অলীক পাতার অন্যান্য সংখ্যা- পড়তে হলে ক্লিক করুন Library ট্যাব টি



। । "অলীক পাতা শারদ সংখ্যা ১৪৩১ আসছে এই মহালয়াতে। । লেখা পাঠানোর শেষ তারিখ ১৫ ই আগস্ট রাত ১২ টা ।.."বিশদে জানতে ক্লিক করুন " Notice Board ট্যাব টিতে"

Sunday, August 26, 2018

যুগলবন্দী ১২ -গল্প -শম্পা সান্যালঃ সোহম সান্যাল

    যুগলবন্দী- সংখ্যা # ১২ 

কলমেঃ শম্পা সান্যাল
ছবিঃ  সোহম সান্যাল

 আষাঢ়ে গল্প 








অঝোর ধারার মাঝে,
ডিঙি-সম রয়েছি ভেসে।
পক্ষ শুক্ল হলেও কৃষ্ণকে হারিয়েছে আঁধার! মেঘাচ্ছন্ন আকাশ,
বিদ‍্যুৎ- লতার শিহরণে,
মেঘ- মন্দ্রিত ধ্বনিতে,
কম্পিত বক্ষে চলেছি-
পথ কোথা!
দ্রুতগতি যানে রচিত তরঙ্গমালা।
অর্নবের সাথে কি তুলনীয়!
যায় কি বলা-তবু মনে আসে!
অত‍্যন্ত ধীরে, সন্তর্পণে চলেছি, একা নই
ক্লান্তি, উদ্বেগ  আঁকে মিছিলের রূপ-রেখা।
হ‍্যাঁ, তলিয়ে গেছে বহু দ্রুতযানের গতিপথ ।
হারিয়ে যায়, দিশাহীন অনুভূতি
আসে তো জীবনে।
অবাক না তো! কেবল বঙ্কিম, বন্ধুর পথ। 
কঠিন হলেও সঠিক ;
অত‌এব,
ছেড়ো না, ছাড়িনি, চলেছি সেই পথেই ;
লক্ষ‍্যে পৌঁছে গেছি প্রায়।
হ‍্যাঁ, প্রবল বর্ষণে জলের তলায় লৌহ-পাত।

-আরে! আস্তে আস্তে! দেখে চলুন!

দুপুরের পর থেকে এমন ঝেঁপে বৃষ্টি এলো! অবশ‍্য বর্ষাকালে এটাই তো স্বাভাবিক। আগে আগে অফিস থেকে ফেরার ইচ্ছে হলেও পারলো না নীলা, এসে গেল কিছু কাজ। রাস্তায় বেরিয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা লদ্ধ উপলব্ধি আবারও, দুকূল ছাপিয়ে ঢেউ তুলে চলেছে যারা, ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, করি কি উপায়! অবশেষে জুটে গেল, এসে স্টেশনে পৌঁছানো গেল। সহযাত্রী পরিচিত দল ছত্রভঙ্গ অত‌এব অল্প মুখ চেনা, অচেনা সহযাত্রী সহ ঠাঁ‌ই মিললো ট্রেনে। উফফ্, যা চিন্তা লাগছিল! আচমকা থেমে গেল ট্রেন। অসহ্য ভ‍্যাপসা গরম, অস্থির ক্লান্ত মানুষের দল বাধ‍্য হলো নামতে।  যান্ত্রিক বিভ্রাট অত‌এব ! কিইই! কতক্ষণ থাকতে হবে এভাবে? নানান আলোচনা, মতামত শুনছে আর ভাবছে, কানে এলো পরবর্তী স্টেশন বেশী দূরে নয়, হেঁটে পৌঁছানো তো যাক্, ওখান থেকে...... আর এই দমবন্ধ হয়ে থাকার চেয়ে হাঁটা ভালো। নামতে শুরু করেছে অনেকেই, আজ লেডিসে উঠতে পারেনি, অস্বস্তি হচ্ছিল এখন মনে হচ্ছে ভালো বলতে এটাই।অপরের সামান্য সাহায‍্যে নেমে নীলা মিছিলে অংশ গ্ৰহণ করে। দুপাশে জনবসতি আঁধারে ঢাকা, মোটামোটি সারিবদ্ধ হয়ে লাইনের মাঝ দিয়ে যাওয়া। টুকরো টুকরো অজস্র কথা শোনার মাঝে কখন যে আনমনা হয়ে গেছিল, মনে মনে নিজ-পছন্দ নেশায় মেতে ছিল।
-লেগেছে?
অপ্রস্তুত নীলা পড়ে যাওয়া ব‍্যাগ, ছাতার সাথে নিজেকে সামলাতে সামলাতে বলে "না,না ঠিক আছে আসলে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না তো!
-দেখার উপায় আছে!
-এই সবাই একটু দেখে দেখে চলুন
আশেপাশের উক্তি। মোবাইলের আলোয় বাড়ানো হাত ধরে উঠেই আবছা আলোয় দেখতে গিয়ে পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোতের অনুভব।
                  ‌‌‌‌                


