অলীক পাতার অন্যান্য সংখ্যা- পড়তে হলে ক্লিক করুন Library ট্যাব টি



। । "অলীক পাতা শারদ সংখ্যা ১৪৩১ আসছে এই মহালয়াতে। । লেখা পাঠানোর শেষ তারিখ ১৫ ই আগস্ট রাত ১২ টা ।.."বিশদে জানতে ক্লিক করুন " Notice Board ট্যাব টিতে"

Saturday, April 25, 2020

বড়গল্প- অহিভূষণের সর্প দোষ- স্বরূপ চক্রবর্তী

অহিভূষণের সর্প দোষ
স্বরূপ চক্রবর্তী

অলঙ্করণঃ মিঠুন দাস


সকাল সকাল কলিং বেলের কর্কশ শব্দে ঘুম ভাঙলো  অহিভূষণ আচার্য্যর , দরজায় দুম দুম ধাক্কা, সাথে খোট্টা দুধওয়ালার চিল চিৎকার, "ওহী বাবু, ও ওহী বাবু, উঠবেন? কি না উঠবেন?" স্ত্রী দিন দশেকের জন্য বাপের বাড়িতে, ফলে বাধ্য হয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে গজ গজ করছিলেন অহিভূষণ, " ব্যাটা খোট্টা, দরজা ভেঙে ফেলবে বোধহয়"।
ধড়াম করে দরজা খুলে রামশরণ কে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, " ব্যাটা ঠিকঠাক বলতে না পারিস তো নাম ধরে ডাকিস কেন? শুধু বাবু বলে ডাকতে পারিস না?"
"কাহে বাবু, ক্যা হুয়া?"
"আমার মুণ্ডু হুয়া, ব্যাটা অর্বাচীন""আমার নাম অহিভূষণ, ফের যদি দেখি ওরকম পাঁঠার মতো চিৎকার করে ওহী বাবু ওহী বাবু বলেছ, তাহলে তোমার একদিন কি আমার"।
"ক্যা হুয়া বাবু, ওহী তো বোলা, আপনার, নাম, ওহী’ বাবু" অবাক হয়ে বলে রামশরণ।
" ব্যাটা মস্করা হচ্ছে? বেরো বেরো বলছি"।
রামশরণ কিছু না বুঝে "সিয়ারাম, সিয়ারাম" করতে করতে বিদায় নিল।
ছোটো বেলায় অহিভূষণ এর ঠাম্মা বলতেন, " বাবা আমার সাত রাজার ধন এক মানিক," আর, মা কে বলতেন , "দ্যাখ ছোটবউ, ছেলেকে আগলে রাখিস, কারণ ওর সর্প দোষ আছে"। উফফ এই সর্পদোষ , মনে পড়লে আজও শিউরে উঠতে হয় তাঁকে।

আজ একে তো শনি বার, তার ওপর শেষ শীতের আকাশ বেশ পরিষ্কার, রোদ একটু কম ,তবে , মোবাইল টা আর একবার দেখলেন, হলুদ সূর্য্যের ওপর কালো মেঘ, যেটা থেকে আবার কি না বৃষ্টি ঝরছে। অর্থাৎ আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে বৃষ্টি, কিন্তু বাস্তবে তার কোনও চিহ্ন নেই।  ওই ছোকরা ক্যাশিয়ার দীপক টা আজ তাঁর নামটা অবশ্যই বদলাবে বোধহয়, উফফ এই সর্পদোষ! কিছুতেই পিছু ছাড়ে না, নানা ভাবে হেনস্থা করেই চলেছে, কিন্তু, একা বাড়িতে থেকেই বা লাভ কি? সেই তো নিজেকে হাত পুড়িয়ে রান্না করতে হবে, অহিভূষনের যে কাজে ভীষণ অনীহা, এর থেকে অফিসের ক্যান্টিন ভালো, আর তা ছাড়া দেখাই যাক না ‘গুগুল বাবার’ জোর কত।
তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে অফিসে চললেন ‘ওহী’ বাবু থুড়ি, অহিভূষণ বাবু, বেসরকারি ব্যাঙ্ক কর্মী, মধ্য চল্লিশের নির্বিরোধী নিপাট অহিভূষণ আচার্য্য।
ঘটনাটি খুলে বলা যাক,  ফেব্রুয়ারির শেষ হতে চলল অথচ এই যখন তখন মেঘের প্রকোপে শীতটা নাছোড়বান্দা অতিথির মতো কিছুতেই আর মুলুক ছেড়ে যেতে চাইছে না , সবাই বিরক্ত, এদিকে মধ্য চল্লিশের টেক স্যাভি ব্যাঙ্ক কর্মী অহিভূষণ আচার্য্য একেবারে যাকে বলে "নেট-আসক্ত", আর গুগুল বাবার দীক্ষা নেওয়া ভক্তও বটে, তাই , তিনদিন আগে যখন ঝকঝকে রোদ্দুর ভরা আকাশ নীল বরণ ধারণ ধরেছে, পাড়ার মোড়ের শিমুল গাছটি আড়মোড়া ভেঙে লজ্জায় লাল লাল ফুল ফোটাতে শুরু করেছে, আর, আকাশে বাতাসে, ফেসবুক টেসবুকে ‘বসন্ত এসে গেছে গেছে’ রব উঠেছে তখনই একদিন লাঞ্চ ব্রেকে অফিসের বড়বাবু অহিভূষণ আচার্য্য আর ক্যাশিয়ার দীপক দস্তিদার এক্কেবারে তর্ক বিতর্কে অফিস ক্যান্টিনের প্লাইউডের সৌখিন দেওয়াল আর জানালার কাঁচ গুলো প্রায় ভেঙ্গে ফেলেন আর কি। কারণ গুগুল বাবা বলেছেন যে আজ থেকে তিন দিনের মাথায় অঝোর বৃষ্টি অথবা শিলাবৃষ্টি,ফলে শীতের পুনরাগমন।
- "না, অসম্ভব, শীত চলে গেছে, আর আসতেই পারেনা, এইতো গেলো রবিবার, গিন্নির হুকুমে গায়ে দেবার মোটা লেপগুলো সব রোদ দেখিয়ে ডিভানের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখতে গিয়ে কোমরে ফিক ব্যথা ধরল, ভারী বলে ভারী! এক্কেবারে গন্ধমাদন", বলে কোমরে হাত বোলালেন দীপক বাবু," বলে কি না আবার বৃষ্টির পূর্বানুমান,ওই গুগুল বাবার মাথা খারাপ ,বুঝলেন 'অহি বাবু'", বলে তড়পালেন দীপক বাবু, বোধহয়  শীত ফিরে এলে গিন্নির তাড়নায়  পুনরায় ওই গন্ধমাদন আবার না মস্তকে ধারণ করতে সেই ভয়ে।
অহিভূষণ ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন,
কারণ দুটো,একে তো গুগুল বাবাকে যা তা বলা, আর দ্বিতীয় ওই 'অহি বাবু' নামে ডাক, কারণ ছোটবেলায় যেদিন থেকে তিনি জেনেছেন 'অহি' হচ্ছে বাংলা অভিধান মতে বিশেষ্য পদ  যার অর্থ হলো 'সর্প', আর সাপের  মালা পরেন যিনি তিনি হলেন ‘অহিভূষণ’ অর্থাৎ মহাদেব শিব , কিন্তু লোকজনের নাম ছোট করে বলার অভ্যাসের কারনে ‘শিবের’ ‘সাপ’ হতে দেরী হয়না, আর,  এই নাম শুনলেই অহি বাবুর পিত্তি জ্বলে যায়। তার মতে ঠাকুমা বর্ণিত সর্প দোষের থেকে কিছু কম নয় এই নামের বিকৃতি। কিন্তু আসল  রাগের  কারণ তার ওই সর্প দোষ নয়বরং এক  দোষী সর্প...তাই সাপকে যতটা না ভয় তার চেয়ে বেশী সাপের ওপর রাগকারন?  দেখা যাক...
" দ্যাখো দীপক, তুমি আমার ভাই এর মত, তাই বলে আমার নাম নিয়ে যা তা বলার অধিকার তোমায় কে দিয়েছে?" রাগে থমথমে মুখে কথা কটা অহিবাবু বললেন।
" যা তা? কেন? আপনার নাম অহিভূষণ আচার্য্য নয়?"  অবাক হয়ে বলে দীপক।
"হ্যাঁ, অহিভূষণ, অর্থাৎ 'অহি' বা সর্প যাঁর ভূষণ, অর্থাৎ 'শিব', আর, তুমি আমায় 'শিব' না বলে 'সাপ' বলছ"।
একথা শুনে  দীপক বেশ মজা পায়। বলে, "আচ্ছা ঠিক আছে, আমি আপনাকে সাপ না বলে শিবই বলব, তবে, একটা শর্ত আছে"।
"হুম", অহিবাবুর ছোট্ট প্রতিক্রিয়া।
" শর্ত হলো যে পরশু শনিবার বৃষ্টি হলে আপনি শিব, নতুবা সর্প," দীপক বিশদ হয়।
এই বারে একটু চিন্তায় পড়লেন অহি বাবু, তবে, যা থাকে কপালে, বলে টেবিল ঠুকে পাকা জুয়াড়ির ভঙ্গিতে বলে উঠলেন-
" ঠিক হ্যায়, মঞ্জুর।"
তোআজ আকাশের মেঘ দেখে গুনগুনিয়ে গান বেরিয়ে এলো,
"আকাশে মেঘ করেছে,
ঝরঝরিয়ে হবে বরিষণ,
রাস্তায় কাদা হবে জল জমবে,
পাগলা হবে মন"...

