অলীক পাতার অন্যান্য সংখ্যা- পড়তে হলে ক্লিক করুন Library ট্যাব টি
Monday, October 8, 2018
কৌশিক চক্রবর্তী
একটি অনন্য
অভিজ্ঞতা
আমার স্বপ্নটা যে এভাবে কোনদিন ফলে যাবে তা কল্পনাও করিনি। ঘটনাটা একটুখুলেই
বলি। আমার নাম অম্বরীশ সেন, পেশায় চাকুরিজীবি। একার ছিমছাম সংসার, তিনকুলে কেউ
নেই- ছোটবেলায় বাবা মাকে হারিয়েছি। এক দূর সর্ম্পকের মাসির কাছে মানুষ, বছর দুয়েক
হল তিনিও গত হয়েছেন। এখন কম্পানির দেওয়া ফ্ল্যাটে একাই থাকি। যা মাইনে পাই তাতে
একার সংসার দিব্যি চলে যায়। সামান্যই খরচ আমার, তাই আর্থিক সঙ্গতির দিক দিয়ে
নিজেকে সচ্ছ্বল বলতে পারি। জীবনে খুব বেশী বন্ধু নেই আমার। দূরে চাকরি নিয়ে চলে আসার সুবাদে ছোটবেলার বন্ধুদের
সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে। তাইএখন সময় কাটানোর উপায় হল বই পড়া, টিভি দেখা ইত্যাদি।
সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার কোন কালেই খুব একটা ঝোঁক ছিল না। তবে কিছুটা জীবনের একাকীত্ব
ঘোঁচাতে আর কিছুটা অফিস কলিগদের উৎসাহে কিছুদিন হল ফেসবুকে একটা একাউণ্ট খুলেছি।
সেল্ফি আমি বিশেষ তুলিনা, তবে নতুন একাউণ্টের দৌলতে দু একটা নিজের সেল্ফি তুলেও
পোস্ট করেছি। আমার নেশা বলতে ফটোগ্রাফি। প্রকৃতির ছবি, এমনকি বাড়ির আশেপাশে
বিভিন্ন গাছপালা, পশুপাখির ছবি তুলে আমি মাঝে মাঝে ফেসবুকে পোস্ট করি। নিজের ছবি
পোস্ট করার থেকে এতে আমি বেশি আনন্দ পাই। কিছুদিন আগে এরকমই একটা “হাঁড়ি চাচা” পাখির ছবি আমি
ফেসবুকে পোস্ট করি। পাখিটা হঠাৎ একদিন সকালবেলা আমার জানলার পাশের লিচু গাছটায় বসে
কর্কশ গলায় ডেকে উঠল। আমি উঠে গিয়ে ওটাকে বেশ কাছ থেকে লক্ষ্য করলাম। আমাকে দেখে
ভয় পাওয়া ত দূরে থাক ঘাড় বেঁকিয়ে আমার দিকে বার কতক তাকিয়ে লিচু খেতে ব্যাস্ত হয়ে
পড়ল। আমিও এই সুযোগে আমার নতুন কেনাSLR ক্যামেরায় তার
অনেকগুলো ছবি তুললাম। বেশ কিছু ক্লোজ আপ শট্দেখে আমি নিজেই নিজেকে তারিফ না করে
পারলাম না। সকালের সূর্যের আলো ও গাছের ছায়ার মাঝে হাঁড়ি চাচার গায়ের সাদা ও খয়েরি
রং খুব সুন্দর লাগছে। ফেসবুকে পোস্ট করতেই অভাবনীয় ভাবে অনেকগুল “Likes” পেলাম, বেশ কিছু comments ও পেলাম – “দারুন সুন্দর,
গ্রেট শট্” ইত্যাদি। তাদেরও নিঃসন্দেহেছবি গুলো ভাল লেগেছে। আর একটা friendship request ও পেলাম। কৌতুহল বশতঃ ভদ্রলোকের প্রোফাইলটা খুললাম। খুলতেই চমক। ভদ্রলোকের
প্রোফাইল পিকচারটা বড় হতেই দেখলাম-লেদার জ্যাকেট পরা, কাঁধে বন্দুক, কোমোড়েহাত
দিয়ে দাঁড়িয়ে। একটা জঙ্গল ঘেরা জায়গায় ছবিটা তোলা। ভদ্রলোক কি শিকারী? ভাল করে
দেখলাম ওনার নাম “ড্যানিয়েলওয়াংগা”।Masai Mara National Reserve- এর চীফ্Surveyor। উরি বাবা এত সাংঘাতিক ব্যাপার। চমকে উঠলাম। প্রথমেই
ওনার friend
request একসেপ্ট করলাম। ওনার আমার ছবি ভাল
লেগেছে তাহলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই উত্তর এল “থ্যঙ্ক ইয়ু ফর একসেপ্টিং মাই
রিকোয়েস্ট। আপনার বন্ধুত্ব পেয়ে খুব খুশী হলাম।” আমিও খুব খুশী ওনাকে জানালাম।
-এটা কী পাখি মিঃ সেন? খুব সুন্দর। এখানে এ ধরণের পাখি আমি দেখিনি। আপনি কি
প্রফেসানাল ফটোগ্রাফার? আপনার সব ছবি দেখলাম। খুব ভাল লাগল।জানালাম যে আমি প্রফেসানাল ফটোগ্রাফার নই। ফটো তোলা আমার নেশা এবং পাস্ট টাইম। আর পাখিটার নাম “হাঁড়ি চাচা” বা বায়োলজিকাল নাম “RufousTreepie”-ভারত, পাকিস্তান, মায়ানমার, থাইল্যন্ড, মূলত দঃ পূর্ব এশিয়ায় পাওয়া যায়।
আফ্রিকায় পাওয়া যায় না।
-ফটোগ্রাফিকে পেশায় বদলে নিন, আপনার হাত খুব পরিষ্কার।-ধন্যবাদ, আমি খুব সাধারণ একজন চাকুরিজীবি। আপনার মতন এত বড় সরকারি আফিসার নই।
আপনার যে আমার ছবি ভাল লেগেছে তার জন্য আমি ধন্য। ভদ্রলোকের সঙ্গে এভাবেই আমার
পরিচয়। ধীরে ধীরে আমাদের বন্ধুত্ব আরও গভীর হল। বিভিন্ন বিষয়ে আমরা আলোচনা করতাম,
তবে মূলতঃ জঙ্গলের বিষয়ে। কথায় কথায় জানালাম যে জঙ্গল আমারও খুব ভাল লাগে। আর ভাল
লাগে ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি। তারপরেই ঘটল অপ্রত্যাশিত সেই ঘটনা। মিঃ ওয়াংগা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন,-বেশ ত
চলে আসুন না এখানে ঘুরতে। যতদিন ইচ্ছা থাকুন, জঙ্গল দেখুন, পশু পাখি দেখুন, চিনুন
আর ফটো তুলুন। আফ্রিকা ত ওয়াল্ড লাইফ ফটোগ্রাফির জন্য স্বর্গ। শুনে সত্যি উৎফুল্ল
হলাম। কোনদিন আফ্রিকা যাবার সুযোগ হবে কল্পনাও করিনি। বললাম আমি কখনও বিদেশ যাইনি।
পাসপোর্ট যদিও আছে, ভিসার ব্যবস্থা করতে হবে আগে। খরচেরও ত একটা হিসেব করতে হবে-
যাওয়া, আসা কমপক্ষে সপ্তাহ দুয়েক থাকা। মিঃ ওয়াংগা আশ্বস্ত করলেন যে আপনার থাকা
খাওয়ার সমস্ত বন্দবস্ত আমি করে দেব, আর ভিসার কথা বলছেন? আমি কেনিয়ান সরকারের
উচ্চপদস্থ কর্মচারী। আপনাকে সরকারের তরফ থেকে আমন্ত্রন পাঠিয়ে দেব, ভিসা আপনি
কয়েকদিনেই পেয়ে যাবেন। শুনে অবাক হলাম যে ভদ্রলোক আমার জন্য এতটা করতেও প্রস্তুত।
কিছুদিনের মধ্যেই আমার ঠিকানায়
একটা চিঠি পেলাম। শীলমোহর দেখে অবাক। মাসাই মারা ন্যশেনাল রিসার্ভের জরিপের কাজে
একজন ফটোগ্রাফারের প্রয়োজন হয়। বিশেষ পরিচিত বন্ধু এবং প্রোফেসনাল ফটোগ্রাফারকে
জরিপের কাজের জন্য আফ্রিকায় নিমন্ত্রন। নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
এও কি সম্ভব, স্বপ্ন দেখছি নাকি। এরপর আর দেরী করা ঠিক নয়। অফিসে ছুটির দরখাস্ত, ভিসার দরখাস্ত, প্লেনের টিকেট
একে একে সব জোগাড় করতে হবে। চিঠির দৌলতে কেনিয়ার দূতাবাস থেকে ভিসা পেতে সত্যিই কোন
আসুবিধে হল না। এক সাপ্তাহের মধ্যেই ভিসা মঞ্জুর হল। যথা সময়ে মুম্বাই থেকেকেনিয়া
এয়ারওয়েজ এর প্লেনে চড়ে বসলাম। প্লেনে ওঠার আগে এয়ারপোর্ট থেকে মিঃ ওয়াংগার প্রতি
অসিম কৃতজ্ঞতাই এক বাক্স দামি হাভানা চুরুট কিনলাম ওনাকে উপহার দেব বলে। উনি চুরুট
খান কিনা জানিনা, তবে কেন জানিনা মনে হল এটা ওনার চেহারার সঙ্গে মানাবে ভাল।
সন্ধ্যাবেলার ফ্লাইট। বিকেল পৌনে পাঁচটায় ছাড়ল। সময় লাগবে ছ ঘণ্টা। প্লেনে বসেও বিশ্বাস হচ্ছে না-
প্রথম বিদেশযাত্রা, তাও আবার আফ্রিকা -উফ্ ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
নাইরোবির জোমো কেনয়াটা বিমানবন্দরে
প্লেন অবতরণ করল ভারতীয় সময় রাত প্রায় এগারটায়। বিমান সেবিকারা জানাল যে নাইরোবির