-ঐ যে নীলিমাদি এসে গেছেন।
-আরে এই ওয়েদারে জমাটি গান চাই।
-আজ শরীরটা ভালো নেই, গাইতে পারবো না গো!
-ঠান্ডা লাগিয়েছেন তো! গলা খারাপ বোঝা যাচ্ছে!
-দ‍্যাখো, ওরা খালি ভূতের গল্প করছে, আমার ভয় লাগে বাবা। জেনারেটর‌ও চলতে চলতে বন্ধ হলো যে কেন ছাতু, ভাল্লাগে না।
সমস্বরে সবার হাসির মাঝে নীলিমা বলে -আমি একটা গল্প বলতে পারি, না ভূতের ঠিক নয়, অদ্ভুতুড়ে বলা যায় !
-আরে, বলুন দিদি 
-আঃ, মোমবাতির আলো এবার জমে যাবে!
-না, না ঠিক সেরকম কিছু নয়, তবে বৃষ্টির.....
বেশ একটা গা ছমছম করা পরিবেশে এভাবেই শুরু করেছিলেন নীলিমাদি।

                ‌     ‌‌‌          
-কেন, কেন!
-পূর্ব পরিচিত নিশ্চয়ই!
-আরে চুপ করো না!!
-হ‍্যাঁ, চেনা বৈকি! খুউব চেনা। মূহুর্তে মন থেকে বাড়ি ফেরার উদ্বেগ মিলিয়ে গেল। শরীরের ক্লান্তি! উধাও। কে যেন ওকে নিয়ে যাচ্ছে আর বলছে এই সুযোগ, শেষ সুযোগ, ছাড়িস না।
-কেন! ক্ষতি করেছিল?
-তাহলে আরো একটু খুলে বলি
-বলো,বলুন, বলুন
-মফস্বলের উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের চার ভাইবোন-দুই ভাই দুই বোন। বোন সবার ছোট, একটু বেশিই ছোট নীলা। দিদি অঞ্জনা খুব মিশুকে, চেহারা, পড়াশোনা সবেতেই এগিয়ে। নীলা একটু সম্ভ্রম করেই চলতো। ওর যখন স্কল-জীবন দিদি তখন কলেজ পেরিয়ে যাচ্ছে, এমন সময় সুখী পরিবারে এলো বজ্রাঘাত, দিদি পাড়ার‌ই একটি ছেলের সাথে পালিয়ে গেল, গেল কারণ বাবার আনা পাত্রের সন্ধান এবং তাদের পছন্দের খবর, সাথে দিদির নিজ-পছন্দে বাস, দৃঢ় অবস্থান, জানাজানির পর উভয় পরিবারের তীব্র আপত্তি। জাত, অর্থনৈতিক অবস্থান নানান অজুহাত, সঙ্গে নাগাড়ে শাসন-চলে গেল।  দিদি চুপচাপ, কান্নাকাটি, মা-বাবার গুরুগম্ভীর আচরণ সব মিলিয়ে বোঝে নীলা, কিন্তু এমন‌ই বয়স যে ওর কোন কথাই বলা চলে না, কারো সাথেই।
             দিদির না ফেরায় আবারো চাঞ্চল্য, অস্থির পরিবেশ। জানতে বাকি র‌ইলো না ঐ ছেলেটিও  নিরুদ্দেশ অত‌এব ........ ।রাগ, দুঃখ যখন আছড়ে ফেলছে দুই পরিবারকে, এলো আরো মারাত্মক সংবাদ। ডায়মন্ড হারবারের কাছে রেল লাইনে কাটা পড়েছে এক যুবক-যুবতী। একাত্মা হয়ে গেল দুই পরিবার শোকে, পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে লাইনে কাটা পড়ে মৃত্যু না-
-মানে! আগেই!
-ঐ লোকটা খুনি তাই তো!
-হতেও পারে!
 -দাঁড়াও না, তারপর কি হলো শুনি।
হা-হুতাশে দিন কাটছে, ক্রমে জানা গেল আরো দু-তিনজনের কথা, সাক্ষ‍্য প্রমাণের অভাবে, অর্থ, ক্ষমতা হারিয়ে দিলো দুই পরিবারকে তবে মূল সন্দেহের তীর যার দিকে তাকে চেনা হয়ে গেল। কিছুদিন পর ছেলেটির পরিবার পাড়া ছাড়া সন্দেহ দৃঢ় হলো তবে আফসোস তো রয়েই গেল।


