অলীক পাতার অন্যান্য সংখ্যা- পড়তে হলে ক্লিক করুন Library ট্যাব টি



। । "অলীক পাতা শারদ সংখ্যা ১৪৩১ আসছে এই মহালয়াতে। । লেখা পাঠানোর শেষ তারিখ ১৫ ই আগস্ট রাত ১২ টা ।.."বিশদে জানতে ক্লিক করুন " Notice Board ট্যাব টিতে"

Saturday, July 7, 2018

যখন তখন-ধারাবাহিক -দন্ত্যস্থ (তৃতীয় পর্ব)-স্বরূপ চক্রবর্তী




দন্ত্যস্থ

(তৃতীয় পর্ব)

স্বরূপ চক্রবর্তী


সংখ্যা-১৭, (৭ ই জুলাই,২০১৮)




()

চাঁদি ফাটা রোদে, গণেশ ও কার্তিক সমভিব্যহারে বাসুদেবপুর বাজারে প্রকট হলেন মা দুর্গা, জমজমাট ধুলো ভর্তি বাজার, দোকানে দোকানে চৈত্র সেলের ধুম, ব্যানার, ডিসকাউন্ট কত কিছু, ফি বছর বাপের বাড়ি আসা বলতে তো ওই পুজোর সময় প্যান্ডেলে পোজ দিয়ে বসে থাকা আর কৈলাশে ফিরে সারা বছর সংসার সামলানো, মা এর কাছে এই রকম পরিবেশ একদম নতুন , ভীড়ে ভীড়াক্কার রাস্তা আর দোকান গুলো , ঘাম আর উৎকট সস্তা সেন্টের গন্ধে নাড়ী ছাড়ার উপক্রম, লোকেরা কিনছে কম দরাদরি করছে বেশী, দোকানী দের দরাজ ডিসকাউন্টও দরাদরি থামাতে পারছে না, কিন্তু বাপের বাড়ি বলে কথা, মা  বেশ এনজয় করছিলেন, দোকানে দোকানে ঝোলানো জামাকাপড় , কার্তিক খালি তাড়া দিচ্ছে আর বলছে ওই "জটাধারী" না,কি, সেই দোকান টি তাড়াতাড়ি খুঁজে কেনাকাটা সেরে বাড়ি ফিরে চল, আমার সাফোকেশন হচ্ছে। এখানে দৈব শক্তি ব্যবহারের উপায় নেই, তাই হাঁটতে হচ্ছে, কার্তিক আর গণেশ মা এর দুই পাশে হাঁটছে, কার্তিকের ময়ূর আর অস্ত্রশস্ত্র বোনেদের জিম্মায় কৈলাশে, শুধু গণেশ কে নিয়েই মুশকিল, গণেশ তার দেড় খানা দাঁত কে প্যাঁচ খুলে একটি কাপড়ের শান্তিনিকেতনী থলেতে ভরে কাঁধে রেখেছে, বোনেরা  বার বার বলল যে তুই তোর দাঁত গুলি আমাদের দিয়ে যা, আমরা ধুয়ে মুছে চক চকে করে রাখব, কিন্তু কে কার কথা শোনে, তার জেদ, সে থলে নেবেই, কি আর করা, অগত্যা..., ওদিকে ওই দেখে কার্তিক মনেমনে খুশি, কারণ সকালের ওই বাঘের ছাল আর হাতির দাঁতের খবর। " বাছাধন, তুমি এবার ফাঁসলে বলে"।