তৎকালীন সময় রাত সাড়ে আটটাঅর্থাৎ আড়াই ঘণ্টা পিছিয়ে। যাইহোক এয়ারপোর্ট থেকে
মালপত্র নিয়ে চেক আউট করে বেরতে বেরতে আরও পঁয়তাল্লিশমিনিট লাগল। আমার তখন চোখে
ঘুম আসতে শুরু করেছে। যদিও লোকাল সময় রাত সারে নটা, তবুও বায়োলজিকাল ঘড়িটিকে ত আর
অস্বীকার করা যায় না। বাইরে এসে দাঁড়াতেই দেখলাম একজন আফ্রিকান লোক হাতে
প্ল্যাকার্ড ধরে দাঁড়িয়ে, তাতে ইংরিজি হরফে আমার নাম লেখা। নিজের পরিচয় পত্র দেখাতে
সাদরে আমার হাত থেকে মালপত্রের ট্রলিটি নিয়ে চলল পার্কিংয়ের দিকে। চড়ে বসলাম যাতে,
সে গাড়ি কেনার সার্মথ আমার কোন কালেই হবে না-রেঞ্জ রোভার। লোকটি জানাল তার নাম
বাশা-সে মিঃ ওয়াংগার একাধারে ড্রাইভার কাম সেক্রেটারি বলা যেতে পারে। এক কথায় ওনার
ডান হাত। বাশা সঙ্গে সঙ্গে ফোন করল মিঃ ওয়াংগা কে। একটা জলদগম্ভীর অথচ শান্ত গলা
আমায় সাদরে অভ্যর্থনা জানাল-“ওয়েলকাম টু কেনিয়া মিঃ সেন। আশাকরি রাস্তায় আপনার কোন
রকমআসুবিধে হয়নি। আজ আপনি নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত। তাই এয়ারপোর্টের পাশে একটা হোটেলে আপনার
রাত্রিবাসের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। গাড়ি আপনার সঙ্গেই থাকবে। আগামিকাল সকাল আটটায় রওনা
হবেন মাসাই মারার উদ্দেশ্যে।” হোটেলে ঘর আগে থেকেই বুক করা আছে। খালি খাবার খরচ
আমার। মাত্র পাঁচ মিনিট লাগল নাইরোবি এয়ারপোর্ট হোটেলে পৌঁছতে।রিসেপশনে পরিচয় পত্র
দেখাতেই ঘর পেয়ে গেলাম। বেশ সুন্দর দক্ষিণ খোলা ঘর তিনতলার ওপর। তিনতলার বারান্দায়
দাঁড়াতেই আলো ঝলমলে রাতের নাইরোবি শহরের অনেকটাই খুব সুন্দর দেখা যেতে লাগল।
প্লেনে ভালই খাওয়া দাওয়া হয়েছিল, তাই রাত্রে আর বিশেষ কিছু খেতে ইচ্ছে করল না। যা
হোক সামান্য কিছু অর্ডার করে দিলাম। তাড়াতাড়ি করে খেয়ে বিছানায় শুতেই দু চোখ
ভেঙ্গে ঘুম এসে গেল। পরের দিন সকাল সাড়ে ছটায় ঘুম ভাঙল।
তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে সোয়া সাতটার মধ্যে নিচে হোটেলের রেস্তোঁরায় পৌছে গেলাম। নানা
রকমের বুফে প্রাতরাশ সাজান রয়েছে, বেশীর ভাগের নাম আমি জানিনা। রিস্ক না নিয়ে আমার
সবসময়ের প্রিয় পাউরুটি, ওমলেট, চা নিয়ে নিলাম- এই প্রাতরাশ সারা বিশ্বে পাওয়া যায়।
খাওয়া শেষ করে বাশা কে ফোন করতেই দু মিনিটের মধ্যে গাড়ি এসে উপস্থিত। ঠিক সকাল
আটটার মধ্যে ঘর ছেড়ে বসলাম গাড়িতে। রাতে শহরটাকে ভালভাবে দেখার সুযোগ
হয়নি। এবার সকালের ব্যাস্ত নাইরোবিকে চোখে পড়ছে। নাইরোবি কেনিয়ার রাজধানী এবং
সবচেয়ে বড় শহর। স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের মুম্বাই, দিল্লীর থেকে কোন অংশে কম নয়। শহরের ব্যাস্ত ট্রাফিক ঠেলে বড় বড় বিল্ডিং রাস্তাঘাট
দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। এখানকার আবহাওয়া চমৎকার- না খুব গরম না ঠাণ্ডা। মাসাই
মারা ন্যাশনাল রিসার্ভ এখান থেকে প্রায় তিনশো কিলোমিটার রাস্তা-পৌঁছতে লাগবে প্রায়
পাঁচ ঘণ্টা। প্রায় এক ঘণ্টা চলার পর শহরের ট্রাফিক কোলাহল কমতে শুরু করল, গাছপালার
সংখ্যা বাড়তে শুরু করল। বুঝলাম নাইরোবির সীমানা ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেছি। বাশা বেশি কথা
বলে না-বা ইংরেজিতে বেশি সড়গড় নয় বলেই বোধহয় আমার সঙ্গে বেশি কথা বলছে না, কিছু
জিজ্ঞসা করলে ছোট করে উত্তর দিচ্ছে। রাস্তা ফাঁকা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির স্পীড
বাড়তে লাগল-প্রায় একশ ছুঁই ছুঁই। আশে পাশে এবার ধূ ধূ মাঠ এবং মধ্যে মধ্যে জঙ্গলের
এলাকা নজরে আসছে। মাঝে মাঝে ক্যামেরায় টুক টাক ছবি তুলছি। দূরে টিলা জাতীয় ছোটখাটো
পাহাড়ও দেখা যাচ্ছে। প্রায় দুপুর সোওয়া একটা নাগাদ মাসাই মারা ন্যাশনাল রিসার্ভের
গেটে পৌঁছালাম। বাশা বলল এখান থেকে মিঃ ওয়াংগার বাড়ি পৌঁছতে লাগবে আরও প্রায় মিনিট
পনের। দুপুর দেড়টা নাগাদ পৌঁছলাম একটা সুদৃশ্য বাংলো বাড়ির সামনে। ছবির মতনই
সুন্দর, দু তলা বাড়ি, সামনে একফালি ছোট লন বেড়া দিয়ে ঘেরা। দোতলার বারান্দায় যিনি
দাঁড়িয়ে ছিলেন তাকে চিনতে কোন অসুবিধে হল না। আমাদের দেখে মিঃ ওয়াংগা তাড়াতাড়ি
নেমে এলেন, করমর্দন করে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। বাশা মালপত্র নিয়ে ভেতরে চলে
গেল। আমরা গিয়ে বসলাম সামনের লনে দুটো মখোমুখি চেয়ারে, মাথার ওপর ছাতা দিয়ে ঢাকা। বেলা বাড়াতে এখন গরমও একটু বেড়েছে। মিঃ ওয়াংগা প্রচুর
উৎসাহ নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। বললেন সন্ধের দিকে আপনাকে ছোট করে একটা
জঙ্গল রাইড দেব। এখানে দিন কয়েক থাকুন তারপর শুরু হবে আমাদের আসল অভিযান। বিভিন্ন
কথার মাঝে আমি সুযোগ বুঝে সুদৃশ্য গিফ্ট র্যাপে মোড়া চুরুটের বাক্সটামিঃ ওয়াংগার
হাতে তুলে দিলাম। প্যাকেট খুলেই উনি উচ্ছসিত। “থ্যঙ্ক ইয়ু, মিঃ সেন। এরকম হাভানা
চুরুট বহুকাল খাইনি। কি করে বুঝলেন আমি চুরুট খাই-আমি কি আপনাকে আগে বলেছি? মনে ত
পড়ছে না।” আমি আন্দাজে এনেছি শুনে খুব একচোট হাসলেন এবং আমার ইন্টিউশনের ভূয়শী
প্রশংসা করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মধ্যাহ্ণ ভোজনের ডাক পড়ল। বাড়ির ভেতরে ঢুকে
সত্যিই অবাক হলাম মিঃ ওয়াংগার রুচি দেখে। বাড়িটি পুরো কাঠের তৈরি-বিভিন্ন দেওয়ালে
বিভিন্ন জন্তুজানোয়ারের ছবি সাজান রয়েছে যেমন হরিণ, শেয়াল এমনকি লেপার্ড পর্যন্ত।
একটা দেওয়ালে একটা সুদৃশ্য লেপার্ডের চামড়া টাঙানো। খাবার টেবিলে বিভিন্ন রকমের
খাবার সাজান। কেনিয়ান পিলাউ (বাংলায় যাকে পোলাও বলা হয়), কুকু চোমা (চিকেন রোস্ট),
সামকি চোমা (ফিস্ রোস্ট), চিপস্ মায়াই (ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও ডিম ভাজা) আরও কতকি। সব
গুলোর সঙ্গে মিঃ ওয়াংগা আমার পরিচয় করালেন, এবং কোন টাতে কি মশলা ব্যবহার করা হয়
তারও পুরো বিবরণ দিলেন। বুঝলাম উনি খুব খাদ্য রসিক মানুষ। বলাই বাহুল্য, দুপুরের ভুড়ি
ভোজটা খুব ভালই হল। খাবারের পর দোতলায় গিয়ে দেখলাম ওপরে দুটো ঘর, একটিতে থাকেন মিঃ
ওয়াংগা স্বয়ং, আর একটি গেস্ট রুম যেটা কিনা আমার জন্য বরাদ্দ হয়েছে। ঘরে এবং
বারান্দায় দেখলাম পর পর সোলার ল্যান্টর্ন ঝুলছে। মিঃ ওয়াংগা বললেম, “আফ্রিকায় ত আর
রোদের অভাবনেই, তাই এই ব্যবস্থা। বাড়ির ছাদে সোলার প্যানেল লাগিয়ে নিয়েছি, দিব্যি
