পরিযায়ী
বনবীথি পাত্র
|
Image Courtesy: Google Image Courtesy |
অন্যদিনের মতই আজও
ভোরবেলাতেই ঘুম ভেঙে যায় ময়ূরীর । দরজার ফাঁক দিয়ে হালকা আলোর রেখা জানান দিচ্ছে
নতুন সকালের । তবু কিছুক্ষণ আলসেমী করে পড়ে থাকে বিছানায় , উঠে তো আর এখানে সংসারের কাজকর্ম কিছু নেই । দিব্যেন্দু
এমনিতেই বেলায় ওঠে , আজ তো কথাই নেই । গতরাতের পার্টির রেশটুকু কেটে ঘুম ভাঙতে আজ আরো বেলা হবে ।
ময়ূরী পছন্দ করে না জেনেও দিব্যেন্দু মদ খায় । ওর ভাষায় , বন্ধুবান্ধবদের সাথে পার্টি নাকি দুপেগ রঙীন তরল ছাড়া জমে
না । আর রঙীন তরল পেটে পড়লেই দিব্যেন্দুর ভালোবাসাও যেন বেড়ে যায় । ময়ূরীর ঐ গন্ধে
গা ঘিনঘিন করে , বমি
পায় । নিজেকে প্রাণপণ দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেও শেষপর্যন্ত ধরা দিতে হয়
দিব্যেন্দুর কাছে । দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে ভালোবাসার অত্যাচার । ভালোবাসার
অত্যাচার না কি অত্যাচারের ভালোবাসা !
কাল বিকালেই ওরা পৌঁছেছে এই বনবাংলোতে । দিব্যেন্দুরা পাঁচবন্ধু আর
তাদের স্ত্রীরা , মোট দশজন । বাংলোতে ঘরগুলো আগে থেকেই বুক করা ছিল । একটু ফ্রেশ হয়ে চা জলখাবার
খেয়েই পাঁচবন্ধুতে বোতল খুলে বসে পড়েছিল । কেয়ারটেকার রামদীন আর ওর বৌ ওদের
রান্নার দায়িত্ব নিয়েছে , কাল রাতে ডিমের ঝোল আর রুটি করেছিল । কিন্তু ওরা পাঁচ বৌই যা একটু খেয়েছে , নেশার ঘোরে ওরা ভালো করে খেতে অবধি পারেনি । বন্য পরিবেশে
তরলের পরিমাণটা কাল বোধহয় একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল দিব্যেন্দুর । আর তারসাথেই রাত
বাড়ার পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল দিব্যেন্দুর ভালোবাসা । বাংলোর ঘরের কম পাওয়ারের
বাল্বের লালচে আলোয় আস্তে আস্তে ক্ষয়ে গিয়েছিল ময়ূরী । দিব্যেন্দু বুনো জানোয়ারের
মতো করে ভালোবেসেছে ময়ূরীকে । চোখ বুজে সবটুকু সহ্য করেছে ময়ূরী । ওর চোখের কোণে
গড়িয়ে পড়া জলের রেখাটুকু নজরেও পড়ে না দিব্যেন্দুর । ক্লান্ত দিব্যেন্দু ঘুমিয়ে
পড়লেও ঘুম আসে না ময়ূরীর । কখন যে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতেও পারেনি ।
ঘুমন্ত দিব্যেন্দুর হাতটা গায়ের
ওপর থেকে সরিয়ে উঠে পড়ে ময়ূরী । গায়ের কম্বলটা
ভালো করে টেনে দেয় দিব্যেন্দুর গায়ে । জানুয়ারীর প্রথমদিক , এমনিতেই জমাটি ঠান্ডা এখন । কলকাতার তুলনায় ডুয়ার্সে
