নিশীথ বাবুর গাড়ি
রবিবারের সকালটায় একটু
তাড়াতাড়িই ঘুম ভাঙ্গল নিশীথ বাবুর। নভেম্বর মাস, চারিদিকে একটা শীতের আমেজ। বিশেষ
করে ভোরের দিকে ত বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। গায়ের চাদরটা মুড়িয়ে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে
বসলেন নিশীথ বাবু। মনটা আজ তার বেজায় খুশি। আজ তার নতুন গাড়ির ডেলিভারী দেওয়ার কথা। মাস দেড়েক আগে উনি একটা সুইফ্ট ডিজায়ার
গাড়ি বুক করেছিলেন। তখন মারুতি কোম্পানি বলেছিল যে ডেলিভারী পেতে প্রায় তিন মাস
লাগবে। গতকাল সন্ধ্যা নাগাদ হঠাৎ মারুতির এজেন্সি থেকে ফোন- “আপনার গাড়ি এসে গেছে।
কাল রবিবার এসে গাড়ি নিয়ে যান।” ফোনটা রিসিভ করেও বিশ্বাস হচ্ছিল না ওনার। নতুন
গাড়ি- ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। অবশেষে স্বপ্নপূরণ হল ওনার। মনে পড়ে গেল প্রায়
বছর চারেক আগের কথা। গাড়ি কেনার স্বপ্ন তার তখন থেকেই। কিন্তু বড় ছেলে অজয় তখন সবে
বারো ক্লাস পাশ করে JEE তে ভাল র্যাঙ্ক করে IIT খড়গপুরে অ্যাডমিশন নেবে, সামনে অনেক খরচ, তাই ইচ্ছা
থাকলেও সে ইচ্ছা দমন করেন নিশীথ বাবু। ছেলেটা আগে ভালভাবে মানুষ হোক, গাড়ি পরে হবে
খন। আজ অজয় ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফাইনাল ইয়ারে। কলেজ ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ তে দুটো ভাল
বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে গেছে। এবার শুধু কোর্স শেষ করে জয়েনিংয়ের অপেক্ষা।
অনেক কষ্ট করে নিজে বড় হয়েছেন নিশীথ বাবু। চাকরি
করতে করতে পড়াশোনা করেছেন। চিরকাল নিজে সাইকেলে চেপেই অফিস করেছেন। কোনদিন গাড়ি
কিনতে পারবেন ভাবেন নি। সংসারের সমস্ত সঞ্চয়ের সিংহ ভাগ উনি ছেলেকে মানুষ করতে লাগিয়ে
দিয়েছেন। অবশেষে ভাগ্যদেবী প্রসন্ন হয়েছেন। ছেলে প্রায় দাঁড়িয়ে গেছে, ওনার জীবনেও
স্বচ্ছলতা এসেছে। একরকম ছেলের আবদারেই গাড়ির অর্ডার দেন তিনি। তিনি নিজে গাড়ি
চালাতে জানেন না। কিন্তু অজয় আজকালকার ছেলে। সে বলেছে, “কোন চিন্তা কোরো না বাবা, তুমি
আর মা পেছনের সীটে আরাম করে বসবে, আমি গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাব।” নিজে গরজ করে মোটর
ড্রাইভিংয়ের স্কুলে ভর্তি হয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই গাড়ি চালানো শিখে নিয়েছে সে। আজ
সেই গাড়ির ডেলিভারী নিতে যাবেন তিনি।
সকাল
দশটা নাগাদ স্ত্রী মালতি ও ছেলে অজয় কে নিয়ে মারুতির শো রুমে এসে উপস্থিত হলেন
নিশীথ বাবু। শোরুমের পাশের ওয়ার্কশপে তাদের নতুন গাড়ি ঝেড়ে পুছে তৈরি করে রাখা
আছে। অ্যাক্সেসারিজ্ কি কি নেওয়া হবে তা দেখে নিচ্ছে অজয়। তার উৎসাহ সবথেকে বেশী।
গাড়ির ভেতরে বসে গাড়ির বিভিন্ন ফিচার তাড়াতাড়ি বুঝে নিচ্ছে সে। গাড়ি সে আজ নিজেই
চালিয়ে নিয়ে যাবে, তাই একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে অজয়ের মধ্যে। নতুন গাড়ি
