অলীক পাতার অন্যান্য সংখ্যা- পড়তে হলে ক্লিক করুন Library ট্যাব টি



। । "অলীক পাতা শারদ সংখ্যা ১৪৩১ আসছে এই মহালয়াতে। । লেখা পাঠানোর শেষ তারিখ ১৫ ই আগস্ট রাত ১২ টা ।.."বিশদে জানতে ক্লিক করুন " Notice Board ট্যাব টিতে"

Showing posts with label SATYAJIT RAY SPECIAL. Show all posts
Showing posts with label SATYAJIT RAY SPECIAL. Show all posts

Sunday, January 9, 2022

ভ্রমণ-নীলকণ্ঠেশ্বর মহাদেব ও চন্দ্রবদনী মন্দির দর্শন - দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

 

নীলকণ্ঠেশ্বর মহাদেব ও চন্দ্রবদনী মন্দির দর্শন

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী    

  

চন্দ্রবদনী দেবীর মন্দির


অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল সময় ও সুযোগ ঘটলে উত্তরাখণ্ডের নীলকণ্ঠেশ্বর মহাদেব ও চন্দ্রবদনী মন্দির দেখে আসার কিন্তু সময় ও সুযোগ হচ্ছিল না। অবশেষে ২০২১ সালের অর্থাৎ এই বছরের হরিদ্বার পূর্ণকুম্ভে গিয়ে সেই সুযোগ এসে গেল। অবশ্য প্রচলিত কথা আছে তীর্থের দেবতার আহ্বান না হলে যতই চেষ্টা করি না কেন যাওয়ার সুযোগ ঘটবে না।

কুম্ভমেলাতে যাবার দুমাস আগে ট্রেনের যাতায়াতের সংরক্ষিত টিকিট কেটে নিশ্চিন্ত হয়েছি। যাত্রার তারিখ পূর্বে আর দেখিনি, যতদূর সম্ভব মনে আছে যে আমি ৫ই মার্চ তারিখের টিকিট কেটে ছিলাম এবং সেইভাবে সকল শুভানুধ্যায়ীকে জানিয়েছিলাম। জিনিসপত্র সব গুছিয়ে চার তারিখে সন্ধ্যের সময় স্ত্রীর সাথে চায়ের টেবিলে বসে ট্রেনের টিকিট বের করে দেখতে পেলাম সেই দিনেই দুপুর  একটাতে আমার নির্দিষ্ট ট্রেন হাওড়া থেকে চলে গেছে। প্রৌঢ় বয়সের দৃষ্টিবিভ্রম। কি করব, কিভাবে যাব যখন কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। মনে খুব আঘাত পেলাম এই ভেবে যে সবকিছু পূর্বের থেকে ব্যবস্থা করেও যাওয়া হলো না। আগেই বলেছিলাম তীর্থদেবতার আহ্বান না হলে কিছুতেই যাওয়া হবে না। যাইহোক তীর্থদেবতা যেন আমার মনোবেদনা জানতে পারলেন। এই সময় যেন ঈশ্বরপ্রেরিত দূত হয়ে আমার জ্যেষ্ঠপুত্র শ্রীমান পার্থ তার ওয়ার্কশপ থেকে বাড়িতে এলো। সে এসে সমস্ত ঘটনা শুনে আমার দুশ্চিন্তার অবসান ঘটালো। আইআরসিটিসি অ্যাপ বের করে ৫ই মার্চ তারিখের ০২৩২৭ নম্বর ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কোচের একটি টিকিট কেটে আমাকে চিন্তার হাত থেকে মুক্ত করল।

 

এবারে আমার যাবার কথা শুনে আত্মীয়-স্বজন শুভানুধ্যায়ীরা নিষেধ করে বলেছিলেন "তিনবার পূণ্য স্নান হয়েছে এবারে করোনার সময়ে না গেলেই ভালো হয়"। কিন্তু কুম্ভের কি যে আকর্ষণ জানিনা, পথে বেরিয়ে পড়লাম। ৫ তারিখে। পরের দিনে নির্দ্ধারিত সময়ের আধ ঘণ্টা আগে বিকেল তিনটে কুড়ি মিনিটে ট্রেন পৌঁছাল হরিদ্বার স্টেশনে।  ভারতীয় রেলের নিয়মানুবর্তিতা এবং ট্রেনের ভিতরের ও স্টেশনের পরিছন্নতা দেখে খুব ভালো লাগলো। স্টেশন থেকে একটি অটো করে আমি বিবেকানন্দ সেবা সমিতির শিবিরে  বিকেল চারটার পূর্বে পৌছালাম।

 

৬ ই মার্চ আমার বন্ধু শ্রী সুকোমল মণ্ডল সস্ত্রীক হরিদ্বারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল। আমরা আগেই স্থির করেছিলাম যে হরিদ্বারে গিয়ে ৮ এবং ৯ই মার্চ  হরিদ্বার থেকে যথাক্রমে নীলকণ্ঠেশ্বর মহাদেব ও চন্দ্রবদনী মন্দির দর্শন করতে যাব এবং ১০ই মার্চ তারিখে বিশ্রাম নিয়ে ১১ তারিখে শাহীস্নান করবো।  ৬ তারিখে বিকেলে পৌছালাম এবং ৭ তারিখে গাড়ির ব্যবস্থা করে স্থির হল ৮ তারিখে একটি 'ট্রাভেরা' গাড়ি করে আমরা নীলকন্ঠ মহাদেব দর্শন করে ফিরে আসবো এবং ৯ তারিখে একটি 'বোলেরো' গাড়ি করে চন্দ্রবদনী মন্দির দর্শন করে ফিরব। হরিদ্বারে আমাদের আবাসিক শিবিরে পৌছাবার পরে আরও চার পাঁচজন আবাসিক আমাদের সাথে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করাতে তাদেরও সঙ্গে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হল। যে দুই তীর্থের দেবতাকে দর্শন করার ইচ্ছা দীর্ঘদিন যাবৎ মনের সংগোপনে জারিত হয়েছিল সেগুলি আশা করছি এবারে ফলপ্রসূ হতে চলেছে।    

 

       ৮ই মার্চ তারিখে অর্থাৎ সোমবার সকাল পৌনে নটাতে আমরা পাঁচজন অর্থাৎ আমি, আমার বন্ধু শ্রী সুকোমল মণ্ডল ও তার স্ত্রী মালতি, শিবিরে আমার সাথে একই ঘরে আছে বাবুলাল ও সুভাষ। শিবির থেকে বেরোনোর আগে চা ও জলখাবার খেয়ে নিলাম। কঙ্খলের শঙ্করাচার্য চক থেকে আমাদের গাড়ি পূর্বদিকে ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে ব্রহ্মকুণ্ডকে বাঁ দিকে রেখে ঋষিকেশ যাবার রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। আজ থেকে চোদ্দ বৎসর পূর্বে এসে দেখেছিলাম হরিদ্বার ও হৃষীকেশের মাঝে অনেক ফাঁকা জায়গা ছিল। কিন্তু বর্তমানে দুই শহরের বিস্তৃতির ফলে সেই ফাঁকা জায়গাগুলি দেখতে পাচ্ছি রাস্তার দু'পাশে গগনচুম্বী অট্টালিকার সারিতে ভরাট হয়ে গেছে। রাস্তার দু'পাশে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সুসজ্জিত শোরুম। ঋষিকেশ শহর ছাড়িয়ে গঙ্গার উপরে পুল পেরিয়ে গঙ্গা নদীকে বাঁ দিকে রেখে আমরা নীলকণ্ঠেশ্বর মহাদেবের আবাসস্থল মণিকূট পর্বতের উদ্দেশ্যে ঋষিকেশ থেকে পাহাড় ও গভীর জঙ্গলের পথে রওনা হলাম। হৃষীকেশের পরে মাঝে মাঝে গঙ্গা নদীকে বাঁ দিকে দেখতে পাচ্ছি। সুন্দর পিচঢালা রাস্তা, পাহাড়-জঙ্গল এবং মাঝে মাঝে সবুজ উপত্যকা পেরিয়ে সকাল এগারোটা নাগাদ মণিকূট পর্বতের পাদদেশে যেয়ে পৌছালাম। গাড়ীকে মন্দিরের এক কিলোমিটার দূরে পার্কিং করতে হলো। এখান থেকে পায়ে হেঁটে যেতে হবে। শিবরাত্রির পূর্বের সোমবার বলে এখানে খুব ভীড়। কিছুদুর যাবার পরে রাস্তার উপরে নীলকন্ঠ মহাদেব তোরনদ্বার।

 