 এর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হলো ঝমাঝম বৃষ্টি।
একটুপরেই দীপক এসে যোগ দেয় টেবিলেহেসে বলে,"হুমমদাদাআপনি তো দেখছি জিতেই গেলেনআপনার সর্প দোষ কাটল দেখছিআজ থেকে আপনি অহিবাবু নন, অহিভূষণ,সাপ নন শিব। তবে,যদি কিছু মনে না করেন,আপনার এই অহি শুনলে রেগে যাবার কারণ টা কি জানা যায়?আজ অহিভূষণ খুশ মেজাজে ছিলেনবললেন," বলতে পারিতবেএকটা শর্তেএই কথা কাউকেবিশেষতঃ তোমার বউদি কে বলা চলবে না"।
"
ও কেডান, " বলল দীপক।

ইতিমধ্যে বাইরে শুরু হয়েছে অঝোর বৃষ্টি...

উনি যেটা বলেছেন সেটা শোনাই আজ
নাম নিয়ে অহিভূষণ কেন এইরকম সংবেদনশীল, সেটা জানতে হলে জানতে হবে অহিভূষণ এর সর্পদোষ এর ব্যাপারে, পেছতে হবে প্রায় সাড়ে তিন দশক, অহিভূষণ তখন 'অহিভূষণ আচার্য্য' বা 'অহিভূষণ বাবু' হয়ে উঠেন নি...
তখন তিনি শুধুমাত্র 'পিকলু',বাবা,মা,ভাই,বোন,ঠাম্মা,দাদু,জ্যাঠা,কাকা ইত্যাদি বাংলা অভিধানে যত সম্পর্ক হয় সব রকমের সম্পর্কের মিলনস্থল, যাকে সাধু বাংলায় যৌথ পরিবার বলে, সেই পরিবারের তখনও পর্যন্ত্য সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য; 'পিকলু' সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে থাকা, আর ভাই বোনদের সাথে মিলে ঠাম্মা-দাদুর প্রশ্রয়ে ও আশ্রয়ে নানাবিধ পুন্য কর্ম- যথা, 'হরি মুদির বাগানের গাছের ফল চুরি', 'রানী গোয়ালীনির  গবাদি পশুদের দড়ি খুলে তাদের মুক্তির আস্বাদ দেওয়া', 'ছোট্ট ছেলে মেয়েদের হাতের মোয়া ছিনিয়ে দৌড়োনো' বা  'ক্ষেতের মটর শুঁটি দিয়ে পিকনিক করতে না দেওয়া প্রতিবেশীর টিনের চালায় রাতের অন্ধকারে পাথর ফেলে ভূতের ভয় দেখানো' ইত্যাদি কর্মকান্ড নিয়েই ব্যস্ত থাকেনস্কুলে নাম লেখানো আছেব্যসওই পর্যন্তইএত বড় রাজকার্য্য সামলে স্কুলে বিশেষ একটা যাওয়া হয়ে ওঠেনা। বয়স আর শারীরিক উচ্চতায় কম হলেও দাপটে আর দুষ্টুমি তে পিকলুর স্থান অনেক ওপরেতার কারণ ঠাম্মা। আসলে বিয়ের অনেকদিন পরেও পিকলুর বাবা মায়ের সন্তানাদি হচ্ছিল নাঅনেক পুজো -আচ্চা - মানত - কিরে করার পর  কোনও এক পুন্য লগ্নে পিকলুর মায়ের কোল আলো করে আবির্ভুত হলেন শ্রীমান পিকলু,এক্কেবারে ক্ষীণ শরীরেরছোট্ট ইঁদুরের মত, এরপর যথারীতি নামকরণ ইত্যাদির পালা এলোসেইসময় পন্ডিত মশায় গণনা টননা করেক্ষীণ দেহী অহিভূষণ এর বিষয়ে বললেন "এ ছেলে ক্ষণজন্মাভবিষ্যতে অনেক টাকার মধ্যে থাকবে",তা আছেনকারণ অহিভূষণ ব্যাঙ্কের যে শাখায় কাজ করেনসেটা মুখ্য শাখা হবার কারণে অনেক নগদ জমা থাকে স্ট্রং রুমেআরসেই স্ট্রং রুমের দায়িত্ব ওনার হাতেইফলেপন্ডিত মশাইয়ের কথা একেবারে ফেলে দেওয়া যায়নাটাকার মধ্যে আছেন তিনিএকপ্রকার টাকায় ডুবে আছেন। তো এতো গেল ভালো কথাকিন্তু পন্ডিত মশাইয়ের এর পরের কথাই হলো মোক্ষমযার কারণে পিকলুর এত প্রতিপত্তি। চশমাটা নাকের ডগা থেকে ঠেলে তুলে পন্ডিত মশাই বললেনশুনুন মা ঠাকুরণএই ছেলের কিন্তু 'সর্প দোষআছেসে কথা শোনামাত্র পিকলুর ঠাম্মা সৌদামিনী দেবীর আর্তনাদে বৃদ্ধ পন্ডিতমশায়ের খাগের কলমের জন্য রাখা কালিভর্তি মাটির দোয়াতখানি উল্টে পড়ে গণনার কাগজের ওপরতারপর সব ঘেঁটে ঘযাকগেপন্ডিতমশাই অনেক ভেবেচিন্তে উপায় বের করলেনবললেন, "সর্প অর্থাৎ অহিআর এই অহি কে বশ করে গলায় ধারণ করেন শিবশঙ্করতাইতাকে বলা হয় অহিভূষণতাইআজ থেকে এই ছেলের নাম হোক অহিভূষণঅহিভূষণ আচার্য্য‘অহি’র সাথে ‘ভূষণ’ থাকলে বোধহয় সর্পদোষ কাটবে।" তাএই সর্পদোষ এর কল্যানে আর ঠাম্মার বরাভয়ে জন্য পিকলু মাত্র আট বছর বয়সেই মহা পরাক্রমশালী হয়ে ওঠে,কারণ ভাইবোনপাড়া প্রতিবেশী যে কেউই কোনও অভিযোগ নিয়ে আসুক না কেনপিকলুর ঠাম্মা আগলে দাঁড়ানবুঝিয়ে বা বকে ধমকে ফেরৎ পাঠানবলেন,  "তোরা না ওর নিজের ভাইবোন,বন্ধুপ্রতিবেশী,ওই একটা ছোট্ট ছেলে,ওকে নিয়ে নালিশ করিস!" এতে যদি মামলা মিটে যায় তো ভালোনা হলে ঠাম্মার ব্রহ্মাস্ত্রআঁচলের কোন দিয়ে চোখের কোনা মুছে বলেন, "বাছার আমার এমনিতেই সর্প দোষ,আরতার ওপরতোরা..."।
এইভাবেই সর্পদোষ এর কল্যানে অহিভূষণ এর দোর্দন্ড প্রতাপ রাজত্ব চলছিল।  বয়স,আকার বা পদমর্যাদায় ছোট যারা তারা অহিভূষণ এর দাসত্ব স্বীকার করে নিয়ে ছিল নির্দ্বিধায়যারা বয়স বা আকারে বড়তাদের কে ঠাম্মার বকুনির ভয় দেখিয়ে দাসত্ব করতে বাধ্য করেছিলেন অহিভূষণ।
কিন্তু যে কোনোও মহান সম্রাটেরও শত্রুর অভাব থাকেনা,আর,শত্রু সুযোগ ছাড়ে না সেইরকম কিছুই ঘটতে চলেছিল অহিভূষণের জীবনেও।