চালানোর মজাই যে আলাদা।
শোরুমের
ম্যানেজার মিঃ প্রধান করমর্দন করে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন নিশীথ বাবুকে। একটা বড়
ফুলের বুকে তুলে দিলেন মালতির হাতে। নিশিথ বাবু ও মালতি একসাথে কেক কাটলেন, সবাই
হাততালি দিয়ে উঠল। ক্যামেরায় ছবি উঠল। এবার
আনুষ্ঠানিক ভাবে গাড়ির চাবি মিঃ প্রধান নিশীথ বাবুর হাতে তুলে দিলেন। সঙ্গে দিলেন
গাড়ির ইনভয়েস্, ইনসিওরেন্স, ম্যানুয়াল ইত্যাদি কাগজপত্র। ইনভয়সে বড় বড় হরফে লেখা “নিশীথ রায়”। হ্যাঁ
সত্যি তাহলে গাড়ি কেনা হচ্ছে- কেমন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছেন নিশীথ বাবু। ছেলে অজয়
উচ্ছসিত। সে তো গাড়ির ড্রাইভারের সীট্ ছেড়ে নামছেই না। এবার যাবার সময় উপস্থিত হল।
-অনেক ধন্যবাদ এত তাড়াতাড়ি গাড়ি ডেলিভারী দেওয়ার
জন্য। আপনারা তো প্রথমে তিন মাস বলেছিলেন। মাত্র দেড় মাসে কি করে দিলেন- জিজ্ঞেস
করলেন নিশীথ বাবু।
-আসলে আপনার গাড়িটা এখনও আসেনি, এটা একটা ক্যানসেল্ড
অর্ডার এর জায়গায়.....শোরুমের তরুণ অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার মিঃ বক্সী আরও কিছু
বলতে যাচ্ছিলেন, তাকে হঠাৎ থামিয়ে মিঃ প্রধান বললেন, “আমরা চাই কাস্টমাররা যেন সব
সময় খুশী থাকে। ভাল জিনিসের সঙ্গে আমরা সব সময় চেষ্টা করি ভাল সার্ভিস দিতে। আমি
পার্সোনালি চেজ্ করে আপনার গাড়িটা আনিয়েছি।”
কেমন একটা খটকা লাগল নিশীথ বাবুর।
-উনি কি একটা ক্যানসেল্ড অর্ডার এর কথা বলছিলেন?
-না না আসলে হয়েছে কি, এই গাড়িটা আপনার আগে আরেক জনকে
ডেলিভারী দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মূহুর্তে উনি অর্ডার ক্যানসেল করেন । যেহেতু
আপনার গাড়ির মডেল আর রং একদম একই ছিল, তাই এটা আপনাকে দিয়ে দেওয়া হল- রুমাল দিয়ে
মুখ মুছলেন মিঃ প্রধান।
-ও, কিন্তু অর্ডার ক্যানসেল করলেন কেন? অবাক হলেন
নিশীথ বাবু।
-বাবা, এটা আমি চালিয়ে নিয়ে যাব, আনন্দে আবদার করে
উঠল অজয়।
-না বাবা, আজ থাক। নতুন গাড়ি, অনেকটা পথ যেতে হবে। আজ
এনাদের কোন ড্রাইভার যদি পৌছে দেয় তো ভাল হয়। একটু হাত পাকিয়ে নাও তার পরে চালিও।
তুমিই তো চালাবে এরপর, আমি তো আর চালাতে পারিনা। মিঃ প্রধান, বুঝতেই পারছেন, নতুন
গাড়ি, আমাদের হাত কারও খুব একটা পাকা নয়। যদি আপনাদের শোরুমের কোনো ড্রাইভার আজ
গাড়িটা আমাদের বাড়ি অব্দি পৌঁছে দেয়।
-শিয়োর স্যার, উইথ প্লেজার। আব্দুল, আমাদের ড্রাইভার
পৌঁছে দেবে। এটা আমাদের কাস্টমার সার্ভিসের মধ্যেই পরে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
মাঝবয়েসী আব্দুল এসে উপস্থিত। হাসি হাসি মুখে গাড়ির
চাবি নিয়ে ড্রাইভারের সীটে বসল সে। অজয় তার পাশে। পেছনের সীটে নিশীথ বাবু ও মালতি।
অভ্যস্ত কায়দায় আব্দুল গাড়ি চালিয়ে চলেছে। নিশীথ বাবু
হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন,
-এই গাড়িটা কি আগে অন্য কারও নামে এসেছিল?