এখন তো আমরা মন্দিরের নিকট পর্যন্ত গাড়িতে আসতে পারছি। অথচ আজ থেকে প্রায় ১৩১ বৎসর আগে স্বামী বিবেকানন্দের গুরুভ্রাতা স্বামী সারদানন্দ, স্বামী তুরীয়ানন্দ এবং স্বামী কৃপানন্দ ১৮৯০ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি শিবরাত্রির দিনে যখন এখানে এসেছিলেন সেই সময়ে তাঁরা ঋষিকেশ থেকে পদব্রজে এসেছিলেন। স্বামী সারদানন্দ চরিত - তপস্যা ও পর্যটন গ্রন্থে এখানে আসার যে অভিজ্ঞতা ও পথের বর্ণনা যেভাবে স্বামী সারদানন্দ মনের আনন্দে শ্রী প্রমদাদাস মিত্রকে লিখিলেন – ‘পথ অতি দুর্গম, পর্বতের চড়াই অতি উচ্চ পাকদণ্ডী দিয়ে লতাপাতা আঁকড়ে ধরে পাহাড়ে চড়তে হয়েছিল। নীলকন্ঠের দৃশ্যের কথা আর লিখিয়া কি জানাইব। এমন শান্তিময় স্থান আর কোথাও দেখি নাই। এখানে নীলকন্ঠ নামে একটি অনাদি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্টিত আছেন। চতুর্দিকে বড় বড় পর্বত দিয়ে ঘেরা, মধ্যে একটি ছোট পর্বতের শিখরে মহাদেবের মন্দির। মন্দিরের বিশ-ত্রিশ হাত অন্তরে একটি নির্ঝর অতি মিষ্ট ঝর্ঝর শব্দ করিয়া চলিয়া যাইতেছে। নানা প্রকার পক্ষী সকল ডাকিতেছে ও পর্বতের বনরাজি সকল মধ্যে অতি সুমিষ্ট গন্ধ দান করিতেছে। নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে হিংস্র জন্তু থাকা দূরে থাকুক, একটা শিয়াল পর্যন্ত ডাকিতে শুনি নাই। বন যে কেবল জঙ্গুলে গাছে পূর্ণ তাহা নয় তপোবনসুলভ  সুস্বাদু ফল -  আম, পিচ, কলা, লেবু, পেয়ারা প্রভৃতির গাছ আছে, কন্দও প্রচুর পাওয়া যায়। স্থানটি এত চিত্তপ্রসাদকর ও মনোহর যে এখানে আসিলে আপনা হইতেই মনে ধ্যান ও ভাবের উদয় হয়। স্বভাবের সুন্দর দৃশ্য ও নিস্তব্ধতার দরুন মনকে একেবারে উদাস করিয়া ভয়, ভক্তি, প্রেম, বিশ্বাস ও উল্লাসে ডুবাইয়া দেয়। এমন চৈতন্যময় স্থান আর কোথাও দেখি নাই। বোধ হয় যেন দেবাদিদেব মহাদেব এইমাত্র এখান হইতে তপস্যা করিয়া উঠিয়া গেলেন। অধিক আর কি বলিব - পর্বত হইতে নামিবার সময় মা গঙ্গার শোভা ও ভাব দেখিয়া আমাদের মনে কান্না আসিল। ঠিক এই রকম দেখিলাম, যেন পতিতপাবনী জগজ্জননী গঙ্গা স্বর্গ হইতে নামিয়া কেবল উত্তরাখণ্ডকে পবিত্র ও ধন্য করিয়া আবার স্বর্গের বাসিনী স্বর্গেতেই ফিরিয়া যাইতেছেন, মর্ত্যলোকে আর নামিলেন না। মায়ের জলেরও যে কত বাহার দেখিলাম তা আর কি লিখিব - যেন উজ্জ্বল হীরার ধারা, রজতের ধারা, অনুপম।‘  পথে তাঁরা শ্রী বীরভদ্রও দর্শন করেছিলেন।  ঋষিকেশ তখন সত্য সত্যই ঋষিসেবিত স্থান ছিল - শান্ত, নির্জন, মৌন।  স্বামী সারদানন্দের  দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল মা গঙ্গার রূপের কত বাহার, গভীর অরণ্যানীর বিটপীগুলি ফলভারে নম্র, কোথাও হিংস্র জন্তুর আওয়াজ নেই, ডালে ডালে পাখির কূজন, মৌন পর্বত - যেন সত্য সত্যই মহাদেবের আবাসস্থল। প্রকৃতির সেই উন্মুক্ত আবাসস্থলে শিবরাত্রির দিন স্বামী সারদানন্দ এক শিলাখণ্ডের উপরে সারারাত্রি ধ্যানে মগ্ন ছিলেন।   

 

নীলকন্ঠেশ্বর পৌঁছাবার আগে নীলকন্ঠ মহাদেব সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য পাঠকের কাছে উপস্থাপনা করছি। সমুদ্র মন্থনে অমৃত লাভ করে দেবতা ও অসুরেরা যখন বিবাদগ্রস্ত সেই সময়ে বাসুকিনাগের তীব্র বিষের জ্বালায় ত্রিজগতের সমস্ত প্রাণী জগৎ ও প্রকৃতিতে এক অস্থির অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। জলের প্রাণীরা ডাঙ্গাতে ছটফট করে মারা যাচ্ছে, বৃক্ষ সকল শুকিয়ে যাচ্ছে, মানবকূল বিষের জ্বালাতে আর্তনাদ করে প্রাণত্যাগ করছে। ত্রিজগতের এরূপ অবস্থা দেখে দেবাদিদেব মহাদেব হলাহল পান করে নীলকন্ঠ হলেন। এদিকে বাসুকিনাগের শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভেঙে এক মাংসপিন্ডে পরিনত হয়েছে। তিনি অর্ধমৃত হয়ে পড়ে রইলেন। সবাই যে যার স্বার্থ ফুরিয়ে যেতে পালিয়ে গেলেন অথচ যে বাসুকিনাগ স্বেচ্ছায় দেবগনের উপকারের কথা ভেবেছিলেন তার দিকে আর কেউ ফিরেও দেখলেন না। মহাদেব তখন বাসুকিনাগকে তাঁর পার্বণীর রাজপ্রাসাদে নিয়ে যেয়ে সেবা শুশ্রূষা করে সুস্থ করে দিলেন এবং ঋষিকেশের উত্তরে বিষ্ণুকূট, ব্রহ্মকূট এবং মণিকূট উপত্যকার মণিকূট পর্বতে নীলকন্ঠ মহাদেব রূপে বিরাজ করতে লাগলেন। প্রবাদ সমুদ্রমন্থনের গরল পান করে ভগবান এখানেই নীলকন্ঠ মহাদেব হয়েছিলেন এবং তারপরে ষাট হাজার বৎসর এখানে তপস্যা করে বিষমুক্ত হয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ করা যায় যে মহাদেব যখন বিষ পান করেছিলেন সেই সময়ে মা পার্বতী মহাদেবের গলা চেপে ধরেছিলেন যাতে বিষের প্রভাব গলার নিচে নামতে না পারে।    

 

নীলকন্ঠ মহাদেব তোরনদ্বারে আমরা পুজোর জন্য জল, দুধ, ফুল, বেলপাতা, নৈবেদ্য ইত্যাদি কিনে ধীরে ধীরে এগোচ্ছি। অগণিত ভক্ত পায়ে হেঁটে এগিয়ে চলেছেন। পাহাড়ি রাস্তা উপরের দিকে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে উচ্চতার জন্য সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করে যেতে হচ্ছে যার ফলে জোরে হাঁটা যাচ্ছে না। প্রায় ৪৫ মিনিট হাঁটার পরে আমরা মন্দিরের নিকটে এসে পৌছালাম। এখান থেকে সরু রাস্তার দু'পাশে এলাকার অধিবাসীদের বাড়িঘর এবং পূজার উপকরণ ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে দোকানীরা বসে আছেন। ভক্তদের যাবার জন্য রাস্তার দুই পাশে লোহার রেলিং, মাথার উপরে আচ্ছাদন। একসময় পথ শেষ হয়ে মন্দিরের গর্ভগৃহের সামনে উপস্থিত হলাম। গর্ভগৃহের দিকে মুখ করে বসে আছেন নন্দীশ্বর। গর্ভগৃহের দরজার সামনে পূজারীরা বসে আছেন। নিরাপত্তারক্ষীদের প্রচণ্ড ব্যস্ততা। উল্লেখ্য যে নীলকণ্ঠেশ্বর মহাদেবের গর্ভগৃহ যেখানে সুদৃশ্য লিঙ্গ বিরাজিত সেই গর্ভগৃহটি আয়তনে এতই ছোট যে সেখানে তিন-চারজনের বেশি ভক্তের স্থান সংকুলান হয় না যার জন্য গর্ভগৃহের দুই দিকের প্রবেশপথের উপরে পিতলের যোনিপীঠসহ লিঙ্গের উপরে জল অভিষেক করার ব্যবস্থা আছে। সেখানে দুধ,জল ঢাললে সেই দুধ,জল পাইপের সাহায্যে যেয়ে অনাদি লিঙ্গকে অভিষিক্ত করছে। আমরাও সেখানে দুধ, জল ঢেলে ফুল বেলপাতা নিবেদন করলাম। পূজারীর হাতে নৈবেদ্য দিতে তিনি শিবলিঙ্গ স্পর্শ করিয়ে আমাদের হাতে দিয়ে দিলেন। মন্দিরে এত ভীড় যে সেখানে এক মিনিটের বেশি দাঁড়ানো যাচ্ছে না, নিরাপত্তা রক্ষীরা ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছেন।      

 

মন্দির থেকে বেরোবার পরে নিরাপত্তারক্ষীরা একটি সহজ রাস্তা দেখিয়ে দিলেন যাতে দশ মিনিটের মধ্যে আমরা যাবার সময়ে যে সরু রাস্তা দিয়ে গিয়েছিলাম সেই রাস্তায় না যেয়ে মূল রাস্তাতে এসে পৌছালাম। গাড়ির কাছে আসতে আরো আধঘণ্টা সময় লাগলো। সবাই এসে পৌঁছাতে গাড়ি ছাড়লো বেলা দেড়টার সময়। এখান থেকে আমাদের গন্তব্য স্থল ৩২ কিলোমিটার দূরের ঋষিকেশ। ঋষিকেশ বর্তমানে একটি জনবহুল শহরে পরিণত হয়েছে যার ফলে আমাদের গাড়ি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে  মিনিট পঁচিশ হেঁটে আমরা যেয়ে পৌছালাম লছমনঝুলা ব্রিজের অপরপাশে চোদ্দো তলার কৈলাসানন্দ মিশন আশ্রমের মন্দিরে। হেঁটে যেতে হবে বলে সুকোমল ও মালতি গাড়ির কাছেই থেকে গেল। মন্দিরের চোদ্দো তলা পর্যন্ত উঠে সমস্ত কিছু দেখে সুভাষ এবং বাবুলাল গীতাভবন ও রামঝুলা দেখতে গেল। আমি আর ওদের সাথে গেলাম না। সবাই একত্রিত হওয়ার পরে বিকেল পাঁচটায় গাড়ি ছাড়লো।  হরিদ্বারে আমাদের আবাসিক শিবিরে এসে পৌছালাম সন্ধ্যা সাতটায়।

 