পিকলুদের বিশাল যৌথ পরিবারের উপযুক্ত বিরাট বাড়ি,নিজস্ব পুকুর বাগান ইত্যাদি মিলিয়ে প্রায় পাড়ার অর্ধেকটা জুড়ে রয়েছেবাড়ির সামনেই একটি প্রায় মিনি দীঘির আকারের জলাশয়ে প্রচুর মাছ ছেড়েছেন পিকলুর দাদুমাঝে মাঝে জেলে ডেকে উনি মাছ ধরান,আরএই মাছটা ছোটএটার স্বাদ ভালো হবেনাইত্যাদি বাহানায় প্রায় নব্বই শতাংশ মাছ আবার পকুরেই ছেড়ে দেনআর বাড়ির কাজের লোক কে আদেশ দেন বাজার থেকে হেঁসেলের জন্য মাছ আনতে। ফলতঃ,মাছ গুলি ইয়া ইয়া সাইজের হয়ে উঠছিল,আর এভাবেই দাদুর প্রশয় পেয়ে জলে মাছ আর ঠাম্মার প্রশয় পেয়ে ডাঙায় পিকলু দিন দিন বেড়ে উঠছিল, আর পিকলুর মতই মানুষজনের প্রতি মাছদেরও সমীহ একেবারেই চলে গিয়েছিল ফলে,পুকুরে বাড়ির লোকজন নামলেই ওরা প্রায় হাতের কাছে চলে আসতে শুরু করেছিল।
পুকুরটিতে পিকলুদের বাড়ির দিকে একটি বাঁধানো ঘাট ছাড়া বেশীর ভাগটাই বড় বড় কচুগাছের জঙ্গলে ঘেরা পাড়চটচটে এঁটেল মাটির তৈরি। সাপ খোপের রাজত্ব,ফলে পুকুরের একমাত্র বাঁধানো ঘাট ছাড়া অন্য কোনো ঘাট পারতপক্ষে ব্যবহার করা হয়না,তবে,নিন্দুকেরা বলে যে পাড়ার কিছু লোক পিকলুর দাদুর চোখের আড়ালে ছোট ছোট হাত জাল ওই জঙ্গলের পাঁকে ফেলে আসেফলে আর কিছু না হোক কিছু মাগুর,প্যাঁকাল বা ভাগ্যে থাকলে কিছু দুঃসাহসী রুই কাতলাও ধরা পড়েএছাড়াও বাবা,কাকা ও কলেজ পড়ুয়া দাদারা ওদিকে যায় লুকিয়ে ধূমপান করতে,সে করুক গিয়ে,ওসব এখন পিকলুর সিলেবাসের বাইরে। পিকলুর রোজকার কাজ ছিল সারা সকাল রাজকার্য্য সেরে সেনাবাহিনী নিয়ে পুকুরের ঘাট থেকে ঝাঁপিয়ে জলে পড়া ও বেশ ঘন্টাখানেক ধরে জলে দাপানোযতক্ষণ না ঠাম্মার ডাক পড়ে মধ্যাহ্নভোজনের জন্য।
তোসেবার ফেব্রুয়ারির প্রায় শেষের দিকে সরস্বতী পুজো ছিল,পিকলুর মেজ জ্যেঠুর ছেলে পল্টু হাই স্কুলের  পড়া শেষ করে শহরের কলেজে ভর্তি হবার জন্য এন্ট্রান্স দেবে,পল্টু পড়াশোনায় ভালোই,আর তার সাথে বেশ রাশ ভারী ও সাথে ওজনেও ভারীপিকলুর জন্মের আগে সে ই ছিল পরিবারে সবার ছোটো এবং বলাই বাহুল্য আদরেরপিকলু আর তার সর্পদোষের ফেরে পড়ে পল্টুকে এখন পিকলুর অধীনস্থ হতে হয়েছেঠাম্মার ও বড়দের প্রশ্রয় তো আছেই,এছাড়াও রয়েছে পিকলুর প্রবল প্রতাপ ও ভাইবোনের কুখ্যাত দলবল। তাই পল্টু কে দমে থাকতে হয়পিকলু বোঝে সে কথা, আর  পলটুকে জব্দ করার ফিকির খুঁজতে থাকে। তাই সেদিন,কলেজে যাবার জন্য যখন পল্টুর জন্য একটি বড় প্যান্টুলুন সেলাই করে বাড়ির দর্জি মোবারক মিঞা ডেলিভারি দিতে এলতখনই পিকলুর সেই প্যান্টুলুনের দরকার পড়ল,এখন আর তাকে কে বোঝায়মোবারক যতই বলে " ছোট বাবু তোমার জন্য এই পোশাক যথেষ্ঠ বড়তোমাকে ছোট মাপের প্যান্টুলুন সেলাই করে দেব'খন । আর যায় কোথায়প্রবল প্রতাপের অধিকারী রাজাধিরাজ অহিভূষণ এর চেহারা নিয়ে কটাক্ষ! প্রবল জেদ ধরলেন মহারাজএই প্যান্টুলুনই তার চাই, সুতরাং,  পিকলুর চিল চিৎকার,মঞ্চে ঠাম্মার প্রবেশআর ব্যস গল্প শেষ।
বহু কষ্টে দড়ি দড়া দিয়ে বুকটা টা ম্যানেজ হলোকারণ কোমরের সাধ্য হলোনা  প্যান্টটি ম্যানেজ করেফলে, প্যান্টটি বুক অব্দি তোলা হলো,পা গুলো গুটিয়ে মুড়ে দেওয়া হলোকিন্তু পায়ের চারপাশ গুলি বেশ ফুলে থাকলোব্যাপারটা দেখতে হলো অনেকটা যেন দুটো গোদা পায়ের উপর বিষফোঁড়ার মতো অহিভূষণের আবক্ষ মুন্ডু।
যাকগেএই পোষাক পরে দলবল নিয়ে অহিভূষণ চললেন রাজ্য জয়ে।
প্রথম লক্ষ্য হরিমুদির সব্জি বাগানকয়েকদিন আগে প্রজাগণ কে সাথে নিয়ে অহিভূষণ ঢুকেছিল হরিমুদির বাগানেইচ্ছে ছিল টম্যাটো,কড়াইশুঁটি,গাজর,মর্তমান কলা ইত্যাদি দিয়ে জলযোগ করারকিন্তু সেদিন হরি বাড়িতেই ছিলবাগানে শব্দ পেয়ে গিয়ে হাতেনাতে সৈন্যসমেত রাজাকে গ্রেফতার করে,আর, সৌদামিনী দেবীর এজলাসে কিচ্ছুটি হবার নয় জেনে হরিমুদি সমস্ত সৈন্যদের সামনে মহারাজ কে কান ধরে ওঠবস করায়অহিভূষণ ভীষণ অপমানিত হন। কিন্তু পল্টুটা জানতে পারলে হ্যা হ্যা করে হাসবেতাই সব চেপে যানঅনেক দিনের মন্ত্রণা করার পর ছোটদা ‘মহামন্ত্রী বিল্টু’ পাক্কা খবর নিয়ে এসেছে,আজ সুবর্ন সুযোগ,আজ হরিমুদির আর পল্টুর দুজনের প্রতিশোধ এক সাথে নেওয়া যাবে। সেই মত প্যান্টুলুন পর্ব শেষ করে পল্টুটাকে হারিয়ে বিজয়ী অহিভূষণ চললেন হরিমুদি নিধনেহরিমুদির বাড়িটা পিকলুদের পুকুরটির ওপারেই প্রায়বেড়া দিয়ে ঘেরা কয়েক বিঘে জমিজমির মধ্যেই বাড়ি আর ফল শাক সব্জীর বাগানহরি খুব যত্নে রাখে এই বাগানটিবাগানের বেড়ার বাইরে অনেকটা খোলা চাষের জমিছাওয়া বলতে একখানি প্রাচীন আমগাছগাছময়  মোটা মোটা পিঁপড়ে,অনেক দূরে সরু রেখার মতো রেল লাইনশীতের ফসল সব কাটা হয়ে গেছেতাই এখন জমি গবাদি পশুর চারণভূমিদেখা গেল বিল্টুর খবর একদম ঠিকশীতের রোদ্দুর ভরা ধূ ধূ মাঠে শুধুমাত্র রানী গোয়ালীনির হৃষ্টপুষ্ট গভীদ্বয় কালী-করালী চোখ বুজে জাবর কাটছে,  এ তল্লাটে রানী গোয়ালীনির ঝগড়ার ও কালী - করালীর শিংয়ের গুঁতোর সুনাম আছে,এখন এদুটি কে হরিমুদির বাগানের রাস্তাটা চেনাতে হবে, ব্যস,তা হলেই হবেএবারে গরুর কান ধরে,বিশেষতঃ রানী গোয়ালীনির গরুর কান ধরে ওঠবস করে দেখাও তো  বাছাধন।

