কালো বাঁশ
(১)
রাত্রি প্রায় সোয়া দশটা,ঝম ঝমে বৃষ্টিতে সামনের পিচের রাস্তার মাত্র কয়েক ফুট দূর অব্দি দেখা যাচ্ছে,হেলমেটের সামনের কাঁচটা বার বার আবছা হয়ে আসছে-
কিন্ত, কিছু করার নেই, রবীন নিরুপায়, কারণ তাকে যে আজ রাত্রের মধ্যেই যে করেই হোক ত্রিশ কিলোমিটার দুরের রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছতেই হবে, মা অসুস্থ......,
নানা ভাবনার মধ্যেই রবীন খেয়াল করলো যে সামনের রাস্তাটা হঠাৎ একটা দ্বিধাবিভক্ত মোড়ে এসে শেষ হ’ল, ডান দিকে গেলে স্টেশন আর প্রায় পঁচিশ কিলোমিটারের রাস্তা, রাস্তা ভাল,মাঝে মধ্যে জনবসতিও আছে, বাম দিকের রাস্তাটি বেশ ছোট,স্টেশন প্রায় দশ কিলোমিটার, কিন্তু একেবারে ফাঁকা , মাঝে পড়বে কালবনির শাল জঙ্গল, এমনিতে কোনও ভয় নেই , তবে ঝড়- বৃষ্টির দাপটে এক আধটা গাছ হয়ত পড়ে থাকলেও থাকতে পারে, তবে, রবীন শুনেছে যে শাল গাছ খুব শক্ত হয়, সহজে ভাঙেনা, সেটা নিয়ে নয়, তার চিন্তা একটা অন্য কারনে......
এখানে সে এসেছিল বন্ধুর বাড়িতে, উচ্যমাধ্যমিকের পর ছুটি কাটাতে, বন্ধু শুভেন্দু ও তার পরিবার সবাই মিলে তার ভীষন যত্ন করেছে, গ্রামের বাড়ী, কিন্তু স্বচ্ছল পরিবারের সমস্ত চিহ্ন বিদ্যমান, এই গ্রামে এখনও শহুরে রাজ নীতির ঘোলা জল ঢোকেনি, ফলে গ্রামের সকলের মধ্যে সৌহার্দ্য বজায় আছে, পুকুরে প্রচুর মাছ, গাছে গাছে আম, কাঁঠাল, লিচু- এক্কেবারে স্বর্গরাজ্য। রবীনের বেশ ভালো লাগছিলো , কিন্তু , একটা ব্যাপার মানতে প্রথম প্রথম তার বেশ কষ্ট হচ্ছিল, সেটা হ’ল যে গ্রামের সবাই, এমন কি শুভেন্দুরা, যারা কিনা উচ্চ শিক্ষিত, বাড়িতে নিয়মিত পত্র পত্রিকা আসে, টেলিভিশন, ল্যাপটপ, মায় আন্ড্রয়েড মোবাইল পর্যন্ত ব্যবহার করে , তারা সবাই এখনও অলৌকিক ব্যাপারে ভীষণ বিশ্বাস করে।
ওদের সবার মধ্যে একটাই আতঙ্কের জায়গা, সেটা হ’ল কালবনির জঙ্গল ও তার মধ্যের নীল কুঠি, ওদের বিশ্বাস যে সেখানে নাকি এখনও অলৌকিক কাণ্ডকারখানা ঘটে। তাই, গ্রাম থেকে মাত্র পাঁচ –ছয় কিলোমিটার দূরের ওই জঙ্গলে পারত পক্ষে কেউই যায়না।
বিজ্ঞানের ছাত্র রবীন ভুত-প্রেতে কিছুটা কম বিশ্বাস করে, তাই সপ্তাহ খানেকের রাজকীয় সেবাতে ,তার মাথার মধ্যে থেকে ভয় , ভাবনা সব হাওয়া হয়ে গিয়েছিল।
আজ বিকালে হঠাৎ ফোন, তার মায়ের ভীষণ অসুখ, তাকে আজই যে করে হোক বাড়ী ফিরতেই হ’বে। কিন্তু এখন তো তাকে শীঘ্রই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতেই হবে, “ডান” দিক ? না “বাম” দিক? কারন বৃষ্টি থামার কোনই লক্ষণ নেই, এদিকে রাত একটা দশের ট্রেনটা ধরা ভীষণ জরুরী, তবেই সে কাল ভোর নাগাদ বাড়ি পৌঁছতে পারবে, কে জানে মা কেমন আছেন?.................................