পরের দিনে অর্থাৎ ৯ই মার্চ তারিখে সকলে সকাল আটটাতে শিবির থেকে চা, বিস্কুট খেয়ে একটি বোলেরো গাড়ি করে আটজনে রওনা হলাম চন্দ্রবদনী দেবীস্থান দর্শনের উদ্দেশ্যে।  আগের দিনের আমরা পাঁচজন এবং শিবিরের অন্য তিন আবাসিক শিবানী গাঙ্গুলি, চন্দনা দত্ত এবং তার সাথী। আগের দিনের একই রাস্তাতে ঋষীকেশ পৌঁছে সকাল দশটায় সেখান থেকে ৫৮ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে আমাদের দেবপ্রয়াগে যাবার রাস্তা। রাস্তার ক্রসিংয়ে উত্তরাখণ্ড পুলিশের ব্যারিকেড। জিজ্ঞেস করে জানা গেল দেবপ্রয়াগের রাস্তাতে পাহাড় থেকে ধ্বস নামার জন্য রাস্তা বন্ধ। অগত্যা আমাদের ঘুরপথে অর্থাৎ নরেন্দ্রনগর, তেহরীবাঁধ হয়ে যেতে হবে। পথের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘায়িত হোল। উপায় নেই, এখান থেকে তো আর ফিরে যাওয়া যাবেনা। দেবপ্রয়াগ থেকে কুড়ি কিলোমিটার যাবার পরে নরেন্দ্রনগর। পাহাড় জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ক্রমশ উপরের দিকে গাড়ি উঠছে। যাবার পথে আমাদের গাড়ির ড্রাইভার পলক সিং দেখিয়ে দিলেন রাস্তার বাঁদিকে নরেন্দ্রনগরের পূর্বতন রাজার প্রাসাদ। আমাদের যথেষ্ট দেরি হয়েছে তারপরে পথের দৈর্ঘ্য বেড়ে গেছে যার জন্য রাজপ্রাসাদ দেখার ইচ্ছা হলেও আমরা প্রকাশ করলাম না। ক্রমশঃ উপরের দিকে গাড়ি উঠছে। নরেন্দ্রনগর থেকে তেহরি বাঁধ প্রায় ৬৫ কিলোমিটার রাস্তা। আগর, ফাকোট, চম্বা হয়ে দুপুর বারোটার পরে আমরা পাহাড়ঘেরা নীল জলের তেহরি বাঁধের নিকটে গিয়ে পৌঁছলাম। দুই পাহাড়ের মাঝখানে ভাগীরথী নদীতে বাঁধ দিয়ে জলস্রোতের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সেচের ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়েছে বিস্তীর্ণ অববাহিকা অঞ্চলে। যেহেতু নদীবাঁধ নির্মাণের সময় রাজনৈতিকভাবে ভারতবর্ষ উত্তাল হয়েছিল এবং যার জন্য বাঁধটির নির্মাণকার্য সম্পূর্ণ হতে নির্ধারিত সময়ের থেকে বিলম্ব ঘটেছিল সেই জন্য তেহরি বাঁধ নির্মাণের আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি।            

 

আন্দোলনের কারণ ছিল হিমালয়ের এই অঞ্চলের ভঙ্গুর শিলার গতি-প্রকৃতির জন্য এবং সব থেকে বড় কথা এই অঞ্চল ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। ১৯৯১ সালের অক্টোবর মাসে উত্তরকাশীতে যে ভূমিকম্প হয়েছিল তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই অঞ্চল থেকে ৫৩ কিলোমিটার ব্যাসার্দ্ধের মধ্যে। এছাড়াও পরিবেশবিদরা আশঙ্কা করেছিলেন এই বাঁধ নির্মাণ হিমালয়ের এই অঞ্চলের জীবনযাত্রা, পরিবেশ ও প্রাণী বৈচিত্রে আঘাত হানবে। যে অঞ্চলে বাঁধটির নির্মাণকার্য হয়েছে ভূতাত্ত্বিকদের মতে সেই অঞ্চলটি মধ্য হিমালয়ের ভূকম্পন এলাকায় অবস্থিত, যদিও নির্মাণ বিশেষজ্ঞদের মত ছিল বাঁধটির নির্মাণকার্য এমনভাবে হয়েছে যে ৮.৪ রিখটার স্কেলের ভূকম্পন প্রতিহত করার ক্ষমতা আছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মত ছিল হিমালয়ের এই অঞ্চল এমন এক জায়গাতে অবস্থিত যেখানে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা বেশি। ১৯৯১ সালের উত্তরকাশী ভূমিকম্পের পরে ২৭শে অক্টোবর থেকে ৪ঠা নভেম্বর পর্যন্ত আইআইটি কানপুরের বৈজ্ঞানিকরা স্থানটি পরিদর্শন করে তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন সন্নিহিত অঞ্চলের ১২৯৪টি গ্রামের প্রায় তিন লক্ষ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, ৭৬৮ জন নিরীহ  গ্রামবাসী মারা গেছলেন, ৭৫০৩টি বাড়ি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল এবং আরো অসংখ্য বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল ছিল গঙ্গোত্রী এবং তেহরি অঞ্চল।      

 

তেহরি বাঁধ আন্দোলন প্রথম শুরু করেন শ্রী বীরেন্দ্র দত্ত সাকলানি নামে একজন আইনজ্ঞ, যিনি তেহরি বাঁধ নির্মাণ বিরোধী কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। শ্রী সাকলানি আন্দোলনের মাধ্যমে জনসাধারণের দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করার পরে নেতৃত্বে আসেন পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম নেতা শ্রী সুন্দরলাল বহুগুণা, জন্মসূত্রে যাঁর পূর্বপুরুষেরা পশ্চিমবঙ্গের বন্দোপাধ্যায় ব্রাহ্মণ।  ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত শ্রী বহুগুণা তেহরি বাঁধ নির্মাণ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন। পরিবেশরক্ষা আন্দোলনকারীদের সমস্ত প্রকার আন্দোলনকে অগ্রাহ্য করে ১৯৭৮ সালে যে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল দীর্ঘ ২৮ বৎসর পরে ২০০৬ সালে সেই বাঁধের নির্মাণকার্য শেষ হয়েছিল। তেহরি বাঁধ ভারতের উচ্চতম এলাকার নদীবাঁধ। বাঁধটি লম্বায় ১৮৮৬ ফুট, চওড়ায় ৬৬ ফুট উপরের অংশ বা শীর্ষদেশ , নিচের অংশ বা তলদেশ ৩৭০১ফুট, উচ্চতায় ৮৫৫ ফুট, জলধারনের ক্ষমতা পাঁচ লক্ষ উনপঞ্চাশ হাজার কিউবিক ফুট। এছাড়াও এখানে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে যার সাহায্যে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, চন্ডিগড়, জম্মু-কাশ্মীর, রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ এবং দিল্লির বিস্তীর্ণ এলাকা আলোকিত। খালের সাহায্যে জল পাঠানো হচ্ছে দু লক্ষ সত্তর হাজার হেক্টর জমিতে। পানীয় জল সরবরাহ করা হচ্ছে উত্তরাখণ্ড,



পানীয় জল সরবরাহ করা হচ্ছে উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ ও দিল্লিতে। বাঁধ নির্মাণে খরচ হয়েছে ১০০ কোটি ডলার। রিজার্ভার ক্যাপাসিটি ৩২ লক্ষ একর ফুট বা চার কিউবিক কিলোমিটার। রাশিয়ার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বাঁধটি সম্পূর্ণ নির্মিত হয়েছে ২০০৬ সালে। তেহরিতে যেখানে বাঁধ নির্মাণ হয়েছে তার থেকে বাইশ কিলোমিটার নীচে ভাগীরথীর উপরে ২০২৯ ফুট উচ্চতায় কোটেশ্বর বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। সেটি লম্বায় ৯৮৪ ফুট, উচ্চতায় তিনশো কুড়ি ফুট,
টিহরি বাঁধ
জলধারণক্ষমতা ৭২০৭২ একর ফুট। জলের স্রোতে টারবাইন বসিয়ে এখানে ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে। তেহরি বাঁধটি কোনক্রমে ভেঙ্গে গেলে অববাহিকা অঞ্চলের প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এখানে দশ মিনিটের বিরতি। গাড়ি থেকে নেমে প্রত্যেকে পাহাড়ের কোলে ভাগীরথীর নীল জলরাশি দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন এবং বিভিন্ন আঙ্গিকে ফটো তোলায় ব্যস্ত হলেন। যেখানে টিহরি বাঁধ নির্মিত হয়েছে সেখান থেকে চন্দ্রবদনী মন্দিরের দূরত্ব প্রায় ৭৫ কিলোমিটার। বেশি সময় এখানে অতিবাহিত না করে আমাদের গাড়ি সাড়ে বারোটায় ছাড়ল। পাহাড় জনপদ পেরিয়ে গাড়ি চলেছে। দেবপ্রয়াগে না যেয়ে তার আগে জামনিখাল থেকে সাত কিলোমিটার পেরিয়ে আমরা চন্দ্রকূট পাহাড়ের পাদদেশে পৌছালাম দুপুর দুটো পনেরোতে। এখানে গাড়ির স্ট্যান্ড, কয়েকটি দোকান আছে যেখানে পূজোর সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও চার-পাঁচটি চায়ের দোকান আছে যেখানে বললে খাবার পাওয়া যায়। এখান থেকে সিঁড়ির ধাপ করা আছে চন্দ্রকূট পাহাড়ের উপরে চন্দ্রবদনী মন্দির পর্যন্ত। প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করে মন্দিরে যেয়ে পৌছালাম পৌনে তিনটার সময়। দর্শনার্থী প্রায় নেই, মন্দির চত্বর ফাঁকা। মন্দিরের সামনের চত্বর থেকে দূরের গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, কেদারনাথ, বদ্রিনাথ পর্বত শৃঙ্গগুলি আকাশ পরিষ্কার থাকলে দেখা যায়।

 