-কেন বলুন ত?
-মিঃ প্রধান যে বললেন এটা নাকি একটা ক্যানসেল্ড
অর্ডার এর জায়গায় আমাকে দেওয়া হচ্ছে, তাই এত তাড়াতাড়ি ডেলিভারী পেলাম?
আব্দুলের হাসি মুখে সহসা কালো ছায়া নেমে এল।
-আর বলবেন না স্যার, একটা খুব খারাপ ব্যাপার।
-কি হয়েছে, নিশীথ বাবু ও মালতি উদ্গ্রীব হয়ে উঠল।
-এই গাড়িটা আসলে প্রিয়তোষ মুখার্জী বলে এক ভদ্রলকের
জন্য ডেলিভারী করা হয়েছিল। পাঁচদিন আগে গাড়িটা আমাদের শোরুমে আসে। আমি নিজেই ত
এটাকে ট্রাক থেকে নামিয়ে শোরুমে চালিয়ে ঢোকাই। ধুয়ে মুছে সাফ করি। তিন দিন আগে মিঃ
মুখার্জীর আসার কথা ছিল।
-তারপর?
-তারপর আর কি? উনি ওই দিন গাড়ি নিতে আসছিলেন আমাদের
শোরুমে। বাসে আসছিলেন বোধহয়। ঠিক আমাদের শোরুমের সামনেই রাস্তা পার হতে গিয়ে বাসের
তলায় চাপা পড়েন। বোধহয় মোবাইল এ কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হচ্ছিলেন, অন্যমনষ্ক ছিলেন। চারিদিকে
হইচই ব্যাপার। আমরাই ওনাকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যাই। হাসপাতালে একবার জ্ঞান
এসেছিল, গাড়িটার কথা কোনমতে একবার জানতে চান, ব্যস তারপর সব শেষ। বাঁচানো যায়নি।
খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। খবর পেয়ে ওনার স্ত্রী আমাদের শোরুমে আসেন। ওনারা বোধহয়
নিঃসন্তান ছিলেন। ওনার স্ত্রী বললেন যে তিনি ওই অপয়া গাড়ি আর নেবেন না। নিয়েই বা
কি করবেন, চালাবে কে? তাই অর্ডার ক্যান্সেল করে দেন। আপনার যেহেতু একই গাড়ি আর একই
রং, তাই আপনাকে এটা দিয়ে দেওয়া হল। গাড়িটা খুবই ভাল স্যার। অপয়া মোটেই নয়। এটা নিছকই
একটা দুর্ঘটনা মাত্র।
যথা
সময়ে গাড়ি পৌঁছে গেলো নিশীথ বাবুর বাড়ি। আব্দুল বিদায় নিতেই অজয়ের আর তর সইছিল না।
গাড়ি স্টার্ট করে চারপাশে এক পাক ঘুরে এল।
-দারুন গাড়ি বাবা, ভীষণ স্মুথ্ গিয়ার, আর কি পিক্-আপ্!
অল্প অ্যাক্সিলারেটর চাপলেই গাড়ির স্পীড হু হু করে বাড়ছে, ব্রেকও খুব স্ট্রং। একটু
চাপলেই গাড়ি একেবারে ডেড্ স্টপ- গাড়ির বিভিন্ন গুনগান করতে লাগল অজয়। শেষে
গ্যারেজে ঢুকিয়ে ঘরে ফিরল। কিন্তু নিশীথ বাবুর মুখ ভার। গাড়িটা নেওয়া কি ঠিক হল?