(২)
এই পর্যন্ত পড়ে বিমল বাবু থামলেন,
সামনের টেবিলে রাখা ঢাকনা দেওয়া গেলাস থেকে জল নিয়ে একটু গলাটা ভিজিয়ে নিলেন, তারপর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলেন ওপারে বসা, রাশভারি ভদ্রলোকের দিকে, ভদ্রলোক পাক্ষিক “ কালো বাঁশ” পত্রিকার সম্পাদক, পত্রিকার এই রকম অদ্ভুত নাম করণের কারণ জানতে চেয়েছিলেন বিমল বাবু তার একান্ত অনুগত ভক্ত শ্রীমান বটুক সরখেলের কাছ থেকে, বটুক ওই পত্রিকায় ডি.টি.পির কাজ করে, বিমল বাবুর পাড়াতেই থাকে, অকৃতদার, রিটায়ার্ড সরকারি চাকুরে বিমল বাবু একটু আধটু লেখা লিখি করতে ভালো বাসেন, তাঁর লেখা তিনি পাঠান বিভিন্ন অন লাইন পত্র পত্রিকায় বা তার নিজের ‘ ফেস বুক ওয়ালে’ পোষ্ট করেন , বেশ লাইক আর কমেন্ট পান, কিন্তু তাতে তাঁর মন ভরেনা, তিনি ছাপার অক্ষরে নিজের নামটা দেখতে চান, তাই পত্রিকা অফিসে কাজ করে শুনে তিনি বটুকের সাথে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলেন, বটুকও মাঝে মাঝে চা এবং সাথে ‘টা’ এর লোভে বিমল বাবুর বাড়ীতে হানা দেয়।
তা, একদিন সুযোগ বুঝে বিমল বাবু বটুকের কাছে টুক করে কথাটা পেড়েই ফেললেন।
-“ বাবা বটুক তুমি তো পত্রিকা অফিসে কাজ করো তাই না ?”
উত্তরে বটুক একমুঠো ডালমুট মুখে চালান করে বলল
-“কালো বাঁশ”।
উত্তর শুনে আবলুশ কালো ক্ষীণকায় বিমল বাবু থতিয়ে গেলেন, ভাবলেন
-“আমাকে কালো বাঁশ বলল?”
তাঁর মুখের করুণ অবস্থা বুঝে বটুক মুখের ডালমুট গুলো ম্যানেজ করে বলল,
-“কিছু মনে করবেন না মেসোমশাই , ওটা আমাদের পত্রিকার নাম”
-“ওহ্ তাই”, হাঁফ ছাড়লেন বিমল বাবু।
বটুক বলে চলল,
-“ আমাদের পত্রিকার সম্পাদক নিত্যনতুন গড়গড়ি মশাই ভীষণ এলেমদার লোক, সাহিত্যের সমঝদার, তিনি বলেন যে ‘আমাদের পত্রিকায় এমন লেখা ছাপাব যে সব ব্যাটা কে একেবারে বাঁশ দিয়ে ছাড়ব”
-“ বাঁশ বুঝলাম কিন্তু কালো কেন?”, বিমল বাবুর জিজ্ঞাসা,
-“ কারণ লাল, সবুজ, গেরুয়া, সমস্ত রঙ গুলোরই কপি রাইট নেওয়া হয়ে গেছে, তাই ‘কালো’
–“ আর তা ছাড়া এই নামটির মধ্যে একটি গভীর শ্লেষ আছে, ঠিক জায়গায় লাগলে একেবারে বাঁশের বাড়ির মতোই লাগবে”, বটুকের মুখে একটি কালজাম অদৃশ্য হয়ে গেলো।
বিমল বাবু একটু দমে গেলেন, ভাবলেন -“ এই রকম প্রগতি শীল পত্রিকায় কি তাঁর মতো সাধারণ অনামি লেখকের লেখা ছাপাবে?”
বটুক আস্বস্ত করল, বলল,
-“ভয় নেই মেসোমশাই, আমাদের সম্পাদক মশাই নিজে আধুনিক কবিতা লেখেন এবং অরিজিন্যাল লেখা খোঁজেন, ভালো হ’লে অবিশ্যি ছাপবেন”,
-“আর তা ছাড়া ওঁনার পরিবারের সঙ্গে আমার একটু ইয়ে আছে”, বলে বটুক তার পান খাওয়া ক্ষয়াটে দাঁত দেখিয়ে হাসল।
-“ইয়ে?” বিমল বাবুর অধীর জিজ্ঞাসা।
-“বৌদি, মানে নিত্যনতুন গড়গড়ি মশাইএর বউ এর সমস্ত ফাই ফরমাশ তো আমিই খাটি,
চাকরির যা বাজার, কোনোও ক্রমে স্কুল ফাইন্যাল টা পাশ দিতেই বাবা চোখ ওলটালেন, আর আমাদের গনেশও ওলটাল, ডি.টি.পি. টা শিখে চাকরি করছি”,
-“বুঝলেন তো?”