এখানে এসে মন চলে গেল অতীতে। আজ থেকে একশো একত্রিশ বছর আগে অর্থাৎ ১৮৮৭ সালে যখন স্বামী বিবেকানন্দের গুরুভ্রাতা স্বামী অখন্ডানন্দ গঙ্গোত্রী থেকে উত্তরকাশী হয়ে টিহরিতে আসার পরে উদরাময়ে আক্রান্ত হয়ে অবস্থান করার পরে চন্দ্রবদনী মন্দির দর্শন করতে এসেছিলেন। স্বামী অখন্ডানন্দ রচিত  'হিমালয়ের আকর্ষণে' যেভাবে বর্ণনা করা আছে সেটি এইরূপ -  ‘চন্দ্রবদনী পীঠস্থান দর্শনমানসে নিবিড় অরণ্য পথে যাত্রা করিলেন। উচ্চ গিরিচূড়ায় দেবীর মন্দিরটি হিমালয়ের এক অপূর্ব সৌন্দর্য কেন্দ্র। যেন মনে হয় গিরিরাজ সগর্বে জগন্মাতার মন্দিরটি ধারণ করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন, আর প্রকৃতিদেবী নানাবিধ ফল পুষ্প দ্বারা ভক্তি বিনম্রচিত্তে নিত্য মায়ের পূজা করিয়া ধন্য হইতেছেন। কিন্তু পর্বতটি দুরারোহ। গঙ্গাধর পথভ্রান্ত হইয়া পড়িলেন। কোনক্রমে পাহাড়টি প্রদক্ষিণ করিতে করিতে কোন প্রকারে আরোহন করিতে লাগিলেন। সন্ধ্যার প্রাক্কালে দেবীর মন্দিরে পৌঁছালেন। নির্জন গিরিমন্দিরের মহা নিস্তব্ধতা অনুভব করিয়া তাঁহার মন যে বিমল আনন্দে পরিপূর্ণ হইল তাহা তাঁহার নিজের ভাষায় এইরূপে বর্ণিত হইয়াছে। "এখানে পৌছিলে মনে হয় যেন চরাচর ব্রহ্মাণ্ড অনন্ত মৌনব্রত ধারণ করিয়া রহিয়াছে। উত্তরে অপার ও অগম্য শুভ্র চিরহিমানী হইতে যেন অনন্তজ্যোতি বিকীর্ণ হইয়া জগতকে আলোকিত করিতেছে। না জানি কি মহান সৌন্দর্য রাশির ঘনীভূত মূর্তি এই অনন্তভাবসম্পন্ন চিরহিমানী। এখানে সকলেই মহা নিস্তব্ধ, কাহারও সাড়াশব্দ নাই। মনে হয় যেন সমগ্র জগৎ এক অনন্তের ধ্যানে সমাধিস্থ। আমি হিমালয়ের বিরাট দেহে অনন্তরূপিনী মহামায়ার আবির্ভাব দর্শন করিয়া ধন্য হইলাম"।  চন্দ্রবদনী দেবীর ধ্যানে মহা-আনন্দে দুই রাত্রি কাটাইয়া মাতৃ চরণে পুনরাগমন বাসনা জানাইয়া গঙ্গাধর নামিতে লাগিলেন। কিন্তু পূর্বের মতো এবারও পথহারা হইয়া চুপ করিয়া বসিয়া পড়িলেন। তাঁহার জীবন সংশয় হইল। এই সময়ে তাঁহার মনে হইতে লাগিল 'এ দিব্য দেবীস্থান, যেখানেই থাকি মায়ের কোলে রহিয়াছি'। কিছুক্ষণ পরে 'জয় মা' বলিয়া আপনমনে এক দিকে নামিতে লাগিলেন। প্রায় গড়াইতে গড়াইতে পর্বতের পাদদেশে নিরাপদ সমতলে পৌঁছিয়া দেখেন কৃষকেরা গম পোড়াইয়া খাইতেছে। কৃষকেরা একটি সাধুকে ঐরূপে আসিতে দেখিয়া বিস্ময় বিমুগ্ধ হইয়া বলিল "তুমি কোথা থেকে এলে? এ পথে কেউ কোনদিন আসেনি। নিশ্চয় চন্দ্রবদনী মা হাত ধরে তোমাকে নিয়ে এসেছেন"। এখান থেকে সরকারী পথ ধরে তিনি তার পরে শ্রীনগরে পৌঁছে কেদারনাথ দর্শনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন।

 

আমরা ওখানে গিয়ে যে সময়ে পৌঁছেছি তখন পাহাড়গুলির উপর চারিদিকে কুয়াশার আস্তরণ পড়তে শুরু করেছে যার জন্য পরিষ্কারভাবে শৃঙ্গগুলি দৃষ্টিগোচর হলো না। মন্দির চত্বরের নিচের দোকান থেকে আমরা পূজার সামগ্রী-  মায়ের বস্ত্র, ফুল, নারকেল, মিষ্টান্ন ইত্যাদি কিনে নিয়ে মন্দিরে গেলাম। পূজারী নিষ্ঠা সহকারে পূজা করে দিয়ে প্রসাদী বস্ত্রখণ্ড, নারিকেল আমাদের ফেরত দিলেন। মন্দিরটি কোনকালে নির্মিত হয়েছে কেউ বলতে পারেন না তবে প্রবাদ যে আজ থেকে পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন এই মন্দির। চন্দ্রকূট পাহাড়ের শীর্ষদেশে একখণ্ড জমি সমতল করে বর্তমানের মন্দিরটি শ্বেতমার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। মন্দিরের পৃথক কোন গর্ভগৃহ নেই। যেখানে মায়ের শ্রীযন্ত্র স্থাপিত তার সামনে বসে পূজারী পূজা করেন এবং তার সামনে  গ্রিলের রেলিং দেওয়া আছে। রেলিংয়ের বাইরে দিকে ভক্তেরা বসে পূজার উপকরণ পূজারীর হাতে তুলে দেবার পরে তিনি সেগুলি শ্রীযন্ত্রে স্পর্শ করে পুনরায় ভক্তকে ফেরত দেন। নিস্পৃহ পূজারী, অর্থের প্রতি কোন লোভ নেই। ভক্তেরা  যা দক্ষিণা দেন তিনি সেটি মায়ের কাছে রেখে দেন। দশমহাবিদ্যায় ত্রিপুরাসুন্দরীর স্থান তৃতীয় অর্থাৎ কালী, তারা ও ত্রিপুরাসুন্দরী এই তিনজনের মধ্যে তিনি প্রাচীন। ত্রিপুরসুন্দরীর  যন্ত্রের নাম শ্রীযন্ত্র। সাধককুলের কাছে এই যন্ত্রের সাধনা হল শ্রেষ্ঠ বৈদান্তিক সাধনা। শ্রীযন্ত্রের সাধনার ফলে সাধকের চতুর্বর্গ অর্থাৎ ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ লাভ হয়। আদি শঙ্করাচার্য ত্রিপুরাসুন্দরী মায়ের উপাসক ছিলেন। কেদারনাথ, বদ্রিনাথ যাওয়ার পথে শঙ্করাচার্য দেবপ্রয়াগ থেকে চন্দ্রবদনী মন্দিরে এসে শ্রীযন্ত্রের উপাসনা করেছিলেন। মন্দির প্রাঙ্গণে শিব-পার্বতী, গণেশ, কালী ও হনুমানের পৃথক পৃথক প্রকোষ্ঠে মূর্তি স্থাপিত আছে। মা দুর্গার অন্য একরূপ চন্দ্রবদনী। প্রবাদ দক্ষযজ্ঞে সতীর দেহত্যাগের পরে নারায়ন যখন সতীর মৃতদেহ সুদর্শন চক্র দ্বারা খন্ড খন্ড করে দিয়েছিলেন সেই সময় সতীর শরীরের ধড় এখানে এসে পড়েছিল এবং তাঁর হাতের অস্ত্র গুলি ও এখানে পড়েছিল। চতুর্দিকে অনেকগুলি ত্রিশূল দেখতে পাওয়া যায় যেগুলিকে সতীদেবীর হাতের অস্ত্র বলে জনমত বা প্রবাদ। চন্দ্রবদনী মায়ের মন্দিরে কোনও মূর্তি নেই কিন্তু শিলাখণ্ডের উপরে শ্রীযন্ত্র আছে। চৈত্র মাসে নবরাত্রির সময়ে পূজারী শ্রীযন্ত্রের উপরে হাতবন্ধ অবস্থায় একটি সামিয়ানা বা চন্দ্রাতপ বেঁধে দেন। শ্রীযন্ত্রের চতুর্দিক লাল কাপড়ে ঢাকা, কেবলমাত্র শিলাময়ী মায়ের মুখমণ্ডলটি দেখা যায়। চৈত্র নবরাত্রি, আশ্বিন মাসের নবরাত্রি, বিজয়াদশমী ও দীপাবলীতে এখানে আড়ম্বর সহকারে পূজা হয় এবং সেই সময়ে উত্তরাখণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অসংখ্য ভক্ত এখানে এসে সমবেত হন। দেবপ্রয়াগ থেকে টিহরি যাবার রাস্তায় জামনি খাল পেরিয়ে, অনুরূপভাবে শ্রীনগর থেকে লছমোলিহিসারিয়া খাল পেরিয়ে চন্দ্রবদনী মন্দির যাবার রাস্তা। দুর্গম পথ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই এবং ব্যাপক প্রচার লাভ করেনি, যার জন্য পর্যটকরা এখানে খুব কম সংখ্যায় আসেন। কিন্তু চন্দ্রকূট পাহাড়ের শীর্ষদেশে যেখানে মন্দির সেখান থেকে চারিদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপূর্ব। নিকটবর্তী রেলস্টেশন ঋষিকেশ অথবা দেরাদুন। দেবপ্রয়াগ থেকে বা শ্রীনগর থেকে গাড়িতে করে এখানে আসা যায়, দূরত্ব কম বেশি চল্লিশ কিলোমিটার।

 


উপর থেকে নিচের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে যখন নেমে এলাম ঘড়ির কাঁটা তখন সময় নির্দেশ করছে পৌনে চারটা। এখানে একটি খাবারের দোকানে আটার রুটি ও সবজি খেয়ে ক্ষুধার নিবৃত্তি হলো। সকালে হরিদ্বারের আবাসিক শিবির  থেকে আসার সময় টিফিন করা হয় নি এবং সমস্ত রাস্তাতে খাবার খাওয়ার মতন সেরকম সময় বা সুযোগ হয়নি। বিকেল চারটার সময় এখান থেকে গাড়ি ছেড়ে পাঁচটার সময় গিয়ে পৌছালাম দেবপ্রয়াগের ভাগীরথী ও অলকানন্দার সঙ্গমস্থলে। রাস্তার উপর থেকে দেখা যাচ্ছে বাঁ দিক থেকে ভাগীরথীর নীল জল এবং ডান দিক থেকে অলকানন্দার চন্দন বর্ণের জল এক জায়গায় মিলিত হয়েছে। ইচ্ছে ছিল ভগীরথ শিলা ও দেবপ্রয়াগের মন্দিরগুলি দর্শন করার কিন্তু সময় অভাবে মনের সেই ইচ্ছা পূরণ হলো না। এখান থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় বেরিয়ে পথিমধ্যে দেবপ্রয়াগ থেকে বেরোনোর আধঘন্টা পরে রাস্তায় ধসের জন্য পুনরায় দেরি হল। ঋষিকেশ হয়ে হরিদ্বারে যখন পৌঁছলাম তখন রাত্রি নটা বেজে গেছে। সারাদিনের ভ্রমণজনিত ক্লান্তিতে হরিদ্বারে আবাসিক শিবিরে যখন পৌঁছালাম তখন আমরা শারীরিক দিক দিয়ে পরিশ্রান্ত ও বিধ্বস্ত ।  