প্ল্যান মতো অহিভূষণএর হুকুমে বিল্টুকেই উঠতে হলো আমগাছেপিঁপড়ের কামড় খেয়ে কোনও ক্রমে পাতা সমেত একটি মোটা ডাল হস্তগত করেছেঁচড়ে ছেঁচড়ে গাছ থেকে নামল বিল্টুএরপর কালী-করালীর গলায় বাঁধা দড়ির অন্য প্রান্তের খোঁটা টি খুলে পাতার লোভ দেখিয়ে দেখিয়ে কালী- করালীকে হরিমুদির বাগানে গ্যারাজ করে দিয়ে অহিভূষণ সদল বলে বাগানের বেড়ার বাইরে ঘাপটি মেরে বসে ছিলেনকালীটা হ্যাংলার মতো আম পাতা খাচ্ছিল হামলে পড়েকিন্তু হঠাৎ করেই বেড়ার ওপারে খচমচ খচমচ শব্দ আর পর মুহূর্তে ই বাগানের বেড়া ভেঙে কালী উর্ধস্বাসে দৌড়ে বেরোলোগলায় বাঁধা লম্বা দড়িআর তার প্রান্তে বাঁধা খোঁটা,সেই খোঁটায় করালীর পা জড়িয়ে করালী রাঙচিতের বেড়া শুদ্ধু সসৈন্য অহিভূষণ এর ওপর পপাত চ, অহিভূষণ এর সৈন্য দল ‘করালী’ চাপা পড়ে গোঙাচ্ছে, অহিভূষণ এই বিপদের মাঝে সৈন্যদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে চাইলেও বস্তবে দেখা গেল যে মাটিতে চিৎ হয়ে আছেন, আর ডান পা টা কোনও অমোঘ টানে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেআর বাধ্য হয়েই গোটা শরীর টাযেটা কিনা ইতি মধ্যেই পল্টুর ঢোলা প্যান্টের মধ্যে প্রায় ঢাকা পড়েছে এগিয়ে যাচ্ছে, -আসলে কালীর কানের মধ্যে আম গাছের বাঘা পিঁপড়েকালীর গলার লম্বা দড়ি,আর অহিভূষণ এর ঢোলা প্যান্টএই ত্রহ্যস্পর্শের কল্যানে অহিভূষণ কলীর গলায় বাঁধা পড়েছেনএ অটুট বন্ধন কিভাবে আলগা হবেভাবতে ভাবতেই কালী অহিভূষণ কে সাথে নিয়ে হরিমুদির চৌহদ্দি ও কাঁকর ভর্তি রাস্তা পেরিয়ে পুকুরের বাঁধানো পাড়ের উল্টো দিকে কচু বনের জঙ্গলে সেঁধিয়ে গেলআর তার পরেই দুর্গন্ধময় পাঁকের পাড় পেরিয়ে সিধে গিয়ে পুকুরের জলে গিয়ে পড়লকিন্তু সেখানেও শান্তি নেইবোঝা গেল সে একটি চোরা জালের মধ্যে পড়েছে আর সেই জালে ইতিমধ্যে কিছু পাঁকের প্রাণী স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ধরা পড়েছেঅহিভূষণ তাঁর তাবৎ গর্বপ্রতিপত্তি নিয়ে দড়ি বাঁধা অবস্থায় বুক অব্দি পাঁকে এই জালের বাসিন্দা দের সাথে পড়ে থাকলেন।
ইতিমধ্যে বল্টু গিয়ে বাড়ীতে খবর দিয়েছেযতটা সম্ভব রাজকীয় গোপনতা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে বলেছেবিশেষতঃ হরিমুদি আর তার বাগান সংক্রান্ত চক্রান্ত একেবারে বাদ। যাই হোকসবাই মিলে জাল,মাছ,কালী সহ অহিভূষণ কে উদ্ধার করল।
এই ঘটনায় দুজনের সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছেপ্রথমতঃ পল্টুর নতুন প্যান্ট আর অহিভূষনের প্রতিপত্তির ফানুস দুটোই ফেঁসে ফর্দা ফাঁই।

