ইউরোপ ভ্রমণ -(পর্ব ৫)
স্বরূপ কৃষ্ণ চক্রবর্তী
|
সংখ্যা-১২, (১৯শে জুন,২০১৮) |
প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এই পর্ব টা দিতে একটু দেরি হয়ে গেল, কারণ আমি একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম অফিসের কাজে।
প্যারিস। স্বপ্নশহর। An evening in Paris সিনেমা, অনেক শোনা কথা, অনেক উপন্যাস পড়ে প্যারিস সম্বন্ধে কেমন যেন একটা আলাদা রকম মনের মধ্যে ধারণা ছিল। পৃথিবীর ফ্যাশন শুরু হয় প্যারিসে। প্রমাণ ও পেয়েছি।
তাই সকালের সব রুটিন কাজ ও সেই আমার প্রিয় বন্ধু প্লাসটিকের গ্লাসের সাথে সখ্যতার যুগলবন্দি শেষ করে ঠিক সময়ে ব্রেকফাস্ট হলে উপস্থিত আমরা কাঁধে রুকস্যাক নিয়ে। সারাদিনের প্ল্যান।
জমিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম সেই আমাদের অভিজ্ঞতা ও মিঃ ইরানি (ট্যুর ম্যানেজার) এর উপদেশ মতো। কারণ দুপুরে তো সেই অপরিচিত সুন্দর সুন্দর কমপ্লিকেটেড নামধারী ও সুন্দর সুন্দর দর্শনধারী খাবার খেতে হবে। যাতে একদিকে জিভ বিদ্রোহ করে ,পেট ভিসা দিতে চায়না ভেতরে ঢুকবার আর আরেকদিকে আমার তাপমাত্রা এক ঝটকায় নেমে যায়। ফলশ্রুতি গিন্নির স্যালাড আর ফলভক্ষন। তবে ওখানের স্যালাড সব সময় তাজা , ফল গুলোও সবসময় তাজা। (তবে স্বাদে আমাদের দেশের ফল ভালো) । আর হবে নাই বা কেন, আমাদের টাকায় যা দাম দিলাম তাতে দেশে আমাদের 4/5 স্টার হোটেলে ব্যুফে লাঞ্চ হয়ে যায়। যতই হোক আমার দেশ গরিব, কিন্তু খাওয়ার ব্যাপারে ও প্রকার বৈচিত্র্যে আমরা ওদের থেকে কয়েকশ যোজন এগিয়ে আছি। যাকগে এসব, এবার ঘুরতে বেরোনো যাক।
আজকের ইটিনিরারি তে আছে বাইরে থেকে দেখতে হবে কিছু বিশেষ বিশেষ দ্রষ্টব্য জায়গা যার মধ্যে আছে Arc the Triomphe, Concorde Square, Opera Garnier ইত্যাদি। তারপরে আছে পৃথিবী বিখ্যাত আইফেল টাওয়ার, প্যারিসের আইডেন্টিফিকেশন মার্ক। আসলে জায়গা গুলো সম্বন্ধে যতটুকু জেনেছি ইরানিজির কাছ থেকে সেগুলো লিখছি। আরও জানতে হলে আমার বিনম্র নিবেদন গুগল দাদাকে বা উইকি দিদিকে একটু বিরক্ত করবেন, গ্যারান্টি , হতাশ হবেন না। সেটা আমিও করতে পারতাম কিন্তু সময়ভাবে করে উঠতে পারছিনা। নতুবা আরও দেরি হয়ে যাবে এই লেখাটা দিতে। ইতিমধ্যেই কয়েকজনের কাছ থেকে তাগাদা পেয়ে গেছি। ক্ষমা চাইছি।
আবার সেই প্লেনের মতো বাসে বসলাম। প্যারিস দেখতে দেখতে চলেছি। মনের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ইতিহাস বইটার অনেক কথা আনাগোনা করছে। আনমনা হয়ে কিছু ছবিও তুলছি। মনে আমার ভেসে আসছে বইয়ে পড়া কিছু টুকরো টুকরো ঘটনার কথা। গর্বে উদ্ধত জার্মান সেনা ফ্রান্স কে আক্রমণ করেছিল 1940 এর মে মাসের প্রথমেই। প্যারিস অধিকার করেছিল 14 ই জুন 1940 আর তার আগেই প্যারিস থেকে পালিয়ে গিয়েছিল 10 ই জুন, ফ্রান্সের সরকার। এখানে একটা মজার জিনিস আছে , জার্মান রা যুদ্ধে পারদর্শী , এ তাদের অতি বড় শত্রুও স্বীকার করবে কিন্তু অধিকৃত প্যারিসে শাসন করার জন্য যদি জার্মানরা বন্দুক নামিয়ে কলম ধরে তাহলে যুদ্ধ করবে কে? তাই তারা ফ্রেঞ্চ অফিসিয়াল দেরকেই কাজে লাগিয়ে প্যারিস শাসন করেছিল। বিজেতা এবং বিজিত। একই দৃশ্য আমরা দেখেছি নিজের দেশেও। মুষ্টিমেয় ইংরেজরা আমাদের দেশের লোক দিয়েই আমাদের শাসন করেছে নয় নয় করেও 200 বছর।