অপয়া
(১)
বাম কানের লতিতে সুড়সুড়ি অনুভব ক’রে হঠাৎ ঘুমের চট্কা টা ভেঙে গেল, ঘুমে ভারী হয়ে আসা চোখের পাতাটা
খুব কষ্ট করে আধ খানা খুলে দেখলাম, একমুখ দাড়ি নিয়ে সৌম্যকান্তি
ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে, চোখে বেশ একখানি শান্ত সমাহিত জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব, ঠিক যেন
কোনও সাধু মহাত্মা, মুখ চলছে অনর্গল কিন্তু বেশ ধীরে ধীরে, ভাবলাম প্রবচন চলছে বোধহয়। এর পর আচমকা একখান রাম ঝাঁকানি
এবং সাথে গগন বিদারী হর্নের শব্দে আধখোলা চোখের ঝাঁপ পুরোপুরি খুলতেই দেখি যে
মহাত্মার দাড়ি ভর্তি মুখের পাশ দিয়ে উঁকি মারছে বিল্টুদের বাগান থেকে চুরি ক’রে
আনা পাতাশুদ্ধ একখানি অশ্বত্থডাল, যেটার রাম খোঁচানি তেই আমার
ঘুম ভাঙ্গল।
‘...ও
ম্যাঅ্যাঁঅ্যাঁ,...না,মানে, মা...আ ! এটা যে করিম চাচার পেয়ারের পাঁঠা হাবুল !’
(২)
আরে,আরে দাঁড়ান মশাই, মুখের হাঁ
টা অমন হাঙরের মতন করবেন না, মুখে মাছি ঢুকে যাবে, আমি বরং শুরু টা শুরু থেকেই বলছি.........
আমার নাম শ্রীল শ্রীযুক্ত, ...ওই যাঃ, মনে নেই, বেশ বড় নাম তো, একটা সাত বছরের ছেলের পক্ষে, তা সে আমি
যতই পাকা হই না কেন, এত বিশাল আর খটমটে যুক্তাক্ষর যুক্ত নাম মনে রাখা সহজ কম্ম
নয়, ওটা আমি প্রায়শই ভুলে যাই, থাক গে, আমি আমার ডাকনাম টাই বলি,আমার নাম
“ভোম্বল”, যদিও আমার ধারণা যে আমি যথেষ্ট রোগা পাতলা, কিন্তু পাড়ার হাড় শয়তান নিন্দুক গুলো আমায় ওই নামেই ডাকে, এমন কি আমার খেলার বন্ধুরা , যেমন- ‘
বাপী,মিন্টু,স্বাতী ,-ওরাও, মনে মনে ভীষণ রেগে গেলেও হাসি
মুখে মানতে বাধ্য হই, কারন, আমি খুবই বাধ্য ছেলে, মা, বাবার আদরের “বাবু”, কারও সাথে
মারা মারি তো দূর, সামান্য ঝগড়া ঝাঁটিও “নট অ্যালাউড” । যাকগে, ভোম্বল হ’ই বা বাবু, আমার
কল্পনা শক্তি কিন্তু খুব প্রখর, এর জন্য দায়ী আমার দিদিমা, ফি বছর উনি আমার জন্মদিনে নানা রকমের গল্পের বই উপহার দেন, বাবার রক্ত চক্ষু এবং স্কুলের হোমওয়ার্ক কে উপেক্ষা করে
হলেও সে সব বই আমি গোগ্রাসে পড়ি, অথবা “গিলি” বলা যায়, সুকুমার রায়ের “হ য ব র ল” থেকে শুরু ক’রে ‘চাঁদ মামা’, ‘শুকতারা’, অরন্য দেব, হাঁদা ভোঁদা, সব আমার
গেলা হয়ে গেছে এবং আমার অবিশ্বাস্য হজম ক্ষমতার গুনে হজমও হয়ে গেছে। ওই যে কথায় আছে না –
“ছাগলে কি না খায়”, তা, ছাগলদের সম্পর্কে আমার জ্ঞান খুব প্রখর, তার কারণ আমাদের এই কাহিনীর নায়ক “পাঁঠা কূল চূড়ামণি”
শ্রীমান “হাবুল”। ইনি একজন