ঠান্ডাটা বেশ বেশি । রাতপোষাকের ওপর বাদামী কার্ডিগানটা পড়ে নেয় ময়ূরী ।
ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হালকা চিরুণী বুলিয়ে নেয় । ওপর ঠোঁটটাতে এখনো
গতরাতের ভালোবাসার দাগ । ব্যাগের ভেতর থেকে শালটা বের করে মাথা দিয়ে জড়িয়ে নেয় ।
ঘরের দরজাটা খুলে বাইরের ছোট্ট বারান্দাটায় এসে দাঁড়ায় ।
জঙ্গলের মাঝে বড় বড় গাছের ফাঁকে
বাংলোগুলো । কাঠ আর বাঁশ দিয়ে দিয়ে তৈরি ঘরগুলো , দেওয়ালে শীতলপাটির অপূর্ব কারুকাজ । ঘরগুলোতে কারেন্টের
ব্যবস্থাও আছে । দশবারো ফুট উঁচু ঘরগুলোতে উঠতে হয় বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে । গাছের গভীরতা
ভেদ করে দিনের আলো এখনো এসে পৌঁছায়নি বাংলোর বারান্দায় । তবু ফাঁকফোকর দিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া আকাশের টুকরো দেখা যাচ্ছে
। যেদিকে চোখ যাচ্ছে , শুধু সবুজ আর সবুজ । অদ্ভুত একটা শান্তি আসছে মনটায় , গতরাতের ক্লান্তি যেন মুছে যাচ্ছে একটু একটু করে । অসংখ্য
পাখির ডাক ভেসে আসছে জঙ্গলের গভীর থেকে । একঝাঁক টিয়া ঝটপট করে উড়ে গেল সামনে দিয়ে
। মনটা অকারণেই খুশি হয়ে যাচ্ছে যেন । বাংলোর নীচে একটা পাহাড়ি বৌ আঁচের উনান
ধরিয়েছে ,
ধোঁয়াটা উঠে আসছে উপরে । ময়ূরীর মনে পড়ে ছোটবেলায় ওদের
বাড়িতেও এমন উনান জ্বালিয়েই রান্না করতো মা । বৌ টা সামনের ফাঁকা জায়গাটা ঝাঁট
দিচ্ছে ,
আর একটা বাচ্চাছেলে খালি খালি ওর কাপড়ের আঁচলটা টেনে ধরছে । নিশ্চয়ই মায়ের কোলে চাপার
ইচ্ছা । রামদীন এসে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেয় । তার মানে এরা
রামদীনের পরিবার । ময়ূরীর বেশ সুখী সুখী লাগে পরিবার টাকে ।
গুডমর্নিং মেডাম !
গুডমর্নিং... রামদীনকে
হালকা হেসে উত্তর দেয় ময়ূরী ।
চা দিব মেডাম ?
না না আর কেউ ওঠেনি , একটু পরে দিও ।
আচ্ছা রামদীন এতো পাখির
ডাক শোনা যাচ্ছে , পাখিদের দেখা যাবে না ?
জরুর যাবে মেডাম । থোড়ি দূর মে এক ঝিল আছে , উহা বহুত সারে পাখি আসে এই ঠান্ডি মৌসমমে । বাঙ্গালাতে
আপনারা কি যেনো বোলেন হাঁ হাঁ মনে পড়চে , পরিযায়ী পাখি ।
রাতের অস্বস্তিটুকু ধুয়ে
ফেলতে স্নান করাটা খুব দরকার । কিন্তু যা ঠান্ডা , বাথরুমে কি গরম জলের ব্যবস্থা আছে কে জানে !
রামদীন বাথরুমে গরম জল
পাওয়া যাবে গো ?