 

১১ ই মার্চ শিবরাত্রির দিনে সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত সাধু-সন্ন্যাসীদের স্নানের জন্য ব্রহ্মকুণ্ডে সাধারণের স্নান সরকার থেকে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে।  সকাল ন'টায় আবাসিক শিবির থেকে শিবিরের আবাসিকদের সাথে যেয়ে ব্রহ্মকুণ্ডের বিপরীত তীরে বাঁধানো ঘাটে শিকল ধরে নেমে তিন ডুব দিয়ে শাহীযোগের স্নান করে পুণ্য লাভ করলাম কিনা জানিনা কিন্তু মনের শান্তি হলো। বহুদিনের তীর্থ দর্শনের ইচ্ছে পূরণ হয়েছে।

 

শিবরাত্রির দিন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে দক্ষ প্রজাপতির মন্দির, বীরভদ্রেশ্বর শিব মন্দির, কঙ্খলের গঙ্গা আরতি, সতীর দেহত্যাগের স্থান প্রভৃতি দর্শনের উদ্দেশ্যে গেলাম। প্রত্যেকটি মন্দির ও আশ্রম আলোকমালায় সুসজ্জিত, রাস্তায় খুব ভিড়। এখানে মন্দিরগুলি দেখে সামান্য দূরে আনন্দময়ী মায়ের আশ্রমে সন্ধ্যারতি দেখে আমাদের শিবিরে ফিরে এলাম। পরের দিন বিকেলে রামকৃষ্ণ মিশন, মিশন পরিচালিত হাসপাতাল যা হরিদ্বারে বাঙালি হাসপাতাল নামে পরিচিত এবং মিশনের পাশে হরিহর আশ্রমের রুদ্রাক্ষ বৃক্ষ, পারদ শিবলিঙ্গ দর্শন করার সুযোগ হয়েছিল।

 

১৩ই মার্চ তারিখে হরিদ্বার থেকে রাত্রের ট্রেনে চেপে ১৫ তারিখ সকাল ন'টায় এসে মেদিনীপুরে  পৌছালাম।

 

 

তথ্যসূত্র –

১। Google website -  উইকিপিডিয়া          

২। হিমালয়ের আকর্ষণে - স্বামী অখন্ডানন্দ।   

৩। স্বামী সারদানন্দ চরিত - তপস্যা ও পর্যটন  

গল্প-ভালোবাসার মোড়কে - চন্দ্রাণী গুপ্তা ব্যানার্জী

 

ভালোবাসার মোড়কে

চন্দ্রাণী গুপ্তা ব্যানার্জী

 

Image Courtesy: Google Image Gallery


পুরনো মানিব্যাগটার চেনটা খুলতেই  লীনার চোখ দুটো আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠলো। মানিব্যাগ টা থেকে উঁকি মারছে তিনটে পাঁচশো টাকার নোট। কবে যে নোটগুলো লীনা ব্যাগটায় রেখেছিল, মনে করতে পারল না। খরচ হবার ভয়ে মাঝে মধ্যেই এখানে ওখানে  টাকা রেখে সে ভুলে যায়। তার জন্য সন্দীপের কাছে সে বকুনিও কম খায় না। ভুলো মন বলে লীনার অপবাদ ও আছে। সে যাই হোক, অফিসে যাওয়ার আগে আলমারিটা খুলে ছিল সে। গোলাপি শাড়িটা  ধরে টানতেই তার ভাঁজে রাখা মানিব্যাগটা বেরিয়ে পড়ল। কৌতূহলবশত লীনা ব্যাগের চেইনটা খুলতেই সেই পরম প্রাপ্তি।

 

কত ভাবনা যে মনের মাঝে খেলা করে যাচ্ছে। অফিসের কলিগ রত্নাদি কী সুন্দর একখানা লাল রঙের লিপস্টিক পরে আসে। রত্নাদির থেকে নামটা আর শেড নম্বর টাও জেনে নিয়েছিল আগে। কিন্তু ওটা যে বড্ড দামী। আজ পর্যন্ত আর কেনা হোলো না। প্রায় হাজারের কাছাকাছি ছিল। অনলাইনে একটা সিল্কের শাড়িতে লীনার গত বছর পুজোর সময় চোখ আটকে গেছিল । কিছু টাকা আলাদা করে জমিয়ে ও রেখেছিল। ভেবেছিল কিনবে। কিন্তু হোল আর কই ? অ্যাকোয়া গার্ডের  A.M.C  র জন্য টাকাটা খরচ হয়ে গেল। সেই নীল রঙা শাড়ি টাকে আজো ভুলতে পারে নি লীনা।

 

উফ্... কী ভীড় রে বাবা বাসটায়। কোন রকমে চেপেচুপে বসার সিটটা পেল। কিছুক্ষণের জন্য শান্তি। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে খুলতেই অপাদির হোয়াটসঅ্যাপে  মেসেজ। বেশ কয়েকটা শাড়ির ছবি। অপাদির শাড়ির অনলাইন স্টোর আছে। শাড়িগুলোর ছবি আপনমনে দেখতে দেখতে একটা ছবিতে থমকে দাঁড়ালো লীনা। সেই নীল রঙা শাড়িটার মতো দেখতে একখানা শাড়ি। অনেকটা কাছাকাছি। মনে মনে তো তাকেই খুঁজছে লীনা। দামটাও মোটামুটি আয়ত্তের মধ্যে। এখুনি অর্ডারটা প্লেস করে দেওয়া যায়। আর বাকি টাকাটা দিয়ে লাল শেডের লিপস্টিকটা অফিস ফেরত গড়িয়াহাটে নেমে কিনে নেবে। ভাবছে ভ্যালেন্টাইন্স ডেতে ওই শাড়িটা পরে সন্দীপ আর মেয়ে বিন্নির সাথে একটু এদিক ওদিক ঘুরে ও আসবে।

-"দিদি , ভাড়াটা দিন।"

কন্ডাক্টরের ডাকে হুঁশ  ফিরল লীনার। মানিব্যাগের চেনটা খুলে খুচরো পয়সা বের করতেই হাতে এল একটা ছোট্ট রসিদ।

 

কলিং বেলটা টিপতেই বিন্নি এসে দরজাটা খুলে দিল। মায়ের হাতে দুটো প্যাকেট। বিন্নি প্রতিদিনই আশা করে থাকে মা অফিস ফেরত তার জন্য কিছু না কিছু আনবেই।  বেশীরভাগ সময়ই আশাভঙ্গ হয়। এই টানাটানির সংসারে সব কিছু সামলে লীনার পক্ষে উপরি খরচ করা সম্ভব পর হয় না। কলঘর থেকে জলের শব্দ আসছে। সন্দীপ আজ তাড়াতাড়ি ফিরেছে। অন্যদিন বেশ রাত হয়। হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর মানুষটা বাড়িতে ফেরে। হ্যান্ডব্যাগ আর প্যাকেটগুলো পাশে রেখে লীনা ধপাস করে সোফায় বসে পড়ে। প্যাকেটগুলো কি এখন খুলবে, না সন্দীপ ফ্রেশ হয়ে ফিরলে! চোখটা বুজে এলো। সারাদিনের ক্লান্তির পর।

-ওঠ, চা টা খেয়ে নাও।

কপালে ঠান্ডা হাতের ভালবাসার উষ্ণ প্রলেপ। এক কাপ চা হাতে সন্দীপ দাঁড়িয়ে আছে।

-কিভাবে বুঝলে যে মনটা চা চা করছিল ?

-এত বছর সংসার করে যদি এটা নাই বুঝলাম তো আর কি করলাম।

লীনা চায়ের কাপে চুমুক দিল।

-চা টা তুমি বরাবরই ভালো বানাও।

দুজনেই হেসে উঠলো। বিন্নি দৌড়ে মা-বাবার কাছে এল। প্রতি দিনের মত আজকেও  বলে, “মা, কি এনেছ আজ আমার জন্য ?

লীনা র চোখে লুকোচুরি। একটা প্যাকেট বিন্নির হাতে তুলে দিল। বিন্নি উচ্ছ্বাসের সাথে প্যাকেটটা খুলতেই আনন্দে লাফিয়ে উঠলো।

-মা, এটা তো সেই কালার বক্সটা!

-হ্যাঁ, বিন্নি সোনা, এটা তোমার। তখন কিনে দিতে পারিনি। আজ নিয়ে এলাম । তুমি খুশি তো?

-ভী...ষ...ণ খুশি।‌ কতত... কালারস দ্যাখো।

বিন্নির চোখ আনন্দে ঝিকমিক করে উঠলো। কাগজ নিয়ে তখুনি রং করতে বসে পড়ল।

-এই যে শুনছো, এটা নিয়ে এলাম।

লীনা সন্দীপের হাতে একটা প্যাকেট দেয়।

-কী এটা?"

-তোমার ঘড়িটা। যেটা চলছিল না। বিয়ের সময় বাবা যেটা তোমায় দিয়েছিল। ওটা তো তিনমাস আগে সারাই করতে দিলে। আনা আর হচ্ছিল না। আজ নিয়েই এলাম। নাও,দ্যাখো, ঠিকঠাক চলছে কিনা।

সন্দীপ প্যাকেটটা খুলে ঘড়িটা বের করে হাতে পরল। পুরনো। কিন্তু বহু স্মৃতি এর গায়ে লেপ্টে আছে। বৃদ্ধ শশুর মশাই এর অপত্য স্নেহ ও ভালোবাসা সন্দীপের মুখে হাসির ঝিলিক। বিন্নি খুব মন দিয়ে একটা ছবি আঁকছে।  একটা ছোট্ট বাড়ি, পাহাড়ের গায়ে, রঙ বেরঙের ফুলের বাগান, রঙিন প্রজাপতি, পাখি, মা-বাবা ও‌ সাথে ছোট্ট বিন্নি। লীনা ভাবে এই টুকরো টুকরো ছোট্ট ছোট্ট ভালোবাসার মূহুর্ত গুলোই তো পরম প্রাপ্তি। জীবনে কোন বিশেষ তারিখ ভালবাসার দিবস নয়। প্রতিটি দিন-প্রতি টি মূহুর্তই ভালোবাসার মোড়কে আবৃত।

ফিরুন সূচিপত্রে



| হিম সংখ্যা-১৪২৮| aleekpata.com|
  |ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty|
 Winter , 2021 | August -December 2021 | Fifth Year  Second  Issue |28 th Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |

গল্প-হিমশীতল জলে -তপন তরফদার

 

হিমশীতল জলে

তপন তরফদার

    

Image Courtesy: Google Image Gallery

মানুষ মরে যায় মাটিতে বা আগুনে পুড়ে বাতাসে মিলিয়ে যায়। অনেক জড় বস্তু চুপচাপ থাকলেও  মৃত হয়ে যায়না। কখন যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে কেউ জানেনা। গল্পের যাদুকর আন্ত্যন চেখভ বলেন  প্রতিটি ধূলিকণার গল্পকথন আছে। পাড়ার ওই লাইটপোষ্টটা, বকুল গাছটা, হলুদ-কালো পাড়ার নেড়ি সারমেয়টির ও নিজস্ব কাহিনী আছে, গল্পকথন আছে। আবার গল্পে “টুইষ্ট”ও আছে। যারা জানার ঠিকই জেনে নেয়।তারা লাইটপোষ্টের সঙ্গে গল্পগুজব করে সময় কাটাবার সময় নেই। যারা পাগলামি করে সময় কাটায়, তারাই কালির আঁচড়ে ওদের মর্মকথা বা ব্যথায় ব্যথিত হয়। হিমঘর থেকে তুলে এনে অনুসন্ধান করে, সময়ের অপচয় করে কিনা তা সময়ই বলবে। 

 

        এই মনমর্জিয়া বৃদ্ধাশ্রমে বেশ কয়েক বছর কেয়ারটেকারের কাজ করে মুখ  দেখলেই বলে দিতে পারি, কি ছিলেন, কেন এখানে এসেছেন। ইদানীং কিন্তু  ওই সিনেমায় গল্পে যা দেখায়, বাড়ির লোকজন জঞ্জালের মতো এখানে ফেলে দিয়ে যায় তা কিন্তু সর্ব ক্ষেত্রে সত্যি নয়। ছায়া দস্তিদার নিজের উদ্যোগে ছেলের বিয়ে দিয়ে অষ্টমঙ্গলার দিনে নিজেই চলে আসেন মনমর্জিয়ায়। পুত্রবধু  কাকলি নিজে এসেছিল ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। ছায়াদেবী ফিরে গেলেন না, উপরন্তু  বললেন, বৈদিক যুগে এই বয়সে বানপ্রস্থে যেতে হতো জীবনকে উপভোগ করতে। শিখা ঘোষ দে, কয়েক বছর হলো এখানে এসে সবার ভোল পাল্টে দিয়েছেন। শিখার রুপের বহ্নি শিখা এখনো জ্বালিয়ে দিতে পারে। কিছু মানুষ মানবদেহে কি যন্ত্রপাতি নিয়ে জন্মায়, যার কোনো ক্ষয় হয়না। শিখার শিখা এখনো দীপ্তিমান। বয়স এখানে একটি সংখ্যা মাত্র।

 

শিখাদেবী নিজেরা আনন্দে থাকবেন বলে ছোট-খাটো অনুষ্ঠান, পুজো-পার্বণ শুরু  করলেন। পুরুষ যতোই সিংহ হোক, ওই সুন্দরী ললনার কাছে নেংটি ইঁদুর। শিখার মুখ থেকে শুধু  নির্দেশ নির্গত হওয়ার অপেক্ষায়। ভাগ্যিস ওদের জীবন-সঙ্গিনীরা ধরাধাম ত্যাগ করেছেন, না হলে “মনমর্জিয়া”তে প্রতিদিনই কুরুক্ষেত্র হত। সিনিয়র সিটিজেনরা এখানে যে উদ্যমে উদ্যোগী হয়ে যা কাজ করে তা অনেক যুবা-পুরুষের কান কেটে নেবে।

শিখা দে সরস্বতী পুজোর উদ্যোগ নিয়েছেন। সাফল্যমন্ডিত হয়েছে।  স্কুলের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীর মত সেজেগুজেই অঞ্জলি দিয়ে  পাত পেড়ে পংক্তি ভোজ খেয়েছে। সন্ধ্যায় ভালোবাসার দ্বৈতগান, দ্বৈতআবৃতি, নাটকের সংলাপে জমজমাট অনুষ্ঠান। বাঙালির ভ্যালেনটাইনসডে সরস্বতী পুজার দিন তা প্রমাণ করে দিল।

 

আক্ষেপের বিষয়  ছায়াদেবী যিনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে আনন্দে বানপ্রস্থের জীবন কাটাবেন বলে এসেছেন তিনি কিন্তু নিজের ছায়াবৃত্ত থেকে বেড়িয়ে আসেননা।  মহাজাগতিক সূত্র অনুযায়ী এক আকাশে দুটো সূর্য থাকতে পারেনা। সেই জন্যই কি ছায়াদেবীর এই পদক্ষেপ। ঠিক বুঝতে পারিনি। বুঝলাম প্রতিমার নিরঞ্জনের পরে।

 

এই সময়ে গোধুলিরই দেখা মেলেনা। দুপুরের পরই ঝুপ করে প্রভাকর প্রভা বন্ধ করে দেয়। অন্ধকার করে দেয় ধরিত্রী। সরস্বতীকে ধুনুচি নাচ দেখিয়ে ভাসান দেওয়া হবে। নাচ চলছে তো চলছেই। এত এনার্জি, এত প্রোটিন কোথা থেকে আসছে কে জানে। রাত হলেও অসুবিধা হবেনা। বৃদ্ধাশ্রমেই সুসজ্জিত পুকুর আছে। আবাসিকরা বাতায়ন থেকেই দিঘির সৌন্দর্যের স্বাদ ফুলের ঘ্রাণ, গ্রহণ করে। কনকনে শীতের রাত।প্রতিমা নিয়ে পুকুরে আমাকেই নামতে হবে।

 

প্রদীপ্ত হাজরা পাইলট ছিলেন। সবসময় বিদেশের গল্পগুজবে খই ফুটান। অনেক জানে, অনেক খেয়েছে, অনেক কিছু  করেছে, ভাগ্যের পরিহাস না এটাই নিয়তি যার জন্য এখানে থাকতে হচ্ছে। উনি কথার কলাকৌশলে সুন্দর উপস্থাপনা করেন। সবাই  শোনে। হাজরা স্যার বলতে শুরু  করলেন – “হিমাহিত জলে  জাপানে এক বিরাট উৎসব হয়। যার নাম হাদাকা মাতসুরি বা নগ্ন পুরুষদের উৎসব। স্রেফ একফালি ন্যাকড়ায় যতটুকু না হলে নয়, ততটুকুই লজ্জা নিবারণ করে হাজারো জাপানি পুরুষ এদিন হাড় কাঁপানো  ঠাণ্ডা জলে নামেন। পশ্চিম জাপানের ওকায়ামার সাইদাইজি মন্দিরে হয় এই উৎসব। হাজরা স্যারের গলায়  যাদু আছে। সবাই সন্মোহিত। চোখ বড়োবড়ো করে বলেন মজার কথা কি জানেন?  শিখারানী বলেন, বলুন বেশি রহস্য করবেন না। হাজরা স্যার শুরু করলেন, পুরোহিতের ছোঁড়া লাঠি পাকড়াতে ছোট্ট জলাশয়ের মধ্যে অসংখ্য লোকের হুড়োহুড়ি।

 

এই উৎসব অন্তত ৫০০ বছরের পুরনো। হাজারদশেক মানুষ ধর্মীয় এই অনুষ্ঠান পালন করেন কনকনে হিম জলে স্নান করে। তবে বিষয়টা স্রেফ বরফ জলে স্নান করা নয়। আহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে ষোল আনা। তাই পরনের ন্যাকড়ায় নিজের রক্তের গ্রুপ লিখে জলে লাফাতে হয়। আচমকা আহত হলে যেন  রক্ত নিয়ে গন্ডোগোল হয়না। হাদাকা মাতসুরিতে যোগ দিয়ে পুরো অক্ষত শরীরে বেরিয়ে আসা অসম্ভব। ঠেলাঠেলিতে কপাল ফুলে যাওয়া, হাত পা ছড়ে যাওয়া তো সামান্য ঘটনা। পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুও হয়েছে বহু। কিন্তু দেড় ইঞ্চি ব্যাস আর আট ইঞ্চি লম্বা ওই পবিত্র লাঠিকে কব্জা করতে প্রাণসংশয় হলেও পিছপা নন জাপানিরা। তাঁদের বিশ্বাস, পুরোহিতের ছুঁড়ে দেওয়া ওই লাঠি যে পাকড়াও করবে, তার ভাগ্য খুলে যাবে। অতএব? হাজারদশেক মানুষ জলে ঝাঁপান। আচমকা নিভে যায় আলো, মন্দিরের ওপর থেকে পুরোহিতরা শুরু করেন রহস্যময় মন্ত্রপাঠ। ওপর থেকে ঢেলে দেওয়া হয় হিমশীতল পবিত্র জল আর লাঠি। ভিড়ের চোটে শ্বাসরোধ হয়ে আসা স্বাভাবিক। আকাশ থেকে ছিটকে পড়া লাঠি ধরতে অন্ধকারেই লাফিয়ে ওঠেন অসংখ্য প্রায় নগ্ন মানুষ। শুরু হয় হুড়োহুড়ি। হাতে পেয়েই নিস্তার নেই, একসঙ্গে যুঝতে হবে অসংখ্য প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে, সৌভাগ্যের আশায় সবাই চেষ্টা করছেন লাঠিটি কেড়ে নেওয়ার।প্রাচীন জাপানিরা বিশ্বাস করতেন, যে ওই লাঠি শেষ পর্যন্ত নিজের সঙ্গে রাখতে পারবেন, তাঁর ক্ষেত শস্যে ভরে যাবে। যন্ত্রণা ভুলতে অনেকে নেশা করে যোগ দিতে আসতেন উৎসবে। এখন অবশ্য নেশা  কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখন আর আগের মত শস্যের সম্ভাবনা নিয়ে মানুষ উৎসাহী নন। এবারেই এক যুবক হাতে লাঠি পেয়ে  একগাল হেসে  বলেছেন, ঈশ্বর উপহার পাঠিয়েছেন, এবার নিশ্চয়ই গোলগাল, সুস্থসবল বাচ্চা হবে। ছায়াদেবী কখন ছায়ার মায়ায় মিলিয়ে গেছেন লক্ষ করিনি।

 

