দন্ত্যস্থ
(প্রথম পর্ব)
স্বরূপ চক্রবর্তী
সংখ্যা-১৫, (৫ই জুলাই,২০১৮) |
(১)
স্থান:- আবার কৈলাস পর্বত, চৈত্রমাস
কাল:- প্রায় মধ্যরাত্রি, আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ
পাত্র:- সপরিবার মহাদেব
আজ সকাল থেকেই শিব ও শিবার মধ্যে চলছে মন কষাকষি, যাকে বলে 'দাম্পত্য কলহ', কি? বিশ্বাস হচ্ছেনা বুঝি? আরে বাবা হয় হয়, এখানেও হয়, ফি বছর বাংলায় যাতায়াত করার ফলে মা দুর্গা ও ভোলেবাবার মধ্যেও দাম্পত্য কলহের বীজ ঢুকেছে, তবে তার যথেষ্ট কারনও আছে, ওইতো সেবার, এক থিম পুজোর আর্টিস্ট থিমের চক্করে মায়ের পোশাক- আশাক এত আধুনিক করে দিয়েছিল যে লজ্জা ঢাকা দায় হওয়ার জোগাড়, নেহাতই বাপের বাড়ি বলে কথা, মা ব্যাপারটাকে মানিয়ে গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করে ছিলেন, কিন্তু গতবছর এক প্যান্ডেলে তো হৈচৈ কান্ড, শিবঠাকুর তো রেগে কাঁই, কর্তাদের একদম অভিশাপ টভিশাপ দিয়ে ফেলেন আর কি,তা, রাগবার কথা তো বটেই, আরে বাবা! তোরা 'গ্লোবাল ওয়ার্মিং ' থিম নিলি তা, বেশ, তা বলে সমস্ত দেবী দেবতা, মায় অসুরকেও কচি কলাপাতার পোষাক পরাবি! আচ্ছা, সেটাও না-হয় মানা গেল, কিন্তু তোরা লক্ষ্য রাখবি না যে কখন পড়ার রাম ছাগলটি, তার সমস্ত গার্লফ্রেন্ড দের নিয়ে প্যান্ডেলে হামলে পড়ে সমস্ত 'পোষাক' কে 'শাক' ভেবে স্রেফ সাবড়ে দিয়েছে? সে তো মা কোনও ক্রমে সিংহের ওপর চড়ে বসে রক্ষা পেয়েছেন, তা না হলে কি যে হতো.......?সেই ঘটনাটি আজও শিবের মনে টাটকা, তাই যখনই মা দুর্গা এই ভরা চৈত্রে মর্ত্যে যাবার বায়না ধরলেন, তখন শিবের মাথা ভিসুভিয়াস হতে দেরি হলনা, নেহাতই মা গঙ্গা শিবের মাথায় জল টল ঢেলে ব্যাপারটা ম্যানেজ দিলেন।
বছরে একবার ছাড়া মায়ের বাংলা ভ্রমণ নিষিদ্ধ, মাও এটা মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু বাদ সাধল ওই ' চৈত্র সেল ' ।
আসলে হয়েছে কি, যবে থেকে ওই মর্ত্যবাসীরা একেবারে গুনে গেঁথে বলে দিল যে গোটা পৃথিবীতে আর মাত্র শতিনেক বাঘ অবশিষ্ট রয়েছে, সুতরাং ওদের শিকার করা চলবেনা, তখন থেকেই মা এর কপালে ভাঁজ,কারন মহাদেব যে কেবল মাত্র বাঘ ছাল ছাড়া আর কিছু পরেন না, তার ওপর আবার সেদিন ওঁনার সবেধন নীলমণি শীতে পরার একমাত্র রয়্যাল বেঙ্গলের ছালটি স্বর্গের ধোপাকে কাচতে দিয়ে পড়েছেন ফ্যাসাদে, ব্যাটা ছাল টিকে ছিঁড়ে ফর্দাফাই করে নিয়ে এসে বলে কি না, 'এত শতাব্দী প্রাচীন ছাল কাচা আমার কম্ম নয়,' তারপর জিব কেটে, পোষা গাধাটির শিংয়ে হাত রেখে বলল,
'এই আমি আমার ব্যবসার , মায় আমার প্রিয় গাধাটির দিব্বি বলছি, এই ছাল আমি আর কাচতে নেবো না, শিগগির একটি নতুন ছাল আনুন' বলে কাচার পয়সা টয়সা না নিয়েই দাপিয়ে চলে গেল।
"এ তো মহা ফাঁপরে পড়া গেল, এখন নতুন ছাল পাই কোথায়?" মায়ের কপালে চিন্তার ভাঁজ।
সুতরাং খোঁজ পড়ল কার্তিকের, এই পরিবারের একমাত্র টেক স্যাভি স্মার্ট সদস্যের।
মা শুধোলেন ,' হ্যাঁ রে কাতু, একটু দ্যাখ না, যদি তোর ওই অনলাইন না কি যেন বলে, ওখানে কোনও রয়্যাল বেঙ্গলের ছাল পাওয়া যায় কি না?'