                   ‌     ‌        
সন্ধ‍্যের পর লাইট নেই, হ‍্যারিকেন জ্বালিয়ে নীলা পড়ছে, সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল-"বোন, এ‍্যাই বোন"
-মাআআআ, দিদি ইইই 
-কিরে, কি হলো ! ওমা একি!!
-নীলু, মা 
চোখে মুখে জলের ছিটে দেবার পর তাকিয়ে দেখে মায়ের কোলে মাথা, চারপাশে উদ্বিগ্ন মুখ, মায়ের চোখে জলের ধারা।
-কিরে, কি হয়েছে? চ‍্যাঁচালি কেন?-দিদিই!
-কিইই! কোথায়?
-ঐখানে, আমাকে ডাকলো তো-
-দূর, তাই কখনো হয়! ও আর কেমন করে আসবে বলতে বলতে মায়ের মুখ আঁচল-চাপা।
-ওঠ্, উঠে পড়্, ও রকম মনে হয়; নিশ্চয়ই ওর কথা ভাবছিলি!
-না, সত্যি , আমি তো পড়ছিলাম
-ছাই, ঘুমাচ্ছিলি, স্বপ্ন দেখেছিস। উঠে বোস্ তো বলে বড়দা বেরিয়ে যায়। মাও গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যায় কিন্তু এখনো যে টাটকা অনুভূতি। তারপরও এই ঘটনা, আলোচনা, ইত‍্যাদি হয়েছে ওর সাথে ক্রমে ক্রমে নীলা অভ‍্যস্ত হয়ে গেছিল। ভয়ডর‌ও ছিল না, কেবল ওর বক্তব্য ঠিকঠাক বুঝতে পারে না, কাউকে যে বলবে! এভাবেই দিন থেকে মাস, মাস থেকে বছর পেরিয়ে পেরিয়ে আজ নীলা এক অফিসের কর্মী। ডেইলি প‍্যাসেঞ্জার। বাবা-মা নেই, বড়দার বিয়ে হয়েছে, চলছিল বেশ। হ‍্যাঁ, একটা কাঁটা তো রয়েই গেছে, জানান দেয় বৈকি। আজো এই আবছা আলোয় নীলা যেন দিদিকে এক ঝলক দেখতে পেলো আর তারপর উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা সব উধাও হয়ে গেল। অজানা এক শক্তি ওকে পরিচালিত করছে আর বলছে " ঐ যে সে, ঐ যে-যন্ত্রচালিত পুতুলের মতোন বাকী সময়  (পরে জেনেছে আড়াই ঘণ্টা)  এক ঘোরাবিষ্ট।

-অনুগ্ৰহ করে শুনবেন আপ......

ঝিমিয়ে পড়া ক্লান্ত মানুষের দল দ্রুত নিজেদের নিয়ে ব‍্যস্ত হয়ে পড়লো। ট্রেন ঢুকছে, সবার‌ই সেদিকে নজর কেবল নীলার-আলতো করে ধাক্কা দিতেই কাজ সারা, বিশেষ জোর খাটাতে হলোনা।

-আআআ

-হায় ভগবান! ঐ যে, ঐ মহিলা...

গ্ৰেপ্তার হলো নীলা। 

-অতো লোকের মধ্যে?

-অনেক লোক তবে কার ভিতরে কি চলে সেতো আর জানা যায় না আর নীলাই কি জানতো! সম্বিৎ ফিরে পেতে ভাবছে এ আমি কি করলাম, কেমন করে পারলাম!

-আচ্ছা, আপনি এটা সত্যি ঘটনা বলছেন?

-হ‍্যাআআ 

-এতো কথা জানলেন কি করে?

-আপনার ঘনিষ্ঠ কেউ?

-যে লোককে সন্দেহ, এতো বছর পরও তাকে ঐ পরিবেশে চিনতে পারলো ঐ নীলা না কে?

-বিচারে সশ্রম কারাদন্ড, যাবজ্জীবন আর তখন‌ প্রমাণিত সঠিক ব‍্যক্তি। আচ্ছা চলি এবার। শুভ রাত্রি।

-হ‍্যাঁ, হ‍্যাঁ আমরাও উঠবো এবার।

-নীলিমাদিকে আজকে যেন কেমন কেমন লাগলো! 