আমাদের দেশি সিপাহি ও পুলিশ অফিসার রা আমাদের উপরে মানে স্বদেশীয় মা বোন ভাইদের উপরে। অত্যাচারে ওদের সাদা চামড়ার প্রভুদেরও হারিয়ে দিয়েছে ওরা। ইতিহাস সাক্ষী। নতুবা ক্ষমতা ছিল কি ওই কয়জন ইংরেজের আমাদের শাসন করার! বিপ্লবীদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম শুধু দেশি পুলিশ সিপাহি আর দারোগরাই যদি বন্দুক উঁচিয়ে ধরতো ওদের দিকে তাহলে বিনয় বাদল দীনেশ বা ক্ষুদিরাম কে শহীদ হতে হতোনা। আরো অগনিত সোনার টুকরো ছেলে এবং মেয়েদের প্রাণ দিতে হোতনা। একটা জাতিই দায়ী নিজের পতনের জন্য। যাকগে, এসব আলোচনা করার জন্য অনেক বিদগ্ধ মানুষেরা আছেন, আমার বামন হয়ে চাঁদ ধরার ইচ্ছে নেই আর ক্ষমতাও নেই। তাই আমি বরং চারণকবির মতো গদ্যে ঘোরার কাহিনী শোনাই।
ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিলো। আমার খুব মিষ্টি লাগছিলো কিন্তু অনেক কে দেখলাম যারা আমার থেকে অনেক ছোট ব্যাগ থেকে জ্যাকেট বের করে পরতে। ছবি তোলা হলো বেশ কিছু বিভিন্ন ভঙ্গিমায় । তারপর চললাম Concorde Square.
দূর থেকেই সোজা রাস্তার ওপারে নাগরদোলার থেকেও বড়, বিশাল একটা হুইল কে মৃদুমন্দ হাওয়ায় ঘুরতে দেখলাম অলস ভাবে। সাথে বসার ও ব্যবস্থা আছে। আসলে কাছে গিয়ে বুঝলাম যে আদতে সেটা একটা নাগরদোলাই। বাস থেকে নামতেই দেখি চারিধারে বিশাল ফাঁকা চত্বর, চারপাশে অনেক পুরোনোদিনের অট্টালিকা। একপাশে মিডল ইস্টের কোন এক দেশের রাজার উপহার দেয়া একটা স্মৃতিচিহ্ন। একটা স্তম্ভের উপরে প্রতিষ্ঠিত। খুব সুন্দর ভাবে ওটাকে বসিয়ে মেন্টেন করে রেখেছে ফরাসিরা। চারিদিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এক টুকরো কাগজও পড়ে নেই। হই হই করে অনেক ছবি তোলা হলো। কিন্তু তার আগে আবার সেই ইউরো খরচ করে লাইন দিয়ে ওয়াশরুম যাওয়া। এই স্কোয়ারের একপাশে ওদের ন্যাশনাল এসেম্বলি হল দেখলাম। লোকাল ফরাসি গাইড মজা করে বললেন যে ওখানে 90% লোক ই ফালতু। আমরা সবাই খুব হাসাহাসি করলেও আমার নিজেদের পার্লামেন্টের লোক গুলোর কথা মনে পড়ে গেল। বেশির ভাগই বেগুন আর চোর গুন্ডা বদমাশ ও খুনি। সব দেশেই এরকম হয় নাকি, জানিনা, হয়তো হয়।
দেখলাম নেপোলিয়নের সমাধি। খুবই সুন্দর। ফরাসিদের রুচি ও পছন্দের ছাপ পুরো সমাধি বিল্ডিং এ ফুটে আছে। আমরা সবাই জানি যে নেপোলিয়নের নির্বাসিত অবস্থায় সেন্ট হেলেনা দ্বীপে মৃত্যু হয়েছিল, যেটা ছিল ব্রিটিশদের অধিকারে। দীর্ঘ 7 বছর ধরে কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা চালিয়ে ফরাসিরা সেন্ট হেলেনা দ্বীপ থেকে নেপোলিয়নের দেহাবশেষ এইখানে এনে নিজের দেশে সমাধিস্থ করেছে। লক্ষ্য করুন ব্রিটিশরা ফ্রান্স বন্ধু দেশ হওয়া সত্ত্বেও 7 বছর নিয়েছে ফেরত দিতে। কি আশ্চর্য !