রীতিমতো উচ্চ জাতের, স্বাস্থ্যবান নধর কান্তি পাঁঠা, দাঁড়ি খানিও বেশ সরেস। তা,এক দিন হয়েছে কি বিকেলে খেলার মাঠে বন্ধুরা আমাকে মানে
ভোম্বল কে আড়ং ধোলাই দিয়েছে, আমিও ‘বাবু’ হয়ে মার খেয়ে চুপ চাপ বাড়ির দিকে হাঁটা দিয়েছি, কিন্তু, রাগ টা তো রয়েইছে, তাই যখন দেখলাম যে মাঠের বাইরে রাস্তার ধারে হাবুল টা দড়িতে
বাঁধা অবস্থায় চোখ বুঁজে নিশ্চিন্ত মনে ঘাস চিবুচ্ছে ভাবলাম এই মওকা, ব্যাটা দড়িতে বাঁধা অবস্থায় আমার কিছুই বিগড়োতে পারবেনা, তাই, বিশ্বাস করুন, এই
এত্তটুকুন একটি পাথর তুলে হাবুল কে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলাম, লক্ষ্যভেদ হয়েছে দেখে নিশিন্তে হাত ঝেড়ে বাড়ির পথ ধরেছি, হঠাৎ চোখে ‘সর্ষে ফুল’, কানে
‘সাইরেন’, আর দুটো হাঁটুতে ‘লঙ্কাবাটা’, সম্বিত
ফিরতে বুঝলাম যে গোগ্রাসে গেলা ছাড়াও আমার সাথে হাবুলের আর একটা মিল আছে সেটা হ’ল
যে হাবুল মশাইও আমার মতোই দড়ি বাঁধা কিন্তু রাগী। কখন দড়ি ছিঁড়ে এসে আমায় ঢিলের
বললে ঢুঁ টি মেরে হৃষ্টচিত্তে ফিরে যাচ্ছে, তবে
হিসেবের বেশ পাকা, একটা “ঢিলের” বদলে মাত্র একটাই “ঢুঁ”।
সেই থেকেই হাবুল কে সমঝে চলতাম আর মনে মনে দিনরাত ওর মৃত্যু
কামনা করতাম। ভগবান আমার কথা শুনে ছিলেন বোধ হয়, তাই সেদিন
২৪ শে ডিসেম্বর রাত্রে হাবুল আর আমি সেই দুই বাই দুই সিটের লজ্ঝড়ে বাসের পেছনের
সিট শেয়ার করছিলাম............।
আঃ মশাই, অধৈর্য হচ্ছেন কেন বলুন তো ? নায়কের ইন্ট্রো টা তো ঠিক ঠাক হওয়া উচিৎ,তা নয় কি? হাবুল বেচারা ছাগল বলে কি আর
মানুষ নয়?
(২)
আচ্ছা যাকগে, বাকিটা বলি............, সেটা ছিল আশির দশকের গোড়ার দিকের কথা, তখন আমরা, মানে আমার বয়সি বাচ্চারা
মুখ্যমন্ত্রী আর জ্যোতি বসু মশাই কে ইকুইভ্যালেন্ট জানতাম, পদের আর মানুষের
নামের কোনও ভেদাভেদ অন্ততঃ আমাদের কাছে ছিল না,তখন আমরা
আমদের গ্রামের বাড়ী তে যেতাম কাঠের ফ্রেমের রঙিন জানলাওলা দুই বাই দুই সিটের
লজ্ঝড়ে বাসে করে,আর আমার চোখে হীরো ছিল ওই সব বাসের হেল্পার, কন্ডাকটাররা, যাঁদের এক
থাবড়ায় বাস চলত আর থেমে যেত, এবং কোনও এক অনিবার্য কারণে
বাসে ভীড় না থাকলেও কন্ডাকটার মশাই বাসের দরজা টি আধ খোলা রেখে পাদানির শেষ
ধাপটিতে একটি পা আর অন্য পা টি দরজার নিচের দিকে একটি খোপে রেখে হাওয়ায় ঝুলতে
ঝুলতে যেতেন।সেই যুগেও কিন্তু লোকে পিকনিকে যেত, বিশেষতঃ
বড়দিনে বা ২৫ শে ডিসেম্বরে, ২৫ শে বৈশাখের মাহাত্ব স্কুলের এবং পাড়ার ক্লাবের
প্রভাতফেরির দৌলতে কিছু জানা থাকলেও, ২৫ শে ডিসেম্বর মানেই বড় দিন, কেবল