শান্তির জল ছিটাবার জন্য মঙ্গলঘটে জল ভরে শিখাদেবীকে দিয়ে, আমি সাঁতার কাটতে থাকি। আবাসিকদের এবার শীত লাগছিল, যে যার ডেরায় ঢুকে পড়েছে। ছায়াদেবী জানলা দিয়ে আমাকে চিৎকার করে বলছেন ঠান্ডায় জলে কেন। উঠে পড়ুন অসুখ হবে। ওনার হাড়হিম আর্তনাদে বুঝতে পারলাম এই ঠান্ডা জলের কোনো ইতিহাস আছে। আমাকে জানতেই হবে, দেরি করলে এই মানসিক অবস্থান পাল্টে যাবে। আমি সিধে উনার ঘরে ঢুকে নাড়ুগোপালের মূর্তি  ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম, কাউকে বলবোনা। আপনি আমাকে বলে মন হালকা করুণ। উনি কিছুতেই বলবেননা। আমিও নাছোড়বান্দা। মুখ খুললেন।

 

“তখন ক্লাস টুয়েলভে পড়ি। আমাদের স্কুলে সরস্বতী ঠাকুর দেখতে এসে অর্নিবান আমাকে ইশারায় বুঝিয়ে দেয় আমার সঙ্গে প্রেম করবে। আমার খুব রাগ হয়। শুনেছিলাম কোনো এক সিনেমায় নায়িকা তার প্রেমার্থীকে বলেছিল, শীতের রাতে সারারাত পুকুরের ঠান্ডা জলে ডুবে থাকলে প্রেমিকা হবে। আমরা থাকতাম বালি দুর্গাপুরের সমবায় পল্লীতে। পল্লীর মাঝখানে ডিম্বাকৃতি এক ঝিল। ঝিলের চারধারে বসতি। অনেক ঘাট, অনেক বাড়ির নিজস্ব ঘাট আছে। সরস্বতী পুজো ওই ঝিলের জলের উপর হয়। লাইট দিয়ে সাজানো হয়। সে এক অপরুপ দৃশ্য। হরিদ্বারের হর কি পৌড়ির থেকেও সুন্দর। মজা করে অর্নিবানকে ফিশফিশ করে বলি সারারাত আমাদের ঘাটের সরস্বতী ঠাকুরের কাছে ডুবে থাকলে আমাকে পাবে।

রাত একটা,আমি জানলা দিয়ে তাকিয়ে ভয় পেয়ে যাই। ইশারায় বলতে থাকি উঠে যাও, বাড়ি যাও। মা বলে এত রাতে জানলায় কেন, শুয়ে পড়। পরদিন শুনতে পাই অর্নিবানের নিউনিমোয়া হয়েছে। ব্যান্ড বাজিয়ে বিসর্জনে বেরুবে। খবর আসলো অর্নিবান মারা গেছে। কাউকেই কিছু  বলতে পারিনি, সারাজীবন চুপচাপ হয়ে  গুমরে মরেছি, আমি প্রেমের লোভ দেখিয়ে হিমায়িত করে খুন করেছি।

ফিরুন সূচিপত্রে



| হিম সংখ্যা-১৪২৮| aleekpata.com|
  |ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty|
 Winter , 2021 | August -December 2021 | Fifth Year  Second  Issue |28 th Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |


Saturday, January 8, 2022

গল্প-কাউন্সেলিং- শম্পা বণিক

 

কাউন্সেলিং

শম্পা বণিক

Image Courtesy: Google Image Gallery
 

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রায়ই আজকাল নিজের সাথে বিরোধ বাধে পারমিতার। জীবনের হিসেবে এত গরমিল মনে হয় কেন তার। বিদ্ধস্ত লাগে। তবে কি তার জীবন দৃষ্টিতে গোড়াতেই ভুল ছিল? অন্যায় ? না বোকামি? আজকাল এমনই প্রশ্ন ঝড়ে আলগা হতে চায় পারমিতার আত্মবিশ্বাসের ভিত । আসলে সে যে সময়ের সাথে চলতে না পারা একজন মানুষ, এটা প্রতি পদক্ষেপে বুঝতে পারে। পৃথিবীর নিরন্তর বেড়ে চলা গতিবেগে ক্লান্ত মনে হয়। “ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু”, এই আকুতি মনজুড়ে। কিন্তু ক্ষমাহীন সংসার উপহাস প্রিয়। উপেক্ষা অসম্মানের সদ্ব্যবহার করেই তৃপ্ত। প্রায় মধ্য পঞ্চাশে এসে এই উপলব্ধি অবসাদ আনে। পারমিতা উত্তর খোঁজে। আগে কিন্তু এসব কথা কোনদিন ভাবেনি সে। নিজেকে বেশ বুদ্ধিমতী মনে হ’ত। সংসারে নিজের গুরুত্ব সম্পর্কে অতিবোধ তাকে তাড়া করে ফিরেছে চিরটাকাল । সবাইকে নিয়ে চলা যায় না এই সত্য বুঝতে বুঝতে পার হয়ে গেছে অনেক মূল্যবান সময়। পান থেকে চুন খসলে সেই মানুষগুলোর আচরণ অচেনা মনে হয়, আঘাত লাগে। তবে পারমিতা পাথেয় সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হলেও সূক্ষ দায়িত্ব পালন আর কর্তব্য বোধ সবসময় তাকে মানসিক তৃপ্তি দিয়েছে শান্তি দিয়েছে। যার কোন তুলনা হয় না। সেই শান্তিগুলো একান্তই তার নিজস্ব সম্পদ। তার মূল্যবোধ তার দুর্বলতা, বোকামি না। একথা জনে জনে বোঝানোর দায় তো তার নয়। সেদিন ছেলে যখন বলল,

_ মা নিজেকে অত গুরুত্বপূর্ণ ভেবো না। যে যা ভালো বোঝে করুক। তোমার কথা তো শুনবে না। নিজে তারপর কেঁদেকেটে প্রেসার বাড়াবে। ওর বাবা বলে,

_পারিস তো বোঝা। আমি তো বলে বলে হাল ছেড়ে দিয়েছি। যেচে অপমানিত হয় প্রতিবার।

 

কী করে বোঝাবে সে এ বয়সে নিজেকে বদলানো যায় না। ভিতরের শিক্ষাকে অস্বীকার করা যায় না। মানবতার সংজ্ঞা প্রতিদিন পাল্টে যাচ্ছে একথা সত্য ,তবু কিছু মানুষ উষালগ্নের মূল্যবোধ কিছুতেই ত্যাগ করতে পারে না । মনে হতেই পারে নির্বোধের অলংকার। বৌমা বোঝায়,

_ তুমি এত ভেবো না মাম্মি। সবাই নিজের ভালো বোঝে। তুমি কাউকে ভালোর জন্য বলতে যাবে সে ভাববে জ্ঞান দিচ্ছ। আর একবার যদি ধরে নেয় তুমি জ্ঞান দিচ্ছ। সে তোমাকে যে ভাবেই হোক অপমান করবে। যুগটাই এমন। আমি জানি বলেই বলছি।

 

পারমিতা বোঝে। বহুবার তার বিশ্বাস ভেঙ্গে চুরমার হয়েছে। আবার জোড়া লাগিয়ে বারবার বেলতলায় যাওয়াটাই তার স্বভাব।

পারমিতার একাকীত্ব সাধ করে বরণ করা। বা ওর অক্ষমতা । সমাজ আমাদের মিলিটারী ক্যাম্প নয় তা বলে নৈতিক চরিত্র এত নেমে যাবে কেন ! হয়তো এই অধঃপতন শুরু হয়েছে অনেক আগেই এখন তার খোলামেলা নির্লজ্জ আত্মপ্রকাশ। মনে কর- একজন বাবা বা মা তাদের সদ্য হাঁটতে শেখা বাচ্চাটার হাত ধরে রাস্তায় হাঁটছে। রাস্তা থেকে ওই শিশুর নাকে উচ্চতা কতটুকু! পারমিতা এগিয়ে গিয়ে বলল,

_ ওকে কোলে নাও । কত দূষিত হাওয়া ওর নাকে ঢুকছে।

_ আপনার কি? খেয়েদেয়ে কি কাজ নেই?

বলা বাহুল্য এখনকার নতুন অভিভাবকরা পারমিতার ছেলের বয়সি। এখন বাড়িতেই বড়রা কিছু বলতে গেলে ছোটদের স্বাধীনতায় হাত পড়ে, আর তো বাইরের লোক। সংবেদনশীল মানুষের অপমান বোধ তীব্র। তবু সে বলে কারণ বাচ্চাটার আসন্ন অসুস্থতা তাকে ভাবায়। সে উদাসীন হতে পারে না। ছেলে বলল,

_ কেন বলতে যাও?

_ কিন্তু বাচ্চাটার কি দোষ বল?

_ তোমার বাচ্চা? ফালতু কথা শুনতে ভালো লাগে ?

 

পারমিতার ছেলে বুবাই তখন ক্লাস টু কি থ্রি তে পড়ে। খুব রোগা ছিল। স্কুলবাসের জন্য দাঁড়িয়ে মায়ের সাথে। সামনের চায়ের দোকানের বয়স্ক ভদ্রলোক দোকানী  এগিয়ে এসে বলল,

_ রোজই একটা কথা বলব মনে করি। খদ্দের এসে যায়।

_ বলুন কি বলবেন?

_ একটা কাঁচের শিশিতে খাটি মধু নিয়ে তার মধ্যে কিছু গোলমরিচ ফেলে রাখবে। কিছুদিন পর থেকে রোজ সকলে ছেলেকে খালি পেটে খাইও। ওর চেহারা ফিরবে। বড্ড রোগা।

_ ঠিক আছে।

 

অভিজ্ঞতাকে সেতো ছোট করতে পারেনি। মনে আছে মধু খেয়ে ছেলের চেহারা না ফিরলেও চট করে ঠান্ডা লাগতো না। পারমিতার কাছে সময়টা অনেক সহজ ছিল।

কেউ হয়ত জরুরি ভিত্তিতে কোন ডাক্তারের ফোন নম্বর চেয়ে নিল। পারমিতা দিল। পরে শুনল ওই ডাক্তারের ব্যবহার খারাপ। ভিজিট বেশি । অকারণে টেস্ট করায়। এই হল রিটার্ন গিফট। এতে ওর দোষ টা কোথায়!