কার্তিক তখন 'স্কাইবুক লাইভে' মগ্ন, সেখানে স্ক্রিনের তলায় ব্যানার স্ক্রল করছে,
' রয়্যাল বেঙ্গল রহস্য, কে বা কারা যেন সুন্দর বনের গভীরে সেঁধিয়ে কয়েকটি ধাড়ি ধাড়ি বাঘকে মেরে তাদের ছাল ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে',
ব্রেকিং নিউজের সাথে নিউজ প্রেজেন্টারের রিসার্চ টিপ, ' শোনা যাচ্ছে যে সুন্দর বনের নগ্ন বাঘের বডির সাথেই আফ্রিকাতে ফোকলা হাতির বডি পাওয়া গেছে, মানে, বডি আছে কিন্তু কে বা কারা দাঁত গুলি সমূলে উপড়ে নিয়ে গেছে, গোটা পৃথিবীর পুলিশ ও গোয়েন্দা হন্যে হয়ে চোরাশিকারীদের তল্লাশ করছে।'
মায়ের ধাক্কায় কার্তিকের মগ্নতা ভাঙে, ' দেখছ না, সারা পৃথিবীর কি হাল!,বাবাকে বলো ওসব বাঘছাল টাগছাল ছেড়ে ট্রেন্ডি হতে, বল ফ্লোরাল প্রিন্টেড বারমুডা ধরতে, একেবারে ইন থিং, আর ইজিলি পাওয়া যায়, একটা ক্লিক আর ,'বৈতরণী ডট কম' থেকে এক্কেবারে কৈলাসে হোম ডেলিভারী, নো পাঙ্গা নো ইস্যু।'
'কিন্তু...',মায়ের কপালে ভাঁজ।
এমন সময় গনেশ এসে হাজির, সব শুনে ফুট কাটল, 'একটু চেষ্টা করলে হয়ত বাঘ ছাল পাওয়া যেত'।
গণেশের কথা শুনে কার্তিকের পিত্তি জ্বলে গেল, এমনিতেই দুইজনের মধ্যের সিবলিং রাইভ্যালরি পুরোনো,সেই পুরাণ যুগ থেকেই চলে আসছে, পৃথিবী পরিক্রমনের কম্পিটিশনের থেকেই, তার ওপর এই সেইদিন ভ্যালেনটাইন ডে তে, বাবার গাঁজা খেয়ে স্বর্গের কার্নিশ টপকে ফুলের বাজারে পড়া, আর চোর সন্দেহে লোকজনের মারের হাত থেকে বাবাকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসার পর থেকেই,
কাল:- প্রায় মধ্যরাত্রি, আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ
পাত্র:- সপরিবার মহাদেব
আজ সকাল থেকেই শিব ও শিবার মধ্যে চলছে মন কষাকষি, যাকে বলে 'দাম্পত্য কলহ', কি? বিশ্বাস হচ্ছেনা বুঝি? আরে বাবা হয় হয়, এখানেও হয়, ফি বছর বাংলায় যাতায়াত করার ফলে মা দুর্গা ও ভোলেবাবার মধ্যেও দাম্পত্য কলহের বীজ ঢুকেছে, তবে তার যথেষ্ট কারনও আছে, ওইতো সেবার, এক থিম পুজোর আর্টিস্ট থিমের চক্করে মায়ের পোশাক- আশাক এত আধুনিক করে দিয়েছিল যে লজ্জা ঢাকা দায় হওয়ার জোগাড়, নেহাতই বাপের বাড়ি বলে কথা, মা ব্যাপারটাকে মানিয়ে গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করে