মাত্র মজা, সেখানে
কোনও ক্রুশ বিদ্ধ যীশুর কথা আমাদের শিশু মনে আঁচড় কাটত না। আমাদের ছোট্ট শহরে ওই
দিনের বিশেষ মজা ছিল -পাড়ায় মোড়ের দোকানের ট্রে তে সাজানো প্লাম কেক, যার মধ্যে থেকে প্রায় দুর্লভ মণি মাণিক্য রূপী লাল নীল চেরী
ও সাদা মোরব্বা খুঁজে বার করার একটা বেশ মজার খেলা ছিল, কেকে ভেজাল থাকত কি না জানিনা, তবে আনন্দ ছিল নির্ভেজাল। কিন্তু গ্রামের দিকে তখনও “কেকের”
চল ছিল না তার দুর্লভতার কারনে, তার থেকেও আকর্ষণীয় ও
সুস্বাদু জিনিষটি ছিল পুলি পিঠে, একেবারে হোম মেড, “মা” এর বেকারী থেকে বেরোনো পুলি পিঠে কে অনেকে গর্ব করে
বাঙ্গালীর “কেক” বলতো।আর ছিল স্বনাম ধন্য “পিকনিক” বা “চড়ুই ভাতি”, আমাদের পাড়ার বড় রা, অর্থাৎ
পুরুষরা যেতেন শহরের উপকণ্ঠে বয়ে চলা কংসাবতী নদীর চরে পিকনিক করতে, বিভিন্ন ক্লাব, এবং
“সমাজসেবী” সংস্থার উদ্দ্যোগে ওঁরা যেতেন নিজেদের “সেবা” করতে, কিন্ত সেখানে বাচ্চাদের প্রবেশ নিষেধ। ‘কারন’ টি ‘বাবুর’
কাছে দুর্বোধ্য হলেও ‘ভোম্বলের’ কাছে ‘কারণ’ টি ছিল বেশ স্পষ্ট।সে কথা থাক, তা, এই রকম একটি ২৪ শে ডিসেম্বরে ঘটল একটি অঘটন, পাড়ার পুরুষেরা কোনও অদৃশ্য শক্তির আদেশেই হোক, বা, দিন রাত হাবুলের মৃত্যু কামনা করে ভগবানের কাছে আমার আকুল
প্রার্থনার জোরেই হোক, একবাক্যে রায় দিলেন যে,
“এবার পিকনিকে শুধু আমরা নই, আমাদের
বাড়ির সব্বাই, বউ, বাচ্চা, মায় কাকিমা, পিসিমা ইত্যাদি যাদের যা সম্বল, (শুধু ঘটিবাটি বিছানাপত্র ছাড়া) সবাই পিকনিকে যাবে,”
বিধি সাথে থাকায় ‘মা ভবতারিণী ট্রাভেলসের’ মালিক ভবেশবাবু
যাঁর কিনা খানপাঁচেক শহরতলীর বাস ছিল, এক কথায় পাড়ার ‘আমরা সবাই’ ক্লাবের সদস্যদের অনুরোধে একটা
বাস সস্তায় ভাড়া দিতে রাজি হয়ে গেলেন।
“আমরা সবাই” ক্লাবের তরুন তুর্কী, সদ্য সদস্য পদ প্রাপ্ত গেনু কাকু মহা উৎসাহে দলপতির পদটি
হস্তগত করে বেশ একটা হামবড়া ভাব নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন।
গেনু কাকু পাড়ার একটি মুদির দোকানে হিসেবের কাজ কর্ম
দেখাশোনা করে্ন, কিন্তু তার অতীত জীবন অতীব বর্ণময়য়, অন্ততঃ আমার কাছে, কারন তিনি
ছিলেন ওই ‘মা ভবতারিণী ট্রাভেলসের’ প্রাক্তন কর্মচারী, হেল্পারী দিয়ে শুরু, তারপর
পদন্নোতি হয়ে ড্রাইভার, এবং সর্বশেষে একটি মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট করে ছয় মাস
শ্রীঘর বাস শেষ করে এখন “আমরা সবাই” ক্লাবের এক জন কেউ-কেটা। মূলতঃ তার সোর্সেই