হাঁ মেডাম টোয়েন্টি
ফোর আওয়ার গরম পানি আছে টোলেটে ।
ঘরে ঢুকে শাল সোয়েটার
খুলে বাথরুমে ঢোকে ময়ূরী । ঠান্ডাগরম জলটা অ্যাডজাস্ট করে শাওয়ার খুলে দেয় । জলের ধারায় ধুয়ে যাচ্ছে
গতরাতের আদর-ভালোবাসা-অত্যাচার । এক একদিন
দিব্যেন্দু কেন যে এমন নিষ্ঠুর আচরণ করে বুঝতে পারেনা ময়ূরী । অথচ দিব্যেন্দু
অন্যসময় যথেষ্ট ভালোমানুষ , কেয়ারিং হাসবেন্ড । কিন্তু ঐ পাশবিক ভালোবাসার পর আবার
দিব্যেন্দুর সাথে সহজ হতে কষ্ট হয় ময়ূরীর , অভিমানে গলা বন্ধ হয়ে আসে ।
স্নান সেরে হলুদ আর বেগুনি রঙের
জংলাপ্রিন্ট পিওরসিল্ক শাড়িটা পড়ে ময়ূরী । রেডি হতে হতেই দেখে ঘুম ভেঙেছে বাবুর ।
বিছানায় বসেই কম্বলমুড়ি দিয়ে বসে দিনের প্রথম সিগারেটে টান দিচ্ছে । কতবার বারণ
করেছে বদ্ধ ঘরে সিগারেট না খেতে , কে কার কথা শোনে । প্রতিবাদ করার ইচ্ছাটুকুও নেই ময়ূরীর , নিজে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয় চুপ করে । একটু পরেই রামদীন
হাজির চা আর স্যান্ডউইচ নিয়ে । দিব্যেন্দু একেবারে চুপচাপ , হয়তো কাল রাতের ব্যবহারের জন্য অনুতপ্ত । তবে এমন অনুতপ্ত
আগেও বহুবার হয়েছে , কিন্তু আবার যা কার সেই । তাই আর অকারণ নাটক দেখার মুড নেই ময়ূরীর , চায়ের কাপটা নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় । সবাই উঠে পড়েছে
এতক্ষণে ,
এত সকালে ওর স্নান হয়ে গেছে দেখে সবাই অবাক । দিব্যেন্দুও
চটপট ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নেয় ।
চাপমারি ওয়াচটাওয়ারে
যাওয়ার প্ল্যান ছিল ওদের আজ , কিন্তু রামদীনের কাছে জানতে পারে প্রতি বৃহস্পতিবার টাওয়ার
বন্ধ থাকে । অগত্যা কোথায় যাবে ভাবার আগে রামদীনই বলে সেই ঝিলটার কথা , যেখানে গেলে নাকি অনেক পাখি দেখা যাবে এইসময় । এককথায় সবাই
রাজি ,
কিন্তু জন্তুজানোয়ারের ভয় আছে কিনা জেনে নেয় রামদীনের কাছে
। দিনের বেলায় তেমন কোন ভয় নেই জেনেই হাঁটতে শুরু করে ওরা । বড় বড় গাছের ফাঁক দিয়ে
পায়ে চলা সরু পথ । হালকা রোদের আঁকিবুকি পথের উপর । জঙ্গলের কেমন একটা যেন আদিম
গন্ধ আছে , মনটায়
কেমন যেন একটা মাদকতা তৈরি হয় সেই গন্ধটায় । অচেনা বুনো পথ , স্বামীস্ত্রী জুটিগুলো স্বভাবতই একটু কাছাকাছি । শুধু
দিব্যেন্দুকে এড়িয়ে চলতে গিয়ে ময়ূরীই একটু
পিছিয়ে পড়েছে । সায়ন্তনীটার মুখে কিচ্ছু আটকায় না , ওইই বলে , " কি হলো দিব্যেন্দুদা বৌ অত দূরে দূরে কেন ? রাতে ভালো করে আদর করেননি নিশ্চই , সেইজন্য অভিমান । আমরা একটু এগিয়ে যাই , আপনি বরঞ্চ রাতের অসমাপ্ত কাজটা সেরে ফেলুন । এই জঙ্গলে কেউ
দেখতে আসবে না ।"
সায়ন্তনীর কথায় সবাই
হেসে ওঠে হা হা করে , দিব্যেন্দুও হাসিতে যোগ দেয় । লজ্জা পেয়ে যায় ময়ূরী । দিব্যেন্দুকে বিশ্বাস
নেই ,
একটু জোরে পা চালিয়ে এগিয়ে এসে সবাইকে ধরে ফেলে । রামদীনের
কথামতো আর একটু এগিয়ে বাঁদিকে বেঁকতেই ঝিলটা ।
ছোট্ট একটা ঝিল , খুব বেশি জল নেই সেখানে । চারপাশের গাছগুলোতে অসংখ্য পাখির