ছিলেন, কিন্তু গতবছর এক প্যান্ডেলে তো হৈচৈ কান্ড, শিবঠাকুর তো রেগে কাঁই, কর্তাদের একদম অভিশাপ টভিশাপ দিয়ে ফেলেন আর কি,তা, রাগবার কথা তো বটেই, আরে বাবা! তোরা 'গ্লোবাল ওয়ার্মিং ' থিম নিলি তা, বেশ, তা বলে সমস্ত দেবী দেবতা, মায় অসুরকেও কচি কলাপাতার পোষাক পরাবি! আচ্ছা, সেটাও না-হয় মানা গেল, কিন্তু তোরা লক্ষ্য রাখবি না যে কখন পড়ার রাম ছাগলটি, তার সমস্ত গার্লফ্রেন্ড দের নিয়ে প্যান্ডেলে হামলে পড়ে সমস্ত 'পোষাক' কে 'শাক' ভেবে স্রেফ সাবড়ে দিয়েছে? সে তো মা কোনও ক্রমে সিংহের ওপর চড়ে বসে রক্ষা পেয়েছেন, তা না হলে কি যে হতো.......?সেই ঘটনাটি আজও শিবের মনে টাটকা, তাই যখনই মা দুর্গা এই ভরা চৈত্রে মর্ত্যে যাবার বায়না ধরলেন, তখন শিবের মাথা ভিসুভিয়াস হতে দেরি হলনা, নেহাতই মা গঙ্গা শিবের মাথায় জল টল ঢেলে ব্যাপারটা ম্যানেজ দিলেন।
বছরে একবার ছাড়া মায়ের বাংলা ভ্রমণ নিষিদ্ধ, মাও এটা মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু বাদ সাধল ওই ' চৈত্র সেল ' ।
আসলে হয়েছে কি, যবে থেকে ওই মর্ত্যবাসীরা একেবারে গুনে গেঁথে বলে দিল যে গোটা পৃথিবীতে আর মাত্র শতিনেক বাঘ অবশিষ্ট রয়েছে, সুতরাং ওদের শিকার করা চলবেনা, তখন থেকেই মা এর কপালে ভাঁজ,কারন মহাদেব যে কেবল মাত্র বাঘ ছাল ছাড়া আর কিছু পরেন না, তার ওপর আবার সেদিন ওঁনার সবেধন নীলমণি শীতে পরার একমাত্র রয়্যাল বেঙ্গলের ছালটি স্বর্গের ধোপাকে কাচতে দিয়ে পড়েছেন ফ্যাসাদে, ব্যাটা ছাল টিকে ছিঁড়ে ফর্দাফাই করে নিয়ে এসে বলে কি না, 'এত শতাব্দী প্রাচীন ছাল কাচা আমার কম্ম নয়,' তারপর জিব কেটে, পোষা গাধাটির শিংয়ে হাত রেখে বলল,
'এই আমি আমার ব্যবসার , মায় আমার প্রিয় গাধাটির দিব্বি বলছি, এই ছাল আমি আর কাচতে নেবো না, শিগগির একটি নতুন ছাল আনুন' বলে কাচার পয়সা টয়সা না নিয়েই দাপিয়ে চলে গেল।
"এ তো মহা ফাঁপরে পড়া গেল, এখন নতুন ছাল পাই কোথায়?" মায়ের কপালে চিন্তার ভাঁজ।
সুতরাং খোঁজ পড়ল কার্তিকের, এই পরিবারের একমাত্র টেক স্যাভি স্মার্ট সদস্যের।
মা শুধোলেন ,' হ্যাঁ রে কাতু, একটু দ্যাখ না, যদি তোর ওই অনলাইন না কি যেন বলে, ওখানে কোনও রয়্যাল বেঙ্গলের ছাল পাওয়া যায় কি না?'