বাসটি পাওয়া, বাস ব্যবসায়ের সাথে
এহেন ওতপ্রোত যোগাযোগ এবং অগাধ অভিজ্ঞতার কারনে তাঁর কথা সবাই একবাক্যে
লিডার মেনে নিতে রাজী হল।
মেনু স্থির হতে কোন সময়ই লাগল না, কারন আপামর বাঙ্গালীর মতো আমরা বাড়ি তে বৃহস্পতি আর শনি বার
নিরামিষ খেলেও পিকনিকে অনিবার্য ভাবে মাংসাশী, তা, সে যেকোনো দিন বা বারই হোক না কেন। তবে,এইখানে একটি সমস্যা দেখা দিল-আগেই বলেছি যে সময় টা ছিল আশির
দশকের গোড়ার দিক, তখন সবে মাত্র
বাজারে ‘ব্রয়লার মুর্গী’ নামক একটি সুস্বাদু প্রাণীর আবির্ভাব হয়েছে, কিন্তু জাত যাবার ভয়ে ব্রাম্ভণ, বৈষ্ণব সবাই ওই বিজাতীয় প্রানীর মাংস থেকে শত হস্ত দূরে
থাকত, কিন্তু মুর্গী রান্না করা সহজ, পাঁঠার মাংস রান্নায় সময় লাগে, পিকনিক ভেস্তে যায় আর কি, তখন গেনু
কাকু মধ্যস্থতা করে বললেন, “মুর্গী আর পাঁঠা দুটোই থাকবে, যার যেটা
পছন্দ”।
স্বভাবতঃই মঞ্চে প্রবেশ পাঁঠাকুল চূড়ামণি, শ্রীমান হাবুলের।
(৩)
সেই মত ২৪শে রাত্তির প্রায় আটটার সময় আমরা সবাই বটতলা
কালীমন্দির বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো ‘বিচিত্রা’ নামক বাসেতে মা ভবতারিনীর নাম স্মরণ
করে চেপে বসলাম। ‘বিচিত্রা’ বাসটির নাম টি যেমন বিচিত্র, তেমনই বিচিত্র তার গোঙানি, বাসের
মধ্যে মাত্র গুটিকয় পরিবার মাত্র এসে
বসেছে, কিন্তু বাসটির ইঞ্জিন স্টার্ট করাই আছে, বাবাঃ কি উৎসাহ, ‘বাবুর’ মনে
হ’ল যে বাসটি যেন একটি দুরন্ত ঘোড়া, মালিকের
একটি মাত্র ঈশারা, আর ব্যস, উনি ছুটবেন রাজ্য জয়ে, ধীরে ধীরে বাস টি যখন প্রায় ভ’রে এসেছে, তখন এসে পৌঁছলেন ক্লাবের ষাটোর্ধ প্রেসিডেন্ট দোলগোবিন্দ
বাবু, ইনি অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়র, টাটা
কোম্পানি তে বেশ উচ্চপদস্থ পদ থেকে রিটায়ার করেছেন, রাশভারী
মানী গুণী লোক, ক্লাবের সবাই এঁনাকে সমীহ করে চলে।বাসে ওঠার আগে উনি বাসটির
চার দিকে টহল দিয়ে এসে গিয়ে ঢুকলেন ড্রাইভারের কেবিনে,কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে
জিভ দিয়ে একটা আক্ষেপ সুচক চুক চুক শব্দ করতে করতে ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে এসে
বললেন,
-“বাবা গেনু, এটা তুমি
কি বাস আনলে,বাবা? একি আদৌ চলতে পারবে বলে তুমি
মনে কর?”
-“ আরে! চলবে মানে! এত দৌড়বে” , গেনু কাকুর তুরন্ত জবাব,
-“এ ‘ত বাস নয়, এ হ’ল গিয়ে
রথ,এই বাসের সব নাড়ী নক্ষত্র আমার এই নখের ডগায়, কারন কি জানেন?”
যথারীতি আমারা কেউ জানতাম না, গেনু কাকু
নাটকীয় ভঙ্গি তে বলে চলেন.........