কাজ হচ্ছে। আমার ইলেকট্রিসিটির খরচা প্রাই শূন্যই বলা যায়।”
দুপুরে ছোট করে একটা দিবানিদ্রা
দিয়ে নিলাম। বিকেলবেলায় চা এসে উপস্থিত, সঙ্গে কিছু খাবার দাবার। সূর্যাস্ত হতে
আরও যখন এক ঘণ্টা বাকি, মিঃ ওয়াংগা বললেন চলুন আপনাকে একটা জীপ রাইড করিয়ে আসি। আপনার
ক্যামেরা নিতে ভুলবেন না। ড্রাইভারের সিটে স্বয়ং মিঃ ওয়াংগা, পাশে আমি। হাতে
ক্যামেরা, পেছনের সিটে একটা সোয়েটার নিয়ে নিলাম। এখানে সন্ধ্যে হলেই জঙ্গলের
এলাকায় হঠাৎ ঠাণ্ডা পড়ে যায়, তাই সাবধানতা অবলম্বন আরকি। পথ ঘাট পেরিয়ে ধীরে ধীরে জঙ্গলের
ঘনত্ববাড়তে লাগল। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। চারিদিকে বড় বড় গাছ, ঝোপ জঙ্গল, তার মধ্যে
দিয়ে সরু উচুঁ নিচু মেঠো রাস্তা। রেঞ্জ রোভার অবলীলাক্রমে সেই সব অতিক্রম করতে
লাগল। জিজ্ঞাসা করলাম, “জানোয়ার দেখা যাবে নিশ্চয়- হরিণ, বুনো শুয়োর, হায়না
ইত্যাদি?” মিঃ ওয়াংগা আড়চোখে তাকিয়ে মিচকিহাসলেন। সূর্য ডুবতে চলছে, আমরা এসে
পরলাম একটা জলার ধারে। এখানে জঙ্গলটা একটুঁ পাতলা হয়ে এসেছে। চারিদিকে গাছপালা
থাকলেও মাঝখানে জলাভূমি। একটা ছোটখাটো পুকুর বলা যায়। এইখানে পশুরা জল খেতে আসে।
এইবার বুঝলাম এখানে আসার কারণ। কাছাকাছি এসে একটা গাছের আড়ালে গাড়িটা দাঁড় করালেন
মিঃ ওয়াংগা। ইঞ্জিন বন্ধ করতেই একটা অদ্ভুত আদিম জংলীপরিবেশে ছেয়ে গেল চারিদিক। শুধু
পড়ন্ত বিকেলে পাখিদের বাড়ি ফেরার কলরব, ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক, মাঝে মাঝে হঠাৎ নাম না
জানা পশুর ডাক- সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত গা ছম ছম করা ভাব। মিঃ ওয়াংগা গাড়ি থেকে
নামলেন। একটুএগিয়ে সামনের ঝোপের আড়ালে উনি অদৃশ্য হলেন। ভাবলাম খালি হাতে এই
জঙ্গলে নামাটা ঠিক হল কি? আমি গাড়িতে একা বসে। ভাবছি কি করব, নামব কি নামব না।
হঠাৎ ঝোপের আড়াল থেকে মিঃ ওয়াংগার গলা। আমি হুড়মুড় করে গাড়ি থেকে নামলাম। দড়াম করে
গাড়ির দরজা বন্ধ করতেই মনে হল জঙ্গলের শান্তি যেন নষ্ট হল। মিঃ ওয়াংগা বললেন
শ-শ-শ-কোন শব্দ নয়,
চুপচাপ এগিয়ে আসুন।ঝোপ পেড়িয়ে আবার জলাভূমি দেখা যেতেই অবাক হলাম। দারুণ
দৃশ্য-একপাল হরিণ-কমপক্ষে গোটা পঞ্চাশেক ত হবেই, সঙ্গে ছোট ছোট বাচ্চাও আছে-জলায়
জল খেতে এসেছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ফটাফট্ তাদের ক্যামেরা বন্দি করলাম। জিঙ্গাসা
করলাম এটা কি হরিণ? মিঃ ওয়াংগা উত্তর দিলেন-“ইম্পালা”। কিন্তু আঙুলের ঈশারায়
বুঝিয়ে দিলেন আস্তে কথা বলুন। আমি ফিস্ ফিস্ করে জিঙ্গাসা করলাম “সিংহ বা বাঘ আসতে
পারে এখানে?” মিঃ ওয়াংগা বললেন, “ভাগ্য ভাল থাকলে নিশ্চয় দেখা পাবেন। ধৈর্য্য
ধরুন।” বেশ কতক্ষণ হরিণের জল খাওয়া দেখলাম খেয়াল নেই, হঠাৎ একটা হিস্ হিস্ শব্দে
চমকে উঠলাম। মিঃ ওয়াংগা মূহুর্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাকে সজাগ করলেন। দেখলাম পেছনের
গাছটার ডাল বেয়ে একটা সাপ ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে ঝোপের ভিতর অদৃশ্য হল। সাপটা দেখতে
অদ্ভুত, একদম সবুজ রঙ, গাছের মধ্যে ডালপালার সঙ্গে যেন মিশে গেছে।
-এটা কি সাপ মিঃ ওয়াংগা?-গ্রীণ মাম্বা,-আফ্রিকার বিখ্যাত ব্ল্যাক মাম্বার জাত ভাই বলতে পারেন। এরা
গাছে থাকতেই পছন্দ করে। এদেরও মারাত্মক বিষ। তবে সাধারণত এরা মানুষকে এড়িয়ে চলে।আমি মনে মনে বললাম, আপাতত আমি তোমাকে এড়িয়ে চলছি। চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। পাশে
মিঃ ওয়াংগা ছাড়া আর বিশেষ কিছুই নজরে আসছে না। আশেপাশের ঝোপ জঙ্গল গাছপালা গুলো
কেমন যেন প্রেতের মতন দাঁড়িয়ে আছে। ভাবছি এই অন্ধকারে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা কতটা
সমীচীন। মিঃ ওয়াংগা হঠাৎ পকেট থেকে কি একটা বার করে আমার হাতে দিলেন। অন্ধকারে
বুঝতে না পারলেও হাতে নিয়ে বুঝলাম ওটা একটা দূরবীণ। এই অন্ধকারে দূরবীণ চোখে
লাগিয়ে কি আর দেখা যাবে? “ওটা চোখে লাগান”-বললেন মিঃ ওয়াংগা। চোখে দিতেই কোথায়
অন্ধকার- একটা সবুজ আলোর আভায় আমার চারিদিক স্পস্ট হয়ে উঠেছে। যেখানে অন্ধকার মনে
হচ্ছিল, সেখানে এখন অজস্র জন্তু জানোয়ারের ছোট ছোট জ্বলজ্বলে চোখ দেখতে পাচ্ছি।
বুঝলাম এটা একটা খুব শক্তিশালী ইনফ্রারেড বাইনোকুলার। বিজ্ঞানের অসাধারন সৃষ্টি- অন্ধ মানুষকেও দৃষ্টি দেয়। অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম।
কেমন যেন একটা নেশা ধরে গেল। আমি আশেপাশে ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখতে লাগলাম-বন জঙ্গল। হঠাৎ পেছনে ঘুরে দেখি দুটো জ্বলজ্বলে চোখ- হায়না নাকি? নাকি শিকারি কুকুর-ভয়
পেয়ে খামচে ধরলাম মিঃ ওংয়াগারহাত। মিঃ ওয়াংগা
ঘুরে আমার থেকে বাইনোকুলারটা নিয়ে চোখে দিলেন। ধীরে ধীরে হাসি ফুটে উঠল ওনার মুখে-
“ফক্স, মিঃ সেন, ভয় পাওয়ার কিছু নেই।” হুট্ করে তাড়া দিতেই পালিয়ে গেল। “চলুন,
এবার ফেরা যাক।” গাড়ির দিকে অগ্রসর হলাম আমরা। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় রাস্তা
আলোকিত। ইতস্তত দু একটা বুনো শুয়োরদৌড়ে রাস্তা পেড়িয়ে যাচ্ছে এধার থেকে ওধারে। আর
বিশেষ কিছু চোখে পড়ল না।
রাতে খাবার টেবিলে বসে পরের
অভিযানের সম্বন্ধে আলোচনা করতে লাগলাম। জঙ্গলের মাঝে গিয়ে তাঁবু ফেলা হবে। সেখানেই
থাকা হবে কয়েকদিন। সেখান থেকেই আরও গভীর জঙ্গলের অভিযানে যাব আমরা। দুদিন এখানে
থেকে, তার পরের দিন ভোরে রওনা দেব। অনেক রাত অবধি চলল আমাদের আড্ডা, তারপর শুতে
গেলাম। রাতে শুয়ে ঘুম আসছিল না- আফ্রিকার জঙ্গলের অভিজ্ঞতাযা হয়েছে আরও কি হবে সেই
সব চিন্তা করছিলাম। মাঝে মাঝে দূরে অনেক রাতজাগা পশুর ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। শুনতে
শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই।
দু দিন বেশ আরামেই কাটল। তার পরের দিন রওনা হব। যাবার দিন ভোর পাঁচটায় ঘুম
ভাঙল। সূর্্য্যোদয় হতে চলেছে। জঙ্গলে সূর্্য্যোদয় প্রথম দেখলাম-ক্যামেরা বন্দি
করলাম। শহরের ভীড় আর রোজকার অফিস যাবার তাড়ার থেকে কত আলাদা এই জঙ্গলের জীবন।
তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে এসে দেখি মিঃ ওয়াংগা নিচে বাগানে দাঁড়িয়ে ওনার বন্দুকের নল চোখে
লাগিয়ে পরীক্ষা করছেন আর লক্ষ্যস্থির করছেন। আমি কাছে যেতেই আমাকে “গুড মর্নিং”