চারিদিকের বিশাল ব্যাপ্তির (84000 বর্গ মিটার) মাঝে আবার আমার মন পিছনপানে চলে গেল। এই সেই স্কোয়ার, যেখানে ফরাসি বিপ্লবের সময়ে গিলোটিনে আঁতয়ানেত (বানানটা ঠিক হলোনা, চেষ্টা করলাম হচ্ছে না) আর ষোড়শ লুই কে বিপ্লবীরা চড়িয়ে হত্যা করেছিল। মনটা ভারী হয়ে গেল। এই জায়গাটা আমরা রাত্রেও দেখলাম পরে, যেন এক মায়াপুরী, কল্পকথার রাজ্য।
লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে, মেঘমন্দ্র স্বরে ইরানিজির ঘোষণা। সবাই বসে ফিরে মার্কেটে গিয়ে নিজেদের পছন্দমতো বিদেশি খাবার খেয়ে জিভ আর পেটের বিদ্রোহ সত্ত্বেও উদর পূর্তি করলাম। পরের গন্তব্য আইফেল টাওয়ার, যা প্যারিসের পরিচয় চিহ্ন। একটা ইঞ্জিনিয়ারিং মার্ভেল।
সেখানে যাবার আগে আমরা আরো কিছু বিখ্যাত জায়গা দেখলাম। এখানে একটি কথা বলে নেই। আমাদের প্যারিস সম্বন্ধে মনে যে ধারণা টা আছে সেটা মনে হয় বদলাবার সময় এসেছে। শালীনতা, ভদ্রতায় ফরাসিরা সত্যিই অনুকরণীয়। যেহেতু ইরানিজির সাবধানবানী কানে ভাসছিল তাই বেশি মেলামেশা করিনি, কিন্তু যেটুকু করেছি দুজনে তাতেই বুঝলাম এরা সত্যিই একটু আলাদা রকমের।
আমরা দেখলাম সর্বন ইউনিভার্সিটি।
কলেজের দিনের কথা মনে পড়ছিল। স্যার দের কাছে শুনেছি ও বইয়ে পড়েছি। এই ইউনিভার্সিটির কত কথা শুনেছি। কত সব বিখ্যাত মানুষেরা এখানে গবেষণা করেছেন , পড়িয়েছেন। দেখলাম সেই বিল্ডিং যার দরজার উপরে ফ্রেঞ্চে লেখা আছে ফরাসি বিপ্লবের স্লোগান। ইংরেজিতে Liberty, Equality , Fraternity. মৈত্রীর গান সাম্যের কথা। দেখলাম ওদের ন্যাশনাল মিউজিক একাডেমি, মিউজিয়াম।
কলেজের দিনের কথা মনে পড়ছিল। স্যার দের কাছে শুনেছি ও বইয়ে পড়েছি। এই ইউনিভার্সিটির কত কথা শুনেছি। কত সব বিখ্যাত মানুষেরা এখানে গবেষণা করেছেন , পড়িয়েছেন। দেখলাম সেই বিল্ডিং যার দরজার উপরে ফ্রেঞ্চে লেখা আছে ফরাসি বিপ্লবের স্লোগান। ইংরেজিতে Liberty, Equality , Fraternity. মৈত্রীর গান সাম্যের কথা। দেখলাম ওদের ন্যাশনাল মিউজিক একাডেমি, মিউজিয়াম।
আইফেল টাওয়ার এর মজা হচ্ছে যে প্যারিসের বেশির ভাগ জায়গা থেকেই এটা দেখা যায়। ধীরে ধীরে সিগনালের নিয়ম মেনে বাস গিয়ে পৌঁছুল আইফেল টাওয়ারের পার্কিং স্পেসে। বাপরে ! কত বাস এসেছে! পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে মানুষেরা হাজির হয়েছে। বাস থেকে নেমে টিকিট কাউন্টার অবধি যেতেই জায়গাটা মেলার চেহারা নিল। কি বিশাল লাইন আর কি ভিড়! এইখানে ওয়াশরুম ফ্রি ছিল কিন্তু সেই আবার লম্বা লাইন। যাকগে ওখান থেকে বেরিয়ে ইরানিজির হাতে ধরা ঝান্ডা খুঁজে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়া গেল। প্রায় 50 মিনিট পরে হাতে টিকিট পেলাম। দুই প্রস্থ সিকিউরিটি চেকিং এ পাস করে লিফটে চড়বার অনুমতি পেলাম।