-“এই বাসটিই তো আমি চালাতাম”
সর্বনাশ! এই সেই ‘চিত্রা’ নামক বাস? যেটা কিনা গেনু কাকুর দয়ায় প্রায় এক বছর রোদে, জলে পড়ে ছিল পুলিশের হেফাজতে? আমি জানিনা,তবে নিন্দুকেরা বলে যে পুলিশের হেফাজতে থাকা কোনও জিনিষ
নাকি আর আস্ত থাকে না, ভেতর থেকে পার্টস হাওয়া হয়ে যায়, তা সে ‘কয়েদিই হোক’ বা ‘বাস’।
গেনু কাকুর কোনও ভাবান্তর নেই, দাঁত বের করে উনি কন্টিনিউ করলেন,
-‘ সেই বাসের ওপরই রঙ করে ‘চিত্রা’ কে ‘বিচিত্রা’ বানিয়ে
আবার লাইনে নামানো হয়েছে, আর আমাকে দিয়েই তার উদ্ঘাটন হ’বে, নেহাতই আমার লাইসেন্স টা বাতিল করে দিয়েছে, না হলে তো বাস টা আমিই চলাতাম’।
-“আমার রথে চড়ার কোনও ইচ্ছে নেই’
বলেই দোলগোবিন্দ বাবু হনহনিয়ে বাস থেকে নেমে হাঁটা দিলেন।
পিকনিক বাতিল হয় হয় আর কি, বাড়ির মা, কাকিমা রা, যাঁরা এই
প্রথম বার পিকনিকের সুযোগ পেয়ে, বাড়িতে ডবল তালা ঝুলিয়ে, মা কালী কে ‘ষোল আনার’ ঘুষ, মানে পুজো
দেবার সঙ্কল্প করে একবার বাড়ীর বাইরে বেরিয়েছেন, তাঁরা
কিছুতেই পিকনিক ভেস্তে দিতে চান না। দোলগোবিন্দ বাবুর স্ত্রী হরসুন্দরী দেবীর
নেতৃত্বে মা, কাকিমারা বেঁকে বসলেন,
-“পিকনিক হবেই, তার জন্য
যদি মা কালীকে একের বদলে পুরো ‘দু টাকা’ দিয়েও পুজো দিতে হয় তাও সই”।
হরসুন্দরীদেবীর, “এই যে, শোনো,” হুঙ্কার শুনেই প্রেসিডেন্ট
সাহেব থেমে গেলেন।
দোলগোবিন্দবাবু বুদ্ধিমান লোক, অহেতুক গৃহ যুদ্ধ না বাঁধিয়ে সুড়সুড়িয়ে ফিরে এলেন এবং বাসে
উঠে মুখ গোমড়া করে সামনের দরজার পাশের প্রথম সিট টি দখল করে বসলেন, সম্ভবতঃ স্ত্রীর মুখ দর্শন যাতে না করতে হয়, কিংবা হয়ত বেগতিক দেখলে তড়িঘড়ি যাতে বাস টি পরিত্যাগ করতে
পারেন, কারণটি যে কি ঠিক জানি না ।
(৪)
শেষমেশ বাস টি চলার জন্য প্রস্তুত হ’ল, ঝপাঝপ সমস্ত মাল পত্র বাসের ছাদে লোড করা হল।
আর ‘ভোম্বলের’ শত আপত্তি সত্তেও ‘বাবু’ কে বসতে হ’ল একে
বারে পেছনের সীটে, আর, পেছনের দরজার যে লম্বা রড টি ধ’রে ঝুলতে ঝুলতে হেল্পার মশাই
“চলো গাড়ী, বেল পাহাড়ী” বলে বাসের গায়ে তুমুল রদ্দা মেরে বাসটির গতি
নিয়ন্ত্রণ করেন, সেই রডে একখানি দড়ি বাঁধা অবস্থায় থাকলেন সেই “পাজির পা
ঝাড়া”, “অহঙ্কারী”, “মহা শয়তান”, “পাঁঠা সম্রাট”
“শ্রীমান হাবুল চন্দ্র”, কারন ,তাকে ছাদে তোলা কর্মকর্তা দের ঠিক নিরাপদ বলে মনে হল না, অগত্যা.........।