বলে আমার দিকে বন্দুকটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “হ্যভ আ ফিল্ অফ্ ইট্, মাই ফ্রেন্ড।”
আমি বললাম, “আমি বন্দুকের ব ও বুঝি না”। মিঃ ওয়াংগা হেসে বললেন তাতে কি হয়েছে,
কাঁধে নিয়েই দেখুন না।
-এটা কি বন্দুক মিঃ ওয়াংগা?-উইন্ চেস্টর ম্যাগনাম। খুব শক্তিশালী রাইফেল। এক গুলিতে একটা বড় হাতিকে
মেরে ফেলা যায়।বন্দুকটা হাতে ধরেই বুঝলাম যে মিঃ ওয়াংগা যত সহজে ওটা নাড়াচাড়া করছেন, আমার
পক্ষে ওটা নাড়াচাড়া করা অত সহজ নয়, বেশ ভারী বন্দুক। কাঁধে ফেলে চোখে লাগিয়ে নিজের
হাত স্থির রাখতেই পারছিলাম না। হেসে বললাম, “ও আমার কর্ম নয় মিঃ ওয়াংগা। শুটিং
আমিও করি, তবে আমার ক্যামেরা দিয়ে।” দুজনেই হেসে উঠলাম।
মালপত্র গাড়িতে তোলা হয়েছে।
তাঁবু, খাবার দাবার, রান্নার জিনিষপত্র, জল, আরও কিছু বন্দুক, গুলি, ওষুধপত্র আরও টুকিটাকি
হাজার জিনিসপত্র যা ওখানে লাগতে পারে। আমরা যাব মাইল পঞ্চাশেক ভেতরে। সঙ্গে যাচ্ছে
বাশা ও ওদুম্বো- মিঃ ওয়াংগার খানসামা। রান্নার হাত তার দারুন, তবে দরকারে বন্দুক ও
ছুড়তে পারে। গাড়ি চালাচ্ছে বাশা। মিঃ ওয়াংগা সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে, হাতে
বন্দুক নিয়ে। আমি ও ওদুম্বো মাঝের সিটে। মালপত্র সব গাড়ির পেছনের সিটে আর মাথার কেরিয়ারে।
প্রায় আধঘণ্টা চলার পর ঘন জঙ্গল শুরু হল। অনেক জায়গায় এতটাই ঘন যে গাড়ি চলতে বেশ
অসুবিধে হচ্ছে। তার মধ্যে খানা খন্দে ভরা রাস্তা। স্বভাবতই গাড়ির গতি ঘন্টায় ৩০-৪০
কিলোমিটারের বেশি নয়। ঝোপে ঝাড়ে অজস্র হরিণ চোখে পড়ছে। কি সুন্দর তাদের গায়ের লোম
আর কি তাদের স্বাস্থ্য! গাড়ির আওয়াজে চোখের নিমেষে কেউ কেউ জঙ্গলে অদৃশ্যহচ্ছে,
কেউ আবার নির্বিকার। একবার ঘাড় বেঁকিয়ে দেখে আবার খেতে ব্যস্ত। যতটা সম্ভব ছবি
তুলছি, তবে গাড়ি এত দুলছে যে ইচ্ছে থাকলেও সব ছবি মন মতন হচ্ছে না। হঠাৎ গাড়ি
থামল।
-কি ব্যপার? -শ-শ, সামনে দেখুন, বললেন মিঃ ওয়াংগা।বুঝতেই পারিনি সামনে প্রায় কুড়ি হাত দূরে একটা বিরাট দাঁতাল হাতি দাঁড়িয়ে
গাছের ডাল খেয়ে চলেছে। বেশী কাছে যাওয়া ঠিক নয়। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ছবি তুলে
গাড়ি সামান্য ঘুরিয়ে এগিয়ে চললাম।
-কোন বাঘ বা সিংহ চোখে পড়ছেনা ত মিঃ ওয়াংগা?-ওরা কিন্তু আপনাকে চোখে চোখেই রেখেছে।-তার মানে?-তার মানে ওরা সচরাচর মানুষের সামনে আসে না। জঙ্গলের ভিতর থেকেই নজর রাখে।
ওদের গায়ের চামড়া জঙ্গলের পরিবেশে এত সুন্দর মিশে যায় যে একদম সামনে না এলে আপনি
বুঝতেই পারবেন না।-তা হলে ত খুব বিপদ, শিকারীরা শিকার করে কিভাবে?মিঃ ওয়াংগা হেসে বললেন, “জঙ্গলে যদি আপনি শুধুমাত্র দৃষ্টি শক্তির ওপর
নির্ভর করে চলেন, তাহলে সমূহ বিপদ। একজন যথার্থ শিকারীকে সব দিক দিয়ে সতর্ক হতে
হবে। দৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে তার নাক, কান, এবং সর্বোপরি তার ষষ্ঠইন্দ্রিয় সজাগ রাখতে
হবে। তা না হলে এই সমস্ত সাংঘাতিক জানোয়ারদের সঙ্গে পেরে ওঠা খুব মুস্কিল। মৃত্যু
যে কোন সময় যে কোন দিক দিয়ে আসতে পারে।” কথাটার নাটকীয়তায় কেরকম যেন একটা শিহরণ
খেলে গেল।
এগিয়ে চলেছি। ধীরে ধীরে আবার
জঙ্গল কমতে শুরু করেছে। সামনে এবার বড় বড় ঘাসের বন। একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের প্রায়
কোমর অবধি উঁচু ঘাস। কোথাও আবার প্রায় বুক অবধি। তার মধ্যে দিয়েই আমাদের গাড়ি
এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ দূরে ধূলোর ঝড়। কি ব্যপার ঝড় আসছে নাকি? কিন্তু আকাশ ত
পরিষ্কার। সঙ্গে অদ্ভুত একটা খটা খট্ শব্দ। যেন একসাথে অনেক মিস্ত্রি মিলে হাতুড়ী
দিয়ে পাথর ভাঙছে। আওয়াজটা বাড়তে লাগল। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ধূলোর ঝড়। মিঃ ওয়াংগার
ঈশারায় বাশা গাড়ি দাঁড় করাল। খটা খট্ শব্দ, ধূলোয় ভাল করে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আরেকটু কাছে এলে বুঝতে
পারব। হঠাৎ দেখলাম এক পাল Wildebeest দৌড়ে আসছে আমাদের গাড়ির দিকে। মিঃ ওয়াংগা হাতে
বন্দুক তুলে নিলেন।
-কি ব্যপার, এরা ত খুব একটা হিংস্র প্রাণী নয় যতদূর
জানি- কোন বিপদের আশঙ্কা আছে নাকি?
মিঃ ওয়াংগা সজাগ দৃষ্টি দিয়ে বললেন, “মনে হচ্ছে
বিপদ এদের পেছনে ধেয়ে আসছে।”-ঠিক বুঝলাম না, কি বলতে চাই….
কথাটা ফুরোবার আগেই দেখলাম Wildebeest-এর পাল তীব্র গতিতে আমাদের গাড়ির চারপাশ দিয়ে পালাচ্ছে।
উর্দ্ধশ্বাসে দৌড় যাকে বলে। কি তাদের গতি! চারিদিকে তাদের খুরের খটা খট্ শব্দে কান
পাতা দায়। ধূলোয় চারিদিক ছেয়ে গেছে।
-গাড়ির সব কাঁচ বন্ধ করুন সবাই-মিঃ
ওয়াংগার নির্দেশ নিমেষে পালিত হল। গাড়ির মধ্যে চুপচাপ বসে আছি। চারিদিকে শুধু Wildebeest-এর পাল। কাতারে কাতারে যাচ্ছে।
কেমন যেন নেশা ধরে যাচ্ছে দেখতে দেখতে। হঠাৎ একটা হুংকার তার সঙ্গে একটা তীক্ষ্ণ
চীৎকার। যা দেখলাম তাতে রক্ত হিম হয়ে গেল। বিশাল আকারের একটি সিংহি আমাদের গাড়ির
প্রায় পচিঁশ তিরিশ হাত সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে একটা Wildebeest-এর গলা কামড়ে ধরেছে। সেটা প্রাণপণে
ছাড়াবার চেষ্টা করছে আর তার চীৎকারে কান পাতা দায়। তাড়াতাড়ি ক্যামেরা তাক করলাম।
ধূলো এবং ধস্তাধস্তির মাঝেও ছবি তুলে যাচ্ছি, যা ওঠে উঠুক। এ দৃশ্য শুধু ডিস্কভারি
বা ন্যাশেনাল জিওগ্রাফিক্ চ্যানেলেই দেখেছি। আজ একেবারে গাড়ির সামনে। সিংহের মরণ
কামড়ে Wildebeestমাটিতে পড়ে ছট্ ফট্ করছে। হঠাৎ আশপাশ থেকে আরও
প্রায় গোটা পাঁচেক সিংহ এসে উপস্থিত। সবাই মিলে এসে বেচারার শরীরের বিভিন্ন অংশে কামড়ে ধরল।।
ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ল Wildebeest।বাকিরা ভয় এদিক ওদিক পালাচ্ছে। সেদিকে সিংহের পালের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। তারা
তখন তাদের সদ্য করা শিকারে মহা আনন্দে ভোজ বসিয়েছে। তাদের হিংস্র রক্ত মাখা মুখ আর থাবা বড় ভয়ংকর
লাগছিল। ভাগ্যিস গাড়ির মধ্যে ছিলাম,বাইরে থাকলে কি হত, ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
মাঝে মাঝে বেচারা Wildebeest- এর জন্য বড় কষ্ট হচ্ছিল-কি ভয়ংকর মৃত্যু। আমার
অবস্থা কতকটা আন্দাজ করেই বোধহয় মিঃ ওয়াংগা জিজ্ঞাসা করলেন, “কি খারাপ লাগছে নাকি
মিঃ সেন?”