বিমল বাবু সব বুঝেছেন।
(৩)
সেই মতো আজ ১০ই চৈত্র তিনি “কালো বাঁশ” পত্রিকার দফতরে সম্পাদক মশাই কে তাঁর গল্পটা পড়ে শোনাচ্ছিলেন, মনে হয় ওঁর ভালোই লাগছিলো, কিন্তু একটা ব্যাপারে খটকা হচ্ছিল বিমল বাবুর, সেটা হ’ল যে তাঁর রোমহর্ষণ কারী রহস্য গল্পের মধ্যে হাসির খোরাক কথায় পেলেন জানেন না কিন্তু চোখ বুঁজে গল্প শুনতে শুনতে নিত্যনতুন গড়গড়ি মশাই তাঁর জালার মত’ শরীর টা দুলিয়ে দুলিয়ে মৃদুমন্দ হাসছিলেন।
বিমল বাবু নিজেকে বোঝালেন ,
-“ এলেমদার আধুনিক কবি, গভীর চিন্তায় মগ্ন, হয়ত বা তাঁর ব্রেনটাই দুভাগে ভাগ হয়ে এক সাথে দুই রকম কাজ করছে, একটা অফিসে বসে যশপ্রাথী নবীন লেখকের লেখা গল্প শুনছে, আর অন্য পাশটা হয়ত কাউকে বাঁশ দেওয়া টাইপ কোন আধুনিক কবিতার পঙতি ভাবছে, বাবাঃ, কি প্রতিভা”।
কিন্তু সন্দেহ যায়না, তাই সন্দেহ নিরসন করতে বিমল বাবু গল্প পড়া থামালেন, ওই সেই যেখানে রবীনের সামনে দুটো রাস্তা খোলা।
-“বাঃ, বেড়ে হয়েছে”, ঢাকাই জালার ভেতর থেকে গমগমে আওয়াজ বেরোল, “ থামলেন কেন? চালিয়ে যান !”
বিমল বাবু খুশি হয়ে বাকিটা পড়তে যাবেন , এমন সময় গড়গড়ি বাবু হাত তুলে ওনাকে থামালেন,
-“গল্পটা অরিজিন্যাল তো?”
-“নিশ্চয়ই”
-“আর কে কে শুনেছে?”
-“কেউ না, কেবল মাত্র বটুক, আর আপনি এই অর্ধেক টা।”
-“যাক, তাহ’লে ওটা রেখে যান”, বাঁজ খাঁই গলায় বললেন সম্পাদক।
-“ওটা আমি নিজে পরে পড়ে নেব’খন ” পানের ডিবে থেকে মুখে একটি বিশাল পান ফেলে বললেন,
-“তবে কি জানেন ময়ায় ? লেখাটা খুবই শিশু সুলভ, ওতে সামান্য ঘষা মাজা করতে হ’বে, সে আমি করে নেব’ খন, ইয়োর স্টোরি হ্যাজ বিন সিলেক্টেড, আপনি এখন আসতে পারেন”।
(৪)
আজ ১লা বৈশাখ, আজই তো কালো বাঁশ পত্রিকার নববর্ষ সংখ্যার প্রকাশের দিন,
উত্তেজনায় বিমল বাবুর ঘুম হয়নি গত রাত্রে, স্বল্পে সন্তুষ্ট বিমল বাবু সংসার করেন নি বলে কোনও ঝক্কি ঝামেলা বা টেনশন পোহানোর অভিজ্ঞতা তেমন নেই বললেই চলে,
তাঁর নিস্তরঙ্গ জীবনে এত ঢেউ উঠবে তিনি কি কখনও ভেবে ছিলেন? মনে হয় না।
প্রথম বার ছাপার অক্ষরে তাঁর নাম শুধু নয় , মায় একটা আস্ত লেখা ছাপতে চলেছে, তাও আবার “ কালো বাঁশ” এর মতো স্বনামধন্য পত্রিকায়,
উফফ্, গায়ে কাঁটা, আর চোখে লঙ্কাবাটা।
নামের বানান টা যেন আবার ঠিক ঠাক ছাপে, বটুক কে তিনি পই পই করে সাবধান করে দিয়েছেন,
-“ বাবা বটুক, তুমিই ভরসা, দেখো ডি.টি.পি.তে কম্পোজ করার সময় আমার নামের বানান টা যেন ঠিক থাকে,”
(৫)
সেই মতো মোড়ের দোকানের ‘জলভরা’, ‘রাবণের মাথার সাইজের রসগোল্লা’, ‘সিঙ্গাড়া’, আর বটুকের প্রিয় ডালমুট, সব কিছু সকাল হতেই তিনি তাঁর কাজের লোকের হাতে আনিয়ে সাজিয়ে একেবারে প্রস্তুত।