বাস ছাড়ল প্রায় রাত প্রায় সোয়া দশটায়।
এতক্ষণ বাস এবং পাঁঠা তে ব্যস্ত থাকায় একটা বিশেষ কথা তো
আপনাদের বলাই হয়নি, সেটা হল আমাদের পিকনিক স্পটের নাম,‘মুকুটমনিপুর’, হ্যাঁ, আমরা পিকনিকের জন্য যাচ্ছি মুকুটমনিপুর, মেদিনীপুর শহর থেকে মাত্র চল্লিশ পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে
বাঁকুড়া জেলার একটি জায়গা, নাম টি শোনা মাত্র বাবুর মনটা কেমন যেন ঝলমলিয়ে উঠেছিল, নামের মধ্যেই মুকুট, মণি সবই
আছে, আজ বাস টি ছাড়ার সময় থেকে বাবুর মনে হচ্ছে যেন সবাই মিলে
রাজ্য জয়ে চলেছে, সাথে আছে
গেনুকাকুর হাঁফ তোলা বাস, থুড়ি, ‘রথ’, একপাল সৈন্য-যাদের পোশাকি নাম ‘ব্রয়লার’, আর এক মহান যোদ্ধা- ‘পাঁঠা কূল চূড়ামণি, শ্রীমান হাবুল’। বাহঃ , বেশ মজা
হবে মনে হচ্ছে।
(৫)
কিন্তু বাসে ওঠা ইস্তক বাস টির বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থেকে
বেরিয়ে আসা নানা রকন ঝড়-ঝড়াম আওয়াজ ও ইঞ্জিনের গুমরানো কান্না, ভোম্বলের বেশ বিরক্তির কারণ হচ্ছিল, আর সব থেকে গা-জ্বালা কর ছিল মহা পাঁঠা হাবুল টাকে চোখ
বুঁজে ডোন্ট কেয়ার ভাবে গাছের পাতা চিবুতে দেখে, কিন্তু
ভোম্বলের একটা সান্ত্বনার জায়গা হ’ল যে, কালকের
‘অপারেশন মুকুটমনি পুর’ যাই হোক না কেন, হাবুল টার
মৃত্যু নির্ঘাত এবং নিশ্চিত। চিবিয়ে নে ব্যাটা, কত চিবোবি, ভাবতে ভাবতে আনন্দে ভোম্বলের চোখ বুঁজে এল।
তা, বাম কানের লতিতে অশ্বত্থ পাতার সুড় সুড়ি ......... কি, জায়গাটি মনে পড়ছে তো?
সুড় সুড়িতে ঘুম ভেঙে বাবুর মনে হ’ল যে বাস টি বেশ ধড়ফড় করছে, যেন হার্ট অ্যাটাক
এসেছে, চারিদিক ঘু্ট্ঘুটে
অন্ধকার, সম্ভবতঃ কোনও গ্রামে এসে বাসটি থেমেছে, লোক জন সব উশখুশ করছে, এমন সময়
বাসের ড্রাইভার কেবিন থেকে আমাদের গেনু কাকু সিনেমায় দেখা এরোপ্লেনের পাইলটের
ভঙ্গিমায় সগর্বে ঘোষণা করলেন,
-“ এইবার আমরা একটু ব্রেক নেবো”
বাসের দুলুনিতে দোলগোবিন্দ বাবুর বেশ একটু ঘুম ধরে গিয়ে ছিল, গেনুকাকুর এই আচমকা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা শুনে ধড়মড়িয়ে উঠে
খেঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
-“ব্রেক মানে? আমরা তো
মাত্র আধা ঘণ্টাও ভালো করে চলিনি”
গেনু কাকুর সোজা সাপটা জবাব,
-“এখানে লিডার কে”?