এক বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে অহিভূষণকে হাজির করা হলোঠাম্মা কেঁদে ভাসালেনপল্টু দৌড়ে এল প্যান্টের খবর নিতেপাঁকে ভিজে অদ্ভূত আকার ধারণ করেছে প্যান্টটিবিশেষতঃ দুটি পা , কোল বালিশের আকার নিয়েছেকিন্তু,পল্টুর নজর গেল প্যান্টের কোমরঅর্থাৎ কিনা যেটা দড়ি সহযোগে অহিভূষণ এর প্রায় বুক উচ্চতায় বাঁধা হয়েছিলদড়ি ঠিকঠাকই আছেকিন্তু বোধহয় ‘প্রাণ’ পেয়েছেতাই তার ডগাটা লিক লিক করছেইতিমধ্যে ঠাম্মা এগিয়ে গিয়ে তাঁর সাধের পিকলুকে জড়িয়ে ধরতেই যাচ্ছিলেনহঠাৎ তখনই পল্টু চিৎকার করে উঠল, " ঠাম্মাসাপ সাপপিকলুর প্যান্টে সাপ"বাকি ঘটনা চোখের নিমেষে ঘটে গেল,সর্পদোষ এর ভয়ে আক্রান্ত সৌদামিনী দেবী এক ঝটকায় প্যান্টের দড়ি খুলে দিলেন, আর পিকলুর ডবল সাইজের প্যান্ট সড়াৎ করে  দোর্দন্ডপ্রতাপ অহিভূষণ আচার্য্যর  সমস্ত মান সম্মান সমেত নিচে নেমে গেলোএকটি জল ঢোঁড়া মুক্তি পেয়ে মাটিতে পড়ল ,আর, অহিভূষণ আচার্য্য  হাইজাম্পের বিশ্বরেকর্ড ভেঙ্গে বিল্টুর কাঁধে চেপে বসলেন, চারিদিকে হাসির হুল্লোড় এর মাঝে নগ্ন দোর্দন্ডপ্রতাপ অহিভূষণ আচার্য্য তাঁর সমস্ত মান সম্মান ধুলায় মিটে যেতে দেখলেন।
আর কিচ্ছু বলার মুখ নেই... এক বাড়ী লোকের ও নিজ সৈন্যদলের সামনে অহিভূষণের মাথা কাটা গেলো। বজ্জাত পল্টুটা সবাই কে বোঝাল যে অহিভূষণের প্যান্টে ‘অহি’  ঢুকে ছিল, আর, বীরপুঙ্গব অহিভূষণ ‘ঢোঁড়া’ কে ‘বোড়া’ ভেবে মহামন্ত্রী  বিল্টুর মাথায় চেপে বসে ছিল। এর পর ধীরে ধীরে  অহিভূষণ এর প্রতিপত্তি কমতে শুরু করে , আর, কেও যদি ভুল করেও কে "অহি" বলে ডাকতো তো উনি তাকে মারতে দৌড়তেন।
"
আর আজও কেউ ওই নামে ডাকলেই সেই তিক্ত স্মৃতি মনে ভেসে ওঠে তাই আর কি" সলজ্জে বললেন অহিভূষণ।
"ওহ এই ব্যাপার! "বলল দীপক, "যাক, আজ আপনার সর্পদোষ সত্যিই কাটল"।
একথায় দুজনেই একসাথে  হো হো করে হেসে উঠলেন।।



