দন্ত্যস্থ
(তৃতীয় পর্ব)
স্বরূপ চক্রবর্তী
সংখ্যা-১৭, (৭ ই জুলাই,২০১৮)
|
(৬)
চাঁদি ফাটা রোদে, গণেশ ও কার্তিক
সমভিব্যহারে বাসুদেবপুর বাজারে প্রকট হলেন মা দুর্গা, জমজমাট ধুলো ভর্তি
বাজার, দোকানে দোকানে চৈত্র সেলের ধুম, ব্যানার, ডিসকাউন্ট কত কিছু, ফি বছর বাপের বাড়ি
আসা বলতে তো ওই পুজোর সময় প্যান্ডেলে পোজ দিয়ে
বসে থাকা আর কৈলাশে ফিরে সারা বছর সংসার সামলানো, মা এর কাছে এই রকম পরিবেশ একদম
নতুন , ভীড়ে ভীড়াক্কার রাস্তা আর দোকান গুলো , ঘাম আর উৎকট সস্তা সেন্টের গন্ধে
নাড়ী ছাড়ার উপক্রম, লোকেরা কিনছে কম দরাদরি করছে বেশী, দোকানী দের দরাজ ডিসকাউন্টও
দরাদরি থামাতে পারছে না, কিন্তু বাপের বাড়ি বলে কথা, মা বেশ এনজয় করছিলেন, দোকানে দোকানে ঝোলানো
জামাকাপড় , কার্তিক খালি তাড়া দিচ্ছে আর বলছে ওই
"জটাধারী" না,কি, সেই দোকান টি তাড়াতাড়ি খুঁজে কেনাকাটা সেরে বাড়ি ফিরে চল, আমার সাফোকেশন হচ্ছে।
এখানে দৈব শক্তি ব্যবহারের উপায় নেই, তাই হাঁটতে হচ্ছে, কার্তিক আর গণেশ মা এর দুই পাশে
হাঁটছে, কার্তিকের ময়ূর আর অস্ত্রশস্ত্র বোনেদের জিম্মায় কৈলাশে, শুধু গণেশ কে নিয়েই
মুশকিল, গণেশ তার দেড় খানা দাঁত কে প্যাঁচ খুলে একটি কাপড়ের শান্তিনিকেতনী
থলেতে ভরে কাঁধে রেখেছে, বোনেরা বার বার বলল যে তুই তোর দাঁত গুলি আমাদের দিয়ে যা, আমরা ধুয়ে মুছে চক
চকে করে রাখব, কিন্তু কে কার কথা শোনে, তার জেদ, সে থলে নেবেই, কি আর করা, অগত্যা..., ওদিকে ওই দেখে
কার্তিক মনেমনে খুশি, কারণ সকালের ওই বাঘের ছাল আর হাতির দাঁতের খবর। " বাছাধন, তুমি এবার ফাঁসলে
বলে"।
যাই হোক ওরা তিনজনে জিজ্ঞেস করে করে দোকানের দিকে
এগোচ্ছে, কিছুক্ষণ পরেই "জটাধর বস্ত্রবিপনীর" দেখা পাওয়া গেলো, ওঁরা ভেতরে গিয়ে হলধর
কে খুঁজে পেলেন, বিশাল বড় দোকান, প্রচুর কাপড় আর প্রচুর খদ্দের।
হলধর পাঁজা মা আর দুই
পুত্রকে খাতির করে বসালেন, মা জননীর গায়ের দুধে আলতা রং, চোখের দীপ্তি, পরনের দামি শাড়ি এসব
দেখে বোঝাই যায় যে তিনি কোনো বড় বংশের গৃহিনী, সাথে দুই ছেলে, একটির চোখ টানাটানা, কোঁকড়া কালো চুল, অন্যটি বেশ নাদুসনুদুস, এঁদের দেখে যেন সাক্ষাৎ শিব পরিবারের কথা মনে পড়ে, হলধরের মনে ভক্তি ভাব জেগে উঠল, উনি নিজে হাতে করে
ওঁদের কাপড় দেখাতে লাগলেন।
এরই মধ্যে হঠাৎ গণেশের উসখুসুনি শুরু হল, আসলে সবাই নিজের
নিজের বাহন রেখে এলেও গণেশ তার প্রিয় ইঁদুর কে ছেড়ে আসতে পারেনি, আর বঙ্গে ইঁদুরের
কখনো কোনো অভাব দেখা যায়নি, ফলে ইঁদুর কে দেখে কেউ গ্রাহ্য করবেনা এটাই স্বাভাবিক, আর ঠিক এই কারণেই গণেশ ওই থলে
টা নিয়ে এসেছে , যাতে করে ওর বাহন কে লুকিয়ে আনা যায়, কিন্তু, দোকানের ভেতরে আসা
ইস্তক ইঁদুর টি বড্ড ছটফট করছে, তাই মা আর দাদাকে বলে গণেশ খোলা হাওয়া খাওয়ার বাহানায়
দোকানের বাইরে গিয়ে দাঁড়াল, কিন্তু ইঁদুর টি এত পাজি যে একটু সুযোগ পেতেই ঝোলা
টপকে এক্কেবারে রাস্তায় পড়ে ঝড়ের বেগে দৌড় লাগালো, "আঃ বাঁচা গেল, যা ভারী মালিক , তাকে বইতে বইতে জান
এক্কেবারে কালি হয়ে গেলো, এই সুযোগ ছাড়া যায়?"