আমি ইতস্তত করছিলাম, হেসে ফেললাম শেষে। বললাম “এই ত
জঙ্গলের নিয়ম।”-ঠিক তাই। ওয়েলকাম টুআফ্রিকা, মিঃ সেন।
বেশ খানিকক্ষণ কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। বাশা
গাড়ি ঘুড়িয়ে নিয়ে চলেছে আমাদের গন্তব্যের দিকে। প্রায় আরও আধ ঘণ্টা চলার পর আমরা
মোটামুটি একটা ফাঁকা সমতল জায়গায় উপস্থিত হলাম। এখানে ছোটছোট ঘাস জমি-কাজেই কোনো হিংস্র জন্তু লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনে নেই। মাঝে মাঝে ইতস্তত কিছু
বড় বড় গাছ রয়েছে।। সেখানেই গাড়ি থামল।
জিনিসপত্র নামল। বাশা ও ওদুম্বো অভ্যস্ত কায়দায় খুব
দ্রুত দুটো তাঁবু খাটিয়ে ফেলল। আমরা তাঁবুর বাইরে গাছের ছায়ায় বসলাম। তাঁবুর একপাশে
পার্ক করা রয়েছে আমাদের গাড়ি। আপাতত বিশ্রাম, ওদুম্বো দুপুরের খাবার বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বাশাও দেখলাম হাত লাগিয়েছে।
আমি আমার সফরের ঘটনাগুলো ডায়েরীতে নোট করছি। দুপুরের খাবার পড়ে একটু গড়িয়ে নিলাম।
বিকেল নাগাদ তাঁবুর বাইরে এসে দেখি এক বিশাল লম্বা আফ্রিকান আদিবাসী মিঃ ওয়াংগার সঙ্গে
ওদের ভাষায় কথা বলছে। পরে জেনেছিলাম ভাষাটা হচ্ছে স্বহিলি ভাষা- আফ্রিকার প্রধান ভাষার মধ্যে একটি। আমাকে দেখে মিঃ ওয়াংগা কাছে ডাকলেন।
পরিচয় করিয়ে দিলেন ওর সঙ্গে। লোকটি প্রায় সাড়ে ছয় ফিটের ওপর লম্বা। মিশকালো গায়ের
রঙ, চোখ দুটো যেন জ্বলছে। খালি গায়ের ওপর একটা চাদর মতন জিনিস আড়াআড়ি ভাবে
চাপানো। কোমোড়ের নিচে একটা খাটো লুঙ্গির মতন কাপড় জড়ানো হাটু পর্যন্ত। হাঁটুর নিচে
ঝালোরের মতন পা অবধি নেমে গেছে। মাথায় একটা মুকুটের মতন যেটা কোন বন্য জন্তুরমাথার
খুলির ওপরের অংশ। তাতেও একটা ঝালর লাগানো। ডান হাতে বিশাল
একটা বর্শা। যেটা কিনা
প্রায় আমার উচ্চতার মতনই লম্বা। পুরোপুরি জংলী আদিবাসী বলতে যা বোঝায় তাই। আমার সঙ্গে
আলাপ হওয়াতে মাথা নুইয়ে আমাকে অভিবাদন জানাল। মিঃ ওয়াংগা আমাদের মধ্যে দোভাষীর কাজ
করছিলেন। আমি বেশী কথা বলার সুযোগ ও পেলাম নাএকটা বর্শা। যেটা কিনা
প্রায় আমার উচ্চতার মতনই লম্বা। পুরোপুরি জংলী আদিবাসী বলতে যা বোঝায় তাই। আমার সঙ্গে
আলাপ হওয়াতে মাথা নুইয়ে আমাকে অভিবাদন জানাল। মিঃ ওয়াংগা আমাদের মধ্যে দোভাষীর কাজ
করছিলেন। আমি বেশী কথা বলার সুযোগ ও পেলাম না, কারণ ওরা মনে হল কি একটা ব্যাপারে বেশ উত্তেজিত ভাবেই কথা বলছিল। মিঃ ওয়াংগা
একটু চিন্তিত হলেন। শেষে যাবার সময় কোলাকুলি করে বড় বড় পা ফেলে লোকটি চলে
গেল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কি ব্যাপার? কিছু হয়েছে নাকি?” মিঃ ওয়াংগা হেসে প্রসঙ্গ পালটে ফেললেন। বুঝলাম তিনি আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে
গেলেন। বললেন, “ও কে জানেন? ও হচ্ছে
এখানকার মাসাই উপজাতির লোক, নাম ওকোরি। ওদের গ্রাম এখান থেকে দশ কিলোমিটার দূর।
আজ সন্ধ্যাবেলা ওদের গ্রামে আমার নিমন্ত্রণ। আপনাকে নিয়ে যাব। কথামতন সন্ধ্যাবেলা
মাসাইদের গ্রামে পৌঁছলাম। গোটা চল্লিশেক ঘর নিয়ে ওদের ছোট্ট গ্রাম। ছোট ছোট কুঁড়ে
ঘর। খড়ের চালা আরবাঁশের বেড়া দেওয়া। আশেপাশে একটু দুরেই জঙ্গল, খালি গ্রামের মধ্যেই সমতল ঘাসজমি। ওরা প্রধানত পশু পালন করে। জিজ্ঞাসা করলাম, “এরা এই সাধারণ ঘরে জঙ্গলের পাশে থাকে- যে কোন
সময় ত হিংস্র জন্তু আক্রমণ করতে পারে, এদের ভয় করে না?”
-এরা পালা করে রাত জেগে পাহারা দেয়। আর ভয়ের কথা বলছেন, এরা মাসাই, ভয় বলে কোন শব্দ এদের অভিধানে নেই। এখানে ছোট বয়স
থেকেই ছেলেদের বর্শা চালান শেখান হয়। তাই দিয়েই এরা শিকার করে। এদের বন্দুকের
প্রয়োজন নেই। পশুরাই বরঞ্চ এদের ভয় পায়।আমরা পৌঁছতেই ওরা সবাই আমাদের সাদরে অভ্যর্থনা
জানাল। বিভিন্ন রকমের ফলাহার আমাদের দেওয়া হল, তার সবই এরা জঙ্গল থেকে জোগাড় করেছে। আরও বেশ কিছু খাবার ছিল সেগুলো কি
বুঝতে না পারায় খাবার চেষ্টা করলাম না। সন্ধ্যা হতেই দেখলাম মেয়েরা দলে দলে
বিভিন্ন সাজে সেজে উপস্থিত। এক জায়গায় গোল হয়ে বসার ব্যবস্থা হল। মাঝে কাঠ জ্বেলে
বেশ বড় একটা বন ফায়ার গোছের বানানো হল। এবার শুরু হল ওদের আদিবাসী নৃত্য।
ছেলেরা
ঢাক বাজাচ্ছে আর ঢাকের তালে তালে মেয়েরা অদ্ভুত সুরে গাইছে আর কোমোড়ে হাত দিয়ে
নাচছে। ছোট ছোট বাচ্চারাও আনন্দে লাফাচ্ছে ছেলেরা
ঢাক বাজাচ্ছে আর ঢাকের তালে তালে মেয়েরা অদ্ভুত সুরে গাইছে আর কোমোড়ে হাত দিয়ে
নাচছে। ছোট ছোট বাচ্চারাও আনন্দে লাফাচ্ছে, ডিগবাজি
খাচ্ছে। বলাই বাহুল্য এসবই হচ্ছে আমাদের অতিথি হিসেবে আপ্যায়নের একটা অংশ। আমি
যতটা সম্ভব এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতা আমার ক্যামেরায় ধরে রাখছিলাম। মেয়েদের নাচ শেষ
হতেই শুরু হল ছেলেদের নৃত্য। তবে সেটা নাচ কম, কসরৎ বেশী। ঢাল আর বর্শা নিয়ে যুদ্ধের বিভিন্ন কলা কুশলী প্রদর্শন। শেষে মশাল
হাতে নাচ। মশালে আগুন জ্বলা অবস্থায় মুখে কামড়ে নিয়ে ডিগবাজি ও আরও কত কসরৎ। এদের
শরীরের ফিটনেস্ কে মনে মনে তারিফ না করে পারলাম না। অনেক রাত অবধি চলল এই
অনুষ্ঠান। শেষে রাত প্রায় এগারোটা নাগাদ খাওয়া দাওয়ার পর আমরা আমাদের নিজেদের
তাঁবুর দিকে রওনা হলাম। রাস্তা বেশী নয়, দশ
কিলোমিটার, যেতে বড় জোর মিনিট পনেরো বা কুড়ি। কিন্তু আফ্রিকার
জঙ্গলে রাত এগারোটা ত আর কোন বড় শহরের রাত এগারোটার সঙ্গে তুলনীও নয়। চারিদিকে
নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। শুধু গাড়ির হেডলাইটের আলোয় গাড়ির সামনের রাস্তার কিছুটা আলোকিত।
অদ্ভুত একটা গা ছম্ ছম্ করা পরিবেশ। আশেপাশে অন্ধকারে কিছুই বোঝার উপায় নেই। মিঃ
ওয়াংগার কাছ থেকে ইনফ্রারেড বাইনকুলারটা চেয়ে নিয়ে চোখে লাগালাম। একটু এদিক ওদিক
চাইতেই গাড়ির ডান পাশে প্রায় কুড়ি পঁচিশ হাত দূরে হঠাৎ দেখলাম একটা বিশাল গণ্ডার।
সঙ্গে রয়েছে তার ছোট্ট ছানা। মা আর বাচ্চা ঘাস খেতে ব্যাস্ত। গাড়ির আওয়াজ আর আলোয় মা
সচকিত হয়ে ঘুরে দাড়াল আমাদের দিকে। রাস্তাটা সামনে ডানদিকে একটু বাঁক নিয়েছে। বাশা