-কেমন আবার! তোমার যতো মনগড়া....চলো তো।

-শরীরটা ভালো না বললেন‌ই তো!

-আমি ভাবছি ঐ নীলা মানে নামটা যদি সত্যি হয় ওনার খুব ঘনিষ্ঠ, নাহলে এতো কথা......

                                 
                  প্রতিবছর‌ই এই তারিখে বড্ড চঞ্চল, অস্থিরবোধে আক্রান্ত হয় নীলা, নীলিমা। না, মা-বাবা,দিদি এদের মৃত্যু দিন না, আজো ভাবে কি করে পারলাম! বিচারের সময় উকিল দাদাদের শত অনুরোধেও রাখেনি, আদালতে প্রশ্নের উত্তরে বলেছে, " আমি দোষী, উকিল দিয়ে কি হবে"! সময়ের আগেই মুক্তি মিলেছে, তখনো ব‍্যাকুলতা  "এখানেই বোধহয় ভালো ছিলাম, দাদাদের আবার....." না, ছোড়দা পিঠোপিঠি , বিয়ে করেনি, ছোট্ট ফ্ল্যাট নিয়েছে ওদের দুজনের জন্য, এনে তুলেছে সেখানেই। দাদা বৌদি আসে। ব‍্যবহারের গুণ এখানেও প্রকাশিত তাই অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সে ফ্ল্যাটের সবার সাথে মিলে গেছে। ছোড়দা গ্ৰন্থ-কীট, অবসরের পর ঐ নিয়েই থাকে আর আছে খেলা। মন খারাপ হলে রবির স্মরণাগত, ইচ্ছে হচ্ছিল তাও নীচে রোজকার আড্ডায় যেতে বাধ সাধলো সেই মন‌ই। 
এই ফ্ল্যাটটাকে ভালো লাগে এখানকার সেক্রেটারি অভিজিতের জন্য। ওর নির্দেশ : সবাই রোজ না পারো কমিউনিটি হলে সন্ধ‍্যেবেলায় অবশ্যই আসবে। সবাই সবার খবরাখবর নেবে, মিশবে। সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ছাড়তেই হয়, আর নিজেরাই তো এই পায়রার খোপ বানিয়েছি, ওদের স্পেস কোথায় অত‌এব বাস্তব মেনে সম্পর্ক ধরে রাখো, নতুন সম্পর্ক গড়ো।
মফস্বলের পাড়া-সংস্কৃতি যুক্তা নীলিমা ফ্ল্যাটে ভেবেছিল কিভাবে থাকবে, কিন্তু এই সুন্দর ভাবনার প্রতিফলনে পরিবেশ বেশ সহজ, সরল। নানা কাজে ব‍্যস্ত জীবন, অফিস থেকে ফেরার সময় একটু উঁকি না মেরে প্রায় কেউই যায় না। এর‌ই কারণে জানা হয়ে গেছে কার কি গুণ। বছরে ছোটদের নিয়ে তিন-চারটে অনুষ্ঠান, সবাই মিলে একদিন বাইরে যাওয়া-যেন যৌথ পরিবারের সংস্করণ।

                ‌    ‌    ‌‌‌    ‌   ‌‌‌     

আজ আড়াইদিন পর সকালটা ঝলমলে। বিকালে নীচে নেমে একটু হাঁটে, কাছাকাছি দোকান থেকে কিছু দরকার থাকলে কিনে সান্ধ্যকালীন আড্ডা ; বেশি সময় নয়, সবার‌ই তো এখন ব‍্যস্ত জীবন, সবাই নিয়মিত‌ও নয়। ঐ নীলিমা আর ওর মতোন কয়েকজন। কয়েকটি জিনিস নেওয়ার আছে, লিফ্টে উঠেই একজনের সাথে দেখা

-কি, আজ শরীর ভালো তো?

-এ‍্যাঁ, হ‍্যাঁ ঠিক‌ই আছি। কাল অনুপস্থিতিতে ভেবেছে শরীর খারাপ, মনে মনে হাসে।

গেট দিয়ে বেরোচ্ছে-কি আজ কেমন?

বোঝো!-কেন! ঠিক আছি তো।

-না, কাল শরীরটা ভালো নেই বললেন তো, তাই।

-কাল! আমি বলেছি! কাকে! 

ইতিমধ্যে অফিস ফেরতা আরো দু-চারজন।

-কি হলো! গলা ঠিক!

-আমার কিন্তু একটু কেমন ভয় ভয়  করেছে, আপনার গল্প শুনে।

-না, এমন ভয়ের কিছুই ছিল না, তোমার যতো বাড়াবাড়ি!