কার্তিক তখন 'স্কাইবুক লাইভে' মগ্ন, সেখানে স্ক্রিনের তলায় ব্যানার স্ক্রল করছে,
' রয়্যাল বেঙ্গল রহস্য, কে বা কারা যেন সুন্দর বনের গভীরে সেঁধিয়ে কয়েকটি ধাড়ি ধাড়ি বাঘকে মেরে তাদের ছাল ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে',
ব্রেকিং নিউজের সাথে নিউজ প্রেজেন্টারের রিসার্চ টিপ, ' শোনা যাচ্ছে যে সুন্দর বনের নগ্ন বাঘের বডির সাথেই আফ্রিকাতে ফোকলা হাতির বডি পাওয়া গেছে, মানে, বডি আছে কিন্তু কে বা কারা দাঁত গুলি সমূলে উপড়ে নিয়ে গেছে, গোটা পৃথিবীর পুলিশ ও গোয়েন্দা হন্যে হয়ে চোরাশিকারীদের তল্লাশ করছে।'
মায়ের ধাক্কায় কার্তিকের মগ্নতা ভাঙে, ' দেখছ না, সারা পৃথিবীর কি হাল!,বাবাকে বলো ওসব বাঘছাল টাগছাল ছেড়ে ট্রেন্ডি হতে, বল ফ্লোরাল প্রিন্টেড বারমুডা ধরতে, একেবারে ইন থিং, আর ইজিলি পাওয়া যায়, একটা ক্লিক আর ,'বৈতরণী ডট কম' থেকে এক্কেবারে কৈলাসে হোম ডেলিভারী, নো পাঙ্গা নো ইস্যু।'
'কিন্তু...',মায়ের কপালে ভাঁজ।
এমন সময় গনেশ এসে হাজির, সব শুনে ফুট কাটল, 'একটু চেষ্টা করলে হয়ত বাঘ ছাল পাওয়া যেত'।
গণেশের কথা শুনে কার্তিকের পিত্তি জ্বলে গেল, এমনিতেই দুইজনের মধ্যের সিবলিং রাইভ্যালরি পুরোনো,সেই পুরাণ যুগ থেকেই চলে আসছে, পৃথিবী পরিক্রমনের কম্পিটিশনের থেকেই, তার ওপর এই সেইদিন ভ্যালেনটাইন ডে তে, বাবার গাঁজা খেয়ে স্বর্গের কার্নিশ টপকে ফুলের বাজারে পড়া, আর চোর সন্দেহে লোকজনের মারের হাত থেকে বাবাকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসার পর থেকেই,
(যারা জানেন না তারা ভ্যালেন্টাইন বম বম টা একটু
পড়ুন)
গণেশ এই পরিবারের নয়নের মনি, তার কথায় সবাই ওঠে বসে, কার্তিক নিজেকে সামলে নিল।
গণেশের কথা শুনে মা বুকে বল পেলেন,
' হ্যাঁ রে, বাবা, তুই কি কিছু উপায় বলতে পারিস?'
'উপায় তো ওই একটাই, চৈত্র সেল!'
' মানে?', মায়ের জিজ্ঞাসা।
'বাংলায় এখন চৈত্র সেল চলছে, শুনেছি সেখানে সবকিছুই পাওয়া যায়, শুধু বাঘের ছাল কেনো ,দাঁত, নখ, দুধ সব পাওয়া যায়।'
'যায়?', মায়ের মাথার পেছনের হাজার ওয়াটের জ্যোতির্বলয় টি জ্বলে উঠল, শিব তেরিয়া হয়ে উঠলেন, ' কথায় কথায় এতো আলো জ্বালিয়ে দাও কেন?
ইলেক্ট্রিসিটির বিল টাও তো মাথায় রাখতে হবে , না কি?'
কার্তিক মুচকি হেসে মনে মনে ভাবল, 'এবার চাঁদ, তোমায় দেখাবো ফাঁদ,'বলল, ' ঠিক আছে, তুইই বল আমাদের ঠিক কি করা উচিত '
প্রশ্রয় পেয়ে গণেশ বলল,' আমরা সবাই মিলে চলো কোনও চৈত্র সেলে যাই,'
'ওনার সাইজ টা মাথায়
রাখলেই ..,'
'ত্রিপল, মানে ট্রিপল এক্সেল,' মুখের কথা কেড়ে বলে কার্তিক।
'ঠিক, বাবা না গেলেও চলবে,' মধ্যস্থতা করল লক্ষী ।
স্বরস্বতী বলল,' আমিও বাদ,' 'কেনো?' মা শুধোলেন
স্বরস্বতী বলল,' আমিও বাদ,' 'কেনো?' মা শুধোলেন
‘ওখানে এখন ভীষণ ধুলো
আর নোংরা, আমার হাঁসের পাখা, আমার শাড়ী সব নোংরা হয়ে যাবে'।
'তোর যত শুভ্র শুভ্র
বাতিক, থাক তুই ঘরেই।
সে তো হলো, কিন্তু কোন বাজারে যাওয়া যায়?