গাড়িটা একটুঁ ডানদিকে ঘোড়াতেই হেডলাইটের বেশ কিছুটা আলো গিয়ে পড়ল শিশু গণ্ডারটার
গায়। ব্যস আর যায় কোথায়, বাচ্চাটা ভয় পেয়ে চেঁচাতেইমা গণ্ডার মাথা নিচু করে ছুটে এল
আমাদের গাড়ির দিকে। “বাশা সাবধান”-আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। “তাড়াতাড়ি
স্পীড নাও, তা না হলে সমূহ বিপদ।” বাশা হতচকিত, কারণ
বাইনকুলারের দৌলতে আমি গণ্ডারটিকে আগে থেকে দেখতে পেলেও, বাশা
দেখেনি। তার রিয়্যকশানের টাইম খুব কম ছিল। গাড়ির স্পীড তুলতে তুলতে একটা প্রচণ্ড
আওয়াজ আর ঝাঁকুনি। মা গণ্ডার এসে গুঁতো মেরেছেআমাদের গাড়িতে। মনেহল গাড়ি বুঝি
প্রায় উল্টে যায় আরকি। রেঞ্জ রোভার ভারী গাড়ি
তাই কোনো মতে বেঁচে গেছে। ছোট গাড়ি হোলে নির্ঘাত উল্টে যেত। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি
কোনমতে সামলে উঠতেই মিঃ ওয়াংগা বিদ্যুৎ গতিতে বন্দুক নিয়ে গণ্ডারটার কান ঘেঁসে
গুলি ছুড়লেন। গুলির আওয়াজে ভয় পেয়ে মা গণ্ডার ও তার বাচ্চা দৌড়ে পালাল। সে যাত্রা
ভগবানের আশীর্বাদে কোনক্রমে প্রানে বাঁচলাম। পরের দিন সকালে উঠে দেখলাম আমাদের
গাড়ির ডান দিকের পেছনের দরজায় বেশ বড় একটা ডেন্ট পড়েছে। দরজাটা খুলতে, বন্ধ করতে
বেশ অসুবিধে হচ্ছে। যাইহোক সকালটা বিশ্রামেই কাটালাম। বিকেল বেলায়
আবার কাছাকাছি
জঙ্গলে ঘুরতে যাওয়া হল। প্রচুর জেব্রা, জিরাফ, হাতির পালের দর্শন হল। যতটা সম্ভব
ক্যামেরা বন্দি করলাম তাদের। সন্ধ্যার পর তাঁবুতে ফিরে ক্যামেরার মেমারি কার্ড
থেকে ল্যাপটপে ডাউনলোড করছিলাম। বেশ রাত অবধি আমার তোলা ছবি গুলো আমি আর মিঃ
ওয়াংগা দেখছিলাম। বিভিন্ন গল্পে সময় কেটে গেল। মিঃ ওয়াংগা আমার ছবি গুলোর খুবই
প্রশংসা করলেন। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর তাঁবুতে শুয়ে আছি- কখন ঘুম এসে গেছে খেয়াল
করিনি। হঠাৎ তাঁবুর বাইরে থেকে বাশার উত্তেজিতগলার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে দেখলাম রাত
প্রায় দেড়টা বাজে। পাশে মিঃ ওয়াংগের বিছানা খালি। তাড়াতাড়ি বাইরে এসে দেখি মিঃ
ওয়াংগা রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে। ভ্রুকুঞ্ছুচিত চিন্তিত মুখ। বাশা ও ওদুম্বো দু্টো
হ্যাজাক জাতীয় লন্ঠন জ্বেলে জায়গাটা আলোকিত করে রেখেছে। আবার কাছাকাছি
জঙ্গলে ঘুরতে যাওয়া হল। প্রচুর জেব্রা, জিরাফ, হাতির পালের দর্শন হল। যতটা সম্ভব
ক্যামেরা বন্দি করলাম তাদের। সন্ধ্যার পর তাঁবুতে ফিরে ক্যামেরার মেমারি কার্ড
থেকে ল্যাপটপে ডাউনলোড করছিলাম। বেশ রাত অবধি আমার তোলা ছবি গুলো আমি আর মিঃ
ওয়াংগা দেখছিলাম। বিভিন্ন গল্পে সময় কেটে গেল। মিঃ ওয়াংগা আমার ছবি গুলোর খুবই
প্রশংসা করলেন। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর তাঁবুতে শুয়ে আছি- কখন ঘুম এসে গেছে খেয়াল
করিনি। হঠাৎ তাঁবুর বাইরে থেকে বাশার উত্তেজিতগলার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে দেখলাম রাত
প্রায় দেড়টা বাজে। পাশে মিঃ ওয়াংগের বিছানা খালি। তাড়াতাড়ি বাইরে এসে দেখি মিঃ
ওয়াংগা রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে। ভ্রুকুঞ্ছুচিত চিন্তিত মুখ। বাশা ও ওদুম্বো দু্টো
হ্যাজাক জাতীয় লন্ঠন জ্বেলে জায়গাটা আলোকিত করে রেখেছে।
-আপনি বাইরে না এলেই পারতেন, বললেন মিঃ ওয়াংগা।-কেন, কি হয়েছে?- আমি জিজ্ঞাসা
করলাম।
বলতে চাইছিলেন না মিঃ ওয়াংগা, কিন্তু চেপে ধরতেই বললেন-“সিংহ। একটা সিংহ কদিন
ধরে খুব জ্বালাচ্ছে আশেপাশের গ্রামে। পাশে মাসাইদের গ্রামেও বেশ কয়েকটা গরু
মেরেছে। ওদের একটা বাচ্চার ওপরেও আক্রমণ করেছিল, কিন্ত সৌভাগ্যক্রমে বাচ্চাটা বেঁচে
যায়। কিন্তু সহজ খাবারের সন্ধান পাওয়ায় সিংহটা মাঝে মাঝেই হানা দিচ্ছে।
-তাই বুঝিকাল সকাল সকাল ওকোরি এসে আপনাকে এই কথাটা জানায়, আর এই জন্যই আমরা
আসলে সন্ধ্যাবেলা ওদের গ্রামে যাই?
-ঠিক তাই। তবে সন্ধ্যাবেলায় নাচগান, প্রচুর লোকজনের সমাগমে সিংহটা আসেনি। কিন্তু
এখন ওটা আমদের তাঁবুর কাছেই কোথাও আছে-বাশা টের পেয়েছে। ও সিংহের গায়ের গন্ধ
পেয়েছে। কথাটা শুনে মনে মনে একটুঁ ভয়ই পেয়ে গেলাম। আমি ঠিক তাঁবুর দরজার বাইরেই
দাঁড়িয়ে আছি। মিঃ ওয়াংগা আর বাশা আমার ডান পাশে। ওদুম্বো আমার বাঁ পাশে। আমাদের
গাড়িটা তাঁবুর বাঁ দিকে প্রায় কুড়ি থেকে পঁচিশ ফুট দূরত্বে রাখা। হ্যাজাকের আলোয়
আমাদের তাঁবুর সামনের কিছুটা জায়গা আলোকিত, বাকি জায়গায় নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। আমরা
সবাই সচকিত হয়ে এদিক ওদিক দেখছি, সিংহটা কোথায় সেটা খুঁজেবার করার জন্য, কিন্তু এই
অন্ধকারে তাকে খুঁজে বার করা খুবই দুষ্কর। বাইরে ভীষণ মশা। হাতে পায়েকামড়াতে শুরু
করেছে। বাঁ পায়ের গোড়ালিতে
একটা কামড় পড়তেই আমি নিচু হয়ে চুলকাতে লাগলাম। নিচু হওয়াতে হঠাৎ আবছা আলোয় গাড়ির
তলা দিয়ে দেখলাম গাড়ির পেছনে চারটে লোমশ জাতীয় গাছের গুড়ির মতন। কি ওটা অন্ধকারে
ঠিক বুঝতে পারছি না। হঠাৎ ওগুলো একটুনড়ে উঠল। মুহূর্তে মাথায় খেলে গেল- তবে কি,
তবে কি – আমি চেঁচিয়ে উঠলাম,- “মিঃ ওয়াংগা, সিংহটা গাড়ির ঠিক পেছনেই আছে- সাবধান।”
মিঃ ওয়াংগা নিমেষে বাঁ দিকে ঘুরে বললেন শিগগিরি তাঁবুতে ঢুকে পড়ুন, বলেই আমাকে এক
ধাক্কা মারলেন। ওনার ধাক্কায় আমি তাঁবুর ভেতরে ছিটকে পড়লাম।। উঠে দাঁড়াবার আগেই
রাইফেলের দুটো গুলির শব্দ ও সিংহের ভয়ংকর গর্জনে চারিদিক কেঁপে উঠল। বাশা ও
ওদুম্বো হই হই করে উঠল। একটু পরেই ওরা তাঁবুর ভেতরে প্রবেশ করল। মিঃ ওয়াংগার রাইফেলের
নল থেকে তখনও অল্প অল্প ধোঁয়া বেড়চ্ছে। চিন্তিত মুখে বললেন, “থ্যাঙ্ক য়ু মিঃ সেন,
আপনি সজাগ না করলে বিপদ ঘটে যেত। বুঝতেই পারিনি ব্যাটা আমাদের গাড়ির পেছনেই ঘাপটি
মেরে বসে ছিল।আপনি তাঁবুর ভেতরে ঢুকতেই ওটা হঠাৎ গাড়ির পেছন থেকে বেরিয়ে ওদুম্বোর ওপর ঝাঁপ
দেয়। আমার সময় এত কম ছিলযে ভাল করে তাক করার সুযোগ পাইনি। গুলি চালাই পর পর দুটো।