-দাঁড়ান, কি বলছেন কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না-

-আরে কালকে এসে আপনার এক আত্মীয়ের কাহিনী বললেন না-

-হ‍্যাঁ, শরীর খারাপ তো তখন‌ই বললেন!

সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে,গলা শুকিয়ে কাঠ।

-কি হলো নীলিমাদি? আবার শরীর খারাপ করছে?

কি বলছে ওরা!! আমি যে কাল নীচে যাইনি ; বলবো ! না, থাক্।

-ও, না না ঠিক আছি। একটু দোকানে যেতে হবে, চলি  কেমন!

মৃদু হাসি এঁকে এগিয়ে যায়। কি  লাভ হলো! আজো দিদি কেন আসে!  কিছুই তো হলো না-অসমাপ্ত জীবনের অংশ হয়ে থেকে যাওয়া!





                                                                                                               অলঙ্করণঃ ফিরোজ আখতার, স্বরূপ চক্রবর্তী





















যুগলবন্দী ১৩-গল্প -শম্পা সান্যালঃ মুস্তাক আহমেদ


    যুগলবন্দী- সংখ্যা # ১৩ 

কলমেঃ শম্পা সান্যাল
ক্যামেরায়ঃ  মুস্তাক আহমেদ

 ভালোবাসা কারে কয়






ভাইঝির বিয়েতে ব‍্যস্ত বুলবুল দ্রুত নেমে আসছিলো। বরযাত্রীরা সবাই এসে গেছেন, তাদের তদারকির প্রধানা তিনি অত‌এব একবারে ব‍্যতিব‍্যস্ত যাকে বলে আর কি। ধূতি-পাঞ্জাবি পরিহিত উঠে আসছেন দাদার সাথে, ও কে!

-বুলু, ইনি অয়নের মামা। আমার বোন বুলবুল
-নমস্কার।
-নমোওষ্কার! 
বুলবুল দ্রুততার সাথে নেমে যেতে চায়, অবশ দেহ- মন। দাদার সাথে প্রবাল!  শ্রাবণ মাস, বৃষ্টি তো স্বাভাবিক।  বিয়েবাড়ি দ্রুত ফাঁকা হয়ে গেছিল, অন‍্যসময় হলে হয়তো আরো খাণিকক্ষণ পরে সবাই যেতো। বরযাত্রীদের প্রবাল প্রায় তাড়িয়ে বাসে তুললো। না, একটাও বাক‍্য বিনিময় হয়নি বুলার সাথে। বৌভাতের দিন খাওয়ার সময় এসে তদারকি করে গেল। বিয়ে করেছে কিনা জানতে  ইচ্ছে হচ্ছিল খুব। সুযোগ হয়নি, পেলেও কি বলতে পারতো!
-কেন রে!
-আমরা এসেছি, তোমাকে ডাকতে হবে!
-না রে, ইচ্ছে করেই আসিনি। আমার কপাল তো জানিস! 
-আবার! আবার ঐ কথা!!
-ছাড়তো।
অয়ন প্রণাম করতে উদ্যত হতেই " থাক্, থাক্ বসো তো! ভালো থেকো।
অষ্টমঙ্গলায় এসেছে, দুদিন আবারও হৈচৈ করে কেটে যায়। প্রবালের  কথা কথায় কথায় জানতেও পারে। প্রবাল এখন বিদেশে থাকে। বিদেশী মোহ ওর থেকে বুলাকে বিচ্ছিন্ন করেছিল আর আজ!


                                   
-বুলা , কাল অয়নের বাড়ির সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছি। কাল ছুটি নিস বুঝলি!
-অয়নের বাড়ির সবাই মানে! এক মা ছাড়া আর কে আছে?
-আরে, অয়নের মামা তো ওদের সব। উনি চলে যাচ্ছেন তাই ওনাকে বললাম আসতে। সাথে অয়নের মা তাকেও বললাম। মিষ্ঠুরা  আসবে, উনি একা বাদ যাবেন কেন, বল্ ?
-কিন্তু আমার এখন ছুটি নেওয়া মুশ্কিল, এতোদিন ছুটি নিয়েছি। আবার যদি বলি! না গো
-দ‍্যাখ্ যা ভালো বুঝিস, আমি আর কি বলবো!
প্রবালরা এসেছিল, না ওকে খারাপ ভাবেনি, তবে দেখাটা আটকাতে পারলো না।  এদিক ওদিক আর কতো করা যায়! স্কুলের পর এক অসুস্থ সহকর্মীকে দেখতে যাবে বলতে বৌদি ফোনটা কেটে দেয়। অবশেষে বাড়িই ফেরে, ফলে সাক্ষাৎ হয়েই যায় আবারও। সৌজন্যে দু- চারটে কথাও হয়। পরে পরে জানে যে বুলার বিগত দিনের কথা ওর অবর্তমানে আলোচিত এবং প্রবাল বিবাহিত। বিদেশী মহিলা আজ ওর গৃহিণী। কোথাও যেন একটা তীক্ষ্ম বেদনা অনুভূত, এক‌ই অনুভূতি কি সেদিন প্রবালের‌ও হয়েছিল! হয়তো কেন, অনেক বেশীই আহত যে সেটাতো  একটু হলেও তো জেনেছিল,  বিবেকে কোথাও আঘাত করেনি সেদিন। নিজ চাওয়া পাওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেসময়। 


                             ‌       
       ‌    ‌    ‌‌  ‌     ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ মিষ্টুরা হানিমুন সেরে ঘুরে গেছে। আহ্লাদিত মিষ্টুর হাসি দেখে মনে আসে -আমরা হানিমুনে কোথায় যাবো?
-কিইই! হানিমুন! এখানে! এখানে দিঘা- পুরীও যেতে কত খরচ জানো তুমি? জানবে কি করে, হ্হ‍্যা বংশে কেউ এসেছে যে-হান্নিমুন!

-তখন তো রাগ, দুঃখ অভিমানের পারা একটুতেই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তো, কথায় কথায় চোখে আসতো জল, ক্রমে জানা হলো, জানা হলো অনেক কিছু। তন্ময়কে ভালো করে জানার তো সময়‌ই পেলো না। অচিন্তিনীয়, ঘুরে প্রবাল এলো !! অহংকার, অবজ্ঞা আত্মগরিমা শিক্ষা দিচ্ছে।  আচমকা ঘুম ভেঙে যায়।  স্ট্রীট লাইটের সৌজন্যে ঘর আলোকিত, নাইট বাল্ব জ্বালাতে হয় না। সোয়া দুটো। বাথরুম ঘুরে এসে জল খেয়ে শুয়ে পড়ে, ঘুম আসে না। মাথার মধ্যে ঘুরেফিরে নানা স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে। বৃষ্টি হচ্ছে, শার্সি বেয়ে জলের ধারা আঁকিবুঁকি কেটে নেমে যাচ্ছে, তাকিয়ে থাকে সেদিকে। প্রবাল। ভাইঝির বিয়েতে কতোবছর পর দেখা। একরাশ লজ্জা চোখে মুখে নিয়ে ওর সামনে দাঁড়ানো যে কি অস্বস্তিকর! সুন্দরী বলে চিরকাল‌ই ছেলেদের নেক নজরে। বেশ উপভোগ্য ছিল।সুযোগ‌ও নিয়েছে। ইচ্ছেমতো সম্পর্ক ভাঙা-গড়ায় মজা পেয়েছে। তবু তার‌ই মধ্যে প্রবাল যে কি করে দুই-আড়াই বছর টিকে গেছিল! সম্ভ্রান্ত পরিবারের সুসন্তানের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে প্রবালকে ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিল বিদেশে। একটুকুও দুঃখবোধে আক্রান্ত হয়নি। আহ্লাদে সুজয়কে জয় করার বোধে ভেসে গেছিল সেদিন। বছর পাঁচেক বাদে ফিরে এসেছিল নিঃস্ব হয়ে। অনুভব করেছিল পরাজয়ের গ্লানি। মা-বাবা আফসোস করে করে নিজেদের শেষ করে দিচ্ছিলেন। দাদা বৌদির উদ‍্যোগে ওর ওজর আপত্তি তোয়াক্কা না করে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। ইতিমধ্যে রূপের সাথে মেধাও ছিল, তার‌ই সুবাদে বেসরকারী এক স্কুলে চাকরি জুটিয়ে নিয়ে ছিল। তখন‌ই দেখেছিল রূপ বড় বিড়ম্বনা। ডিভোর্সি সুন্দরী মহিলা বড্ড সহজলভ্য অনুমানে কি যে লালসার শিকার হতে হয়েছে, ভাবলে গা রি রি করে আজো। অনেকটা সেকারণেই মুক্তি পেতে দ্বিতীয় বিয়েতে নিমরাজি হয়েছিল। অন‍্যের ভালোবাসা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা শিক্ষা দিলো আবারও। দু'বছর গড়ালো না, তন্ময় চলে গেল অ‍্যাক্সিডেন্টে, অফিস থেকে ফেরার পথে। শ্বশুরবাড়িতেও থাকা সম্ভব হলো না নানান কটুক্তির কারণে।  খুব যে বিশাল অভাব তন্ময়ের জন্য, না হয়নি। আসলে তন্ময়‌ও ডিভোর্সি, দুজনের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হতে সময় নিচ্ছিল আর গড়ে ওঠার মুখেই যবনিকা টেনে দিলেন ঈশ্বর। চেষ্টা করেছিল শ্বশুরবাড়িতে থাকতে। ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে ছেড়ে এলো আবারো রিক্ত হাতে।