মহিলা মহলের হাতে শেষ বার হেনস্থা হয়ে দোলগোবিন্দ বাবু অনেক
টা জমি হারিয়ে ছিলেন, ফলে গেনুকাকুর হুমকি আর বাইরের নিকষ কালো অন্ধকারে ঝিঁঝিঁর
কলতান শুনে বাস থেকে তাঁকে নামিয়ে দিলে কি হতে পারে সেটা আঁচ করে প্রেসিডেন্ট
সাহেব যেন মিইয়ে গেলেন, বললেন,
-“ বাবা গেনু, লিডার তো
তুমিই, কিন্তু এভাবে চললে মেদিনীপুর থেকে মুকুটমনি পুর পৌঁছতে তো
পয়লা জানুয়ারী হয়ে যাবে”।
কিন্তু গেনু কাকু একদম পাত্তা দিলেন না, বললেন,
-“ আমরা এখন ‘ধেড়ুয়া’ পৌঁছেছি, এই গ্রামে আমার পিসির বাড়ি, মা মারা
যাবার পর এই পিসিই আমাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন”, “ আজ ২৪ শে ডিসেম্বর, কাল বড়দিনে
আমি থাকব বাড়ির বাইরে, আমার পিসি প্রতি বছর বড়দিনে পিঠে বানান, তা, বচ্ছরকার দিনে বাঙ্গালির কেক , মানে পুলি পিঠে আর আস্কে পিঠে ছেড়ে চলে যাব?”
-“আপনারা জানেন?” গেনুকাকু
চালিয়ে যান,
-“এই পিসি আমাকে জেলে থাকতেও পিঠে করে খাইয়ে এসে ছিলেন ? সেই মা সমান পিসি কে কি এভাবে অমান্য করা যায়?”
অকাট্য যুক্তি, না, যায় না, প্রান থাকতে নয়।
অগত্যা গেনুকাকু নামলেন বাস থেকে , বাসসুদ্ধ লোকের জন্য পিসির পায়ের ধুলো ব’য়ে আনতে ড্রাইভার
কেও সাথে নিলেন।
এইবার আসরে অবতীর্ণ হলেন আমদের পাড়ার সার্বজনীন ঠাকুমা, মনি ঠাকুমা। উনি আমাদের সকলের মায়, ষাটোর্ধ ক্লাব প্রেসিডেন্ট দোলগোবিন্দ বাবুরও ঠাকুমা, মনি ঠাকুমা বেশ মিষ্টি ও মিশুকে, ওনার ছেলে বউমা বিদেশে থাকেন চাকরি সুত্রে, কিন্তু উনি শ্বশুর বাড়ির ভিটে আঁকড়ে পড়ে আছেন , দিনরাত পূজা –ঠাকুর ইত্যাদি নিয়েই থাকেন, পাড়ার সবাই ওনাকে মান্যি করে, তা, সেই মনি ঠাকুমা বলে উঠলেন,
-“বাবা গেনু, বাড়ি যাচ্ছ
যাও, পিসিমাকে আমাদের প্রণাম জানিও, কিন্তু বাবা, ওখানে গিয়ে
পিঠে খেয়োনা, কারন পিঠে হ’ল “অপয়া”, “অযাত্রা”
, কোথাও যাবার আগে পিঠে খাওয়া উচিৎ নয়”।
(৬)
ঠাকুমার কথা বেদ বাক্য, সুতরাং, মনি ঠাকুমার ‘ভেটো’ তে সিদ্ধান্ত হ’ল যে, গেনু কাকু পিসি বাড়ি যাবেন, কিন্তু
পিঠে ছুঁয়ে দেখবেন না।তাঁর কথা মেনে নিয়ে শান্ত হয়ে গেনু কাকু বলে গেলেন যে তিনি
যাবেন আর আসবেন, ‘নো পিঠে ভক্ষণ’।
প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট সবাই বাসেই অপেক্ষা করল।
এর মাঝে হাবুলটা আর কোনও গণ্ডগোল করেনি, কেমন যেন ঝিমিয়ে ছিল, হয়ত সে
বুঝতে পারছিল,
-“ অদ্দ্যই শেষ
রজনী”, কে জানে !
বাবুর কল্পনাশীল মন কিছুটা হলেও দঃখিত হচ্ছিল, আর ভীষণ দুঃখে বা গভীর চিন্তায় পড়লে বাবুর চোখ ঘুমে জড়িয়ে
আসে। আর তা ছাড়া রাত্তির প্রায় ১২ টা, একটা ছোট্ট
ছেলে আর কতক্ষণই বা জাগতে পারে..................