 

আজও এমন ঘটনা ঘটে। তবে এখন ওর কাছে অনেককিছুই প্রত্যাশিত। কয়েকবছর আগের কথা, পাড়ার এক শয্যাশায়ী বৃদ্ধা মাসিমাকে দেখতে গিয়ে ওনার ছেলের বউটাকে বলল,

_ মাসিমার হাতে পায়ে একটু বোরোলিন লাগিয়ে দিতে বলো আয়াকে।

পাশের ঘর থেকে ছেলে বেরিয়ে এসে বলল,

_ মাকে ভাবছি এবার পার্লারে নিয়ে যাব। সারা পাড়ায় মায়ের এত হিতাকাঙ্খী জানা ছিল না।

পারমিতা আর কথা বলতে পারেনি। জীবন্মৃত মানুষটার গায়ে একবার হাত বুলিয়ে চলে এসেছিল।

পারমিতার মনে হয় অথর্ব মানুষদের অবসর ভাতার আইন পরিবর্তন দরকার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর অপব্যবহার হয়। ওর বর বলল,

_ ঠিক হয়েছে। বলতে গেছে কেন, ওদের মা ওরা বুঝবে।

_ যা বুঝছে দেখে এলাম তো।

 

পারমিতার মায়ের শিক্ষা ছিল ডাক্তারবাবুদের ঠিকানা সবসময় হাতের কাছে রাখবে। তাই ওর মোবাইলে অনেক ডাক্তারের নম্বর সেভ করা। একবার কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আলাপ হয়েছিল তারই সমবয়সী হবে একজন মহিলার সাথে। শাশুড়ি মা কে নিয়ে এসেছে তলপেটের ইউ.এস.জি করাতে। সত্তরোর্ধ বৃদ্ধা। খুব ব্লিডিং হচ্ছিল। বৃদ্ধার ছেলে কাপড়ের দোকানে কাজ করে। ছুটি পায়নি। ছেলের বউটা মনমরা হয়ে বসে। জানে না এরপর কি করবে কাকে দেখাবে। ডাক্তার সন্দেহ করছে জরায়ু ক্যান্সার। পারমিতা ওকে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ আর  অঙ্কোলজিস্ট এর নম্বর দিয়ে বলল,  এনাদের সাথে দেখা করবেন । আপনার অসুবিধা হবে না । নিজের মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ার পর থেকে এই নম্বরগুলো ওর কাছে সেভ করা। সাধারণ অসুখ বিসুখ করলে সহজেই কোন ডাক্তার দেখিয়ে নিই আমরা। কিন্তু এইসব অসুখ দিশেহারা হয়ে পড়ে মানুষ। পারমিতার সে অভিজ্ঞতা আছে। ভদ্রমহিলা ওর দুহাত ধরে কেঁদে পড়েছিল। পারমিতা ভাবে এটুকু তো করা যেতেই পারে। বিনিময়ে মন যে শান্তি টুকু পায়, তা দুর্লভ। এ তার মনের পরম পাওয়া প্রতিক্রিয়া যাই ই হোক। একবার প্রায় মধ্যরাতে এক আত্মীয়ের ফোন এল,

_ বৌদি, বাবাকে এক্ষুনি কোথাও ভর্তি করতে হবে। কথা জড়িয়ে গেছে । মনে হয় স্ট্রোক।

ভদ্রলোককে সেই রাতেই ভর্তি করা হল, কাছেরি এক নার্সিংহোমে । সে যাত্রায় মানুষটা বেঁচে ফিরলো । এবার পারমিতার রিটার্ন গিফট ,

_বৌদি। আর কদিন বাবাকে রাখতে হলে আমাদের তো পথে বসতে হোত। নার্সিংহোম না কসাইখানা! যাই হোক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। কৈ এর তেলেই কিন্তু কৈ ভেজেছে। অথচ হাবভাব দেখলে মাথা গরম হয়ে যায়।

কথায় আছে স্বভাব যায় না ম'লেও। উপকারের গুঁতো কখনো দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসে। যার ফল ভোগ করতে হয় বর কে ছেলে কে। আজকাল সে অনেক মেপে মেপে চলে। ঘর সংসার আত্মীয় বন্ধু এই নিয়েই তো জীবন বয়ে চলে। অসুস্থ মনে হয় নিজেকে পারমিতার। অসুখ যেন তার রক্তসংবহণে।

কিন্তু ও এমন কেন খুঁজতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে অনেকগুলো বছর। একটা আট দশ বছরের মেয়ের উপর ভার তার ছোট ছোট ভাইবোনের। মা অসুস্থ তাই । সেই মেয়ে দিদি নয় মায়ের মতো করে আগলে রাখত। দায়িত্ববোধের জন্ম সেই থেকে। যতদিন গেছে তা আরও বেড়েছে। স্বভাব বা অভ্যাস বশতঃ  শ্বশুরবাড়িতেও প্রথম থেকেই দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে জড়িয়ে পড়েছে। সময়ের স্পর্শে সবাই আজ নিজের নিজের মতো সাজিয়েছে জীবন। পারমিতার প্রয়োজন ফুরিয়েছে কালের নিয়ম মেনে। কিন্তু কষ্ট সেখানে কেউ আঙুল তুললে অন্য কেউ বলে না,

_দিদিতো এমন নয়। বা,

_বৌদি একথা বলতেই পারে না। বা,

_পারমিতা এ কাজ করতে পারে না

উল্টে আঙুল গুলো দলবদ্ধ হয় জীবনের উৎসবে। পারমিতাই দোষী। সময় কোথায় যেন থেমে আছে তার।

পারিবারিক ডাক্তারবাবু ওর বরকে বলল,

_ কোথাও ঘুরে আসুন। ভালো কাউকে দিয়ে কাউন্সেলিং করানো দরকার। আমি ওষুধ দেবো না। তাতে উনি স্লো হয়ে যাবেন। উনি যে লেখালেখি করেন সেটা বন্ধ হয়ে যাবে।

পারমিতার কিছু ভালো লাগে না। সবসময় দোলাচল মনের মধ্যে। ঠিক হল হাওয়া বদল করতে যাওয়া হবে দক্ষিণভারত । পারমিতার প্রিয় গন্তব্য । প্রায় কুড়ি বাইশ দিন বেড়ানো শেষে এবার বাড়ি ফেরা। যশোবন্তপুর স্টেশন । দুরন্ত দেয়নি এখনও। পারমিতারা চারজন ওয়েটিং রুমে বসে। বছর পাঁচেকের ছোট্ট মেয়েটি ছুটে বেড়াচ্ছে। ওর মা বসে পারমিতার পাশে। বাবাটা একটু দূরে দাঁড়িয়ে কারো সাথে কথা বলছে। ওরাও দুরন্ত এক্সপ্রেস ধরবে। ওদের বাড়ি শিলিগুড়িতে। ব্যাঙ্গালোরে এসেছে ট্রিটমেন্ট করতে। ভদ্রলোকের ব্রেন টিউমার অপারেশন হয়েছে। ডাক্তার বলেছে রেডিওথেরাপি করতে হবে । একমাস হোটেলে থেকে টাকাপয়সা শেষ। ভদ্রলোকের দিদি থাকে ব্যান্ডেলে। এখন সেখানেই উঠবে। তারপর কোথায় কিভাবে পরের চিকিৎসা হবে পুরোটাই অনিশ্চিত। তবে ডাক্তার বলে দিয়েছেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রেডিয়েশন শুরু করে দিতে । পারমিতার বৌমা পাশেই বসে শুনছিল ভদ্রমহিলার কথাগুলো। বলল ,

_আপনাদের কত নম্বর কম্পার্টমেন্ট?

_ বি২

_আমাদেরও । ট্রেনে উঠে কথা হবে।

 

দুরন্ত তে ওঠা মাত্র এটা সেটা খাবার দেওয়া শুরু হয়ে যায়। লাঞ্চের পর পারমিতা জানালায় বসে বাইরে তাকিয়ে। কিছুটা আনমনা। বৌমার ডাকে ঘুরে তাকাল। সাথে ওই ওয়েটিং রুমের ভদ্রমহিলা-

_ মাম্মি আমি বলেছি তুমি নিশ্চয়ই হেল্প করবে।পারমিতা তাকিয়ে বৌমার দিকে।

_ বলে দাও কোলকাতায় গিয়ে কোথায় কিভাবে কি করতে হবে।

পারমিতা যেন জানালায় বসে এ কথাই ভাবছিল। তখনই প্রয়োজনীয় ঠিকানা ফোন নম্বর দিয়ে কিভাবে যেতে হবে সব বুঝিয়ে দিল। মনটা অনেক হালকা লাগছে। সন্ধ্যার দিকে ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা দুজনেই এল । বলল

_ ডাক্তারের সাথে কথা হয়েছে। আগামী পরশু থেকেই রেডিওথেরাপি শুরু করা যাবে। কেস হিস্ট্রি ফোনে যতটা সম্ভব বলেছি। বললেন কোন ভয় নেই । দিদি কাল গিয়ে টাকা জমা দিয়ে আসবে । ধন্যবাদ না অন্তরের কৃতজ্ঞতা রেখে গেলাম।

 

ওরা চলে গেলে পারমিতা আবার জানলায় চোখ রেখে বসে রইল । সে যেন অনেক দূর থেকে বাড়ি ফিরছে আজ। মনে আসছে কান্ত কবির লেখা প্রিয় লাইন-

"প্রভু, বিশ্ব -বিপদহন্তা ,

তুমি দাঁড়াও ,রুধিয়া পন্থা ;

তব, শ্রী চরণ তলে নিয়ে এস, মোর

মত-বাসনা গুছায়ে !

মলিন মর্ম মুছায়ে"

ফিরুন সূচিপত্রে



| হিম সংখ্যা-১৪২৮| aleekpata.com|
  |ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty|
 Winter , 2021 | August -December 2021 | Fifth Year  Second  Issue |28 th Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |

Main Menu Bar



অলীকপাতার শারদ সংখ্যা ১৪২৯ প্রকাশিত, পড়তে ক্লিক করুন "Current Issue" ট্যাব টিতে , সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

Signature Video



অলীকপাতার সংখ্যা পড়ার জন্য ক্লিক করুন 'Current Issue' Tab এ, পুরাতন সংখ্যা পড়ার জন্য 'লাইব্রেরী' ট্যাব ক্লিক করুন। লেখা পাঠান aleekpata@gmail.com এই ঠিকানায়, অকারণেও প্রশ্ন করতে পারেন responsealeekpata@gmail.com এই ঠিকানায় অথবা আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।

অলীক পাতায় লেখা পাঠান