মেলা । লাল,নীল, সাদা, কালো, ধূসর, বেগুনি কতরকমের নামনাজানা পাখি । কলকাকলিতে মুখরিত চারদিক । সেই ভোরবেলা
থেকে এই পাখিগুলোর ডাকই শুনতে পাচ্ছিল ময়ূরী ।
অরিন্দম আর শাশ্বত ক্যামেরা নিয়ে পাখিদের ফটো তুলতে ব্যস্ত । বাকিরা গাছের
ফাঁকফোকর দিয়ে আরো পাখি খুঁজছে , শিস দিয়ে পাখিদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে । দিব্যেন্দু
ঝিলের ধারে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে আনমনে । গতরাতের কষ্টটা এখনো কুচি কুচি বরফের
মতো আর্দ্র করে রেখেছে ময়ূরীকে , কিছুতেই যেন সবার সাথে স্বাভাবিক হতে পারছে না ।
একটা গাছের তলায় বসে পড়ে ময়ূরী , ঝরে পড়া শুকনো পাতাগুলোয় হাত বুলায় অকারণে । ওদের শহরতলি
ছাড়িয়ে একটা দীঘি ছিল , শীতকালে ওখানেও অনেক পাখি আসত । একবার গানের মাস্টারমশাই সবাইকে নিয়ে ঐ ঝিলের
ধারে পিকনিক করতে গিয়েছিলেন । সারাদিন খুব মজা হয়েছিল । খাওয়াদাওয়া , গানবাজনা , ক্রিকেট খেলা , পাখিদেখা । সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফেরার আগে নির্মাল্য একটা
ছোট্ট এত্তটুকু পাখির ছানা কুড়িয়ে পেয়েছিল একটা গাছতলায় । দুহাতের তালুতে
পাখিরছানাটাকে নিয়ে ছুটে এসেছিল স্যারের কাছে , বলেছিল ওকে আমি পুষব স্যার , আমি বড় করবো ওকে ।
ধুর ঐটুকু বাচ্চাটাকে
কতো যত্নে রাখতে হবে জানিস ?
জানিস উষ্ণতা দরকার একে বাঁচানোর জন্য ?
শীতের দেশ থেকে ওরা
আমাদের দেশে উড়ে আসে শুধু উষ্ণতার খোঁজে । যদি উষ্ণতাটুকু না পায় ওরা উড়ে যাবে
অনেক দূরে । ভালোবাসাও তেমনি , অন্তরের উষ্ণতাটুকু দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় , নাহলে কখন যে দূরে চলে যায় বোঝাও যায় না ।
কে একজন পিছন থেকে বলে , ঐ শীতের দেশ থেকে উড়ে আসা পাখিদের কি বলে স্যার ?
পরিযায়ী পাখি ।
ময়ূরী তখন ক্লাস সেভেন , প্রথম শুনেছিল পরিযায়ী কথাটা ।
সেই রাতে শুয়ে ছোড়দি
ঠাকুমার কান এড়িয়ে চুপিচুপি বলেছিল ,স্যার তখন ঐ ভালোবাসার কথাগুলো কাকে শুনিয়ে বলছিল বল্ তো ?
কাকে আবার আমাদের সবাইকে
।
ছোড়দি মাথায় আলতো একটা
চাটি মেরে বলেছিল , তুই দেখছি বাচ্চাই থেকে গেলি । আমাদের সবাইকে না , স্যার কথাগুলো বলছিল মহুয়াদিকে । স্যার মহুয়াদিকে ভালোবাসে
তাও জানিস না !
আজ অনেক বছর বাদে
কথাগুলো হঠাৎ মনে পড়ে ময়ূরীর । অন্তরের উষ্ণতাটুকু না দিলে ভালোবাসা দূরে চলে যায় ?
অবসন্নতা টুকু ঝেড়ে উঠে
পড়ে ময়ূরী । এগিয়ে গিয়ে দিব্যেন্দুর একটা হাত জড়িয়ে ধরে আপন করে । এইটুকুর জন্যই
হয়ত অপেক্ষা করছিল দিব্যেন্দু । দুহাত দিয়ে কাছে টেনে নেয় ময়ূরীকে । পরিযায়ী
পাখিদের সাথে ওরাও ভালোবাসার উষ্ণতাটুকু ভাগ করে নেয় দুজনে ।
| Aleekpatamagazine.blogspot.in |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
|ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |
| Winter Issue,2010 | November-January, 2020 |
| Third Year Fourth Issue |21st Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |