ডিঙি-সম রয়েছি ভেসে।
পক্ষ শুক্ল হলেও কৃষ্ণকে হারিয়েছে আঁধার! মেঘাচ্ছন্ন আকাশ,
বিদ্যুৎ- লতার শিহরণে,
মেঘ- মন্দ্রিত ধ্বনিতে,
কম্পিত বক্ষে চলেছি-
পথ কোথা!
দ্রুতগতি যানে রচিত তরঙ্গমালা।
অর্নবের সাথে কি তুলনীয়!
যায় কি বলা-তবু মনে আসে!
অত্যন্ত ধীরে, সন্তর্পণে চলেছি, একা নই
ক্লান্তি, উদ্বেগ আঁকে মিছিলের রূপ-রেখা।
হ্যাঁ, তলিয়ে গেছে বহু দ্রুতযানের গতিপথ ।
হারিয়ে যায়, দিশাহীন অনুভূতি
আসে তো জীবনে।
অবাক না তো! কেবল বঙ্কিম, বন্ধুর পথ।
কঠিন হলেও সঠিক ;
অতএব,
ছেড়ো না, ছাড়িনি, চলেছি সেই পথেই ;
লক্ষ্যে পৌঁছে গেছি প্রায়।
হ্যাঁ, প্রবল বর্ষণে জলের তলায় লৌহ-পাত।
-আরে! আস্তে আস্তে! দেখে চলুন!
দুপুরের পর থেকে এমন ঝেঁপে বৃষ্টি এলো! অবশ্য বর্ষাকালে এটাই তো স্বাভাবিক। আগে আগে অফিস থেকে ফেরার ইচ্ছে হলেও পারলো না নীলা, এসে গেল কিছু কাজ। রাস্তায় বেরিয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা লদ্ধ উপলব্ধি আবারও, দুকূল ছাপিয়ে ঢেউ তুলে চলেছে যারা, ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, করি কি উপায়! অবশেষে জুটে গেল, এসে স্টেশনে পৌঁছানো গেল। সহযাত্রী পরিচিত দল ছত্রভঙ্গ অতএব অল্প মুখ চেনা, অচেনা সহযাত্রী সহ ঠাঁই মিললো ট্রেনে। উফফ্, যা চিন্তা লাগছিল! আচমকা থেমে গেল ট্রেন। অসহ্য ভ্যাপসা গরম, অস্থির ক্লান্ত মানুষের দল বাধ্য হলো নামতে। যান্ত্রিক বিভ্রাট অতএব ! কিইই! কতক্ষণ থাকতে হবে এভাবে? নানান আলোচনা, মতামত শুনছে আর ভাবছে, কানে এলো পরবর্তী স্টেশন বেশী দূরে নয়, হেঁটে পৌঁছানো তো যাক্, ওখান থেকে...... আর এই দমবন্ধ হয়ে থাকার চেয়ে হাঁটা ভালো। নামতে শুরু করেছে অনেকেই, আজ লেডিসে উঠতে পারেনি, অস্বস্তি হচ্ছিল এখন মনে হচ্ছে ভালো বলতে এটাই।অপরের সামান্য সাহায্যে নেমে নীলা মিছিলে অংশ গ্ৰহণ করে। দুপাশে জনবসতি আঁধারে ঢাকা, মোটামোটি সারিবদ্ধ হয়ে লাইনের মাঝ দিয়ে যাওয়া। টুকরো টুকরো অজস্র কথা শোনার মাঝে কখন যে আনমনা হয়ে গেছিল, মনে মনে নিজ-পছন্দ নেশায় মেতে ছিল।
-লেগেছে?
অপ্রস্তুত নীলা পড়ে যাওয়া ব্যাগ, ছাতার সাথে নিজেকে সামলাতে সামলাতে বলে "না,না ঠিক আছে আসলে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না তো!
-দেখার উপায় আছে!
-এই সবাই একটু দেখে দেখে চলুন
আশেপাশের উক্তি। মোবাইলের আলোয় বাড়ানো হাত ধরে উঠেই আবছা আলোয় দেখতে গিয়ে পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোতের অনুভব।
-ঐ যে নীলিমাদি এসে গেছেন।
-আরে এই ওয়েদারে জমাটি গান চাই।
-আজ শরীরটা ভালো নেই, গাইতে পারবো না গো!
-ঠান্ডা লাগিয়েছেন তো! গলা খারাপ বোঝা যাচ্ছে!
-দ্যাখো, ওরা খালি ভূতের গল্প করছে, আমার ভয় লাগে বাবা। জেনারেটরও চলতে চলতে বন্ধ হলো যে কেন ছাতু, ভাল্লাগে না।
সমস্বরে সবার হাসির মাঝে নীলিমা বলে -আমি একটা গল্প বলতে পারি, না ভূতের ঠিক নয়, অদ্ভুতুড়ে বলা যায় !
-আরে, বলুন দিদি
-আঃ, মোমবাতির আলো এবার জমে যাবে!
-না, না ঠিক সেরকম কিছু নয়, তবে বৃষ্টির.....
বেশ একটা গা ছমছম করা পরিবেশে এভাবেই শুরু করেছিলেন নীলিমাদি।
-কেন, কেন!
-পূর্ব পরিচিত নিশ্চয়ই!
-আরে চুপ করো না!!
-হ্যাঁ, চেনা বৈকি! খুউব চেনা। মূহুর্তে মন থেকে বাড়ি ফেরার উদ্বেগ মিলিয়ে গেল। শরীরের ক্লান্তি! উধাও। কে যেন ওকে নিয়ে যাচ্ছে আর বলছে এই সুযোগ, শেষ সুযোগ, ছাড়িস না।
-কেন! ক্ষতি করেছিল?
-তাহলে আরো একটু খুলে বলি
-বলো,বলুন, বলুন
-মফস্বলের উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের চার ভাইবোন-দুই ভাই দুই বোন। বোন সবার ছোট, একটু বেশিই ছোট নীলা। দিদি অঞ্জনা খুব মিশুকে, চেহারা, পড়াশোনা সবেতেই এগিয়ে। নীলা একটু সম্ভ্রম করেই চলতো। ওর যখন স্কল-জীবন দিদি তখন কলেজ পেরিয়ে যাচ্ছে, এমন সময় সুখী পরিবারে এলো বজ্রাঘাত, দিদি পাড়ারই একটি ছেলের সাথে পালিয়ে গেল, গেল কারণ বাবার আনা পাত্রের সন্ধান এবং তাদের পছন্দের খবর, সাথে দিদির নিজ-পছন্দে বাস, দৃঢ় অবস্থান, জানাজানির পর উভয় পরিবারের তীব্র আপত্তি। জাত, অর্থনৈতিক অবস্থান নানান অজুহাত, সঙ্গে নাগাড়ে শাসন-চলে গেল। দিদি চুপচাপ, কান্নাকাটি, মা-বাবার গুরুগম্ভীর আচরণ সব মিলিয়ে বোঝে নীলা, কিন্তু এমনই বয়স যে ওর কোন কথাই বলা চলে না, কারো সাথেই।
দিদির না ফেরায় আবারো চাঞ্চল্য, অস্থির পরিবেশ। জানতে বাকি রইলো না ঐ ছেলেটিও নিরুদ্দেশ অতএব ........ ।রাগ, দুঃখ যখন আছড়ে ফেলছে দুই পরিবারকে, এলো আরো মারাত্মক সংবাদ। ডায়মন্ড হারবারের কাছে রেল লাইনে কাটা পড়েছে এক যুবক-যুবতী। একাত্মা হয়ে গেল দুই পরিবার শোকে, পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে লাইনে কাটা পড়ে মৃত্যু না-
-মানে! আগেই!
-ঐ লোকটা খুনি তাই তো!
-হতেও পারে!
-দাঁড়াও না, তারপর কি হলো শুনি।
হা-হুতাশে দিন কাটছে, ক্রমে জানা গেল আরো দু-তিনজনের কথা, সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে, অর্থ, ক্ষমতা হারিয়ে দিলো দুই পরিবারকে তবে মূল সন্দেহের তীর যার দিকে তাকে চেনা হয়ে গেল। কিছুদিন পর ছেলেটির পরিবার পাড়া ছাড়া সন্দেহ দৃঢ় হলো তবে আফসোস তো রয়েই গেল।
সন্ধ্যের পর লাইট নেই, হ্যারিকেন জ্বালিয়ে নীলা পড়ছে, সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল-"বোন, এ্যাই বোন"
-মাআআআ, দিদি ইইই
-কিরে, কি হলো ! ওমা একি!!