'দ্যাখ না, দাদা , তোর 'গোলগাল' ম্যাপে, কোথায় ট্রাফিক একটু কম,'।
'হুম বাছাধন, আজ তুমি পড়েছ ফাঁদে, আমি কার্তিক, তোমার বড় ভাই কি সাধে,?' মনে মনে বলে কার্তিক কিছুক্ষণ খুট খাট করে সুন্দরবনের লাগোয়া একটি বাজার খুঁজে বের করল।
"বাসুদেব পুর বাজার।"
সব ঠিকঠাক
সে তো হলো, কিন্তু কোন বাজারে যাওয়া যায়?
'দ্যাখ না, দাদা , তোর 'গোলগাল' ম্যাপে, কোথায় ট্রাফিক একটু কম,'।
'হুম বাছাধন, আজ তুমি পড়েছ ফাঁদে, আমি কার্তিক, তোমার বড় ভাই কি সাধে,?' মনে মনে বলে কার্তিক কিছুক্ষণ খুট খাট করে সুন্দরবনের লাগোয়া একটি বাজার খুঁজে বের করল।
"বাসুদেব পুর বাজার।"
সব ঠিকঠাক
সেই রাতে জরুরী তলব পড়ল নন্দী ভৃঙ্গীর মহাদেবের
কাছে,
"এই, তোরা দুটোতে গিয়ে
এক্ষুনি একটা সার্ভে করে আয়, ওই বাসুদেবপুর না কি যেন জাগাটার নাম, তোদের মায়ের তো বঙ্গে
যাবার একটা সুযোগ চাই ব্যস, আর ওদিকে আমি চিন্তায় মরি আর কি, কচি কচি ছেলেপুলে
নিয়ে এই প্যাচ প্যাচে গরমে... যাক গে বুঝবে ঠ্যালা।" বলে গাঁজার কলকে তে মনোযোগ করলেন ভোলানাথ,
"বাবা, বলছি কি, মানে ইয়ে যদি একটু
... পেসাদ, না, থাক”, বাবার রক্তচক্ষু দেখে থতিয়ে
গেল নন্দী।
(২)
বাসুদেব পুরের আকাশে নিশুত রাতে নন্দী-ভৃঙ্গী কে
গ্লাইড করতে দেখা গেল।
"বাজার টা স্ক্যান কর, হাঁদারা", ওদের 'শিং ফোনে' বাবার হুঙ্কার শোনা গেলো।
"আচ্ছা বাবা”, বলে দুজনেই দুই দুই চারটে শিং খুলে ফেললো। যাক, অ্যান্টেনা নেই,
বাবার হুঙ্কারও নেই, ছদ্মবেশ ধারণ করার জন্য শিং খুলতে হয়েছে বলে বাবাকে বুঝিয়ে দেওয়া যাবে 'খন।
বাবার হুঙ্কারও নেই, ছদ্মবেশ ধারণ করার জন্য শিং খুলতে হয়েছে বলে বাবাকে বুঝিয়ে দেওয়া যাবে 'খন।
ওরা উড়তে লাগল ইতি উতি। বাসুদেবপুর হল সুন্দর বনের
লাগোয়া একটি মাঝারি সাইজের গঞ্জ, নোনা জলের খাঁড়ি দিয়ে
তিনদিকে ঘেরা,তবে, এখানকার বাজারটি বেশ জমাটি, বেশ কয়েকটি বড়সড়
দোকান আছে এখানে, আশেপাশের গ্রাম, এছাড়া ক্যানিং , নেতিধোপানি, গোসাবা, ইত্যাদি সুন্দর বনের
তাবড় তাবড় এলাকা থেকে নোনা খাঁড়িতে ডিঙি নৌকা বেয়ে লোকজন আসে, আর জঙ্গলের খাবারে
অরুচি ধরলে মাঝে মাঝে ডোরা কাটা কেঁদোরা এখানে হামলা করে, তবে এখানকার
বাসিন্দারা এতে অভ্যস্থ , তাদের চলে যায়।
উড়তে উড়তে একটি বেশ বড়সড় শাটার টানা দোকানের সামনে
এসে পড়ল ওরা, বিশাল সাইন বোর্ড টাঙানো, "জটাধর বস্ত্র