“অপয়া” কথাটা বার বার ওনার মনের মধ্যে ঘুরতে লাগল।
রাতে
খাওয়া দাওয়া সেরে সাড়ে দশটার মধ্যে উনি শুয়ে পরেন। অজয় রাত অবধি পড়াশোনা করে।
প্রায় রাত বারোটা নাগাদ শুতে যাবার আগে অজয়ের মনে হল, নতুন গাড়িটাকে একবার
গ্যারেজে দেখে আসি। নতুন গাড়িটার প্রতি তার উত্তেজনা যে সবচেয়ে বেশি। গ্যারেজের
দরজা বন্ধ। আশেপাশে সবাই শুয়ে পরেছে, চারিদিক অন্ধকার। কিন্তু গ্যারেজের দরজার
ফাঁক দিয়ে কিসের আলো দেখা যাচ্ছে? গাড়ির লাইট জ্বলছে নাকি? সর্বনাশ, গাড়ি ঢোকানোর
সময়ে হেডলাইট নিভাতে ভুলে গেছে নাকি সে? ব্যাটারি ডাউন হয়ে যাবে যে। তাড়াতাড়ি দরজা
খুলে লাইট বন্ধ করে অজয়। ইস্ ছি ছি, এতটা অমনোযোগী হল কি করে সে? ভাগ্যিস্ দেখতে
এসেছিল সে, তা না হলে ত সারা রাত গাড়ির লাইট জ্বলত। নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিল না
অজয়।
পরের
দিন সন্ধ্যাবেলা কলেজ থেকে ফিরে বাবা মা কে সঙ্গে নিয়ে অজয় গাড়ি করে ঘুরতে গেল।
নতুন গাড়িতে সারা পাড়ায় ঘুরে শেষে আরও দূরে বেশ খানিকটা পথ ঘুরে প্রায় আধ ঘণ্টা পর
ওরা বাড়ি ফিরল। মন খুব খুশি সবার। খুব আরামদায়ক গাড়ি। শেষে গাড়ি গ্যারেজে ঢুকিয়ে
বেড়োনোর সময় ভাল করে চেক করল যাতে লাইট সে না জ্বালিয়ে রাখে। তারপর গ্যারেজ বন্ধ
করে ঘরে ঢুকল।
আজ
পড়তে পড়তে অজয়ের অনেক রাত হল। কলেজের একটা প্রজেক্টের কাজ করার ছিল। রাত প্রায়
একটা। বাবা মা অনেক আগেই শুয়ে পড়েছে। শুতে যাবার আগে আবার তার গাড়ি দেখার একটা
অদম্য আগ্রহ জাগল। গ্যারাজের দরজার কাছে পৌছে অবাক অজয়। ভেতরে আবার আলো জ্বলছে! এ
কি করে সম্ভব? সে নিজে দশ বার করে চেক করেছে গাড়ি পার্ক করার সময়, সব লাইট সে নিজে
হাতে বন্ধ করেছে। তাহলে.....বাবা কি এসেছিল? বাবা কি ভুল করে.....? না না, বাবা
এলে আমাকে নিয়ে আসত। তাড়াতাড়ি আবার সব লাইট বন্ধ করে গেল বাবাকে জিজ্ঞেস
করতে। মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে ছেলের প্রশ্ন শুনে নিশীথ বাবু অবাক। “আমি ত গাড়ি হাতই
দিই না। তুই ই ত চালাস। ভেবে দেখ, ঠিক মতন লাইট বন্ধ করেছিলিস তো?”
-হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত।
-আচ্ছা এমন কোনো সিস্টেম নেই ত যে নিজে নিজে কোন ভাবে
লাইট অন্ধকারে জ্বলে উঠছে-মানে মডার্ন গাড়ি ত তাই জিজ্ঞাসা করছি?
-উফ্ বাবা, এমন কোনো সিস্টেম হয় না। বরঞ্চ উল্টোটা
তাও হয়। ওটাকে বলে ‘ফলো মে হেড লাইট’- অর্থাৎ ইঞ্জিন বন্ধ করলেও আলো খানিকক্ষণ
জ্বলতে থাকে। পড়ে নিজে নিজেই নিভে যায়।
-তাহলে? একবার শোরুমে ফোন করে দেখ এটা কি নর্মাল, না
আমরা কোন ভুল করছি? ম্যানুয়ালটা ভাল করে পড়ে দেখ।
কোনো সমাধান পাওয়া গেল না এ সমস্যার।
পরের দিন বিকেলে আবার সবাই মিলে বেড়াতে বেরল গাড়ি
করে। ফিরে এসে গাড়ি গ্যারেজে পার্ক করার সময় এবার বাবা আর ছেলে দুজনেই মনের
সন্তুষ্টি করলেন যে আজ কোনো লাইট জ্বলছে না। অজয় এক ঘণ্টা পরে এসে আবার দেখে গেল,
না আজ আর হেডলাইট জ্বলছে না। নিশ্চিন্ত মনে পড়তে বসল সে। রাত প্রায় বারোটা। আজ
নিশীথ বাবু নিজেই উঠলেন।
-বাবা, এত রাতে তুমি আবার উঠলে কেন?