-নীলু, মা
চোখে মুখে জলের ছিটে দেবার পর তাকিয়ে দেখে মায়ের কোলে মাথা, চারপাশে উদ্বিগ্ন মুখ, মায়ের চোখে জলের ধারা।
-কিরে, কি হয়েছে? চ্যাঁচালি কেন?-দিদিই!
-কিইই! কোথায়?
-ঐখানে, আমাকে ডাকলো তো-
-দূর, তাই কখনো হয়! ও আর কেমন করে আসবে বলতে বলতে মায়ের মুখ আঁচল-চাপা।
-ওঠ্, উঠে পড়্, ও রকম মনে হয়; নিশ্চয়ই ওর কথা ভাবছিলি!
-না, সত্যি , আমি তো পড়ছিলাম
-ছাই, ঘুমাচ্ছিলি, স্বপ্ন দেখেছিস। উঠে বোস্ তো বলে বড়দা বেরিয়ে যায়। মাও গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যায় কিন্তু এখনো যে টাটকা অনুভূতি। তারপরও এই ঘটনা, আলোচনা, ইত্যাদি হয়েছে ওর সাথে ক্রমে ক্রমে নীলা অভ্যস্ত হয়ে গেছিল। ভয়ডরও ছিল না, কেবল ওর বক্তব্য ঠিকঠাক বুঝতে পারে না, কাউকে যে বলবে! এভাবেই দিন থেকে মাস, মাস থেকে বছর পেরিয়ে পেরিয়ে আজ নীলা এক অফিসের কর্মী। ডেইলি প্যাসেঞ্জার। বাবা-মা নেই, বড়দার বিয়ে হয়েছে, চলছিল বেশ। হ্যাঁ, একটা কাঁটা তো রয়েই গেছে, জানান দেয় বৈকি। আজো এই আবছা আলোয় নীলা যেন দিদিকে এক ঝলক দেখতে পেলো আর তারপর উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা সব উধাও হয়ে গেল। অজানা এক শক্তি ওকে পরিচালিত করছে আর বলছে " ঐ যে সে, ঐ যে-যন্ত্রচালিত পুতুলের মতোন বাকী সময় (পরে জেনেছে আড়াই ঘণ্টা) এক ঘোরাবিষ্ট।
-অনুগ্ৰহ করে শুনবেন আপ......
ঝিমিয়ে পড়া ক্লান্ত মানুষের দল দ্রুত নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ট্রেন ঢুকছে, সবারই সেদিকে নজর কেবল নীলার-আলতো করে ধাক্কা দিতেই কাজ সারা, বিশেষ জোর খাটাতে হলোনা।
-আআআ
-হায় ভগবান! ঐ যে, ঐ মহিলা...
গ্ৰেপ্তার হলো নীলা।
-অতো লোকের মধ্যে?
-অনেক লোক তবে কার ভিতরে কি চলে সেতো আর জানা যায় না আর নীলাই কি জানতো! সম্বিৎ ফিরে পেতে ভাবছে এ আমি কি করলাম, কেমন করে পারলাম!
-আচ্ছা, আপনি এটা সত্যি ঘটনা বলছেন?
-হ্যাআআ
-এতো কথা জানলেন কি করে?
-আপনার ঘনিষ্ঠ কেউ?
-যে লোককে সন্দেহ, এতো বছর পরও তাকে ঐ পরিবেশে চিনতে পারলো ঐ নীলা না কে?
-বিচারে সশ্রম কারাদন্ড, যাবজ্জীবন আর তখন প্রমাণিত সঠিক ব্যক্তি। আচ্ছা চলি এবার। শুভ রাত্রি।
-হ্যাঁ, হ্যাঁ আমরাও উঠবো এবার।
-নীলিমাদিকে আজকে যেন কেমন কেমন লাগলো!
-কেমন আবার! তোমার যতো মনগড়া....চলো তো।
-শরীরটা ভালো না বললেনই তো!
-আমি ভাবছি ঐ নীলা মানে নামটা যদি সত্যি হয় ওনার খুব ঘনিষ্ঠ, নাহলে এতো কথা......