           ‌‌‌          ‌‌‌‌‌‌‌            


স্বপ্নে কি দেখছিল!   শার্সির গায়ে জলের ধারায় কে   লিখছিল??  কে ছিল!  লেখাটা কি ছিল, মনে পড়ছে না। অনিন্দ্য, বিভাস! না, না তবে কি সুজয়! মনে আসছে না। অনেকগুলো মুখ ভেঙ্গে চুরে মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছে। খুব ধাক্কাধাক্কি হচ্ছে, সবাই এগিয়ে এসে পড়ছে জানলাটার উপরে, আরে ভেঙ্গে যাবে তো! এই তোমরা কে? সবাই মিলে ওরকম করছো কেন?  আজো বর্ষা-ঘন রাত। আর ওর জীবনের সাথে বৃষ্টির অদ্ভুত একটা সম্পর্ক আছে, কেন কে জানে ! স্বপ্নটা ভেঙে যায়, হাত-পা অসাড়, গলা শুকিয়ে গেছে। স্বপ্ন ছিল!  আস্তে আস্তে উঠে জল খায়, শুয়েও পড়ে আবার, আবারও নানা কথা, নানা স্মৃতি-ঘুমিয়েও পড়ে একসময়। বৌদির ডাকে লাফ দিয়ে ওঠে___ওরে বাবা, পৌনে আটটা! ডাকোনি কেন?
-আমি তো ঠাকুরঘর থেকে নেমে দেখলাম। শরীর ঠিক আছে তো?
-হ‍্যা,হ‍্যা আমি তৈরি হচ্ছি। তুমি যাও, আমি যাচ্ছি।
-শোন্, আজ আর স্কুলে যাসনা।
-কেন!
-দরকার আছে। তুই মুখ ধুয়ে নীচে আয় বলে বৌদি বেরিয়ে যায়। একটু বিরক্ত‌ই হয় বুলা। এদের বোঝানোই মুশ্কিল, কথায় কথায়-মনেমনে গজগজ করতে করতে ফ্রেশ হয়ে নীচে নামতেই দেখে টেবিলে দাদা বৌদি বসা।
-আয়, আজ লেট যে!
-ঐ, আজকাল ঘুমটা ভালো হয়না রে, যাকগে বৌদি কি বলছিল!
-হ‍্যাঁ, আমি বলছি। ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাদা বলে-একটা বাজে খবর আছে। ধড়াস করে ওঠে বুকটা। ক্বি, কি হয়েছে,কার কি হয়েছে!!
-অয়নের মামা মারা গেছেন। এতো বাজে........
মিষ্ঠুদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী, সবাই মিলে আনন্দ করার মাঝে অয়ন চ‍্যাঁচায়, হাতে ধরা ট‍্যাবের দিকে তাকিয়ে হাসছে, মাথা নাড়ছে- প্রবাল। ভিডিও কল করেছে। সবাই তো হুমড়ি খেয়ে যে যার ইচ্ছেমতো দেখছে, কথা বলছে। বুলার‌ও খুব ইচ্ছে, না প্রবালের প্রতি না, আগ্ৰহ ওর বিদেশি স্ত্রীকে দেখার। জানা হয়ে গেছে তিনি খুব ভালো। দুটো ছেলে ইত‍্যাদি ইত‍্যাদি। মিষ্ঠু বাবা মাকে দেখাতে নিয়ে এলো ট‍্যাবটা। সৌজন্য আদান-প্রদান হলো, -মিষ্ঠু, তোমার পিসি আসেনি?
-হ‍্যাঁ, হ‍্যাঁ এই তো ! সঙ্কুচিত বুলা বাধ‍্য হয় তাকাতে। পাশে স্ত্রী, বাধ‍্য হয় হাতজোড় করে সৌজন্য প্রদানে।ট‍্যাব দ্রুত চলে যায় অন‍্যদিকে। শুনতে পায় সমস্বরে সবাই আদরের শাসন করছে, কিনা_আবার কবে আসবের উত্তরে মজা করে বলেছে " বলতে পারছি না, তবে বলে রেখেছি মরলে আমাকে যেন দেশে পাঠানো হয়......"-স্বাভাবিক। এসব কথার প্রত‍্যুত্তর যেমন হয় সবাই তার তার মতো রিয়াক্ট করছে। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি ঘটে যাবে যে-