লেগেছে নিশ্চই, কিন্তু সঠিক জায়গায় নয়। ওটা পালিয়েছে। আজ রাতে বোধহয় আর আসবে না।
কাল সকালে খুঁজে দেখতে হবে।
সেদিন রাতে আর কারও ঘুম এল না।
আমরা সবাই এক তাঁবুতে বসে রাত কাটিয়ে দিলাম। পরের দিন সকালে তাঁবু থেকে বেড়িয়ে
দেখলাম একটু দূরেই রক্তের দাগ। অর্থাৎ সিংহটা গুলিতে আহত হয়েছে। মিঃ ওয়াংগা দেখলাম
চিন্তিত, “আহত সিংহ ভীষণ সাংঘাতিক মিঃ সেন। এরা প্রায়শই ম্যান্ইটারে পরিণত হয়। আর
এই সিংহটা ত এমনিতেই মানুষকে আক্রমণ করতে শুরু করেছে। খুব ভুল হয়ে গেছে, এটাকে
এভাবে ছেড়ে দেওয়া। সিংহটাকে না মারলেই নয়, তা না হলে বিপদ আরও বাড়বে বই কমবে না।”
সারাদিন অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সিংহের পাত্তা পাওয়া গেল না। সন্ধ্যাবেলা আবার সবাই তাঁবুতে
ফিরলাম। পরের দিন ভোর হতে না হতেই ওকোরি এসে হাজির। আপাত শান্ত মানুষটার চোখে মুখে
দুঃখ এবং প্রতিহিংসার ছাপ স্পষ্ট। বুঝলাম ব্যাপার গুরুতর। মিঃ ওয়াংগার সঙ্গে
উত্তেজিত হয়ে কি বলছে। মিঃ ওয়াংগা ওর কথায় নড়ে চড়ে বসলেন।। চিন্তিত মুখে বললেন,
“যা ভয় পেয়েছি তাই-গতকাল রাতে সিংহটা মাসাইদের গ্রামে এক মহিলাকে তুলে নিয়ে যায়।
ওই মহিলা বোধহয় রাতের বেলা কোনো কারণে ঘর থেকে বেরিয়েছিল। পেছন থেকে সিংহের
আক্রমন। টুঁ শব্দ পর্যন্ত করতে পারেনি সে। অনেকক্ষণ আসছেনা দেখে সবাই রাত্রে মশাল নিয়ে খুঁজতে
বেড়োয়-কিন্তু খুঁজে পায় না। আজ সকালে গ্রামের পাশের জঙ্গলে ওর আধ খাওয়া শরীরটা পাওয়া গেছে।” শুনে শিউরে
উঠলাম। হে ভগবান, এ কোন বিপদে পড়লাম। ম্যান্ইটার সিংহের খপ্পরে পড়ে শেষে পৈত্রিক
প্রাণটা না দিতে হয়।
মিঃ ওয়াংগা বললেন, “মিঃ সেন আমাদের
বেড়োতে হবে। সিংহটাকে না মারলেই নয়। আমি আর ওকোরি জঙ্গলে যাচ্ছে, আপনি কি থাকবেন
না আমাদের সঙ্গে যাবেন?”-পাগল নাকি, এখানে একা থাকি কার ভরসায়? আমিও যাব আপনার সাঙ্গে।আমরা রওনা দিলাম অজানার উদ্দেশ্যে। বেলা বাড়ছে। মনে মনে ভাবলাম, এখন কি সিংহটাকে বাইরে পাওয়া যাবে, ওটা
হ্য়ত কোনো গুহায় লুকিয়ে আছে। রাত হলে বেড়বে। জঙ্গলের রাস্তায় বেশ খানিকটা পথ
এসেছি। এখানে ঘাস গুলো বেশ বড় বড়– সিংহের লুকিয়েথাকার পক্ষে আদর্শ জায়গা। ইতস্তত
কিছু বড় গাছ। কাঁটা ঝোপ ঝাড়। বাশা ও ওকোরি দেখি সতর্ক হয়ে গেছে। ওরা কি কিছু টের
পেয়েছে?বেশ খানিকক্ষণ আমরা গাড়িতেই বসে রইলাম। কারো মুখে কোন কথা নেই। একটা অদ্ভুত
নিস্তব্ধতা গ্রাস করেছে চারিদিক। সময় যেন কাটছে না। বেলা প্রায় দুটো বাজতে চলেছে।
সকালে তাড়াহুড়োয় ঠিকমতন ব্রেকফাস্ট করা হয়নি- ক্ষিদে পাচ্ছে। হঠাৎ ওকোরি গাড়ি থেকে নামল। গাড়ির ছাদের ক্যারিয়ার
থেকে বর্শা নামিয়ে ধরল ডান হাতে। বাঁ হাত মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে অদ্ভুত কায়দায় ডাক
ছাড়ল।
-কিসের শব্দ করছে ও?মিঃ ওয়াংগা বললেম, “হরিণের”।বুঝলাম হরিণের আওয়াজ করে ও সিংহটাকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে।
-কিন্তু সিংহটা কি এখানেই আছে?
-হ্যাঁ, আসে পাশেই আছে, ওরা ঠিক বুঝতে পারে, গন্ধ পায়, বললেন মিঃ ওয়াংগা।ঝোপ ঝাড়ের আড়ালে ওকোরি অদৃশ্য হল। একটু পড়ে মিঃ ওয়াংগাও নামলেন। ওকোরি যে
রাস্তায় গেছে সেই পথেই এগোলেন। উনিও একটুঁ পড়ে জঙ্গলে অদৃশ্য হলেন। গাড়িতে এখন
শুধু আমি আর বাশা। ওদুম্বো আসেনি। অধৈর্য্য অপেক্ষা। সময় যেন কাটছে না। প্রায় আধ
ঘণ্টা হয়ে গেল ওদের কোনো সাড়া শব্দ পাচ্ছি না।,বিরক্তি লাগছে। গেল কোথায় ওরা? গাড়ি
থেকে নামব? দোনামোনা করে নেমেই পড়লাম। গলায় ক্যামারা ঝোলানো। গাড়ি থেকে নেমে একটু
এগোতেই একটা বিশাল বাওবাব্ গাছ চোখে পড়ল। বিরাট চওড়া গুঁড়ি। ওপরের দিকে হাজারো ডালপালা
উঠে গেছে। গাছটার কাছে গিয়ে কতগুলো ছবি নিলাম। এরকম গাছ ভারতবর্ষে পাওয়া যায় না।
খেয়াল নেই হাটতে হাটতে, ছবি তুলতে তুলতে গাড়ি থেকে প্রায় বেশ খানিকটা পথ চলে
এসেছি। হঠাৎ কেমন জানি মনে হল একটা অদ্ভুত চাপা গুর্ গুর্ শব্দ। সচকিত হলাম।। বাঁ
পাশে ফিরতেই যা দেখলাম তাতে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। আমার থেকে প্রায় হাত পঞ্চাশেক
দূরে ঝোপের আড়ালে যার মাথা দেখা যাচ্ছে, সেটা আর কেউ নয় স্বয়ং মূর্তিমান শয়তান-সেই
সিংহটা। বেশ বুঝলাম ওর লক্ষ্য আমারই দিকে। শরীরটা কেমন যেন হিম হয়ে
গেল। ভাবলাম আর বোধহয় প্রাণ নিয়ে ফেরার
কোনো উপায় নেই। এখানেই আমার ভবলীলা সাঙ্গ হবে। দৌড়বার শক্তি নেই-হাত পা ভয়ে অসাড়
হয়ে আসছে। আর দৌড়ে যাবই বা কোথায়? যার সামনে পড়েছি, দৌড়ে বা গায়ের জোরে কোনোটাতেই আমি
তার সমকক্ষনই- কাজেই আমার একটিই পরিণতি-সুনিশ্চিত মৃত্যু। আমার অসহায় অবস্থাটা বোধহয়
সিংহটাও বুঝতে পেরেছে। উঠে দাঁড়িয়েছে ঝোপের ভেতরে। তার উচ্চতা প্রায় আমার কাঁধের
সমান। কি বিশাল সিংহ- এই প্রথম তাকে ভাল করে দেখলাম, কালচে বাদামি রঙের কেশর, পিঠের
কাছে একটা ক্ষত চিহ্ন-বোধহ্য় পরশুর সেই গুলির চিহ্ন। ধীরে ধীরে আমার দিকে
এগোচ্ছে-মুখে ঘড়্ ঘড়্শব্দ। সামনে নিশ্চিত মৃত্যু এগিয়ে আসছে-এত কাছ থেকে কখনও
মৃত্যুকে দেখিনি। আর দেশে ফিরতে পারলাম না। কোন মতে একটা অস্ফূট শব্দে ডাক দিলাম,
“মিঃ ওয়াংগা”। আমার গলার আওয়াজ আমি নিজেই চিনতে পারছিলাম না। হঠাৎ দেখলাম আমার ডান পাশের
ঝোপের ভিতর থেকে ওকোরি বেড়িয়ে আসছে-হাতে বর্শা। সিংহের নজর শুধু আমারই দিকে, লাফাল
বলে। আমি পেছতে পেছতে বাওবাব গাছের গুড়ির সঙ্গে সেঁটে গেছি, আর পেছবার জায়গা নেই।
সিংহটা আমার দিকে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে।হঠাৎ যা ঘটল, সেটা লিখতে বা বলতে যা সময় লাগবে
ঘটল তার চেয়ে অনেক কম সময়ে। এইবার দেখলাম “মাসাই” কাকে বলে। সিংহটা এবার আমার দিকে
দৌড়তে শুরু করেছে আর দৌড়ে আসা সিংহের দিকে ওকোরিও তীরের মতন বর্শা হাতে ছুটে
যাচ্ছে। যেই সিংহটা আমাকে লক্ষ্য করে লাফাল, অলিম্পিকে যে ভাবে জ্যাভেলিন
থ্রোয়াররা দৌড়ে গিয়ে জ্যাভেলিন ছোঁড়ে, সেইভাবে ওকোরি প্রচন্ড জোরে বর্শাটা ছুঁড়লো