(৭)
কিছুক্ষণ পর মহা হই চই, গণ্ডগোল, আর বাসের গোঙানি তে বাবুর ঘুম ভাঙ্গল, চোখ খুলে ব্যাপার টা বুঝতে একটু সময় নিল বাবু, দেখল যে বাসের কেবিনের ভেতর, যেখানে
ইঞ্জিন টা থাকে সেখানে মহা হট্টগোল, উঁকি মেরে
দেখে কি ইঞ্জিনের ঢাকনা খোলা, ঠিক যেন বাসটির ওপেন হার্ট
সার্জারি হচ্ছে, আশেপাশে ডাক্তারের দল উদ্বিগ্ন মুখে মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে, ডাক্তার দলের লিডার হলেন দোল গোবিন্দ বাবু, বাস টি থর থর করে কেঁপে চলেছে, ভোম্বল ভীড় ঠেলে উঁকি মেরে দেখল যে কি একটা গোল মতো জিনিষ
বনবন করে ঘুরছে, সেটার চার ধারে জড়ানো একটা নারকেল দড়ি অন্য একটা গোল মতো
জিনিষ কে পেঁচিয়ে আছে, ভোম্বল তার স্বল্প যান্ত্রিক জ্ঞান দিয়ে বুঝল যে আর যাই হোক
না কেন ওই নারকেল দড়িটা ওখানে একদম বেমামান, ওটার বদলে
অন্য কিছু থাকলে ভালো হ’ত, কিন্তু সেটা যে কি, সে কিছুতেই
মনে করতে পারল না।
সংশয় দূর হ’ল দোলগোবিন্দ বাবুর কথায়, অনেকক্ষণ পর পালে হাওয়া আর হালে পানি পেয়ে প্রেসিডেন্টের
মেজাজ সপ্তমে, তিনি চিৎকার করে বললেন,
-“এই যে, গেনু লিডার, এটা কি মস্করা হচ্ছে?, বেল্টের
বদলে নারকেল দড়ি দিয়ে পুলি ঘোরানোর চেষ্টা?”
-“এই তোমার রথ?, এ তো
ঠেলাগাড়ী”।
তাঁর তড়পানিতে গেনু কাকু কাঁচু মাঁচু কেঁচো, দোলগোবিন্দ বাবু ছড়ি তুলে ড্রাইভার কে এই মারেন তো সেই
মারেন, ভয় পেয়ে ড্রাইভার বলল,
-“বাবু মাফ করবেন, আসলে, মেদিনীপুর থেকে ধেড়ুয়া আসতে আসতেই পচা বেল্ট ছিঁড়ে যায়”।
-“ও, তাই বুঝি মূর্তিমান গেনুর মাতৃ প্রেম জেগে ওঠে, হতচ্ছাড়া কোথাকার!” মুখের কথা কেড়ে বলেন দোলগোবিন্দ বাবু।
-“তাই ভাবি! চোরের মুখে রাম নাম কেন হঠাৎ?”
-“তার মানে”, আমার মায়ের
আকুল জিজ্ঞাসা।
মানে পিকনিক ভণ্ডুল, সবার মুখ
কালো। এত মহাভারতের কর্ণের মতো ব্যাপার, রথটাই
বিট্রে করল, আর যুদ্ধ কি করে করা যায় ?
কানা ঘুষো শোনা গেল যে গেনু “অপয়া” পিঠের লোভ সামলাতে পারেনি , ফলে এই দশা।
যাকগে, কোনওক্রমে দড়িদড়া বেঁধে পুলি
চালিয়ে মহা সাবধানে বাস নিয়ে আমরা ফিরলাম মেদিনীপুরে, ঘড়িতে রাত তখন তিনটে।
(৮)
একে একে মাল পত্র নামানো হচ্ছে, সবার মুখে দুঃখ আর নিরাশা, কিন্তু এরই
মাঝে বাবু স্পষ্ট শুনল কে যেন “ম্যা......হ্যা...হ্যা...হ্যা...” করে হেসে উঠল।
আরে! হাবুলটার কথা তো মনেই ছিলনা,
বাবু স্পষ্ট শুনল যে হাবুল বলে উঠল,“পিঠে অপয়া নয়”।
বাবু বলল,“নিশ্চয়ই অপয়া, তা না হলে আমাদের মুকুটমনি পুর জয়ে এই রকম বাধা আসে?”
হাবুল ফিচেল হেসে বলল, “একদম অপয়া
নয়, তা না হলে আমার প্রানটা বাঁচল কেমন ক’রে, মূর্খ সম্রাট?”
এখন আপনারাই বিচার করুন।