                    ‌    ‌        
প্রবাল শায়িত।  ওর স্ত্রী আর ছোট ছেলে এসেছে। আজ আর কাছথেকে প্রবালের বৌ- বাচ্চা দেখার আগ্ৰহ নেই, কান্নাকাটির মাঝে স্তব্ধ হয়ে  একদৃষ্টিতে প্রবালের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে বুলা। আজ নিজে থেকেই এসেছে। বৃষ্টি ঝরা রাতে জানলার কাঁচে জড়ো হয়েছিল যারা তাদের মধ্যে ও কি ছিল! জলের দাগ শুকিয়ে গেছে। ক্ষতবিক্ষত মন নিয়ে থেকে যায় বুলবুল। 
"আমি কি বিষকন‍্যা" !
 বর্ষা এলে বুলার  অসুস্থতা বাড়ে। জানলার পাশে বসে থাকে একভাবে। মানসিক যন্ত্রণা থেকে আজ মানসিক রোগীতে পরিণত বুলবুল কি যে দেখে ! জলে লেখা খোঁজে, খোঁজে ওর ভালোবাসাকে। চোখের জলে স্নাত বুলবুল  সজল কালো মেঘে চেনে ভালোবাসাকে। 



                                                                                                               অলঙ্করণঃ ফিরোজ আখতার, স্বরূপ চক্রবর্তী




















যুগলবন্দী ১৫-কবিতা -মৌসুমি চক্রবর্তীঃ প্রতীক কুমার মুখার্জি



    যুগলবন্দী- সংখ্যা # ১৫ 

কলমেঃ মৌসুমি চক্রবর্তী
ছবিঃ  প্রতীক কুমার মুখার্জি



 দিগন্তে







 
কথা ছিলো, একফালি চালাঘরে 
দুজনে বাঁধব এমন সুখের ঘর 
    নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাবে,
     তপ্ত হবে যদি বা বালুর চর...
তবু আমরা হাল ভাঙ্গা নৌকোতে 
ভেসে চলে যাব অতল সমুদ্দুর 
    ঢেউ এর 'পরে উঠবে বিশাল ঢেউ 
     জমবে মেঘ; উঁকি দেবে রোদ্দুর...

সমুদ্রটা ফেলে এসেছি দূরে 
এখন সে শুধুই স্মৃতির কোলাজ 
বৃষ্টি এখনো ঝরে সমুদ্র জুড়ে 
বৃষ্টি ঝরার নেই যে বিরাম আজ।


                                                                                                               অলঙ্করণঃ ফিরোজ আখতার, স্বরূপ চক্রবর্তী




















যুগলবন্দী ১৬-কবিতা -মৌসুমি চক্রবর্তীঃ প্রতীক কুমার মুখার্জি

    যুগলবন্দী- সংখ্যা # ১৬ 

কলমেঃ মৌসুমি চক্রবর্তী
ক্যামেরায়ঃ  প্রতীক কুমার মুখার্জি


 বৃষ্টি স্নাতা শহর









  বর্দ্ধমান তাপপ্রবাহ-জ্বরে
যে শহর পোড়ে রাত-দিন , দিনে রাতে
সেই শহরেও অঝোরে বর্ষা নামে
আষাঢ়ে - শ্রাবণে , অবিরল ধারাপাতে।
  তোমার আমার যেদিন দেখা হ'ত
বৃষ্টি নামত শহরের বুক জুড়ে 
হাত ধরাধরি পেরিয়ে যেতাম পথ
   ব্যস্ত শহর ছাড়িয়ে, অনেক দূরে .....
                           



                                                                                                               অলঙ্করণঃ ফিরোজ আখতার, স্বরূপ চক্রবর্তী


















Main Menu Bar



অলীকপাতার শারদ সংখ্যা ১৪২৯ প্রকাশিত, পড়তে ক্লিক করুন "Current Issue" ট্যাব টিতে , সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

Signature Video



অলীকপাতার সংখ্যা পড়ার জন্য ক্লিক করুন 'Current Issue' Tab এ, পুরাতন সংখ্যা পড়ার জন্য 'লাইব্রেরী' ট্যাব ক্লিক করুন। লেখা পাঠান aleekpata@gmail.com এই ঠিকানায়, অকারণেও প্রশ্ন করতে পারেন responsealeekpata@gmail.com এই ঠিকানায় অথবা আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।

অলীক পাতায় লেখা পাঠান