-একবার গাড়িটা দেখে আসি।
অজয় হেসে বলল, “আজ সব ঠিক আছে, আমি কয়েক ঘণ্টা আগে সব
দেখে এসেছি।
-তাও একবার দেখে আসি।
গ্যারেজের দিকে গুটি গুটি অগ্রসর হলেন নিশীথ বাবু।
শীতের রাত, বাইরে বেশ ঠান্ডা। গ্যারেজের কাছে আসতেই নিশীথ বাবুর কান খাঁড়া হয়ে
গেল। চারিদিক নিস্তব্ধ, কিন্তু কোথা থেকে একটা হাল্কা গুর্ গুর্ শব্দ আসছে। গ্যারেজের
দরজার ফাঁক দিয়ে চোখ পড়তেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন তিনি। ভেতরে স্পষ্ট দেখলেন গাড়ির
হেডলাইট জ্বলছে, আর তার সঙ্গে গাড়ির ইঞ্জিনও চলছে। কেউ যেন গাড়ি স্টার্ট করে রেখে
দিয়েছে। শীতের রাতেও ঘামতে শুরু করলেন নিশীথ বাবু। হাত পা কাঁপছে তার।
-এ গাড়ি অপয়া, এ গাড়ি অপয়া- দৌড়ে ঘরে ফিরে হাঁফাতে
লাগলেন তিনি। চোখ মুখ তার ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
-বাবা অজয় এ গাড়ি অপয়া, এ গাড়ি রাখব না আমি।
-বাবা, কি হয়েছে, তুমি এরকম করছ কেন?
বাবার কাছে সব শুনে অজয় অবাক।
-কি বলছ এটা হতেই পারে না। আমি নিজে সব চেক করে
এসেছি। দাঁড়াও, আমি দেখে আসছি।
-না বাবা, যাস না। ও বড় ভয়ংকর গাড়ি, যাস না বাবা। যা
হয় হোক, আলো জ্বলে জ্বলুক, ইঞ্জিন চলে চলুক।
অজয় জোর করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে গ্যারাজের
উদ্দ্যেশ্যে। গ্যারেজের দরজার কাছে এসে দেখে, কই না, কোনো আওয়াজ নেই, কোন আলো
জ্বলছে না ভেতরে। দরজা খুলে গাড়ির কাছে গিয়ে ভাল করে পরীক্ষা করল সে। না সব ঠিকই
আছে। সবই ত বন্ধ- যেমন সে ছেড়ে গিয়েছিল। বাবা কি তবে ভুল দেখল? নিশ্চই তাই। ঘুমের
ঘোরে উঠে এসে কি দেখতে কি দেখেছে কে জানে। ফিরে এসে নিশীথ বাবুকে জানাতে, তিনি
খানিকটা ধাতস্থ হলেন। ছেলে যখন বলছে তখন হয়ত ঘুমের ঘোরে সত্যিই উনি ভুল দেখে
থাকবেন। হাজার হলেও বয়স হচ্ছে ত। সে রাতে বাবা ও ছেলে কেউই ভাল করে ঘুমোতে পারল না।
পরের দিন সন্ধ্যাবেলা আবার ওদের
বেড়নোর কথা। নিশীথ বাবু আজ নিজে আগে এসেছেন গ্যারাজের দরজা খুলবেন বলে। ভয়ে ভয়ে
দরজা খুললেন। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, গ্যারেজের ভেতরটা একটু অন্ধকার মতন। নাঃ, আজ গাড়ি
ত ঠিকই আছে, তাহলে গতকাল রাতে উনি হয়ত ভুলই দেখেছিলেন। আশ্বস্ত হলেন তিনি।
গ্যারেজের দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালেন তিনি। অজয় এখুনি এসে গাড়ি বার করবে। হঠাৎ
গ্যারেজের স্তব্ধতা ভেঙে গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট হল। গাড়ির হেডলাইট জ্বলে উঠল।