এটার নামকরণ হয়েছে গুস্তাভ আইফেল এর নামে। যাঁর কোম্পানি এটা তৈরি করেছিল আজ থেকে প্রায় 129 বছর আগে। এরা এত সুন্দর রক্ষণাবেক্ষণ করে যে এখনও মজবুত । বড় বড় লিফট কার হড়হড় করে হাই গ্রেডিএন্ট প্রায় 80 বা 85 ডিগ্রি তে উঠছে নামছে। তবে সিঁড়িও আছে আমরা চড়েছিলাম লিফটে নেমেছিলাম সিঁড়ি দিয়ে। অসাধায়ণ অভিজ্ঞতা।
মাথার টিপ অবধি 324 মিটার উঁচু। উপর অবধি যাবার লিফট আছে। লাইন ও লম্বা আর টিকিটের দাম ভীষণ বেশি। তাই আমাদের পূর্বনির্ধারিত প্ল্যান অনুযায়ী দ্বিতীয় ধাপ অবধি যাওয়া হয়েছিল। তাতেই প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লেগে গেলো। উপরে গিয়ে চারিদিকের দৃশ্য দেখে মুখে কথা নেই আমাদের। পুরো প্যারিস দেখা যাচ্ছে 360 ডিগ্রি তে। দ্বিতীয় ধাপেই এই , তাহলে চূড়ায় চড়লে কি হবে! উপরে শপিং মলের মতো অনেক দোকান পাট আছে। খাবারের দোকান, স্মারক কিনবার দোকান ইত্যাদি। অনেক ছবি তোলা হলো। আবার লাইন দিয়ে বেশ কিছু ইউরো খরচ করে খেলাম ।
আইফেল টাওয়ার এ খাবার এর আনন্দ নেবার জন্য। আর একটা অভিজ্ঞতাও বটে। অনেক নীচে পিঁপড়ের মতো মানুষ গাড়ি দেখা যাচ্ছে আর আমরা অত উপরে বসে খাচ্ছি। বেশ মজাই লাগছিলো। সমতল থেকে দাম বেশ বেশি। নামবার লিফটের সামনে আবার লাইন। তাই আমরা দুজন দেশে রেগুলার মর্নিং ওয়াক এই অভ্যাস এর কথা মনে রেখে আরেকটা অভিজ্ঞতার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নামলাম। নামছি তো নামছিই। যখন নিচের পিঁপড়ের সাইজের লোকগুলো আমার সাইজের হলো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিছু মেমেন্টোও কেনা হলো। তারপর ইরানিজির কথা ও সময় অনুযায়ী বাসে গিয়ে বসলাম। তারপর আছে সিন নদীতে ক্রুজের গল্প। সেটা আজ নয় , বড় হয়ে যাচ্ছে।
আইফেল টাওয়ার এ খাবার এর আনন্দ নেবার জন্য। আর একটা অভিজ্ঞতাও বটে। অনেক নীচে পিঁপড়ের মতো মানুষ গাড়ি দেখা যাচ্ছে আর আমরা অত উপরে বসে খাচ্ছি। বেশ মজাই লাগছিলো। সমতল থেকে দাম বেশ বেশি। নামবার লিফটের সামনে আবার লাইন। তাই আমরা দুজন দেশে রেগুলার মর্নিং ওয়াক এই অভ্যাস এর কথা মনে রেখে আরেকটা অভিজ্ঞতার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নামলাম। নামছি তো নামছিই। যখন নিচের পিঁপড়ের সাইজের লোকগুলো আমার সাইজের হলো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিছু মেমেন্টোও কেনা হলো। তারপর ইরানিজির কথা ও সময় অনুযায়ী বাসে গিয়ে বসলাম। তারপর আছে সিন নদীতে ক্রুজের গল্প। সেটা আজ নয় , বড় হয়ে যাচ্ছে।
এবার মনে হয় থামতে হবে। নতুবা বড় হয়ে যাচ্ছে। কিছু ছবিও দিচ্ছি।
আবার আসছি ক্রুজে ঘুরবার জন্য, তৈরি থাকুন।
সমস্ত ছবি লেখকের নিজের তোলা