| Aleekpatamagazine.blogspot.in |
  |ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Special Lock-down Issue,2020 | April 2020 |হাসিরাশি সংখ্যা।
।নববর্ষ ১৪২৭| Third Year Fifth Issue |22nd Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |


 সূচি পত্র / Index
















বড়গল্প-‘মন’ এর কথা - দেবশ্রী চক্রবর্তী



মন’ এর কথা
দেবশ্রী চক্রবর্তী
অলঙ্করণ ঃ মিঠুন দাস

(এই ঘটনার স্থান, কাল, পাত্র সবই অতিমাত্রায় বাস্তব)

সকাল থেকেই বাড়িতে সে এক হুলুস্থুল কান্ডহবে নাই বা কেন?
আজ যে মনের এক্সামআজ শর্ট হ্যান্ডের প্র্যাক্টিক্যালসকাল সকাল মাতু  রান্না বান্না করছেভাতআলুসেদ্ধঘী কিছুই বাকি নেই। কিন্তু মনের গলা দিয়ে যে কিছুই নামে নাতার ওপর ছোটমামার মেদিনীপুরের  ট্রেনের টাইম হয়ে যাচ্ছেসে বিদ্যাসাগার ইউনিভার্সিটির ইকনমিক্স এর ছাত্রমাতু একবার তাকে খাওয়ায় একবার মন কেমন ভাতটা মুখে নিয়ে একবার পুরো বাড়ী ঘুরে আসে মুখের ভাত টুকু শেষ করতেকে বলবে যে সে কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রীবলাই হয়নিমাতু হোল মনের দিদাজন্ম থেকে বেশির ভাগই  মন তার দিদার কাছেই থেকেছেমায়ের বয়স কম হওয়ায় তার পক্ষে তিন তিনটে বাচ্চা সামলানো দুস্কর ছিল। আগে দিদাকে মন মা বলেই জানতপরে আশপাশের প্রতিবেশিনী দিদাদের কথায় প্রথমে অসুবিধে হলেও পরে দিদাকে মা এর বদলে মাতু বলতে শুরু করে।  ছোটমামা মনের থেকে পাঁচ ছয় বছরের বড়বয়সের বেশী ফারাক না থাকায় দুজনে ভাই বোনের মতো খুনসুটিঝগড়ামারামারি করেই বড় হয়েছেমনের আর এক মামা আছে সেঅতিশয় গম্ভীরস্বল্পভাষীএকটুতে রেগে যায়কাজেই বাড়ির সবাই তাকে একটু ভয়ই পায়। মাসীদের বিয়ে হয়ে গেছেযে যার সংসার নিয়ে ব্যস্তরিটায়ার্ড রেলওয়ে কর্মচারী অবসর কাটান পাড়ার দাদুদের সাথে তাস খেলে বা টিভি দেখেকখনও বা রিক্সা দাদুর রিক্সা চড়ে মাতুর সেজ ভাইমানে সেজ দাদুর বাড়িতে গিয়ে সময় কাটান।
ফিরি আবার সেই দিনেতোআজ মনের এক্সামএদিকে আকাশে মেঘের ঘনঘটাবৃষ্টিও শুরু হয়েছে, কাজেইছাতাটা নিয়েই বেরোতে হবেবড়দের প্রণাম করে মন কলেজের উদ্দেশ্যে  বেরিয়ে পড়লএমনি তে সে ছোটমামার সাথে বন্ধুর মতই মেশেকিন্তু এই পরীক্ষার সময় ছোটমামাও তার চরণ দুখানি মেলে ধরেনমন ভক্তি ভরে প্রণাম করেবাবা! পরীক্ষার ভয় কি যে সে ভয়সবারই আশীর্বাদই চাইযাকএটা নিয়ে পরে ভাবা যাবেযাক। এক হাতে ছাতা আর অন্য হাতে সাইকেল নিয়ে মন কলেজে পৌঁছল, পরীক্ষাও হল ভালো ভাবেএবারবাড়ী ফেরার পালাকিন্তু বৃষ্টি আর থামেই নাসেই এক হাতে সাইকেলঅন্য হাতে ছাতাপিচরাস্তা তে তেমন একটা অসুবিধে হলনাতবেবাদ সাধল কাঁচা রাস্তা টুকুরাস্তার এক দিকে পুকুরঅন্য দিকে সুন্দর ধানের ক্ষেতকয়েকটা সাদা বক এক পায়ে দাঁড়িয়ে বেদম ভিজছেযেন অঝোর ধারায় ধ্যানে বসেছেতবেধ্যান ভগবানের, না মাছেরতা ঈশ্বরই জানেন। ওদিকে পুকুরে ছাতা মাথায় দু একজন মাছ ধরছে-রাস্তাটা কাদায় জ্যাব জ্যাব করছেকোথাও উঁচুকোথাও বা নিচুকিছু দূরে কতগুলি ছোট বাচ্চা অই জল কাদাতেই খেলা করছেএকবার মন ভাবল – হেঁটেই যায়কিন্তু হেঁটে গেলে সম্মান যায়তাই সাইকেল চালানোই ভালোযেমন ভাবাতেমনি কাজকিন্তু আজসাইকেলটা কেমন যেন দুলে দুলে চলছেখেয়েছে! সামনে একটা গর্তওদিকে কেমন যেন একটা হাওয়া মন কে ধাক্কা দিয়ে গেল। ছাতার সাথে মন উড়েই যাচ্ছিল প্রায়কোনোক্রমে নিজেকে মন সামলে নিতে চেষ্টা করেও হার মানলসাইকেল একদিকেমন একদিকেমন ছাতা হাতে বসে পড়ল মাটিতেলজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে গেছেকোনরকমে উঠে দাঁড়াতেই বাচ্চা গুলো খিল খিল করে হেসে উঠলএক ধমক দিয়ে বাচ্চা গুলোকে মন বলল, “ পরে হাসবিআগে ছাতাটা ধর”। সাইকেল টা তুলে পুকুরের দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিশ্চিন্ত হওয়া গেলনাঃ ওরা মাছ ধরছেকেউ কিছু দেখেনি। বাড়িতে আসা মাত্রই মাতুর উদ্বেগ, “ কি রে!জামার এই অবস্থাছোট লাগেনি তো?”
মন বলল,  “ নানাবৃষ্টির জন্য কাদা জলের একটু ছিটে লেগেছে”।
মনে হল, মাতু বিশ্বাস করে নি। রাত্রে বড়মামা বাড়ি ফিরে এসেছে বুঝতে পেরে টিভি ছেড়ে দৌড়ে পড়তে বসে যায় মুন। মামা পাশ দিয়ে যাবার সময় বলে গেল, “ কিরে!তুই নাকি আজ পড়ে গিয়ে ছিলি?” মাতু বলল, “ ওই দ্যাখআমিঠিকই বুঝে ছিলামতা তুই কি ভাবে জানলি?”
মামা বলল, “অর্ক মাছ ধরছিলও দেখেছে”।
মনের অর্ক মামার ওপর ভীষণ রাগ হলআররাগ হল হঠাৎ আসা ওই ঝড়টার ওপরেরও।