যাই হোক ওরা তিনজনে জিজ্ঞেস করে করে দোকানের দিকে এগোচ্ছে, কিছুক্ষণ পরেই "জটাধর বস্ত্রবিপনীর" দেখা পাওয়া গেলো, ওঁরা ভেতরে গিয়ে হলধর কে খুঁজে পেলেন, বিশাল বড় দোকান, প্রচুর কাপড় আর প্রচুর খদ্দের।
হলধর  পাঁজা মা আর দুই পুত্রকে খাতির করে বসালেন, মা জননীর গায়ের দুধে আলতা রং, চোখের দীপ্তি, পরনের দামি শাড়ি এসব দেখে বোঝাই যায় যে তিনি কোনো বড় বংশের গৃহিনী, সাথে দুই  ছেলে, একটির চোখ টানাটানা, কোঁকড়া কালো চুল, অন্যটি  বেশ নাদুসনুদুস, এঁদের দেখে যেন সাক্ষাৎ শিব পরিবারের কথা মনে পড়ে, হলধরের মনে ভক্তি ভাব জেগে উঠল, উনি নিজে হাতে করে ওঁদের কাপড় দেখাতে লাগলেন।
এরই মধ্যে হঠাৎ গণেশের উসখুসুনি শুরু হল, আসলে সবাই নিজের নিজের বাহন রেখে এলেও গণেশ তার প্রিয় ইঁদুর কে ছেড়ে আসতে পারেনি, আর বঙ্গে ইঁদুরের কখনো কোনো অভাব দেখা  যায়নি, ফলে ইঁদুর কে দেখে কেউ গ্রাহ্য করবেনা এটাই স্বাভাবিক, আর ঠিক এই কারণেই গণেশ ওই থলে টা নিয়ে এসেছে , যাতে করে ওর বাহন কে লুকিয়ে আনা যায়, কিন্তু, দোকানের ভেতরে আসা ইস্তক ইঁদুর টি বড্ড ছটফট করছে, তাই মা আর দাদাকে বলে গণেশ খোলা হাওয়া খাওয়ার বাহানায় দোকানের বাইরে গিয়ে দাঁড়াল, কিন্তু ইঁদুর টি এত পাজি যে একটু সুযোগ পেতেই ঝোলা টপকে  এক্কেবারে রাস্তায় পড়ে ঝড়ের বেগে দৌড় লাগালো, "আঃ বাঁচা গেল, যা ভারী মালিক , তাকে বইতে বইতে জান এক্কেবারে কালি হয়ে গেলো, এই সুযোগ ছাড়া যায়?"

()

গণেশ থতমত খেয়েই নিজেকে সামলে দৌড় লাগালো পিছু পিছু, বাজারের ভীড়ের মধ্যে লোকজনের ধাক্কা বাঁচিয়ে, স্রোতের উল্টো দিকে কোনোও ভাবে গণেশ এগিয়ে চলছে, ভাগ্যিস দৈব শক্তি ব্যবহার নিষিদ্ধ, নইলে এতক্ষনে ইঁদুর বাবাজি কব্জা হয়ে যেতেন।  ওদিকে থলেতে দাঁত গুলো রয়েছে, কিন্তু না, অনেক চেষ্টা করেও গণেশের সাথে একটি সিঁড়িঙে লোকের ধাক্কা লেগেই গেল,আর ধাক্কা লাগতেই লোকটি কঁকিয়ে উঠল, " আরে আরে! আপনার থলেতে কি আছে মশাই? বন্দুক টন্দুক নয় তো? না কি তলোয়ার বল্লম টল্লম কিছু?", “আপনি ডাকাত না কি?"
বলে রাখা ভালো যে সুন্দরবনের এইসব এলাকা, বিশেষতঃ নেতিধোপানী এলাকা  পর্তুগীজ জলদস্যুদের লুকোনোর স্থান ছিল, ১৭৫৭ সালে মুঘল বাদশা দ্বিতীয় আলমগীরের হাত থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুন্দরবনের দখল নিয়ে এই সব ডাকাতদের কিছুটা দমন করেছিল, কিন্তু আজ এই একবিংশ শতকেও ডাকাতি সমানে বিদ্যমান, তাই , ভদ্রলোকের আশঙ্কা অমূলক নয়।
হতভম্ব গণেশ কিছু বোঝার আগেই লোকটি গনেশকে  জাপ্টে ধরে একটি খোলা জায়গায় এনে ফেলল, " থলিতে কি আছে দেখাও", গণেশ জমা হওয়া ভীড়ের হাতে মার খাবার থেকে বাঁচার চেষ্টায় থলেটি আঁকড়ে ধরে থাকল, কিন্তু লোকটিও নাছোড়বান্দা, গণেশের হাজার ওজর আপত্তি সত্ত্বেও যা হোক করে থলেতে উঁকি মেরে ভেতরের জিনিষ দেখেই ভিরমি খাবার জোগাড়, আসলে থলেতে রাখা গণেশের দাঁতের সুচালো অংশ টি তেই লোকটি খোঁচা খেয়ে ছিল। গণেশের সামলে চলা উচিত ছিল,কিন্তু ....আজ  মনে হচ্ছে যে কপালটিই খারাপ।
ভীড়ের মার যে কি জিনিস তা গণেশ জানে,গণেশ চোখ বুঁজে মারের জন্য অপেক্ষা করছিলকিন্তু লোকটি দেখা গেল কোনও রকম চিৎকার চেঁচামেচি না করে গণেশের কানে কানে বলল, " ভাই, বুঝতেই পারছ যে হাতির দাঁত কোনো ছাতা নয় যে ব্যাগে নিয়ে ঘোরাফেরা করবে",
"আর বাঘের ছাল, হাতির দাঁত, এসব সমেত ধরা পড়লে কি হতে পারে বোঝ নিশ্চই?"
গনেশের ভাঁজ করে লুকিয়ে রাখা শুঁড় শুকিয়ে গেলো, কারন কাল সন্ধে বেলায় দাদার ল্যাপটপে চোরাশিকারের কাহিনী টি সে শুনেছে।
সেই লোকটি আরও ঘন হয়, বলে," যদি বাঁচতে চাও তা হলে আমার কথা শোনো যা বলি কর, তাহলে কোনো ভয় নেই"।
এরা নিশ্চয়ই তাকেও চোরাশিকারী ভেবে জেলে পাঠাবে, সর্বনাশ! সামনেই আবার পয়লা বৈশাখ , সে জেলে থাকলে ব্যবসায়ীরা হাল খাতা করবে কিভাবে? বাণিজ্য বিরল এই বঙ্গে সব লাটে উঠবে যে! আর দোকানে দোকানে তার উদ্দেশ্য যে মিষ্টি ভোগ দেওয়া হবে, তার সবটাই তো ওই হতভাগা ইঁদুর খাবে, ব্যাটার জন্যই আজ এত দুর্ভোগ। মাথাটা গরম হচ্ছিল, কিন্তু কোনো মতে সামলে নিয়ে গণেশ লোকটির সাথে চলতে রাজী হয়ে গেল।
উত্তেজিত ভীড় কে শুনিয়ে লোকটি গণেশকে বলল, "মাফ করবেন ভাই, ছাতাটা একটু সামলে রাখলেই তো পারতেন," উত্তম মধ্যম ধোলাই দেবার এমন সুবর্ন সুযোগ টি হাত ছাড়া হয়ে যেতে ভীড়ের লোকজন  বিমর্ষ বদনে নিজের নিজের রাস্তা ধরল।

()

গনেশকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে লোকটি ভুলিয়ে এনে তুলল বাসুদেবপুর থানায়, আসলে সে হল থানার কনিষ্ঠ কনেস্টবল নীলরতন এর লাগানো খেচর,
গণেশের তো চক্ষু চড়ক গাছ, হরিপদ সরখেল লাফিয়ে উঠে বললেন," সাবাশ ন্যালা, তোর জন্য আমি সদরে নিশ্চই বলব, হয়ত তুই একটা ভারত রত্ন টত্ন পেয়ে যেতেও পারিস।
আসলে হরিপদর কথা মত ন্যালার ফিট করা খেচর বাজারে চক্কর দিচ্ছিল, ঠিক তখনই হরিপদর ভাগ্য বলে আর গণেশের দুর্ভাগ্য বলে  তার হাতে পড়ে গণেশ আর, গণেশের হাতে হাত কড়া।
কিন্তু একটা ব্যাপারে হরিপদর খটকা কিছুতেই যাচ্ছিল না, "আচ্ছা ন্যালা, আমরা তো খুঁজছিলাম বাঘের ছাল, কিন্তু বেরোলো অন্য মাল, আচ্ছা, সুন্দরবনে হাতির দাঁত এলো কি করে?"
"আরে স্যার," খোলসা করে নীলরতন, আপনি তো খালি প্ৰথম পাতাটি পড়েছেন, তিন নম্বর পাতাটি তো পড়েই দেখেননি," বলে আফ্রিকার হাতির দাঁতের ব্যাপারটি বলল নীলরতন।
"কিন্তু তিন নম্বর পাতাটি কোথায়?"
লজ্জা লজ্জা কণ্ঠে নীলরতন বললে ,"আজ্ঞে, ওটার ওপরেই তো সকাল বেলায় আপনার জন্য তেলে ভাজা আর মুড়ি সার্ভ করেছিলাম"।
"হারামজাদা!,তুমি পুরানো কাগজ পাওনি?"
"দেখা কোথায় গেল দাঁতটা, মানে খবর টা", তম্বি করল হরিপদ।
"এইযে স্যার, চপে চাপা পড়ে আছে", বলে আধ খাওয়া চপটি নিজের মুখে চালান করল ন্যালা।
"হ্যাঁ, এইত", বলে বিড়বিড়িয়ে খবর টি পড়লেন হরিপদ।
"হুমম", হুঙ্কার ছাড়লেন হরিপদ,তার মানে, সুন্দরবনের খাঁড়ি পথে চোরা চালান, আন্তর্জাতিক চক্র, মানে 'ভারত রত্ন', 'আফ্রিকার কালোহীরে'"!
খুশীর আতিশয্যে হরিপদ নীলরতন কে জড়িয়ে ধরলেন, " ওরে আমার ন্যালা, ভাই আমার, তুই আমার হীরে, আমার মানিক, আমার গলদা চিংড়ি, আমার ইলিশের পেটি,তুই তো হেলে ধরতে গিয়ে একেবারে কেলে ধরে ফেলেছিস!"
"এবারে আমায় আর পায় কে, এবার দেখি কোন শালা আমার প্রমোশন আর ট্রান্সফার আটকায়,"
"বলে কি না ঘুষ নিই না, ব্যাটা জোচ্চোর বড় সায়েব"


দ্বিতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব
ক্রমশঃ





Thursday, July 5, 2018

যখন তখন-ধারাবাহিক -দন্ত্যস্থ (দ্বিতীয় পর্ব)-স্বরূপ চক্রবর্তী

দন্ত্যস্থ

(দ্বিতীয় পর্ব)

স্বরূপ চক্রবর্তী


সংখ্যা-১৬, (৬ ই জুলাই,২০১৮)

()

একেবারে ভোর রাতে ধানাই-পানাই, থুড়ি, নন্দী- ভৃঙ্গী মহাদেবের সামনে করজোড়ে  দাঁড়িয়ে সব ব্রিফ করল শুধু গাঁজা খাওয়ার ব্যাপারটা সযত্নে এড়িয়ে গেল, কারন ডিউটি আওয়ার্সে নেশা করা বাবার না পসন্দ। মহাদেব ওদের কাজে খুশি হয়ে হৃষ্ট চিত্তে বললেন , যা ব্যাটারা, আজ তোদের ছুটি, আর এই নে পেসাদ, বলে গাঁজার কলকে টি ওদের হাতে তুলে দিলেন।

ওদিকে সকাল থেকেই  মা দুর্গা, গণেশ ও কার্তিক সাজুগুজু করে একেবারে যাকে বলেরেডি
বেরোবার আগে মা ছেলেদের নিয়ে শিবঠাকুরের কাছে এলেন, বললেন ,"এগোচ্ছি, তোমার জন্য পান্তা ভাত আর আলুসিদ্ধ করে রেখে যাচ্ছি, যা গরম, এবারে তো দেখছি কৈলাশেও শান্তি নেই",
মহাদেব স্মিত হেসে বললেন ," আমার জন্য ভেবো না, আর , বাসুদেবপুর বাজারে নন্দীরা গিয়ে খবর নিয়ে এসেছে, ওখানে জটাধর বস্ত্রবিপনীর মালিক হলধর পাঁজা খুব ভালো লোক, আমাকে মন্যি করে, বড় কাপড়ের দোকান, ওখান থেকেই তোমরা তোমাদের জিনিষ  খুঁজে নিও"।
বাবার কথা শুনে মা খুব খুশি হলেন, ভাবলেন, মানুষ টা যেমনই হোক, আমাকে খুব ভালো বাসে।
"আর শোনো", বাবা চালিয়ে যান, "একটা কথা মনে রেখ, ওখানে গিয়ে নিজেদের স্বরূপ প্রকাশ করবে না, আর দৈব শক্তি প্রয়োগ নৈব নৈব চ, ওই ব্যাটা মর্তবাসী দের কোনও হক নেই ওদের ওই পাপ চক্ষে আমাদের দেখার, মনে থাকে যেন", চোখ পাকিয়ে সাবধান করলেন ভোলে বাবা।
মা মাথা নিচু করে ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন; আর বললেন,"আচ্ছা , চলি, আর তুমি কিন্তু ওই ছাইপাঁশ গাঁজা  খাবেনা মোটেই, তোমার আবার গরমে এইসব সহ্য হয়না।"
রটন ওল্ড ফ্যাশনড ন্যাকা ফ্যামিলি প্রেম, একে অপরের স্পেস হ্যাক করে খবরদারি",” কি হলো, চলো", কার্তিক তার বিরক্তি প্রকাশ করল।
আচ্ছা আচ্ছা আসছি বাবা, বললেন মা।

()

সবে মাত্র সকাল হচ্চে, আকাশ হালকা হলদে বরণ ধরেছে, বাসুদেবপুর বাজারের এক কোনায় খাঁড়ির এক্কেবারে গা ঘেঁষে অবস্থিত বাসুদেবপুর থানা, বাজার খুলতে এখনো অনেক দেরি, কিন্তু এই ভোরেই থানার ইনচার্জ  হরিপদ সরখেল ব্যাজার মুখে ডিসচার্জড হয়ে চেয়ারে এলিয়ে বসে আছেন, একে তো কুটকুটে গরম, তার ওপর সিলিং ফ্যানটাও যেন ঘুরতে চাইছে না, কনিষ্ঠ কনেস্টবল নীলরতন প্রানপনে হাত পাখা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু গরম যেন আর কমেই না।
বছর পঞ্চান্নর হরিপদর মনে মোটেই সুখ নেই, কারন আজ প্রায় সাত বছর হলো এই পাণ্ডব বর্জিত জঙ্গলে শাস্তিমূলক পোস্টিংয়ে পড়ে আছেন, ওনার  প্রমোশোনও আটকে আছে, তার জন্য উনি নিজেকে মোটেই দোষারোপ করেন না,
হতে পারে যে দু একটা ঘুষের আর কয়েদি ফেরার হবার মামলা চলছে ওনার নামে, তা, সে আর এমন কি, অমন এক আধটা মামলা তো থাকতেই পারে, তা, বলে এই শাস্তি!
এইত সেদিন, সদরে  গিয়েছিলেন একটি কেসের তদ্বির করতে, তা , বড় সায়েব বললেন,
েখুন মশাই, প্রোমোশনের কথা আপনি ভুলেই যান",
"হেঁ হেঁ, ক্যানো সার?"
"এসব ছোট খাটো চোর বাটপাড় ধরে আপনি নিজের ক্যারিয়ারের কালি মুছতে পারবেন না", "যদি ভালো কোনও কেস সলভ করতে পারেন, তাহলেই আমার কাছে তদ্বির করতে আসবেন, না হলে নয়ুষ আমি নিই না, আর, যাবার সময় দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যাবেন।"