(৭)
গণেশ থতমত খেয়েই নিজেকে সামলে দৌড় লাগালো পিছু পিছু, বাজারের ভীড়ের মধ্যে লোকজনের ধাক্কা
বাঁচিয়ে, স্রোতের উল্টো দিকে কোনোও ভাবে গণেশ এগিয়ে চলছে, ভাগ্যিস দৈব শক্তি
ব্যবহার নিষিদ্ধ, নইলে এতক্ষনে ইঁদুর বাবাজি কব্জা হয়ে যেতেন। ওদিকে থলেতে দাঁত
গুলো রয়েছে, কিন্তু না, অনেক চেষ্টা করেও গণেশের সাথে একটি সিঁড়িঙে লোকের ধাক্কা
লেগেই গেল,আর ধাক্কা লাগতেই লোকটি কঁকিয়ে উঠল, " আরে আরে! আপনার থলেতে কি আছে
মশাই? বন্দুক টন্দুক নয় তো? না কি তলোয়ার বল্লম টল্লম কিছু?", “আপনি ডাকাত না কি?"
বলে রাখা ভালো যে সুন্দরবনের এইসব এলাকা, বিশেষতঃ নেতিধোপানী
এলাকা পর্তুগীজ জলদস্যুদের লুকোনোর স্থান ছিল, ১৭৫৭ সালে মুঘল বাদশা
দ্বিতীয় আলমগীরের হাত থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুন্দরবনের দখল নিয়ে এই সব
ডাকাতদের কিছুটা দমন করেছিল, কিন্তু আজ এই একবিংশ শতকেও ডাকাতি সমানে বিদ্যমান, তাই , ভদ্রলোকের আশঙ্কা
অমূলক নয়।
হতভম্ব গণেশ কিছু বোঝার আগেই লোকটি গনেশকে জাপ্টে ধরে একটি খোলা জায়গায় এনে ফেলল, " থলিতে কি আছে দেখাও", গণেশ জমা হওয়া ভীড়ের হাতে মার
খাবার থেকে বাঁচার চেষ্টায় থলেটি আঁকড়ে ধরে থাকল, কিন্তু লোকটিও নাছোড়বান্দা, গণেশের হাজার ওজর
আপত্তি সত্ত্বেও যা হোক করে থলেতে উঁকি মেরে ভেতরের জিনিষ দেখেই ভিরমি খাবার জোগাড়, আসলে থলেতে রাখা
গণেশের দাঁতের সুচালো অংশ টি তেই লোকটি খোঁচা খেয়ে ছিল। গণেশের সামলে চলা
উচিত ছিল,কিন্তু ....আজ মনে হচ্ছে যে কপালটিই খারাপ।
ভীড়ের মার যে কি জিনিস তা গণেশ জানে,গণেশ চোখ বুঁজে মারের
জন্য অপেক্ষা করছিল, কিন্তু লোকটি দেখা গেল কোনও রকম চিৎকার চেঁচামেচি না করে গণেশের কানে কানে বলল, " ভাই, বুঝতেই পারছ যে হাতির দাঁত কোনো ছাতা নয় যে ব্যাগে নিয়ে ঘোরাফেরা করবে",
"আর বাঘের ছাল, হাতির দাঁত, এসব সমেত ধরা পড়লে কি হতে পারে বোঝ নিশ্চই?"