বিপনী", "এখানে সকল প্রকার কাপড় সুলভে পাওয়া যায়"
"প্রোপ্রাইটর : হলধর পাঁজা"। সবই ঠিক আছে, কিন্তু সাইন বোর্ডের
দুই প্রান্তে দুইটি ইয়া সাইজের শিব ঠাকুরের ছবি একটু বেমানান লাগল ওদের।
"হুমম, বেশ বড়ই দোকানটা, কি বলিস?" বলল ভৃঙ্গী।
"চল দেখা যাক", সায় দিয়ে বলল নন্দী।
জটাধর ভান্ডারের পেছনেই মালিকের বাড়ী, দোকানটা বাজার মুখো
আর বাড়িটি খাঁড়ি মুখো। ওরা বাড়ির দিকটা তে ভেসে চলল, ওদিক পানে যাবার সময়
তাজা গাঁজার সুমিষ্ট ধোঁয়া ওদের নাকে প্রবেশ করল, দুজন দুজনের দিকে
তাকিয়ে অর্থবহ ইশারা করল।
(৩)
জটাধর বস্ত্র বিপনীর মালিক ষাটোর্ধ হলধর বাবুর এই
তল্লাটে বড় এবং সৎ ব্যবসায়ী বলে খুব নামডাক, তিন পুরুষের এই
ব্যবসা শুরু করেন হলধরের পিতা জলধর, সেই ব্যবসা বাড়ান হলধর আর এখন তাঁর
পুত্র সূত্রধর ব্যবসা দেখাশোনা করে, তিনি এখনও দোকানে যান,বিশেষতঃ পুজো পার্বণ
বা মেলা টেলা হলে, ক্যাশ সামলান, খদ্দেরের ভীড় দেখতে তার বেশ লাগে।
শোনা যাচ্ছে যে আসছে পঞ্চায়েত ভোটে তিনি নির্দল প্রার্থী হবেন, হলধরের আর একটি
বিশেষত্ব হল দেবদ্বিজে তাঁর অচল ভক্তি, বিশেষতঃ ভোলেবাবার
তিনি কট্টর চেলা, রোজ রাত্তিরে খাওয়া দাওয়ার পর তিনি বাবার আরাধনায় বসেন, উপকরণ অতি সামান্য, উত্তম কোয়ালিটির
গাঁজা, কলকে, আর দেশলাই, ব্যস, বেশ কয়েক ছিলিম টেনে আর ব্যম ব্যম হুঙ্কার
ছেড়ে তিনি তাঁর আরাধনা শেষ করেন তার পর সদর দরজা বন্ধ করে তবে শুতে যান, এই সব ক্রিয়া
প্রক্রিয়া সাঙ্গ করতে বেশ রাত হয়ে যায়, তাই পরিবারের শান্তি বজায় রাখতে বাইরের
ঘরেই তিনি ঠাঁই নিয়েছেন।
চৈত্র মাস চলছে , আজ বেশ গরম, তাই তিনি একেবারে
বাইরের দাওয়াতে তিনি তাঁর পুজোর আসন পেতেছেন, নন্দীরা ধীরে ধীরে
হলধরের সামনে ল্যান্ড করল।
হলধর সবেমাত্র পরিপাটি করে দুই ছিলিম শেষ করার পর
সবে তিন নম্বরটি ধরাচ্ছেন, এমন সময় দুটি গ্রাম্য লোক যেন আকাশ থেকে ভেসে তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল, হতে পারে তৃতীয় ছিলিম, কিন্তু হলধরের জ্ঞান
বেশ টনটনে আছে, "এত রাতে আবার এরা কারা, আপদ", তিনি ভোটে দাঁড়াচ্ছেন
শুনে আশপাশের অনেক লোক তাঁর কাছে বিভিন্ন কাজের উমেদারী করতে আসে, হলধর তাঁর সাধ্য মত
সাহায্য করেন,কিন্তু তা বলে এত রাতে....। কিছুটা বিরক্তির সাথে তিনি
লোক দুটোকে জিজ্ঞাসা করলেন,
"কে হে তোমরা, এত রাতে, কি ব্যাপার"?