প্রতিবছরই এই তারিখে বড্ড চঞ্চল, অস্থিরবোধে আক্রান্ত হয় নীলা, নীলিমা। না, মা-বাবা,দিদি এদের মৃত্যু দিন না, আজো ভাবে কি করে পারলাম! বিচারের সময় উকিল দাদাদের শত অনুরোধেও রাখেনি, আদালতে প্রশ্নের উত্তরে বলেছে, " আমি দোষী, উকিল দিয়ে কি হবে"! সময়ের আগেই মুক্তি মিলেছে, তখনো ব্যাকুলতা "এখানেই বোধহয় ভালো ছিলাম, দাদাদের আবার....." না, ছোড়দা পিঠোপিঠি , বিয়ে করেনি, ছোট্ট ফ্ল্যাট নিয়েছে ওদের দুজনের জন্য, এনে তুলেছে সেখানেই। দাদা বৌদি আসে। ব্যবহারের গুণ এখানেও প্রকাশিত তাই অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সে ফ্ল্যাটের সবার সাথে মিলে গেছে। ছোড়দা গ্ৰন্থ-কীট, অবসরের পর ঐ নিয়েই থাকে আর আছে খেলা। মন খারাপ হলে রবির স্মরণাগত, ইচ্ছে হচ্ছিল তাও নীচে রোজকার আড্ডায় যেতে বাধ সাধলো সেই মনই।
এই ফ্ল্যাটটাকে ভালো লাগে এখানকার সেক্রেটারি অভিজিতের জন্য। ওর নির্দেশ : সবাই রোজ না পারো কমিউনিটি হলে সন্ধ্যেবেলায় অবশ্যই আসবে। সবাই সবার খবরাখবর নেবে, মিশবে। সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ছাড়তেই হয়, আর নিজেরাই তো এই পায়রার খোপ বানিয়েছি, ওদের স্পেস কোথায় অতএব বাস্তব মেনে সম্পর্ক ধরে রাখো, নতুন সম্পর্ক গড়ো।
মফস্বলের পাড়া-সংস্কৃতি যুক্তা নীলিমা ফ্ল্যাটে ভেবেছিল কিভাবে থাকবে, কিন্তু এই সুন্দর ভাবনার প্রতিফলনে পরিবেশ বেশ সহজ, সরল। নানা কাজে ব্যস্ত জীবন, অফিস থেকে ফেরার সময় একটু উঁকি না মেরে প্রায় কেউই যায় না। এরই কারণে জানা হয়ে গেছে কার কি গুণ। বছরে ছোটদের নিয়ে তিন-চারটে অনুষ্ঠান, সবাই মিলে একদিন বাইরে যাওয়া-যেন যৌথ পরিবারের সংস্করণ।
আজ আড়াইদিন পর সকালটা ঝলমলে। বিকালে নীচে নেমে একটু হাঁটে, কাছাকাছি দোকান থেকে কিছু দরকার থাকলে কিনে সান্ধ্যকালীন আড্ডা ; বেশি সময় নয়, সবারই তো এখন ব্যস্ত জীবন, সবাই নিয়মিতও নয়। ঐ নীলিমা আর ওর মতোন কয়েকজন। কয়েকটি জিনিস নেওয়ার আছে, লিফ্টে উঠেই একজনের সাথে দেখা
-কি, আজ শরীর ভালো তো?
-এ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিকই আছি। কাল অনুপস্থিতিতে ভেবেছে শরীর খারাপ, মনে মনে হাসে।
গেট দিয়ে বেরোচ্ছে-কি আজ কেমন?
বোঝো!-কেন! ঠিক আছি তো।
-না, কাল শরীরটা ভালো নেই বললেন তো, তাই।
-কাল! আমি বলেছি! কাকে!
ইতিমধ্যে অফিস ফেরতা আরো দু-চারজন।
-কি হলো! গলা ঠিক!
-আমার কিন্তু একটু কেমন ভয় ভয় করেছে, আপনার গল্প শুনে।
-না, এমন ভয়ের কিছুই ছিল না, তোমার যতো বাড়াবাড়ি!
-দাঁড়ান, কি বলছেন কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না-
-আরে কালকে এসে আপনার এক আত্মীয়ের কাহিনী বললেন না-
-হ্যাঁ, শরীর খারাপ তো তখনই বললেন!
সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে,গলা শুকিয়ে কাঠ।
-কি হলো নীলিমাদি? আবার শরীর খারাপ করছে?
কি বলছে ওরা!! আমি যে কাল নীচে যাইনি ; বলবো ! না, থাক্।
-ও, না না ঠিক আছি। একটু দোকানে যেতে হবে, চলি কেমন!
মৃদু হাসি এঁকে এগিয়ে যায়। কি লাভ হলো! আজো দিদি কেন আসে! কিছুই তো হলো না-অসমাপ্ত জীবনের অংশ হয়ে থেকে যাওয়া!