছে ছোটে। শরীরের জ্বালা থেকে রেহাই পেতে। অথচ
তার সে লজ্জাও ধরে ফেলল বৌদি।
সদর থেকে বেরিয়ে সামনে ডোবার ধারে শিমূলের নিচে সে দাঁড়ায়। একটা মাছ ঘাই
মারে। খড়কুটো দিয়ে হলদে যে পাখিটা বাঁসা বেধেছে ক্ষীণ ডালে, তারও ঘুম ভাঙে। গা ঝাড়া দিয়ে ডেকে ওঠে
কিচকিচ শব্দে। সুহাসের ভয় করে। শিরায় শিরায় সন্ধ্যার সাপটা
এঁকেবেঁকে ছোটে। চারদিকে চাপ চাপ ভয়। অথচ কতদিন বৌদিকে এড়িয়ে আকাশের নিচে
রাত বাড়াবে সে, জানে না।
কতক্ষণ
বাইরে থাকবে?
বৌদির ডাক কানে আসতেই নিজের বিছানায় ফেরে। মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা
করে, বৌদি যেন আর কখনো তার কাছে না আসে। ওর রক্ত
আছে। সেই রক্তের ডাক ও কেমন করে আটকাবে!
দড়াম করে দরজা বন্ধ করে খিলটা তুলে দেয় বৌদি। সুইচ বোর্ডে হাত।
নাইটল্যাম্পের নীলচে আলোয় খুব কাছে। খোপায় হাত গুঁজে কোমরটা বাঁকিয়ে। মিহি
আলোয় অলৌকিক পরীর স্টাইলে। কেন পালাল দাদা?
সুহাস চোখ বুঝে নিজের মৃত্যু কামনা করে। মেয়েটা বলে, তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছেঁদো নয়।
তুমি আমার দেবর। মানে দ্বিতীয় বর।
ছি
ছি, আমি এমন সম্পর্কে বিশ্বাসী নয় বৌদি।
বৌদি হাসে, শব্দ করে হাসে।
সুন্দরী মেয়েরা কুৎসিত হাসলে হরর সিনেমার প্রেতিনীদের মতো লাগে। কিন্তু এই
মেয়েকে একা রেখে সে কোথায় পালাবে!
বৌদিকে কাছে এগিয়ে আসতে দেখে ভয়ে সিঁটিয়ে যায় সুহাস। হঠাৎ লোকজনের হই হই
আওয়াজ ভেসে আসে। দ্রুম দ্রুম। পর পর বোমা। ত্রস্ত রাতের জড়িমা খানখান করে কারা
ছুটছে।
উঠে দাঁড়ায় সুহাস। বিছানার উপর থপ করে বসে পড়ে বৌদি। গুলির শব্দ বাতাস
ফুঁড়ে ঘরের জানলায় ধাক্কা খায়। বৌদি সজোরে তাকে টেনে নেয়। জড়িয়ে ধরে। খুঁজে
ফেরে শরীরের ভেতরে সাহসী শরীর।
সুহাসের সব প্রতিরোধ ভেসে যায়। বৌদি ওর উপর চেপে বসে। তীব্র ফ্ল্যাশে তাকায়।
চোখ-মুখ বদলে যাচ্ছে দ্রুত। হরর নায়িকার বিকৃত চেহারা। বলপূর্বক তৃপ্তি পেতে
মানুষ কি এমন বদলায়? মানুষ
মানুষের মাংস খায় এভাবে?
ছাড়ো বৌদি ছাড়ো। এ অন্যায়, পাপ!
পাপ? ওই ভরত কবিরাজ বলেছে? এতদিন এক বাড়িতে আছি,
আমি কি জানি না আমার শরীরের দিকে তোমার লোভ?
বৌদি আর বলার সুযোগ দেয় না। হিস হিস করে বলে, আমার কথামতো না চললে কী করতে পারি জানো তো? নিজে মরব, তোমাকেও ফাঁসাব।
ভীত, সন্ত্রস্ত সুহাসের কানের কাছে মুখ আনে
বৌদি। বলে, যখন প্রেম থাকে না, জীবনটা
অরুচির হয়, তখন এই শরীর, এই মাংস। তার ভালোমন্দ, পচাগলা
কিছুই থাকে না। আর এটাই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। এসো নিজে বাঁচো, আমাকে বাঁচতে দাও।
এক বঞ্চিত যুবতীর সঙ্গে মেঝেতে যুঝতে যুঝতে আক্রান্ত সুহাসের চোখ পড়ে তক্তাপোশের
নিচে। চকচক করছে একটা হেঁসো । এই হেঁসো দিয়ে সে গাছ ছাড়ায়। খেজুরের রস করে, তালের রস করে। আজ মনে হয় এই হেঁসো দিয়ে
সে কুচিকুচি করতে পারে আস্ত একটা মেয়েকে। প্রেম আর প্রাণে সে বড় নিষ্ঠুর।
যখন ঘোর কাটে, দেখে
তার সামনে একটা মৃত রক্তাক্ত শরীর। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মৃত শকুন। সে কী করবে
বুঝতে পারে না। ধীরে ধীরে হেঁসেটা নামায় নিজের তলপেটের কাছে। মৃত্যুর আগে একটু কাঁদতে
ইচ্ছে করে, কিন্তু পারে না। তীব্র দুর্গন্ধ। বমি। হাজার
হাজার কুকুর ছুটে আসছে। বানের মতো ভেসে আসছে বৃহদাকার ভাগাড়। সে অসহায়, ভীষণ অসহায়...
অধিবাস পর্ব- রম্য রচনা-কিতনে বাজু! কিতনে শির!- সৌরচক্র
কিতনে বাজু! কিতনে শির!
সৌরচক্র
কিতনে বাজু! কিতনে শির! শুনলে মনে হয়
যেনো শত্রু পক্ষের গুরুত্ব গণনা চলছে প্রবল বিস্ময়ে। যেনো যুদ্ধ হবে। যদিও এখানে বিষয়'টা
অন্যরকম, তবে অনেকটা তাই। বোধন থেকে দশেরা যুদ্ধ জয়ের শৈল্পিক উদযাপন তো বটেই। এক
"দশ" (দশভূজা) এর বিজয় উৎসব, আর অন্য "দশ" (দশানন) এর নিধন উৎসব।
তবে একটা সময় বিস্ময়টাই শুধু ছিল।
কারণ যুদ্ধ কি তা জানা ছিলনা। জ্ঞান হওয়ার
পর প্রথম দুর্গা আর রাবণ'কে দেখলে প্রথম যে বিস্ময়'টা শিশু মনে জাগতো, সেটা অবশ্যই
সংখ্যা'র বিস্ময়। "ও বাবা, কতগুলো হাত!
কতগুলো মাথা!"
এখন সময় অনেক বদলেছে। এখন যুদ্ধ, বিস্ময়
সবই অনুভূত হয়। তবে তাতে কোনও পৌরাণিক কাহিনী নেই। আছে আধুনিক বাস্তব। এখন, অনেক যুদ্ধ
করেও যখন ভিড় ঠেলে দুর্গা পুজোর মণ্ডপে বা দশেরার প্রাঙ্গণে প্রবেশের ব্যর্থতা নিয়ে
অনেক দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখি হাজার হাজার মানুষের মাথা আর সবার দু'হাত তুলে মোবাইলে
ছবি তোলার ব্যস্ততা, তখনও ঠিক একই রকম বিস্ময়ে মাতৃভাষা ভুলে গিয়ে অস্ফুটে বলে ফেলি
"উরিব্বাস, কিতনে বাজু! কিতনে শির!"