তাএমনি করেই দিন কাটছিল মুনেরএক্সামও শেষ হলক্রমশঃ রেজাল্টের দিন এগিয়ে আসছিলএখন আর এক কান্ডমনের মেডিটেশন আর পুজোর সময় ক্রমেই বাড়তে লাগলবাড়িতে আর কারও বুঝতে বাকি নেই কেন মুনের এই পুজো পাঠের ধুম বাড়ল। সেদিনমন খুব মন দিয়ে পুজো করছিল, পুজো হবার পর ঠাকুরের দিকে পেছন করে চলতে নেই বলে সে ঠাকুরের দিকে তাকাতে তাকাতে পেছনে হাঁটতে লাগলবেশ কিছুটা যাবার পর মুন কিছুর সাথে ধাক্কা খেলআর ওমনি এক বিকট গোঙ্গানির শব্দ পেলোসঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে পেছন ফিরে দেখে কি ছোটমামা দুই হাত মাথার উপরে করে নমস্কারের মুদ্রায় এক পা তুলে নিজেকে ব্যলেন্স করার এক ব্যর্থ প্রচেষ্টায় টল টল করছেআর সেই সাথে মুখে এক যন্ত্রণার ছাপহবে নাই বা কেনমন যে তার মাটির ওপর একমাত্র পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে পড়েছিলমামার এইরূপ দুর্গতি দেখার পর মন প্রচণ্ড হাসি চেপে তড়িঘড়ি মাতুর পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাসিতে ফেটে পড়ল, মাতু জিজ্ঞাসা করল, “ কি হয়েছে রেএত হাসছিস কেন?” সমস্ত কথা বলতে বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসা দাদুভাইএর অট্টহাস্য শোনা গেল।
মাতুও হাসি চাপতে পারল নামামা ঠাকুর ঘর থেকে বেরিয়ে মাতুকে বেজায় রেগে বলল, “ মামন কে বোঝাও যে ও এখনও বড় হল না আমার পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে পড়েছিল, তোমরা হাসছওর পেছন ফিরে  হাঁটার কি ছিল?” বলে রেগেমেগে ক্লাবে চলে গেল।
সেদিন বিকেলে ছোটমামা মনকে বলল, “ শোন, আজ ক্লাবে আমাদের একটা পিকনিক আছে, আসতে দেরী হবে, মা কে ম্যানেজ করেছি, কিন্তু রাত্রে মা ঘুমিয়ে পড়বে, তুই জেগে থাকিস বুঝলি? দরজায় টোকা দিলেই দরজা টা খুলে দিস”।
মন বলল, “ ঠিক আছে”, ঘাড় নাড়ল ঠিক যেন রামভক্ত হনুমান।
রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর যথা সময়ে সবাই শুয়ে পড়ল, বড়মামা দোতলায় নিজের ঘরে শুতে চলে গেল, দাদুভাই তাঁর নিজের ঘরে, মন আর মাতু  একসাথে তাদের নিজের ঘরে।
মনের প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছিল, কিন্তু তাহলে তো মামার রাতে বাড়ি ফিরে ঢুকতে অসুবিধে হবে, দাদুভাই আর বড়মামা জেগে যাবে, সুতরাং ঘুমোলে চলবে না, এদিকে, সারাদিন সংসার সামলে মাতু বেজায় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, নাক ডাকছে, ঠিক যেন শান্টিং ইঞ্জিন, ছুক্‌...ছুক্‌...ছু...উ...ক, এই লয়ে মাতুর ট্রেন যে কতগুলো স্টেশন পেরিয়ে গেল কে জানে? কিন্তু, ছোটমামার এখনো আসার সময় হল’ না, মনের এইসব ভাবনার মাঝেই হঠাৎ গাড়ীর ঘরের দরজা তে খুট খুট শব্দ হল, মেইন গেট লক করা আছে, সুতরাং, মামা নিশ্চয়ই গাড়ীর ঘরের দিক দিয়েই এসেছে, মুন ধীর পায়ে  অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে কোনোক্রমে গাড়ী ঘরের দিকটায় পৌঁছল, একটু সময় লাগল কিন্তু আলো জ্বালালে যে সবাই উঠে পড়বে, যাই হোক দরজাটা মন আস্তে আস্তে খুলল, বাইরে তাকাতেই একরাশ ফুটফুটে চাঁদের আলোতে গাছগুলো কে কেমন সুন্দর, মায়াবী লাগল, পাতা গুলো আলতো আলতো দুলছে, চারিদিক নিঃস্তব্ধ, গাছের পাতায় কেউ যেন রূপো ঢেলে দিয়েছে, জ্যোৎস্নাতে সেগুলো চকচক করছে, খুব সুন্দর একটা মিষ্টি হাওয়া বইছে। কিন্তু একি! মামা তো আসেনি! কতক্ষণ এমনি ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল খেয়াল নেই, সম্বিৎ ফিরতেই ভয় পেয়ে হাতের চেটো ঘামে ভিজে গেছে বোঝা গেল, “তবে কি নিশিতে ডাকল? অদ্যই কি  তবে শেষ রজনী? এবাই কি হবে? মাতুকেই বা কি ভাবে ডাকবে?” মনে হচ্ছে কেউ যেন গলাটা চেপে ধরেছে, গলা থেকে কোনও আওয়াজ বের হচ্ছে না, প্রচণ্ড চীৎকার করতে ইচ্ছে হচ্ছে, এমন সময় অন্ধকার ফুঁড়ে কে যেন সামনে এসে দাঁড়াল, আর যায় কোথায়? যে আওয়াজ টা এতক্ষণ আটকে ছিল, সেটা বেরিয়ে এল। মন নিজেও বুঝল না যে এত জোরে সে কি বলল, বিশাল এক থাবায় তার মুখ কে যেন বন্ধ করে দিল, বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে দেখল যে তার ছোটমামা একহাতে তার মুখ চেপে অন্য হাতের তর্জনী নিজের ঠোঁটের ওপর রেখে, ইশারায় মন কে চুপ করতে বলল।
এবার মুনের হুঁশ ফিরে এল, ওদিকে ওপরের বড়মামার ঘর থেকে আওয়াজ এল, “ কে! কে!”, জ্বলে উঠল আলো, মন এক দৌড়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল, ওই অত রাত্রে মামার বকা খাওয়ার ইচ্ছে এতটুকুও নেই তার। যে দেরি করেছে, দরজাও সেই বন্ধ করুক, এক দৌড়ে মাতুর আঁচলের তলায় গিয়ে শুয়ে পড়ল মন, মাতুর গায়ের গন্ধ মেশানো আঁচলে প্রশ্রয়ের আস্বাস, এবার আর কেউ ধরতে পারবে না, ওদিকে বারান্দায় কোনও শব্দ নেই, সব চুপচাপ, যেন কিছুই হয়নি, ওপরের ঘরের আলোও নিভে গেল, শুধু দাদুভাইয়ের কাশির আওয়াজে মন এটুকু বুঝল যে দাদুভাই মোটেই একটুকুনও ঘুমনই, ছোটমামা ওই অন্ধকারে কি করে যে নিজের ঘরে গেল কে জানে? মন ধীরে ধীরে অতল ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেল।