স্পষ্ট ইঙ্গিত বুঝে কোনও ক্রমে হতাশা সামলে বিমর্ষ  সরখেল দরজার দিকে পা বাড়াতেই  বড় সায়েব বলে উঠলেন, " গত পরশু আপনার চেলা নীলরতনের হাতে যে রসগোল্লার হাঁড়ি টি পাঠিয়ে ছিলেন , সেটার মধ্যে কতগুলি যেন পচা পচা ঠেকছিল, নেহাতই আমার বাচ্চাটা হ্যাঙলা, সবকটা মেরে দিল তাই, না হলে গিন্নি বলছিলেন যে আপনি এলে আপনাকে জল খাবারে খাওয়াবেন, যত্তসব আনাড়ী, ওদিকে গিন্নির আবার একজোড়া ঝুমকো দুলের শখ হয়েছে, আমার সময় নেই, তা, আপনি কি জানেন কোনো স্যাকরার খবর, যেখানে খাঁটি মাল পাওয়া যাবে?"
সরখেল হালে পানি পেয়ে আকর্ন বিস্তৃত হাসি দিয়ে বললেন, " হেঁ হেঁ , কি যে বলেন স্যার, আমি কালই বাসুদেবপুরের সেরা স্যাকরার থেকে স্যাম্প্যাল পাঠিয়ে দেব 'খন, সাথে সুন্দর বনের খাঁটি মধু,", "আরে, নাআআআ, না, দাম নিয়ে কিস্যু ভাববেন না, ওটাতো আর ঘুষ নয়, ওটা আমার তরফ থেকে বৌদি আর ভাইপোর জন্য কিঞ্চিৎ ...মানে... উপহার... মাত্র...., আর, ইয়ে, স্যার, আমার, মানে, ফাইলটা যদি ... একবার",
"বললাম না, কোনও ভালো কেস সলভ করুন, তবেই আপনার ফাইল মুভ করবে, নচেৎ নয়"।
সরখেল হাঁড়ি মুখে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন….

"এই হারামজাদা ন্যালা, বলি ঘুমিয়ে পড়লি না কি ব্যাটা, হাত পাখাটা জোরে জোরে চালা"
"শরীরটা বড্ড ম্যাজ  ম্যাজ করছে, আলস্য কাটাতে একটা বিশাল হাই তুলে কোনও মতে আড়াইমনি শরীর টাকে চেয়ার থেকে মুক্ত করে সরখেল হাতে রুলটি তুলে নিয়ে হাজতের দিকে এগিয়ে গেলেন, হাজতের ভেতরে তিনজন কয়েদি ছিল, দুইজন কে দেখলেই বোঝা যায় যে, এই হাজত টি হল তাদের ঘর বাড়ি, দিব্যি দুই জনায় বাজি রেখে তাস খেল ছিল, তৃতীয় জন একটি বছর বিশের যুবক, দেখলেই বোঝা যায় শিক্ষিত , ভদ্র, সে হাজতের এক কোনায় হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে ছিল, সরখেল কে ভেতরে আসতে দেখে প্রথম দুই জন উঠে সেলাম ঠুকল, আর সরখেল বিনা বাক্য ব্যয় করে এলো পাথাড়ি রুল চালাতে লাগল, আর ওরা যথা সাধ্য চেষ্টা করছিল বেঁকে চুরে মার এড়াতে, মিনিট পাঁচেক এভাবে চলার পর সরখেল হাঁপিয়ে মার বন্ধ করল, কয়েদি দুটো সরখেল কে সমীহ করে বলল, "স্যার, লাগেনি তো?", "আপনার দয়ায় কিছু করেকম্মে খাচ্ছি, আপনি চোট পেলে যে আমাদের নরকেও ঠাঁই হবে না", আশীর্বাদের ভঙ্গীতে ওদের মাথায় হাত রেখে সরখেল মুড়লেন সেই যুবক টির দিকে,মিচকি হেসে বললেন " তা, শালা বাবু, কেমন আছেন? আপনার জামাই বাবুকে খবর পাঠানো হয়েছে, উনি আপনার জন্য জামিন নিয়ে এলেই আপনি ছাড় পেয়ে যাবেন, আর যদি না আসেন..হেঁ হেঁ, তাহলে এই রুল দিয়ে....", বলে রুলটি ছেলেটির নাকের সামনে ঘোরালেন।
"আপনি কিন্তু অন্যায় করছেন স্যার, আমি কিছুই করিনি, দিদি জামাই বাবুর বাড়িতে বেড়াতে আসা কি অন্যায়?" ছেলেটি বলে উঠল।
"না, না, না,না, সেটা অন্যায় হবে কেন? কিন্তু আমার এলাকায় বড়লোক স্যাকরা হওয়া পাপ, সেই স্যাকরার শালা হওয়া পাপ, আর আরও পাপ বড় সায়েবের গিন্নির যখন ঝুমকো দুলের শখ উঠবে তখন জামাই বাবুর বাড়ি বেড়াতে আসা", "বুঝেছ হে ছোকরা? বেশি আইন দেখিও না, এটা কলকাতা নয়, বাসুদেবপুর, এখানে কয়েদিদের আমি আকছার হাপিস করে দিই, কেউ জানতেও পারে না"।
বলে সরখেল হৃষ্ট চিত্তে নিজের চেয়ারে এসে এলিয়ে বসলেন, বেলা প্রায় সাড়ে আটটা, ইতিমধ্যে  নীলরতন মোড়ের দোকান থেকে তেলেভাজা, গরম জিলিপি আর মুড়ি নিয়ে এসে দারোগা বাবুর সামনের টেবিলে পাতা খবরের কাগজের ওপর রেখেছে, দারোগা গিন্নির রাতে টিভিতে  হিন্দি সিনেমা দেখে শুতে রাত হয়, তাই সকালের জলখাবার টা দারোগা সায়েব এই থানাতেই সারেন।
মুখে একমুঠো মুড়ি আর আধখানা চপ ফেলে দারোগা বাবু কাগজে মন  দিলেন।
প্রথম পাতাতেই এক্কেবারে বড় বড় হেডিং, " রয়্যাল বেঙ্গল রহস্য", পুরো খবরটা পড়েই হরিপদ সরখেল লাফিয়ে উঠলেন, " আরে!! এত একেবারে আমার নাকের ডগায়"।
"কি স্যার? মাছি?" , বলে উঠল নীলরতন ওরফে ন্যালা।
হরিপদ খেঁকিয়ে  উঠলেন, "চোপ , মাছি নয় রে হতভাগা, বাঘ,"
আতঙ্কিত নীলরতন ইতি উতি দেখে ভয়ে ভয়ে বলল, "বা..ঘ, কক..কোথায় স্যার?"
আসলে একেবারে  খাঁড়ির এপারে লাগোয়া এই বাজার ও থানা এলাকা। খাঁড়ির ওপারে লাগোয়া সুন্দর বন থেকে ইয়া ইয়া কেঁদো সাইজের বাঘ মাঝে মাঝে  জল খেতে  চলে আসে, যদিও খাঁড়ি পেরিয়ে এপারে কোনো দিন আসেনি, তবে আসবেনা, তার গ্যারান্টি কোথায়?
হরিপদ বললেন," আমার নাকের ডগা দিয়ে... বাঘের ছাল পাচার!দাঁড়া, দেখাচ্ছি "