গ্যারেজের সামনের দেওয়ালে লাইটের খানিকটা প্রতিফলিত হয়ে গ্যারেজের ভেতরটা অনেকটাই
আলোকিত হয়ে উঠল। সেই আলোতে নিশীথবাবু পরিষ্কার দেখলেন কে যেন ড্রাইভারের সীটে বসে
আছে। ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল নিশীথ বাবুর। গ্যারেজের ভেতরে ধীরে ধীরে ঢুকে এলেন
তিনি গাড়ির ঠিক পেছনে।
-কে, কে ভেতরে? কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন
তিনি। কোন উত্তর নেই।
হঠাৎ গাড়ির রিভার্সিং লাইট জ্বলে উঠল। তাহলে কি গাড়ি
এবার পেছবে? গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ বদল হওয়াতে নিশীথ বাবু পরিষ্কার বুঝলেন
অ্যাক্সিলেটরে চাপ দেওয়া হচ্ছে, অর্থাৎ গাড়ি এবার সত্যিই পেছবে। কিন্তু উনি যে
একদম গাড়ির পেছনেই দাঁড়িয়ে। না সরে গেলে সমূহ বিপদ। নিশীথ বাবু পরিষ্কার দেখলেন
আধো অন্ধকারে ড্রাইভার এবার পেছেনে ফিরে তাকিয়েছে। কে ও? ভয়ংকর মুখ, সারা মুখে
রক্ত মাখা। চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরচ্ছে। পারলে নিশীথ বাবুকে গাড়ির চাকার তলায়
পিষে ফেলে আরকি। হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে গাড়ির সামনের চাকা পেছনে ঘুড়তে লাগল, চাকা
দিয়ে ধোঁয়া বেরতে শুরু করল, অর্থাৎ গাড়ি এবার ভীষণ গতিতে পেছবে। এইবার প্রচন্ড
গতিতে গাড়ি পেছতে শুরু করল। নিশীথ বাবু প্রাণপণে গাড়ির পেছন থেকে সরে যাবার চেষ্টা
করলেন। কিন্তু জায়গা বড় সংকীর্ণ, পারলেন না। পেছতে গিয়ে প্রচন্ড জোরে মাথায় আঘাত
পেলেন গ্যারেজের লোহার দরজায়। জ্ঞান হারালেন তিনি।
জ্ঞান ফিরল হাসপাতালের বিছানায়।
পাশে স্ত্রী মালতি আর ছেলে অজয় বসে।
-কেমন বোধ করছো, বাবা?
-ও বড় ভয়ংকর গাড়ি বাবা। ও আমাদের শেষ করে দেবে। আমাকে
প্রায় পিষে ফেলেছিল আরকি। ঘটনার বিবরণ দিয়ে কেঁদে ফেললেন নিশীথ বাবু।
-কিন্তু বাবা, গাড়ি ত গ্যারেজে ঠিকই ছিল। কেউ ত ছিলনা
গাড়িতে, আর গাড়ি পিছিয়েও যায়নি। যেখানে ছিল সেখানেই আছে।
-ওরে ও গাড়ির মালিক অন্য কেউ, আমরা নিয়ে এসেছি।
আমাদের সহ্য হবে না। ও গাড়ি তুই বেচে দে বাবা, তা না হলে আমরা শেষ হয়ে যাব।
নতুন
গাড়ি বেচে দিয়েছিলেন নিশিথ বাবু। পাড়াপড়শি জিজ্ঞাসা করল, “নতুন গাড়ি এত সখ করে
কিনলেন, বেচলেন কেন?”
নিশীথ বাবুর সহজ উত্তর, “ছেলে চাকরি নিয়ে মুম্বাই চলে
যাচ্ছে সামনের মাসে। ওখানেই হয়ত সেটল করে যাবে। আমরাও পরে ওখানে ওর কাছে চলে যাব
ঠিক করেছি। এখানে আর গাড়ি রেখে করব কি? চালাবে কে? তাই বেচে দিলাম। আর একটা
মুম্বাইতে কিনে নেব খন।”
চিত্রঋণঃ www.Google.com
চিত্রঋণঃ www.Google.com