| Aleekpatamagazine.blogspot.in |
  |ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Special Lock-down Issue,2020 | April 2020 |হাসিরাশি সংখ্যা।
।নববর্ষ ১৪২৭| Third Year Fifth Issue |22nd Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |


 সূচি পত্র / Index

















Cover Page April -May 2020

 Click To Read The Magazine

INDEX-APRIL MAY 20 (LOCK-DOWN SPECIAL)







সম্পাদকীয় * লকডাউন ও আমরা (পড়ুন)


ফুলঝুরি


লকডাউন * শম্পা সান্যাল (পড়ুন)

ঘর আপন আপন ঘর * সান্ত্বনা দাস  (পড়ুন)

বিতান বাবুর কেনাকাটা * শ্রাবণী গুপ্ত সরকার (পড়ুন)

যুগোস্লোভাকিয়া - চেকোস্লোভাকিয়া... * সম্পা দত্ত দে  (পড়ুন)


অথ সারমেয় কাহিনী * জ্যোতিকা পোদ্দার  (পড়ুন)

অচিন্ত্য স্যার * ফিরোজ আখতার  (পড়ুন)

ভাষার বিভ্রাট * কৃষ্ণা সাহা  (পড়ুন)


তুবড়ি
অহিভূষণের সর্প দোষ * স্বরূপ চক্রবর্তী   (পড়ুন)

মনএর কথা  দেবশ্রী চক্রবর্তী  (পড়ুন)


টেনশন * প্রতীক কুমার মুখার্জি  (পড়ুন)


কেলুদার 'সংকটময়' কেস সায়ন্তনী পলমল ঘোষ  (পড়ুন)




রং মশাল


পেন্সিল স্কেচ ১ * দেবরূপা চক্রবর্তী ( অষ্ঠম শ্রেনী (দেখুন)

পেন্সিল স্কেচ ২ * দেবরূপা চক্রবর্তী ( অষ্ঠম শ্রেনী) (দেখুন)


রংতুলি ১* দিশা প্রধান ( দশম শ্রেনী) (দেখুন)


রংতুলি ২* দিশা প্রধান  ( দশম শ্রেনী) (দেখুন)


সূর্যাস্ত * জ্যোতিকা পোদ্দার (দেখুন)




| Aleekpatamagazine.blogspot.in |
  |ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Special Lock-down Issue,2020 | April 2020 |হাসিরাশি সংখ্যা।
।নববর্ষ ১৪২৭| Third Year Fifth Issue |22nd Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |
 পড়া শেষ? পত্রিকা বন্ধ করুন
পড়া শেষ? পত্রিকা বন্ধ করুন।

Main Menu Bar



অলীকপাতার শারদ সংখ্যা ১৪২৯ প্রকাশিত, পড়তে ক্লিক করুন "Current Issue" ট্যাব টিতে , সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

Signature Video



অলীকপাতার সংখ্যা পড়ার জন্য ক্লিক করুন 'Current Issue' Tab এ, পুরাতন সংখ্যা পড়ার জন্য 'লাইব্রেরী' ট্যাব ক্লিক করুন। লেখা পাঠান aleekpata@gmail.com এই ঠিকানায়, অকারণেও প্রশ্ন করতে পারেন responsealeekpata@gmail.com এই ঠিকানায় অথবা আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।

অলীক পাতায় লেখা পাঠান