ঠিক সাড়ে নটা, “রিইইইইইইং করে ডোর বেলটা বেজে উঠল, যেন বেল নয় কোনও মহান ঘটনা ঘটার আগের শঙ্খনাদ, আঃ, ডোর বেল টা এত মধুর কোনও দিন শোনায় নি।
দরজা খুলতেই বটুক হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকল,
-“ এই নিন মেসোমশাই”,
বলে এক খানা পাকানো “কালো বাঁশ” বিমল বাবুর হাতে গুঁজে দিয়েই, খাবার প্লেটে ঝাঁপিয়ে পড়ে “ রাবণ বধে” মন দিল।
-“চৌত্রিশ নম্বর পাতাটা খুলুন”, মুখের রসগোল্লা ম্যানেজ করতে করতে বলল বটুক।
কম্পমান হাতে চৌত্রিশ নম্বর পাতাটা খুলে বিমল বাবুর নয়ন সার্থক হ’ল।
এইত, তাঁর লেখা গল্পটি দেখা যাচ্ছে, সুদৃশ্য হরফে, ঝক ঝকে কালিতে, পুলকে কেঁপে উঠল তাঁর মন, তড়ি ঘড়ি গল্পের শেষে তাঁর নামটি দেখতে গিয়ে চক্ষু ছানাবড়া, আরে! লেখকের নামের জায়গায় তাঁর নামের বদলে এটা কার নাম লেখা?
বার তিনেক চোখ ঘষার পরও নামটা সেই একই আছে, বিমল চন্দ্র বড়াল এর জায়গায় “শ্রীমতি নবীনা গড়গড়ি”, বিমল বাবু রক্ত চক্ষু করে বটুক কে বললেন,
-“এটা কি হল’”
-“বাঁশ। কালো বাঁশ”, অম্লান বদনে বলল বটুক।
-“মানে?” বিমল বাবু রাগে অগ্নিশর্মা।
এক সাথে দুটো জলভরা মুখে চালান করে দিয়ে বটুক বিস্তারিত বলে চলল...
-“আসলে সম্পাদক মশাই বললেন যে আপনার লেখাটা একেবারে অপরিনত, কাঁচা,
ওতে বর্তমান আর্থসামাজিক তথা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এর বর্ণনা ও তার বিশ্লেষণ মিসিং , একেবারে যা তা, তাই ওটাকে অনেক শুধরাতে হয়েছে, একটা মুখবন্ধও উনি লিখে দিয়েছেন, এই দেখুন,”
-“ উনি লিখেছেন যে”,
-“এটা একটা পথভ্রষ্ট যুবকের গল্প, যে দ্বিধাতে আছে যে তার কোন আদর্শের সাথে যাওয়া উচিত, ডান নাকি বাম,.........ইত্যাদি ইত্যাদি”।
-“আর আমি তো বলেইছি যে উনি অরিজিন্যালিটি তে বিশ্বাস করেন, তাই বললেন, যে এত কিছু যখন ওনাকে লিখতে এবং বদল করতে হল’ তখন লেখাটি তো এক প্রকার ওঁরই,”
-“হেঁ হেঁ বটুক লেখাটি তুমি বরং তোমার বউদির নামের ছাপিয়ে দাও, সম্পাদকের গিন্নি বলে কথা, সমাজে মুখ দেখাতে হলে’ ওনারও তো কিছু সাহিত্য কর্ম থাকা উচিৎ, কি বল বটুক, ঠিক কি না”?
-“আর মেসোমশাই আপনি আর কি বুঝবেন, আমার বিশাল সংসার টা তো আমারই ঘাড়ে, চাকরির যা বাজার”।
(৬)
বিমল বাবু লেখা ছেড়ে দিয়ে এখন বাড়ির পিছনে একফালি জমিতে মন দিয়ে বাগান করছেন।ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখছেন যে নিজের বাগানে “বাঁশ” ফলানো যায় কি না,
তা হ’লে এক খানি সরেস বাঁশ তিনি “ নিত্য নতুন গড়গড়ি কে” পাঠিয়ে দেবেন।।