হাটুরে লোকদের মত খাটো ধুতি, মাথায় বাবরি চুল, অদ্ভুত ধরণের পিরান গায়ে লোকদুটির গায়ের
রং এক্কেবারে মিশকালো, আর সবচেয়ে বে মানান হচ্ছে ওদের পায়ের রাংতা ওয়ালা নাগরা।
"কোন যাত্রা দলের লোক হে তোমরা? এমন সং সেজে এত রাতে
ঘুরে মরছে দ্যাখো"
"ব্যম ভোলে" বলে হুকার ছাড়লেন হলধর।
চমকে উঠে নন্দী-ভৃঙ্গী আমতা আমতা করে নিজেদের জন্য
একটি পরিচয় খুঁজছিল, কিন্তু অমন সুমিষ্ট ঝাঁঝালো গাঁজার গন্ধে প্রাণ টা আকুলি বিকুলি করে উঠছে, যাক শালার সার্ভে, এখন যেভাবেই হোক দু
এক ছিলিম না টানতে পারলে
...উফফ, কি সুন্দর গন্ধ....।
...উফফ, কি সুন্দর গন্ধ....।
"কি! নিজেদের পরিচয় দিতে এত ধানাই পানাই কিসের হে
তোদের?" বিরক্ত হলধর তুই তোকারিতে নেমে এলেন।
“ঠিক বলেছেন স্যার, আমাদের ওই নাম"
"আমি ধানাই, আর ও আমার তিন
মিনিটের ছোট ভাই পানাই", বলে নিজেদের দেখালো নন্দী।
"হাঃ হাঃ, এ আবার কি ধরণের নাম?" , জিজ্ঞাসা হলধরের।
“না, মানে দুগণ্ডা ভাই
বোনের পর যখন আমাদের জন্ম হল, তখন বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসল,”আমার গরীবের সংসার, খুদ কুঁড়ো খাইয়ে নাহয় এদের মানুষ করব কিন্তু এখন এই দরিদ্র চাষার
রতন এই ছেলে দুটোর জন্য নাম পাই কোথায়? আমরা যে বড্ড গরীব"।
সেই শুনে আমার দাদু, যাঁকে আমাদের দুগন্ডা
ভাই বোনের সকল অন্যায় আবদার মেটাতে হত, তিনি বিরক্ত হয়ে
বললেন, "আরে নামের জন্য অত ধানাই পানাই কিসের?এ দুটোর নাম হোক ধানাই
আর পানাই", " আর বলে দিচ্ছি সুবল, এই শেষ, না হলে কিন্তু বৌমাকে বাপের বাড়ি
পাঠিয়ে দেব বলছি, মনে থাকে যেন "।
ওদের কথা শুনে হলধর বেশ আমোদ পেলেন,
"বোস বাছারা", বলে দাওয়ার এক পাশে
বসালেন এবং নন্দী ওরফে ধানাই এর দিকে গাঁজার ছিলিম
এগিয়ে দিয়ে বললেন, "এই নাও, মহাদেবের প্রসাদ, তুমি বড় ভাই, তুমিই আগে..."
"বড় আমার বড় এয়েছেন রে, বলে কলকে টা এক
প্রকার ছিনিয়ে নিল ভৃঙ্গী ওরফে পানাই"।
পারিবারিক কলহের মধ্যে না পড়ে হলধর শুধোলেন , " এবার বলোতো বাছারা, তোমাদের এখানে আসার
কারণটি কি"?
"আজ্ঞে, আমরা হেতাল গঞ্জের জমিদার বাড়ি থেকে আসছি, উনারা ভীষণ শিব ভক্ত," বলে কপালে হাত ঠেকায়
ধানাই।
“আপনাদের বাসুদেব পুর
বাজারের নামডাক শুনে এখানে এসে আপনার ও আপনার দোকানের ব্যাপারে জানলাম, তা, আমাদের মা জননীর খুব বাজার করার দরকার, ওদিকে আমাদের এলাকায় মশার উৎপাতে
ব্যবসাপত্র প্রায় বন্ধ,লোকজন সব এলাকা ছেড়ে
পালাচ্ছে, কিন্তু জমিদার পরিবার তো আর যেতে পারে না, তাই ওখানেই পড়ে আছেন, তো, জমিদার গিন্নী আর তাঁদের দুই ছেলে
এখানে আপনার দোকানে কালকে আসবেন কেনাকাটা করতে, একটু খেয়াল রাখবেন, এই আর কি।"
“কিন্তু, সাবধান!” ঘনিয়ে আসে পানাই,"ওঁদের আসল পরিচয়
কিন্তু কেউ যেন জানতে না পারে, এই টুকু
অনুরোধ"।
"এ আর বড় কথা কি, আমার দোকানে ওঁরা
আসবেন, তাতেই আমি ধন্য”, বিগলিত হাসলেন হলধর।
ক্রমশঃ
দ্বিতীয় পর্ব