সিংহের দিকে। আমি তখন শুধুই নিরব দর্শক। বর্শাটা বিদ্যুৎ গতিতে উড়ে গিয়ে সিংহের
গলায় বাঁ দিক দিয়ে ঢুকে ডানদিক দিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেল। কত জোড়ে এত বড়
বর্শা ছুড়লে এভাবে একটা সিংহ কে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেওয়া যায় সেটা অকল্পনীয় আমার
কাছে। একটা বিকট হুংকার দিয়ে সিংহটা আঁছরে পড়ল আমার থেকে মাত্র হাত পাঁচেক দূরে।
হাত পা গুলো শুন্যে কয়েকবার ছুঁড়ল যেন মনে হল শরীর থেকে ধীরে ধীরে নিসৃত প্রাণবায়ুকে
ধরার শেষ চেষ্টা করছে ও।সারা শরীরটা থর্ থর্ করে কয়েকবার কেঁপে উঠে নিস্তেজ হয়ে
গেল চিরকালের মতন। সারা জায়গাটা রক্তে লাল হয়ে গেছে। কি ভয়ংকর দৃশ্য
আমার চোখের
ঠিক সামনে। এর মধ্যে কোথা থেকে মিঃ ওয়াংগাও এসে উপস্থিত হয়েছেন। ওকোরি ধীরে ধীরে
এগিয়ে গেল মৃত সিংহটার কাছে।নীচু হয়ে বসে সিংহটার কেশরে হাত বুলালো কয়েকবার-যেন
বলতে চাইছে, তোমাকে মারতে চাইনি বন্ধু, কিন্তু তুমি আমায় বাধ্য করলেআমার চোখের
ঠিক সামনে। এর মধ্যে কোথা থেকে মিঃ ওয়াংগাও এসে উপস্থিত হয়েছেন। ওকোরি ধীরে ধীরে
এগিয়ে গেল মৃত সিংহটার কাছে।নীচু হয়ে বসে সিংহটার কেশরে হাত বুলালো কয়েকবার-যেন
বলতে চাইছে, তোমাকে মারতে চাইনি বন্ধু, কিন্তু তুমি আমায় বাধ্য করলে। আমার সারা শরীরটা কাঁপছিল। আর
দাঁড়াতে পারলাম না- ধপ্ করে মাটিতে বসে পড়লাম। মিঃ ওয়াংগা দৌড়ে এসে আমাকে তুলে
ধরলেন। “আপনি ঠিক আছেন ত মিঃ সেন?” পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মিঃ ওয়াংগার আওয়াজটা যেন মনে
হচ্ছিল বহু দূর থেকে আসছে। ধীরে ধীরে ধাতস্থ হয়ে বললাম, “হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি।”
কিন্তু সত্যিই কি ঠিক আছি? বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই ভয়ংকর সিংহের লাফ আর
তার গলা বর্শায় এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে বীভৎস মৃত্যু। থেকে থেকেই শিউরে উঠছিলাম আমি। যখন
তাঁবুতে ফিরলাম তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমার শরীর মন কিছুই ভাল লাগছিল না। সেদিনকার
মতন যাহোক কিছু মুখে দিয়ে আমি খুব তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি। রাতেও ভাল মতন ঘুম হল না।
ঘুমের মধ্যে যে কতবার ভয়ংকর দৃশ্য মনে করে চমকে চমকে উঠেছি তার ইয়ত্তা নেই।
পরের দিনটা কোথাও বেড়লাম না,
সারাদিন তাঁবুতেই কাটালাম। মন বলছে এবার দেশে ফেরার পালা, অনেক হয়েছে জঙ্গলের অভিজ্ঞতা। যাবার দিন সত্যিই উপস্থিত হল। আমার সামান্যই
মালপত্র। সকাল সকাল রওনা হয়ে ফিরব মিঃ ওয়াংগার বাংলোয় সেখান থেকে সোজা নাইরোবি
এয়ারপোর্ট। গোছ গাছ শেষ করে গাড়িতে উঠতে যাব। তাঁবু থেকে বেরতেই দেখি সামনে ওকোরি
দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে আমি যেন কেমন হয়ে গেলাম। মুখে কোন কথা ফুটছিল না। আমার কাছে ওর
ধন্যবাদ প্রাপ্য, কিন্তু ধন্যবাদ কথাটা সেই মুহূর্তে খুব ছোট মনে হচ্ছিল ওর জন্য।
ও আমার জীবন বাঁচিয়েছে, কিন্তুতার পরিবর্তে আমি তাকে কি দিতে পারি? আমার যে কিছুই
নেই ওকে দেওয়ার মতন। ওর ভাষাও আমি বুঝিনা। দুই হাত করজোড়ে বুকের কাছে নিয়ে ওকে
নমষ্কার জানালাম। তারপর যেটা ঘটল সেটা অভাবনীয়। ওকোরি আমার কাছে এগিয়ে এল। নিজের
গলায় একটা পুঁথি আর হাড়ের টুকরো দিয়ে তৈরি একটা মালা ছিল। সেইটা খুলে সযত্নে আমার
গলায় পরিয়ে দিয়ে কি একটা বলল। আমি অবাক হয়ে মিঃ ওয়াংগার দিকে চাইলাম। মিঃ ওয়াংগা
অনুবাদ করে বললেন যে ওকোরি বলছে এই মালাটা ছোটবেলায় ওর মা ওদের আরাধ্য দেবতার পায়ে
ছুঁইয়ে ওকে পড়িয়ে দিয়েছিলেন। এটা ওকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করবে বলে ওদের বিশ্বাস।
আপনার মঙ্গল হোক। ভগবান আপনাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করুন। এই কামনা করেই এই মালাটা
ও আপনাকে পড়িয়ে দিল। আমি অভিভূত হলাম। চোখ ভাবাবেগে ঝাপসা হয়ে এল। আমাদের মতন তথাকথিত
শহুরে লোকের কাছে এই মাসাইরা এক প্রকার জংলী সম্প্রদায় বলা চলে। কিন্তু কত বড় মনের
মানুষ হয় এরা। আনন্দে জড়িয়ে ধরলাম ওকোরিকে। সেও আমাকে জড়িয়ে ধরল। বললাম ভগবানের
কাছে প্রার্থনা করি যে তুমি এমনই থাক। তোমার আমাদের মতন ‘সভ্য মানুষ’ হয়ে কাজ নেই।
তোমাদের বীরত্ব ও ঔদার্্য্য এই ভাবেই মানুষের হৃদয় জয় করুক। মিঃ ওয়াংগা আমাদের
দুজনের একটা ছবি তুলে দিলেন।
ফিরে চললাম নাইরোবি এয়ারপোর্টের দিকে। এবার
আমার ড্রাইভার স্বয়ং মিঃ ওয়াংগা। আমি তার পাশে। বাশা পেছনের সিটে। বিকেল নাগাদ
পৌছলাম জোমো কেনয়াটা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। আমার ফ্লাইট রাত পৌনে এগারোটা
নাগাদ, কাজেই এখনও যথেষ্ট সময় আছে। বাশা মালপত্র নামিয়ে ট্রলিতে তুলে দিল। শেষবারের
মতন মিঃ ওয়াংগাকে জড়িয়ে ধরলাম।
-অনেক ধন্যবাদ
বন্ধু। যে অভিজ্ঞতানিয়ে দেশে ফিরছি, তা সারাজীবন আমার পাথেয় হয়ে থাকবে। এবার কিন্তু
ভারতে আসার পালা আপনার। এবং বলাই বাহুল্য আপনার থাকা, খাওয়া এবং ঘোরার
সব বন্দোবস্ত আমি করব। মিঃ ওয়াংগা সহাস্যে রাজি হলেন-
-নিশ্চই যাব,
ভারতে যাবার শখ আমার বহুদিনের, আর এখন ত আপনার মতন এমন বন্ধু থাকায় আরও সুবিধা হবে
আমার। বাশা আমাদের দুজনের একটা শেষ ছবি তুলে দিল। এয়ারপোর্টের ভেতরে যাবার জন্য পা
বাড়ালাম। বাই বাই নাইরোবি, বাই বাই মিঃ ওয়াংগা। কিন্তু তাও পা যেন আটকে যাচ্ছে
আমার, কিসের পিছুটানে। গলায় মালাটায় হাত দিয়ে ভাবলাম যে এলে সবচেয়ে
খুশী হতাম, জানি সে কোনদিনও আসবে না। দেশকালের গণ্ডি পেড়িয়ে, পাসপোর্ট ভিসার ঝক্কি
সামলে ওকোরি কোনদিনই আসবে না আমার কাছে। তাকে আর কোনোদিনও দেখতে পাব না। তবুও
যতদিন বেঁচে থাকবো তাকে কোনদিনও ভুলতে পারব না, ভোলা সম্ভব নয়। আমার এই নবজীবন তার
জন্যই সম্ভব-আমার নবজীবনদাতা, ওকোরি।
Painting Courtesy: Various artists, Google
Subscribe to:
Posts (Atom)