গনেশের ভাঁজ করে লুকিয়ে রাখা শুঁড় শুকিয়ে গেলো, কারন কাল সন্ধে বেলায় দাদার ল্যাপটপে
চোরাশিকারের কাহিনী টি সে শুনেছে।
সেই লোকটি আরও ঘন হয়, বলে," যদি বাঁচতে চাও তা হলে আমার কথা শোনো যা বলি কর, তাহলে কোনো ভয়
নেই"।
এরা নিশ্চয়ই তাকেও চোরাশিকারী ভেবে জেলে পাঠাবে, সর্বনাশ! সামনেই আবার পয়লা বৈশাখ , সে জেলে থাকলে
ব্যবসায়ীরা হাল খাতা করবে কিভাবে? বাণিজ্য বিরল এই বঙ্গে সব লাটে উঠবে
যে! আর দোকানে দোকানে তার উদ্দেশ্য যে মিষ্টি ভোগ দেওয়া হবে, তার সবটাই তো ওই
হতভাগা ইঁদুর খাবে, ব্যাটার জন্যই আজ এত দুর্ভোগ। মাথাটা গরম হচ্ছিল, কিন্তু কোনো মতে
সামলে নিয়ে গণেশ লোকটির সাথে চলতে রাজী হয়ে গেল।
উত্তেজিত ভীড় কে শুনিয়ে লোকটি গণেশকে বলল, "মাফ করবেন ভাই, ছাতাটা একটু সামলে রাখলেই তো পারতেন," উত্তম মধ্যম ধোলাই দেবার এমন সুবর্ন সুযোগ টি হাত ছাড়া হয়ে যেতে ভীড়ের
লোকজন বিমর্ষ বদনে নিজের নিজের রাস্তা ধরল।
(৮)
গনেশকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে লোকটি ভুলিয়ে এনে তুলল
বাসুদেবপুর থানায়, আসলে সে হল থানার কনিষ্ঠ কনেস্টবল নীলরতন এর লাগানো খেচর,
গণেশের তো চক্ষু চড়ক গাছ, হরিপদ সরখেল লাফিয়ে
উঠে বললেন," সাবাশ ন্যালা, তোর জন্য আমি সদরে নিশ্চই বলব, হয়ত তুই একটা ভারত
রত্ন টত্ন পেয়ে যেতেও পারিস।
আসলে হরিপদর কথা মত ন্যালার ফিট করা খেচর বাজারে
চক্কর দিচ্ছিল, ঠিক তখনই হরিপদর ভাগ্য বলে আর গণেশের দুর্ভাগ্য বলে তার হাতে পড়ে গণেশ আর, গণেশের হাতে হাত কড়া।
কিন্তু একটা ব্যাপারে হরিপদর খটকা কিছুতেই যাচ্ছিল
না, "আচ্ছা ন্যালা, আমরা তো খুঁজছিলাম বাঘের ছাল, কিন্তু বেরোলো অন্য মাল, আচ্ছা, সুন্দরবনে হাতির দাঁত এলো কি
করে?"
"আরে স্যার," খোলসা করে নীলরতন, আপনি তো খালি প্ৰথম পাতাটি পড়েছেন, তিন নম্বর পাতাটি তো
পড়েই দেখেননি," বলে আফ্রিকার হাতির দাঁতের ব্যাপারটি বলল নীলরতন।
"কিন্তু তিন নম্বর পাতাটি কোথায়?"
লজ্জা লজ্জা কণ্ঠে নীলরতন বললে ,"আজ্ঞে, ওটার ওপরেই তো সকাল বেলায় আপনার জন্য তেলে ভাজা
আর মুড়ি সার্ভ করেছিলাম"।
"হারামজাদা!,তুমি পুরানো কাগজ পাওনি?"
"দেখা কোথায় গেল দাঁতটা, মানে খবর টা", তম্বি করল হরিপদ।
"এইযে স্যার, চপে চাপা পড়ে আছে", বলে আধ খাওয়া চপটি নিজের মুখে চালান করল ন্যালা।
"হ্যাঁ, এইত", বলে বিড়বিড়িয়ে খবর টি পড়লেন হরিপদ।
"হুমম", হুঙ্কার ছাড়লেন হরিপদ,তার মানে, সুন্দরবনের খাঁড়ি পথে চোরা চালান, আন্তর্জাতিক চক্র, মানে 'ভারত রত্ন', 'আফ্রিকার কালোহীরে'"!
খুশীর আতিশয্যে হরিপদ নীলরতন কে জড়িয়ে ধরলেন, " ওরে আমার ন্যালা, ভাই আমার, তুই আমার হীরে, আমার মানিক, আমার গলদা চিংড়ি, আমার ইলিশের পেটি,তুই তো হেলে ধরতে গিয়ে একেবারে কেলে ধরে ফেলেছিস!"
"এবারে আমায় আর পায় কে, এবার দেখি কোন শালা আমার প্রমোশন আর ট্রান্সফার আটকায়,"
"বলে কি না ঘুষ নিই না, ব্যাটা জোচ্চোর বড় সায়েব"।
চতুর্থ পর্ব
ক্রমশঃ