শুনে নীলরতন হাঁফ ছাড়ে।

তড়িঘড়ি ভুঁড়ি ওয়ালা পেটের ওপর বেল্টটা টাইট করে শার্টের কলার ঠিক করে সিধে হয়ে বসলেন সরখেল, ভাবলেন এই মওকা, কেসটা সলভ করতে পারলে কেল্লা ফতে, পেয়ারের নীলরতন কে  কাছে ডেকে চাপা গলায় সমস্ত প্ল্যানটা বোঝালেন , " শোন ন্যালা, তুই আজ থেকেই লেগে পড়, চারিদিকে খেচর লাগা, ওই পোচাররা, বাঘের ছাল পাচার করার আগেই ওদের পাকড়াও করা চাই,তাহলেই আমার এই নির্বাসন থেকে মুক্তি, আর তোরও একটা হিল্লে হয়।



ক্রমশঃ

প্রথম পর্ব


তৃতীয় পর্ব





Main Menu Bar



অলীকপাতার শারদ সংখ্যা ১৪২৯ প্রকাশিত, পড়তে ক্লিক করুন "Current Issue" ট্যাব টিতে , সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

Signature Video



অলীকপাতার সংখ্যা পড়ার জন্য ক্লিক করুন 'Current Issue' Tab এ, পুরাতন সংখ্যা পড়ার জন্য 'লাইব্রেরী' ট্যাব ক্লিক করুন। লেখা পাঠান aleekpata@gmail.com এই ঠিকানায়, অকারণেও প্রশ্ন করতে পারেন responsealeekpata@gmail.com এই ঠিকানায় অথবা আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।

অলীক পাতায় লেখা পাঠান